#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-শেষ|
সময় প্রবাহমান। এই সময়ের স্রোতধারার মধ্যে দিয়ে কেটে গেছে অনেক গুলো দিন। পরিবারের সবার উত্তেজনা আকাঙ্ক্ষা শেষ করে আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ হাজির হয়েছে। অভির আজ শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়েছে। বধু বরণ করে গৃহবধূকে গৃহে তোলা হয়েছে। সবার চোখে-মুখে উল্লাসিত হাসির। সারা বাড়িময় বাচ্চাদের হইহল্লা চিৎকার-চেঁচামেচিতে মুখরিত হয়ে আছে পরিবেশ। অভি সে বরণের পর থেকে লাপাত্তা। বিয়ের পুরোটা সময় সে থমথমে মুখে ছিল। প্রয়োজন ব্যতীত কারো সঙ্গে কথা বলিনি। বাড়ির বসার ঘর থেকে শুরু করে উঠান এর অধিকাংশ নিয়ে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব গল্পগুজব, হাসি, ঠাট্টা করছে। রাত আটটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ পড়ে অভির। খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ধারার আব্বাজান ফোন করে অভিকে। অভি ওর আব্বাজানের শক্ত শক্ত কথা শুনে আর কালবিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে আসে। নিয়ম অনুসারে কাল বৌভাত। তা নিয়ে আয়োজন তুঙ্গে। অভি গম্ভীর মুখে সে সব কিছু দেখছে। অভি তার এই নাম মাত্র বিয়ের জন্য শহরের কোন বন্ধুবান্ধবকে খবর দেয়নি। গ্রামে যে কয়জন বন্ধু বান্ধব ছিল তাদের ওর বড় ভাইয়া নিমন্ত্রণ করেছে। সবাই অভি কে নিয়ে মজা করলেও অভি মুখে কিছু বলে না। পুরোটা সময় অভি থমথমে মুখে বসে ছিল। এরমধ্যে ওদের আড্ডার মাঝে জোনাকি ভাবি এসে রাতের খাবার জন্য ডেকে নিয়ে যায়। আপাতত এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে বুক চিরে নিঃশ্বাস ফেলে অভি। খাওয়া দাওয়ার পরে উঠানের কোন বন্ধুদের সঙ্গে বসে যখন কথা বলছিল অভি, তখন আগমন ঘটে তিন রমণীর। জোনাকি ভাবি অভির সামনে দাঁড়িয়ে ঠাট্টার সুরে বলল,
‘ কী গো দেবর সাহেব আজ কী ঘরে যাবেন না আপনি? নাকি আজ সারারাত এখানে থাকবেন বলে পণ করেছেন?’
অভি ছোট ছোট চোখে জোনাকি ভাবির দিকে তাকায়। পাশ থেকে স্বর্ণা মৃদু স্বরে বলল,
‘ কী হলো ভাইয়া এখনো বসে আছেন কেন? চলুন। আমাদের আদরের ছোট জা বসে আছে যে আপনার অপেক্ষায়।’
অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ এইতো যাচ্ছি ভাবি।’
ধারা অভির দিকে না তাকিয়ে ওর হাতে থাকা ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
‘ এখন দীর্ঘশ্বাস ফেলছিস, ফেল। কিন্তু খানিকক্ষণ পরে এই দীর্ঘশ্বাসের পরিবর্তে তোর ঠোঁটে ভয়ানক সুন্দর হাসি ফুটে উঠবে। পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করবে তখন তোর। পাগলের মতো বিহেভ করতে ইচ্ছে করবে। তখন যাকে সামনে পাবে তাকেই চুমু দিতে ইচ্ছে করবে। তখন তোর সুখে আকাশে ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছে করবে।’
অভি ধারার কথার মানে বুঝতে না পেরে ওর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায়। ধারা অভির এমন তাকানো দেখে ধমকের সুরে বলল,
‘ বোকার মত আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? চল ঘরে চল। ভাবি সেই কখন থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছে। আর তুই এখনো এখানে বসে আছিস। চল বলছি তাড়াতাড়ি।’
ধারার কথা শুনে অভি ঠাহর করতে পারে না, বয়সে ধারা বড় নাকি ও বড়? ধারার কথার ধরনে আজ কেমন বড়দের মতো তীক্ষ্ণতা। অবশ্য থাকবে নাই বা কেন? এক বাচ্চার মা বলে কথা। এসব ভেবে অভি হালকা হেসে ওদের সঙ্গে পা মিলায়।
অভি অনেকক্ষণ ধরে আচ্ছা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁসফাঁস করছে। বিছানায় তার বিয়ে করা নতুন বউ ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। সাহস হচ্ছে না মেয়ের দিকে তাকানোর। অভি হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। এই নিয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। নিজের উপর নিজেরই বিরক্ত হচ্ছে অভি। এমন করে অহেতুক দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী? মেয়েটা তো তার বিয়ে করা বউ। তাহলে তার ভয় হচ্ছে কেনো? অভি সাহস করে এক পা এগিয়ে গিয়ে আবার দুই পা পিছলে পড়ে। অভি মনে একটু সাহস সঞ্চয় করে গলা পরিষ্কার করে কাশি দিয়ে বলল,
‘ আসসালামু আলাইকুম। আপনার সঙ্গে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। অবশ্য এখন এসব কথার কোনো মানেই হয় না। আমরা পবিত্র একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছি। আমি মনে করি এসব কথা আপনার জানার অধিকার আছে। তাই আমি আপনার এসব বলছি, আমার একটা অতীত আছে।’
একটুকু বলে অভি থামে। কিছুক্ষণ চুপ করে অভি আবার বলল,
‘ আমি একজন কে ভালোবাসতাম। অপ্রিয় সত্যি হলেও এখনো তাকে আমি ভালোবাসি। আমার করা ছোট্ট ভুলের জন্য আজ সে আমার থেকে দূরে। আপনি হয়তো ভাবছেন আমি এই কথাগুলো এখন আপনাকে কেন বলছি বিয়ের আগে কেন বলিনি? আমি বিয়ের আগে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু আমার পরিবারের কেউ সেই সুযোগ আমাকে দেয়নি। যেদিন আপনাকে আমার পরিবারের লোকজন দেখতে গেছিলো সেদিন আমার নিজস্ব কাজের জন্য যেতে পারিনি। এরপরে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। আপনি ভাববেন না যে এখন আমি আপনাকে বাংলা সিনেমার মতো বলবো আমি আপনাকে স্ত্রীর অধিকার দিতে পারব না! বিয়েটা কোন ছেলে খেলা নয়। তাই আমি আপনার থেকে কিছুদিন সময় চাচ্ছি নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য। নিজেকে আপনার মতো করে তৈরি করার জন্য।’
এইটুকু বলে অভি থেকে যায়। বিছানায় বসে থাকা নতুন বধু উঠে এসে অভির সামনে দাঁড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া অবস্থায় বলল,
‘ আপনার ভালবাসার মানুষটার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিবেন? জানতে চাই কে সেই ভাগ্যবতী!’
অভি মলিন গলায় বলল,
‘ তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এখন তো সম্ভব নয়। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি তার সঙ্গে আমার দেখা হয় তাহলে অবশ্যই আমি আপনার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেব। জান্নাতের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই সে অনেক কাল।’
এইটুকু বলে অভি থামে। পুরো ঘর জুড়ে পিনপিনে নীরবতা। কিছুক্ষণ পর অভির বউ ঘোমটা খুলে অভির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে বলল,
‘ আপনি যে জান্নাত কে এতটা ভালোবাসেন সে কথা কী জান্নাত নামের মেয়েটাকে কখনো জানিয়েছেন? নাকি সব কথা মনের মনিকোঠায় যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছেন?’
অভি বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা মেয়েটার দিকে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
‘ আমি কী সত্যি দেখছি? জানেন আপনাকে দেখতে না অনেকটা ঠিক জান্নাতের মতো।’
অভির বউ অভির কথা শুনে মৃদু হেসে বলল,
‘ জি না, আমি জান্নাতের মতো দেখতে না, আমি সেই আপনার জান্নাত।’
অভি বউ সেজে থাকা মেয়েটার দিকে অবাক চোখে তাকায়। বউ সেজে থাকার কারণে চেনার উপায় নেই মেয়েটা জান্নাত নাকি অন্য কেউ? তবে চেহারার আদল বলে দিচ্ছে মেয়েটা জান্নাত! অভি অবাক গলায় বলল,
‘ সত্যি? সত্যি কী তুমি জান্নাত?’
জান্নাত চোখগুলা ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
‘ কেন এখনো বুঝি বিশ্বাস হচ্ছে না জান্নাত? নাকি ছোটবেলার মতো আবার আপনাকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দেবো? তাহলে বিশ্বাস হবে তো আমি জান্নাত।’
জান্নাতের কথা শুনে অভি অতীতের স্মৃতির পাতা ঘাটাঘাটি করে, জান্নাতের ধাক্কা দেওয়ার দিনটার কথা মনে করে। এক শীতের অন্ধকার রাতে ধারা, অভি, জোনাকি ভাবি, সম্রাটের ভাইয়া, জান্নাত সবাই মিলে পুকুরপাড়ের বসে গল্প গুজব করছিল। অভি কথার ছলে হঠাৎ করে জান্নাত কে ক্ষেপিয়ে দেয়। জান্নাতে বারবার বারণ করা সত্ত্বেও অভি জান্নাতকে ক্ষ্যাপাতে শুরু করে। জান্নাত নিজের রাগ সহ্য করতে না পেরে অভি কে ধাক্কা দিয়ে হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়। এসব কথা মনে করে শুকনো গলায় ঢোক গিলে জান্নাতের দিকে তাকায় অভি। তাহলে এই মেয়েটা সত্যি সত্যি জান্নাত। হঠাৎ করে একগুচ্ছ ভালোলাগার বাতাস এসে অভির মন প্রান ছুঁয়ে দিয়ে শীতল করে দিয়েছে। এতদিনের বিচ্ছেদের পর সে তার ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে বিবাহ নামে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। নিজের বিয়ে করা বউ কে ভালো ভাবে না দেখে নিজের মনে কথা বলে দেওয়ার জন্য, অভি এই মুহূর্তে নিজেই নিজের বোকামির জন্য নিজেকে বকাবকি করছে। এই বিচ্ছু মেয়েটাকে সে তার ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিয়েছে। এখন নিশ্চয়ই তার ওপর দিয়ে ভূমিকম্প নামক প্রকৃতির ঝড় বয়ে যাবে। জান্নাত অভির উপর হামলে পড়ার আগে অভি মৃদু স্বরে বলল,
‘ আপনার না না তোমার চেহারার আদল বলে দিচ্ছে তুমি জান্নাত। নতুন করে তা আর প্রমাণ করার দরকার নেই। কিন্তু আমি কিছু বিষয় নিয়ে কনফিউজ আছি।’
জান্নাত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলল,
‘ কী বিষয়ে?’
অভি শুকনো গলায় ঢোক গিলে বলল,
‘ প্রথমত তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হল কিভাবে? তোমার কিংবা তোমাদের পরিবারের সঙ্গে তো আমাদের কারো যোগাযোগ ছিল না। তাহলে? দ্বিতীয়তঃ পরিবারের সবাই তো জানতে তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে, তাহলে সবাই কেন বিষয়টা আমার কাছে লুকিয়ে গেলো? তৃতীয়তঃ বিয়ের পরে আমি তোমার বাবা-মাকে তোমাদের বাড়িতে দেখতে পাই নি কেন?’
জান্নাত মৃদু হেসে বলল,
‘ বা বা কতগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন আমি সবগুলো প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দিচ্ছি, আপনার প্রথম প্রশ্ন আমার সঙ্গে আপনার বিয়ে কিভাবে হলো তাই তো? আমার সঙ্গে যে কারো যোগাযোগ ছিল না এটা আপনার ভুল ধারণা। ধারার সঙ্গে আমার বরাবরই যোগাযোগ ছিল। আর আমাদের বিয়েটা হয়েছে একমাত্র ধরার জন্য। আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, আপনার পরিবারের লোকজন চান তো আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে তাও আপনাকে কেন জানায়নি? আপনাকে আপনার পরিবার কিংবা ধারা তো কয়েকবার বলেছিল পাত্রীর বাড়ি গিয়ে পাত্রীকে দেখে আসার জন্য কিন্তু আপনি যাননি পাত্রী দেখতে। তাই এখানে তো তাদের কোন দোষ নেই। আপনারা তৃতীয় প্রশ্ন হল, আমাদের বিয়েতে আপনি আমার বাবা-মাকে কেন দেখতে পাননি? আপনি তখন আমার বিরহে এতটাই শোকাহত ছিলেন যে তাদের আপনি খেয়াল করেননি। তাছাড়া বয়সের জন্য তাদের চেহারায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। বিদায়ের সময় বাবা নিজের হাতে, আপনার হাতে আমাকে তুলে দিয়েছিল।’
অভি সন্দেহের চোখে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ বিয়ের সময় যখন কাজী সাহেব বর-কনের নাম বলছিল তখন তোমাদের বাড়িতে যে অস্বাভাবিক ভাবে বাজি ফাটানো হচ্ছিল, যার কারণে আমি কনের এর নাম শুনতে পাইনি এটা নিশ্চয়ই তোমার পূর্বপরিকল্পিত ছিল?’
জান্নাত ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
‘ জি মশাই তা আমার পূর্বপরিকল্পিত ছিল।’
জান্নাতের কথা শুনে অভি তার দিকে নির্বাক চোখে তাকায়। তার অগোচরে এতকিছু পরিকল্পনা হয়েছে অথচ সে কিছু জানতো না। জান্নাত আবারো বলল,
‘ ধারা যখন আপনার ওয়ালেট এ আমার ছবি দেখে কখন থেকে ধারার শুরু হয় আমাদের এক করার পরিকল্পনা। প্রথমে আপনার আব্বাজান এবং পরিবারের লোকজনকে রাজি করায় আমাদের বিয়ের জন্য। সবাই রাজি হলে ধারা নিজে প্রস্তাব নিয়ে যায় আমাদের বাড়িতে। প্রথমে আপনার প্রতি তীব্র অভিমানে কারণে আমি বিয়েতে রাজি হইনি। ধারা যখন এক এক করে সব কিছু আমাকে বলে, তখন আমি আর অভিমান করে থাকতে পারিনি। আমি রাজি হই তখন। যখন শুনলাম আপনি আমাকে দেখতে আসবেন না তখন মনে মনে প্ল্যান করি একেবারে বাসর ঘরে আপনাকে চমকে দেবো। কিন্তু বিয়ের আসরে যদি আপনি আমার নাম কাজির মুখে শুনে ফেলেন তাহলে তো আমার সব প্লান ভেস্তে যাবে। তাই আমার কাজিন দের আগে থেকে বলে রাখি যেই মুহুর্তে কাজী সাহেব বর-কনের নাম উচ্চারণ করবে তখন এমন কিছু করতে হবে তাতে যেন বর-কনের নামে স্পষ্টভাবে শোনা না যায়। ব্যাস আমার কথা শুনে ওরা অনেকগুলো বাজি একসঙ্গে ফাটিয়ে দেয় তখন।’
এইটুকু বলে জান্নাত খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করে। অভি বিষ্ময় চোখ জান্নাতের দিকে তাকিয়ে আছে। জান্নাত হাসি থামিয়ে গম্ভীর মুখ করে বলল,
‘ শুনুন আপনি আমাকে এতগুলো বছর অকারনে কষ্ট দিয়েছেন। আমি আপনার মত এতগুলো বছর আপনাকে আমি কষ্ট দিতে পারব না। আমি আপনার মত এত নিষ্ঠুর নই। আপনার শাস্তি হিসেবে আপনি আমার থেকে তিন মাস দূরে থাকবেন। তিন মাসের যদি আপনি আমার কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেন কিংবা ছোঁয়ার চেষ্টা করেন তাহলে আমি আপনাকে মেরে আপনার হাত-পা ভেঙে দেবো। কিন্তু আমার যখন ইচ্ছে হবে আমি আপনার কাছে যেতে পারবো।’
অভি অসহায় গলায় বলল,
‘ তিন মাস? তিন মাস আমি তোমাকে ছুঁতে পারব না এ কেমন বিচার? তুমি আমার কাছে আসলে এমনিতেই আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায় তার উপরে আমি তোমাকে ছুঁতে পারব না অসম্ভব আমি পারবো না।’
জান্নাত চোখ গুলো ছোট ছোট করে বলল,
‘ ঠিক আছে কাল সকালেই তাহলে আমি আমার বাপের বাড়ি চলে যাব।’
অভি আহত গলায় বলল,
‘ তিন মাস পরে আমি তোমাকে আমার নিজের করে পাব তো?’
জান্নাত ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘ আমি বরাবরের জন্য আপনার হয়ে গেছি তাই নিশ্চিন্তে এবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমি এই গয়না গাটি খুলে আসছি।’
অভি আর কিছু না বলে মনে মনে ধারার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার গায়ে থাকা পাঞ্জাবীটা খুলে একটা টি-শার্ট পড়ে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরে জান্নাত ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসে চোখ বন্ধ করে থাকা অভির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটাকে সে পাগলের মত ভালোবাসে। এই তিন মাস সে এই মানুষটার সঙ্গে প্রেমিক প্রেমিকার মত প্রেম করবে বলে শাস্তির নাম করে তিন মাস সময় নিয়ে নিয়েছে সে। জান্নাত এসব ভেবে মৃদু হেসে অভির বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বলল,
‘ আমি এখন থেকে প্রতিদিন এই ভাবে আপনার বুকে মাথা রেখে, আপনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো। খবরদার আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন তো আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।’
অভি জান্নাতের কথা শুনে মৃদু হেসে জান্নাতের কপালে চুমু দেয়। জান্নাত কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থেকে মৃদু চিৎকার দিয়ে বলল,
‘ আপনি আমাকে চুমু খেয়েছেন কেন? এটা তো কথা ছিল না।’
অভি জান্নাতের কথায় পাত্তা না দিয়ে মৃদু হেসে জান্নাত কে নিজের সঙ্গে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে।
রাত কত হলো তা জানা নেই কারো। অভিকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে জোনাকি ভাবি এবং স্বর্ণা ভাবির সঙ্গে যখন কথা বলছিল ধারা তখন ইভান এসে জরুরি তলব দিয়ে ধারা কে নিজের সঙ্গে নিয়ে যায়। মাঝরাতে নৌকা ভাড়া করে মেয়ে বউকে নিয়ে নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছে ইভান। আজ আকাশের চাঁদ নেই কিন্তু অসংখ্য তারার আলোতে আশেপাশে প্রকৃতি দেখে যাচ্ছে। নৌকার অসংখ্য প্রদীপ আর হারিকেন দিয়ে সাজানো হয়েছে। ধারা নৌকার ছাউনির নিচে বসে আছে আর তার কোলে দুইপাশে দুজন বাবা মেয়ে শুয়ে আছে। ধারা দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ইহিতা নৌকায় চড়ার পরে থেকে উত্তেজনা শেষ ছিল না। তার উল্লাসিত খুশি চোখেমুখে প্রকাশ পেয়েছে। ইহিতা তার মাম্মার কোলে শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পরেছে। ইভান সে এখনো জেগে আছে। মাঝেমধ্যে তার মাথায় ধারার বুলিয়ে দেওয়া হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে শব্দ করে চুমু খায় ধারার হাতে। ইভানের এমন কাজে ধারার প্রতিবার ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠে। ধারা রা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা এখন থেকে এ দেশেই থাকবে। কিন্তু ইভানের ইতালির বিজনেস এর ঝামেলা সবকিছু ঠিক করে দেশে আসতে আসতে তাদের দুই তিন বছর সময় লেগে যাবে। ততদিন অন্তত তাদের ইতালিতে থাকতে হবে। এরপরে পাকাপাকিভাবে দেশে থাকতে শুরু করবে ওরা। দেশে ফিরে ধারা ওর শাশুড়ি আম্মুর কথা রাখতে ওদের পারিবারিক হসপিটালে জয়েন করবে। ধারার ভাবনার সমাপ্তি ঘটে ইভানের কথা শুনে। ইভান ধারার দিকে না তাকিয়ে বলল,
‘ তখন থেকে এত মনোযোগ দিয়ে কী ভাবছো?’
ধারা ইভানের গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
‘ ভাবছি তোমার কথা, তুমি এমন কেন বলবে আমায়? এই প্রশ্নটা আমি তোমাকে কয়েক হাজার বার করেছি, কিন্তু তুমি আমাকে কখনো উত্তর দাওনি। ইতালি থাকা অবস্থায় আকাশে যখন চাঁদ না থাকতো তখন তুমি আমাকে নিয়ে হয় বেলকুনিতে না হয় ছাদে গিয়ে তোমার প্রেম বিলাস করবে। তোমার এই অদ্ভুত ধরনের কাজ দেখে আমার মনে হয় তুমি শুধু প্রেম বিলাস করার জন্য নয় অদ্ভুত প্রেম বিলাস করার জন্য আমাকে তোমার কাছে নিয়ে আসো। আজ আবারো চন্দ্র বিহীন খোলা আকাশের নিচে নৌকায় ভেসে ভেসে তোমার সঙ্গে, তোমার খুব কাছে বসে অদ্ভুত প্রেম বিলাস করছি।’
ইভান আহ্লাদী গলায় বলল,
‘ আম্মু সবসময় আমাকে কী বলতো জানো, আমার ভালোবাসার ধরন নাকি অদ্ভুত। কাউকে একবার ভালোবেসে ফেললে নাকি তাকে মারাত্মকভাবে ভালোবাসি ফেলি। এছাড়া আর কিছু জানি না আমি বিল্লু রানী।’
ধারা হেসে একটু ঝুঁকে ইভানের কপালে চুমু দিয়ে দিয়ে বলল,
‘ থাক তোমাকে আর কিছু জানতে হবে। এবার চলো বাড়ির দিকে যাই। রাত তো আর কম হলো না।’
ইভান ধারার কোল থেকে শোয়া থেকে উঠে ইহিতা কে নিজের কোলে নিয়ে বলল,
‘ আমি তো এতক্ষন খেয়াল করিনি, আমরা দুজনে তোমার পায়ের উপরে শুয়ে ছিলাম নিশ্চয়ই তোমার পায় এতক্ষণে ব্যাথা হয়ে গেছে। আমি মাঝি কে বলছি নৌকা ঘোরাতে ততক্ষণ তুমি পা মেলে দিয়ে বসো।’
ধারা ইভানের কথা শুনে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে তোলে। মাঝির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইভান আর ধারা ইহিতা কে কোলে নিয়ে পা বাড়ায় ওদের বাড়ির পথে। নদীর পাড় থেকে ওদের বাড়ির দূরত্ব খুব একটা বেশি দূরে নয়। আট দশ মিনিটের রাস্তা। ইভান ইহিতা কে কোলে নিয়ে ধারার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে ধারার হাতে থাকা ফোনের টর্চ লাইটের আলোতে। কিছুদূর হেঁটে আসার পরে, ইভান ধারার কোলে ইহিতা কে দিয়ে রাস্তার পাশে হিজল গাছ থেকে এক গুচ্ছ ফুল হাতের মুঠোয় নিয়ে এসে, ধারার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে মুঠো হাত মুক্ত করে দিয়ে ধারার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
‘ এই মেয়ে তুমি এত নিষ্ঠুর কেনো? সেই প্রথম দিন তুমি আমার দিকে এক নজরও তাকাওনি। আমি সেইদিন তোমার চোখের গভীরতা মাপার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে ছিলাম। খুব বড় ভুল করেছো তুমি! এর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। কঠিন শাস্তি! কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি। আর সে শাস্তি হলো আমি তোমাকে আমার ভালোবাসার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবো। তখন তুমি বুঝবে এই মানুষটাকে অবহেলা করার শাস্তি কত ভয়ানক হতে পারে। আজ বিয়ে বাড়িতে তুমি যখন কালো রঙের শাড়ি পড়েছিলে জানো তখন আমার অবস্থা কেমন হয়েছিলো। জানবে কী করে তুমি তো নিষ্ঠুর। তোমার সাজ সব কিছু আমাকে দিশেহারা করে দিয়েছিল। তোমাকে এমন অবস্থায় দেখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। হার্ট বিট বেড়ে যায়। তারপরেও তুমি বারবার এইভাবে সেজেগুজে আমার সামনে এসে দাঁড়াও। তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? তুমি কী কখনো আমাকে বুঝবে না মেয়ে? তুমি আমাকে বোঝো আর নাই বোঝ তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি সারা জীবন তোমাকে ভালোবেসে যাবো। ভালোবাসি তোমায়।’
ধারা ইভানের প্রপোজ এর ধরন দেখে ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
‘ আমি পাগল হয়ে যাবো তোমার এই পাগলামো দেখে। উঠো, উঠে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো। ইহিতা আমার কোলে না হলে আমি তোমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতাম।’
ইভান হেসে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ধারা কে শক্ত করে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে, ধারা মুচকি হেসে ইভানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস বলল,
‘ পাগল মশাই আমিও আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসি। বড্ড বেশি ভালোবাসি।’
ইভান ধারার কথা শুনে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলে ধারার কপালে চুমু দিয়ে আবারো নিজের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। ধারা চোখ বন্ধ করে ইভানের বুকে ধুক ধুক শব্দ গুনতে শুরু করে। ইভানের প্রতিটা হৃদ কম্পন যেন ধারা কে নিখুঁতভাবে তার পাগলামো ময় ভালোবাসার কথা বলছে।
সমাপ্ত —
[ অবশেষে গল্পটা শেষের দাড়ি টানতে হলো। কিন্তু সমাপ্তি নেই ইভান এবং ধারার ভালোবাসার। গল্পটা থেকে আপনাদের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি তার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। জানি না এই গল্পের শেষটা কেমন হয়েছে? শেষের দিকে গল্পটা কেমন ছন্নছাড়া ভাবে লিখেছি। গল্পটা আপনাদের কেমন লেগেছে জানাবেন প্লিজ। আর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সঙ্গে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদের। ধন্যবাদ।]