#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৯
‘সন্দেহ’ দুনিয়ার সব থেকে ভয়ংকর একটা শব্দ। এর প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসাত্মক রুপ যে কোন সম্পর্ককে মুহূর্তেই ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। প্রচণ্ড ক্ষিপ্র গতিতে ঘরের এপাশ থেকে অপাশে পায়চারি করছে ঈশা। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করার বৃথা চেষ্টা। কোন লাভ হচ্ছে না এতে। বেহায়া মন আর চোখ দুটোই বারবার জানালার দিকে আর বারান্দার দরজার দিকে আটকে যাচ্ছে। কিন্তু সব কিছুই বন্ধ। গত দুইদিন ধরেই বন্ধ। কিছুতেই খোলা হবে না। আর কোনদিন খোলা হবেনা। মস্তিষ্কে অগোছালো চিন্তা ভাবনা জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ভোতা অনুভুতি গুলো এলোমেলো হয়ে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতরে তাদের প্রচণ্ড আঘাতে চোখ ভরে আসছে। কিন্তু বারবার চোখ মুছে নিজেকে শান্ত করে আবার পায়চারি করছে। কি করছে না করছে নিজেই বুঝতে পারছে না। পুরো ঘর বস্তি বানিয়ে রেখেছে। গত দুইদিন ধরে অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না। ঘড়ির কাটাও গতি হারিয়ে থেমে গেছে যেন। ভয়ংকর সব চিন্তা ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভয়ে গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। আর কোন ভাবেই অপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ভয়ংকর রকমের চিন্তা ভাবনা মাথায় নিয়েই করে ফেলল এক দুঃসাহসের কাজ। দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ইভানদের বাসায়। তীব্র গতিতে কলিং বেল চাপতে লাগলো। কারন সে জানে এখন বাসায় ইভান আর ইফতি ছাড়া কেউ নেই। কিছুক্ষন পরেই ইফতি এসে দরজা খুলে দিলো। ঈশাকে দেখে হেসে বলল
–আরে ভাবি আপু তুমি?
ঈশা ক্ষিপ্র গতিতে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বলল
–তোর ভাইয়া কোথায়?
ইফতি একটু অবাক হয়ে বলল
–ঘরে। শুয়েছে মনে হয়।
ঈশা কোন কথা না বলে সোজা ইভানের ঘরে গিয়ে ঢুকল। ভর দুপুর বেলাও পুরো ঘর অন্ধকার। লাইট জালাতেই ইভান বিরক্তি নিয়ে চোখ মুখ খিচে তাকাল। ঈশাকে এভাবে দেখে অবাক হল। আবার নিজেকে সংযত করে নিয়ে বলল
–কি হয়েছে?
ঈশা এলোমেলো পায়ে ইভানের সামনে এসে দাঁড়ালো। ইভান ঈশার অস্বাভাবিক চেহারা দেখে উঠে দাড়িয়ে গেলো। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল
–কি হয়েছে পাখি? কোন সমস্যা?
–আমাকে বিয়ে করো না!
ঈশার নির্লিপ্ত কথা শুনে ইভান থমকে গেলো। সব কিছু যেন তার মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো। মৃদু সরে বলল
–কি বললি আবার বল।
–আমাকে বিয়ে করো।
ইভান অস্পষ্ট সরে বলল
–বিয়ে?
–হুম।
–মানে?
–বউ করে তোমার ঘরে এনে রাখো। তোমার কাছে।
ঈশার কথা শুনে ইভান এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন জীবদ্দশায় এরকম অবাক কখনও হয়নি। সব থেকে বড় কথা ঈশার কাছ থেকে এরকম কথা যে শুনবে তা কোনদিনও ভাবেনি। অনুভুতি শুন্য দৃষ্টি নিয়ে দাড়িয়ে আছে ইভান। ঈশার কথা বুঝে উঠতে পারেনি এখনও। ঈশা আবারো বলল
–করবে বিয়ে?
ইভানের ঘোর কাটল। বুঝতে পারলো বাস্তব। কয়েকবার চোখের পলক ফেলে বলল
–তুই তো আমার বউ।
–তাহলে তোমার কাছে এনে রাখো না কেন?
–এখনও সময় হয়নি তাই।
–যদি বলি আর সময় দিতে চাইনা?
–কিন্তু আমার যে সময় চাই। সব কিছু গুছিয়ে নিতেই একটু সময় চাই। ইনফ্যাক্ট আমাদের দুজনেরই এই সম্পর্ক এগিয়ে নিতে একটু সময় চাই।
–যদি না দেই?
ইভান কোন উত্তর দিতে পারলো না। এলোমেলো লাগছে নিজেকে। সে ঈশাকে কাছে চায়। খুব করে কাছে চায়। কিন্তু বাস্তবতা তো ভিন্ন। তাকে একটু হলেও গুছিয়ে নিতে হবে। আর ঈশা এরকম পাগলামি করলে ইভান কিভাবে নিজেকে আটকাবে? একটু ভাবল। ঈশা পাগলামি করলেও সে তো আর আবেগে গা ভাসিয়ে দিতে পারেনা। তাই নিজেকে শান্ত করে নিয়ে বলল
–আমি নিরুপায়। আমাকে সময় দিতেই হবে।
–আমি এখনি এই মুহূর্তে বিয়ে করতে চাই তোমাকে।
–তোর কি মাথা ঠিক আছে?
–আমি ঠিক আছি। তুমি হ্যা না কিছু একটা বল।
ইভান এগিয়ে এসে ঈশার দুই গালে হাত রেখে বলল
–পাগলামো করিস না। আমাদের দুজনেরই একটু সময় দরকার। তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস না। কিন্তু যখন বুঝতে পারবি তখন মনে হবে সত্যিই আর একটু সময় দরকার ছিল। আবেগের বশে নেয়া ডিসিশন ভুল হয় ঈশা।
ঈশা হাত সরিয়ে দিলো। পিছিয়ে দরজার কাছে গেলো। বলল
–বিয়ে করেছ আর বউ হিসেবে রাখতেই যত প্রবলেম?
ঈশার কথার সুর অতি তাচ্ছিল্যে ভরা ছিল। ওভাবে বলায় ইভানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ভালো কথা এই মেয়েটা বুঝতে অনেক সময় নেয়। যখন সে বিয়ে করতে চেয়েছিল তখনও উলটা আচরন করেছে। কিন্তু তখন ইভানের প্রয়োজন ছিল ঈশাকে এটা বোঝানো যে সে চাইলেই তার জীবনের সাথে নিজের ইচ্ছা মতো কোন আচরন করতে পারেনা। ঈশার কাছ থেকে তার অধিকারটা কেড়ে নেয়া তখন জরুরি হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন যদি ইভান আবার সেটার বিপরিত কিছু বলে তাহলে অবশ্যই সেটার কারন আছে। একে অপরকে ভালবাসে তারা ঠিকই। কিন্তু কাছাকাছি আসার জন্য এই সম্পর্কটাকে একটু সময় দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু ঈশা অযথাই জেদ করছে। তাই ইভান একটু ঝাঝাল সরে বলল
–স্টে ইন ইউর লিমিট ঈশা। আমি যখন বলেছি তখন অবশ্যই সেটার পিছনে কোন কারন আছে।
–আর আমি যখন বলেছি তখন কারো কথা শুনতে আমি রাজি না।
ইভান অতি বিস্ময় মাখা দৃষ্টিতে তাকাল। গম্ভির গলায় বলল
–না বুঝেই জেদ করছিস। এতো জেদ ভালো না। ফলাফল কিন্তু খারাপ হয়।
–আমি এই মুহূর্তে আমার জেদের ফলাফল নিয়ে ভাবছি না। আমি যা জানতে চেয়েছি সেটার উত্তর দাও।
–আমার…
–জাস্ট সে ইয়েস ওর নো!
–নেভার!
ইভান একটুও না ভেবে জেদের বশে উত্তর দিয়ে দিলো। ঈশা কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকলো। শান্ত দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষন পর স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–তোমার কাছে কোন অপশন নেই। বিয়ে করার জন্য রেডি হও।
ঈশা বের হয়ে গেলো। ইভান বিছানায় বসে পড়ল। মাথায় হাত দিয়ে চুল টেনে ধরল। এতক্ষন ঈশার আচরনে মনে হচ্ছে মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণা করছে প্রচণ্ড। ইভান শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে ভাবছে। ঈশা প্রচণ্ড রেগে চলে গেলো। রাগ করুক আর অভিমান করুক। এই মুহূর্তে ইভানের কিছুই করার নেই। কারন ঈশা এখন কোন কথাই শুনবে না। সন্ধ্যা বেলা ইভান ঠাণ্ডা মাথায় তাকে বোঝাবে। তখন একটু হলেও বুঝবে। একটু ভাবল। বাইরে কোথাও নিয়ে যাবে একা। ঈশাকে কখনও একা একা বাইরে নিয়ে যায়নি। যখনি গেছে সবাই মিলে গেছে। নিজেদের মতো সময় কাটানো হয়নি তাদের। আর এটাই হয়তো ঈশার মাথায় ঢুকেছে। তাই এভাবে জেদ করছে। ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলল।
————–
দুই ঘণ্টা ধরে কান্নাকাটি করার ফলে চোখ মুখ সব কেমন ফোলা ফোলা লাগছে। এলোমেলো লাগছে নিজেকে। মনে হচ্ছে এক দমকা হওয়ায় সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। আর সে চেয়েও কিছুই আটকাতে পারছে না। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। অনেক ভেবে আবারো নিজের সাহসের পরিচয় দিতে প্রস্তুত হয়ে গেলো। এ ছাড়া যে তার আর কোন রাস্তা খোলা নেই। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল বাবার ঘরের উদ্দেশ্যে। দরজার সামনে দাড়িয়ে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস টেনে ভিতরে ঢুকেই দেখল বাবা মা বসে কি যেন বিষয় নিয়ে কথা বলছে। ঈশাকে দেখে তারা থেমে গেলেন। তার চেহারার এরকম ভয়ংকর রুপ দেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে ঈশার বাবা বললেন
–কি হয়েছে তোমার? এরকম অবস্থা করে রেখেছ কেন নিজের? তোমার কি শরীর খারাপ?
ঈশা সেসব কথার গুরুত্ব না দিয়েই বিছানায় বসে পড়ল। কঠিন গলায় বলল
–তোমাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে।
ঈশার বাবা মনোযোগ দিলেন। বললেন
–বল।
ঈশা মাথা নামিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে বলল
–বাবা আমার বিয়ে হয়েছে। আমি এখন আমার শশুর বাড়িতে গিয়ে থাকতে চাই।
ঈশার বাবা মেয়ের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ার উপক্রম হলেও ঈশার মায়ের মাঝে তেমন প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হল না। তিনি শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের দিকে। চোখ ফিরিয়ে পানের বাটা থেকে পান বের করে সাজাতে লাগলেন। ঈশার বাবা তার মায়ের দিকে তাকালেন। স্ত্রির এরকম স্বাভাবিক আচরন তিনি হজম করতে পারছেন না এই মুহূর্তে। ঈশার দিকে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন
–আমি তো ভেবেছিলাম তোমার পড়া শেষ হলে আমরা অনুষ্ঠান করে তোমাকে আবার বিয়ে দেবো। এখনও তো অনেক দেরি আছে। সবে মাত্র তোমার অনার্স ফার্স্ট ইয়ার কমপ্লিট হল।
ঈশা চোখ তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল
–কোন অনুষ্ঠানের দরকার নেই বাবা। আমি এখনি যেতে চাই ঐ বাড়িতে।
ঈশার বাবা এবার কি বলবেন সেটা বুঝতে পারলেন না। মুখে হাত দিয়ে একটু ভাবলেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন
–তোমার বিয়ে হয়েছে ঠিক আছে। কিন্তু এখনও তো শারিয়াহ অনুযায়ী বিয়ে হওয়া বাকি মামনি। এভাবে তো তুমি ঐ বাড়িতে যেতে পারনা। সব কিছুর একটা নিয়ম আছে।
ঈশা অস্থির কণ্ঠে বলল
–তাহলে কি করতে হবে এখন?
ঈশার বাবা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
–কাজী ডেকে বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা সবাই মিলে কথা বলি। তোমার বড় বাবা বড় মা তাদের সাথে আলোচনা করি। তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। ইভানের সাথেও কথা বলি।
ঈশা তীব্র প্রতিবাদী সরে বলে উঠলো
–এতো কিছুর সময় নেই বাবা। যা করার আজকেই করো। এখনি করো। এই মুহূর্তে। আমি আজই ঐ বাড়িতে যেতে চাই।
ঈশার বাবা এবার বিস্ময়কর দৃষ্টিতে নিজের স্ত্রির দিকে তাকালেন। ঈশার মা পান চিবুতে চিবুতে বললেন
–বিয়ে তো অর্ধেক হয়েই গেছে। শুধু কাজী ডেকে বাকি কাজটা সম্পন্ন করে দিলেই তো আর কোন ঝামেলা থাকে না। মেয়ে যখন বলছে তখন আর দেরি করে কি লাভ।
বলেই থামলেন তিনি। ঈশার বাবা বেশ অবাক হলেন। মা মেয়ের এমন কথা বলার পিছনে কি কারন থাকতে পারে? তিনি স্ত্রির দিকে তাকিয়ে বললেন
–ইভানের সাথে অন্তত কথা বলা প্রয়োজন। ইভানের এরকম কোন চিন্তা এখন নেই। আমি ওর সাথে কথা বলেছি। ও আমাকে বলেছে এখন ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছে।
ঈশার মা বাধা দিয়ে বললেন
–আহা। ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছে ভালো কথা। এমন তো না যে নিজের বউকে পালতে পারবে না। ইভান এখন যে পরিমান ইনকাম করে সেটা দিয়ে অনায়াসে ওদের সংসার চলে যাবে। ওর ব্যবসা তো ভালই চলছে। আর তাছাড়াও ওদের বিয়ে হয়েছে। জীবনের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার সম্পূর্ণ ওদের। যা চায় করুক না। আমাদের এখন এসব নিয়ে কি কথা বলা সাজে। বিয়ের আগে পর্যন্ত মেয়ে আমাদের দায়িত্তে ছিল। এখন ইভানের দায়িত্তে। সেটা ওরা বুঝে নিবে। আমাদের কর্তব্য পালন করে দিলেই হল।
ঈশার বাবা ঈশার দিকে তাকালেন। ঈশা কঠিন গলায় বলল
–বিয়ে আজ সন্ধ্যায় হবে বাবা। তুমি অনুমতি দাও।
ঈশার বাবা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন
–মামনি একটা বিয়ে কি সহজ কথা? কত প্রস্তুতি আছে বল। আমি সবার সাথে কথা বলি। কাজী সাহেবের সাথে কথা বলে নেই। ওনার সময় আছে কিনা আসতে পারবে কিনা সেটাও তো দেখতে হবে তাই না? সব কিছু মিলে ঠিক করে কাল নাহয়……।
কথা শেষ হওয়ার আগেই ঈশা উঠে দাঁড়ালো। বলল
–সত্যিই বাবা এতো কিছুর সময় থাকলে আমি তোমাকে দিতাম। কিন্তু এখন আমার নিজেকে ভাবতে দেয়ার সময়টাই নেই। তাই আমিও ঠিক ভাবে ভাবতে পারছি না। তুমি শুধু অনুমতি দাও। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।
চলবে…………
(আপনাদের মাথায় এখন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি কিন্তু একটু হিন্ট দিয়েছি। যারা বোঝার বুঝে যাবেন। আর যারা বুঝতে পারেন নি। একটু অপেক্ষা করতে হবে।)