শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-২৬

0
1837

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২৬

ল্যাম্পোস্টে ভিজে আলোয় ইলেক্ট্রিক তারের ওপর সার বেঁধে জ্বলছে বৃষ্টির শিশির, জলের ফোঁটাগুলো একপলক পর পর নিচে ঝরে পড়ছে। বৃষ্টির অবিরাম ছন্দবদ্ধ সঙ্গীত। গাছের পাতাগুলো বৃষ্টির পানিতে মৃদু মন্দ কাঁপছে। বৃষ্টি পড়ার শব্দ। মাঝে মাঝে আকাশের এক কোণে হঠাৎ জ্বলে উঠে হারিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের চমক। স্নিগ্ধ বাতাসের স্পর্শ। দূর দিয়ে চলে যাওয়া কোন রিকশার অস্পষ্ট ঘন্টার শব্দ। মাঝে মাঝে বড় গাড়ি রাস্তায় জমে থাকা পানির মাঝে ছলাত ছলাত শব্দ করে জোরে ছুটে চলেছে। মাঝ রাতের বৃষ্টি বিলাস! কি যে এক অপার আনন্দ। ঈশা বারান্দায় দাড়িয়ে নিজের ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে ভালো করে মুছতে মুছতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি এখনও কমেনি। তুমুল বেগে পড়ছে। কিছুক্ষন আগেই দুজন ছাদ থেকে বৃষ্টিতে ভিজে নিচে নেমেছে। ঈশা নামতে চাচ্ছিল না। ইভান জোর করে নামিয়ে এনেছে। তাই সে রাগ করেছে। ভেজা কাপড় বদলে নিজের চুল মুছতেই ব্যস্ত সে। আর ইভান ওয়াশ রুমে কাপড় চেঞ্জ করছে। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে দেখল ঈশা বারান্দায় দাড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান পিছনে দাড়িয়ে জোরে ধমক দিয়ে বলল
–এখানে কি? ঘুম পায়নি?

ইভানের এমন গলার আওয়াজ শুনে ঈশা চমকে তাকাল। একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তোয়ালেটা মেলে দিয়ে ঘরের ভিতরে পা দিতেই ইভান আটকে দিলো। মৃদু সরে বলল
–একটু আগেই তো কত প্রেম ছিল। এখন কি হল? সব উধাও হয়ে গেলো কোথায়?

ঈশা মুখ ভার করে বলল
–আমার ঘুম পেয়েছে। ঘুমাবো।

ইভানের হাত সরিয়ে ঈশা ঘরের ভিতরে চলে গেলো। বিছানায় বসে পড়ল। ইভান তার কাছে গিয়ে পাশে বসলো। ঈশা পা তুলে ঘুরে শুতে যাবে তখনই ইভান ধরে ফেলল। নিজের কাছে টেনে এনে দুই হাত আলতো করে গালে রাখল। ঈশা বিরক্ত হওয়ার চেষ্টা করে বলল
–ছেড়ে দাও। আমি ঘুমাব।

ইভান গালে নাক ঘোষতে ঘোষতে বলল
–যদি ঘুমাতে না দেই।

ইভানের কথা শুনে ঈশা একটু অভিমানী সুরে বলল
–তোমার ইচ্ছাই তো সব। যা বলবে শুনতেই হবে।

ইভান ছেড়ে দিলো ঈশাকে। আলতো করে দুই আঙ্গুলে গালে স্লাইড করতে করতে বলল
–আমি কি এতো বড় অপরাধ করেছি যার শাস্তি স্বরূপ মাঝ রাতে এভাবে রাগ করে আমাকে কষ্ট দেয়া হচ্ছে?

ঈশার মনটা গলে গেলো। শান্ত চোখে তাকাল। ইভান আবার বলল
–আচ্ছা বাবা সরি। আর এভাবে জোর করবো না।

ঈশা তাকিয়েই থাকলো। ঈশা মনে মনে ভাবল এই মানুষটা এমন কেন? জোর করে কিন্তু অন্যায় করেনা। সব কিছুর পিছনে একটা সুনির্দিষ্ট কারন থাকে। সব ভাবনা কেমন গোছানো। ঈশার মতো এমন এলোমেলো একটা মেয়েকে প্রতি নিয়ত নিজের মতো করে গুছিয়ে নেয় সে। ইভান চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–এতো সময় ধরে বৃষ্টিতে ভিজলে ঠাণ্ডা লাগবে তাই………।

ইভান কথা শেষ করার আগেই ঈশা আদুরে কণ্ঠে বলল
–শুয়ে পড়। আমি মাথা টিপে দেই?

ইভান চোখ তুলে তাকাল। হেসে ফেলে বলল
–লাগবে না। শুয়ে পড়।

ঈশা বসেই থাকলো। ইভান লাইট অফ করে দিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে হাত বাড়িয়ে ঈশাকে বলল
–কাছে আসো।

ঈশা মৃদু হেসে ইভানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ইয়াভন তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল।

—————-
কালো মেঘে ছেয়ে থাকা আকাশটা বিকেলের আলো গ্রাস করে ফেলেছে। এখনও বেলা থাকলেও মনে হচ্ছে সন্ধ্যা নেমেছে। ইভান আজ সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হয়েছিলো। কি যেন জরুরী কাজ আছে দুপুরেও বাসায় আসেনি। ঈশা ঘরে বসে অপেক্ষা করছে তার জন্য। বলেছিল বিকেলের মধ্যে চলে আসবে। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল এখনও কোন খবর নেই। হঠাৎ করেই মেঘ ডেকে উঠলো প্রচণ্ড শব্দে। ভয় পেয়ে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল গুমোট মেঘ। প্রকৃতি তাণ্ডব শুরু করেছে। যেকোনো সময় মুশল ধারে বৃষ্টি নামবে। চিন্তিত হয়ে গেলো ঈশা। এমনিতেই গত রাতে অনেকটা সময় বৃষ্টিতে ভিজেছে। আবার এখন ভিজলে যদি অসুস্থ হয়ে যায়। বিছানার কাছে এসে ফোন হাতে নিয়ে ইভান কে ফোন দিলো। কিছুক্ষন রিং বাজতেই ইভান ফোন ধরে ফেলল
–হ্যালো।

ঈশা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল
–কোথায় তুমি?

ইভান একটু থেমে গেলো। ঈশা আবারো বলল
–কি হল? কথা বলছ না কেন? কোথায় তুমি?

–একটু কাজে আছি। কেন?

ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–কেন আবার কি? তুমি কখন আসবে?

–বললাম তো কাজে আছি। আসতে দেরি হবে।

ঈশা তেতে উঠে ঝাঝাল গলায় বলল
–কেন দেরি হবে? সেই সকালে বের হয়ে গেছ। এখনও কাজ শেষ হয়নি। কি এমন কাজ করছ? বলেছিলে বিকেলের মধ্যেই চলে আসবে। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। তবুও খবর নেই। আকাশে মেঘ জমেছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসো।

ইভান একটু থেমে নরম গলায় বলল
–বললেই হল। কাজ না শেষ হওয়া পর্যন্ত তো আমি বাসায় আসতে পারবো না। বৃষ্টি হলেই বা আমার কি?

ঈশা রেগে গেলো। রাগ করে বলল
–তোমার কি মানে? এতো কথা কেন বলছ? আমি বলেছি আসবে মানে আসবে। আর কোন কথা বলবে না। ১০ মিনিটের মধ্যে বাসায় চলে আসবে। নাহলে……।

–নাহলে?

হঠাৎ করেই কানের কাছে আওয়াজ শুনতে পেয়ে ঈশা চমকে গেলো। ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেলো। পিছনে ঘুরতেই ইভানের সাথে ধাক্কা খেলো। এভাবে ইভান কে দেখে ঈশা কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। ইভান মুচকি হেসে বলল
–১০ মিনিটের আগেই চলে এসেছি। এখন?

ঈশা হেসে ফেলল। চোখে মুখে অবাধ খুশি। হাসি থামিয়ে বলল
–তুমি এখনি আসলে?

ঈশার খুশি দেখে ইভান মুচকি হেসে সামনের চুল গুলো যত্ন করে কানের পিছনে গুজে দিয়ে বলল
–আমার বউ আমাকে মিস করছে। আর আমি বাইরে থাকব। কিভাবে সম্ভব?

–আমি কি বলেছি মিস করছিলাম? বৃষ্টি হবে তাই আসতে বললাম। কাল রাতেও ভিজেছ। আজ আবার ভিজলে যদি জ্বর হয়।

ইভান ঈশার ঘাড়ে দুই হাত রেখে একটু ঝুকে বলল
–হলে হবে। সমস্যা কি?

ঈশা সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–সমস্যা কি মানে? জ্বর হলে তো তোমার মাথায় কিছু থাকেনা। তুমি কিভাবে বুঝবে কি হয়?

ইভান অসহায়ের মতো বলল
–আমার ক্ষমতা থাকলে তো আমি প্রতিদিন অসুস্থ হয়ে থাকতাম। অসুস্থ হলেই ভালো। বউ কত আদর করে। সেবা করে। খাইয়ে দেয়।

ঈশা একটু লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিতেই দরজায় নক করার আওয়াজ হয়। ইভান ঈশাকে ছেড়ে দেয়। বাইরে থেকে ইলু আর ইরিনার গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ইভান একটু রেগে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–এই তোর জন্য ওরা আমার বেড রুম পর্যন্ত আসার সাহস পায়। নাহলে কেউ আমার ঘর অব্দি আসার সাহস এখনও পেতনা। বাড়িটা একদম বস্তি বানিয়ে রেখেছে। সারাদিন এখানেই ঘুরঘুর করে। বউয়ের সাথে যে একটু মন খুলে কথা বলবো সেটারও উপায় নেই আর রোমাঞ্চ তো দুরের কথা।

ইভানের রাগ দেখে ঈশা একটু ঘাবড়ে গেলো। নরম গলায় বলল
–তুমি দুপুরে খেয়েছ? খাবার দেই।

ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–আমি খেয়েছি। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। যা দরজা খোল।

ঈশা আর কথা না বলে দরজা খুলে ফেলল। ওরা দুজনি হুরমুরিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে ঈশাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিলো। ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?

ইলু ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–ভাইয়া আমরা ঈশাকে একটু নিয়ে গেলাম আমাদের বাসায়। তুমি ভেব না। আবার সময় মতো দিয়ে যাব তোমার বউকে।

ইভান দাত বের করে হেসে বলল
–কোন সমস্যা নেই। এক কাজ কর। তোরাই আমার বউকে নিজের কাছে রেখে দে। মাঝে মাঝে আমার যখন প্রয়োজন হবে তখন আমি চাইব দিয়ে যাস। তাহলেই হবে।

ইভানের কথা না বুঝেই ইরিনা বলল
–তোমার কখন দরকার হবে?

ইরিনার এমন প্রশ্নে সবাই থেমে গেলো। ইভান ঈশার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ঈশা বুঝতে পারলো ইভান অনেক রাগ করেছে। অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকলো। সারাদিনের কাজ শেষ করে ক্লান্ত শরীরে ইভান রাতে বাড়ি ফিরে ঈশার সাথে একটু সময় কাটাতে চায়। কারন ইভানের ব্যস্ততার কারনে রাতে ছাড়া ঈশার সাথে তার তেমন কোন কথা হয়না। কিন্তু সব দিকে এভাবে সামলাতে ঈশাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সবার মন রাখতে গিয়ে কি ইভান কে কষ্ট দিয়ে ফেলছে সে?

চলবে…………
(দুইটা পর্ব চেয়েছিলেন। দিয়েছি। এখন আর কেউ বকবেন না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here