#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক-এ রহমান
শেষ পর্ব
“কতদিন এই চোখ গুলো তাকিয়ে থাকে না প্রিয় কোনো চোখের দিকে। অবাক হয়ে দেখে না কারো মুগ্ধকরণ হাসি। যে হাসির মাঝে নিজের সমস্ত সুখ খুজে পেয়েছিলো। এক পাহাড় স্বপ্নের জন্ম হয় না কতদিন। তোমার ঐ শীতল কন্ঠের মাদকতায় এক সমুদ্র প্রেম হাতছানি দিয়ে ডাকে না আর। ওই চোখের শীতল চাহুনিতে আর তোমার ছোঁয়ায় হাজারও অগ্নি দাবানল শান্ত হয়ে ছেয়ে যায় না হিম শীতলতায়। কোন একদিন আসবে যেদিন তুমি সামনে দাঁড়াবে। সেদিন চোখ জুড়ে থাকবে নতুন করে পাওয়ার উচ্ছ্বাস। শরীর জুড়ে থাকবে শুভ্রতার ছড়াছড়ি। আর তোমার কাছে থাকবে নীল বেদনা। সেই শুভ্রতা আর নীল মিলে তৈরি করবে কতো ভয়ানক প্রহর। কিন্তু আমি বিচলিত হব না। গুছিয়ে নিবো সবটা। আবার নতুন করে গড়ে তুলবো সেই প্রেমপ্রহর। শুভ্র_নিলের_প্রেমপ্রহর!”
–আপু?
শুভ্র রঙের কাগজটা পুনরায় সেই বিশেষ ঢঙ্গে ভাজ করে ডাইরির পাতায় রেখে দিলো ঈশা। শুভ্র রঙের পাতায় নীল রঙের কালির সেই লেখা চিরকুট হয়তো কোন একদিন পৌঁছাবে কাঙ্ক্ষিত মানুষটার কাছে। পুরো ডাইরির প্রতিটা পৃষ্ঠার ভাঁজে একটা করে এরকম শুভ্র কাগজে লেখা নীল কালির চিরকুট রয়েছে। ঈশা ইভান কে উদ্দেশ্য করে লিখেছে সব কিন্তু দেয়া হয়নি।
–ও আপু?
ইরার আওয়াজ শুনে ঈশা তার দিকে তাকিয়ে নরম কণ্ঠে বলল
–কি হয়েছে?
ইরা এগিয়ে এলো। ঈশার হাতে থাকা ডাইরিটার দিকে তাকিয়ে বলল
–সবাই এসেছে। তোমাকে ডাকছে।
ঈশা ডাইরিটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল
–তুই যা আমি আসছি।
ইরা কিছুক্ষন ডাইরিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। কোন কথা না বলে নিশব্দে বেরিয়ে গেলো। ইভানের ডাইরিটার উপরে হাত বুলিয়ে আলমারিতে তুলে যত্ন করে রেখে দিলো ঈশা। ভারি দীর্ঘশ্বাসটা চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। ভালো করে নিজেকে দেখে নিলো। ৫ বছরে নিজের চেহারার ঠিক কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে? ম্লান হাসল। চেহারার পরিবর্তন না হলেও বাস্তবতা যে তার জীবনে পরিবর্তন এনে দিয়েছে। জীবনের এই পরিবর্তনের জন্য তার অপরাধ ঠিক কতটুকু সেটাই বুঝতে পারছে না আজও। অনেক হিসেব মেলাতে চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু পারেনি। কারন তার জীবনের হিসাব তো অন্য কেউ মিলে দিতো। ভাবনার মাঝেই উচ্চ শব্দে ফোনটা বেজে উঠলো। খানিকটা চমকে সেদিকে তাকাল। স্ক্রিনে ইফতির নামটা জ্বলজ্বল করছে। ফোনটা হাতে তুলে নিলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে রিসিভ করে ফেলল। ঈশা ‘হ্যালো’ উচ্চারণ করতেই ওপাশ থেকে ইফতি বলল
–মার শরীরটা ভালো না। তোমার কথা বারবার বলছিল। তুমি কি একবার আসবে আপু?
ইফতির শেষের কথাটা খুব অসহায় শোনালো। ঈশার চোখ ছলছল করে উঠলো। চোখের পানি উছলে পড়তে নিলেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু ধারা। ইফতি বুঝতে পারলো ঈশা কাঁদছে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–মাকে ঔষধ খাওয়াতে হবে। আমি রাখছি।
–শোন ইফতি।
ঈশার বিচলিত কণ্ঠ শুনে ইফতি থেমে গেলো। নরম কণ্ঠে বলল
–বলো।
–আমি আসছি।
ঈশার কথা শুনে ইফতির চোখ ছলছল করে উঠলো। সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে টলমলে চোখে হেসে বলল
–সত্যি আসবে?
–আমি এসে বড় মাকে ঔষধ খাওয়াবো।
ইফতি আর কথা বলতে পারলো না। ফোন কেটে কেদে ফেলল। ৫ বছর পর ঈশা এই বাড়িতে আসবে। সত্যিই খুব খুশির খবর। ইফতি চোখের পানি মুছে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
–মা আপু আসছে।
ইভানের মা শব্দ করে কেদে ফেলল। ইফতি তাকে শান্তনা দিলো না। কারন এটা যে তার মায়ের কাছে কত বড় খুশির খবর সেটা সে ভালো করেই জানে। আর এই কান্না খুশির কান্না।
ঈশা ঘর থেকে বের হয়ে এলো। বাইরে সোফায় সবাই বসে আছে তার অপেক্ষায়। বের হয়েই সবাইকে দেখে মনটা উতফুল্য হয়ে উঠলো তার। কত বছর পর সবার সাথে দেখা। ঈশা এগিয়ে যেতেই ইলু উঠে এসে জড়িয়ে ধরল। নিজের আবেগ সামলাতে না পেরে কেদে ফেলল। ঈশা জড়িয়ে ধরে তাকে শান্তনা দিতে বলল
–তুমি এখনও কাদছ। তোমার মেয়ে তাহলে কি করবে?
ঈশার কথা শুনে গম্ভীর পরিবেশে প্রান আনার চেষ্টায় সায়ান বলে উঠলো
–আর বল না। এই মা মেয়েকে সামলাতে আমার যে কি কষ্ট হয়ে যায়। একবার মা কাদে তো আরেক বার মেয়ে।
তার কথায় এবার সবাই হেসে দিলো। ইলু কান্না থামিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। সায়ান থেমে গেলো। তার মুখভঙ্গি দেখে আবার সবাই হেসে দিলো। ঈশা ইলুকে বলল
–তোমরা একটু বসো। আমি আসছি।
ইরিনা নিজের ৬ মাসের ছেলেকে কোলে নিয়ে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল
–আসছি মানে? কোথায় যাচ্ছিস?
ঈশা একটু এগিয়ে দরজা অব্দি গিয়ে সহজ ভাবে বলল
–বড় মার কাছে।
সবাই তার দিকে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশা কারো দিকে না তাকিয়েই বাইরে যেতে পা বাড়াতেই ইরিনা বলল
–আমরাও তোর সাথে ঐ বাড়ি যাব ঈশা।
ঈশা থেমে গেলো। একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে ছোট্ট করে বলল
–আসো।
সবার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। ঈশা নিজের কথা শেষ করে বাইরে পা বাড়াল। সবাই ঈশার পিছু পিছু চলে গেলো। বাড়ির দরজার সামনে দাড়িয়ে কলিং বেল চাপল। ইফতি দরজা খুলেই ঈশাকে দেখে এক গাল হেসে দিলো। সবাইকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সে। ঈশার সাথে যে সবাই আসবে সেটা হয়তো কল্পনাও করেনি। ঈশা ইফতির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মাথা বাড়িয়ে ভিতরে তাকাল। ইফতি বুঝতে পেরে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। সেই চিরচেনা পরিবেশ। ৫ বছরে তেমন কোন পরিবর্তন নেই। ঈশা একটা শ্বাস টেনে ভিতরে পা রাখল। গা শিরশির করে উঠলো তার। ভিতরে ঢুকেই চারিদিকে চোখ চালিয়ে জিজ্ঞেস করলো
–বড় মা কোথায়?
ইফতি ধরা গলায় বলল
–ঘরে।
তার গলা শুনেই ঈশা ঘুরে তাকাল। চোখ ছলছল করছে। অতি কষ্টে কান্না চেপে রেখেছে। ছেলে মানুষের কাদতে নেই তাই হয়তো নিজের চোখের পানিটা অনবরত পলক ঝাপটে আড়াল করার চেষ্টা করছে। গড়িয়ে পড়তে দিলে ক্ষতি কি? এটা তো খুশির কান্না। এতদিন পর সবাই একসাথে হওয়ার খুশি। চোখ ফিরিয়ে ঈশা ঘরে গেলো। ইভানের মা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তিনি এখন আর চলাফেরা করতে পারেনা। ঈশা গিয়ে পাশে বসতেই চোখ খুলে ফেলল। ঈশাকে দেখে জোরে কেদে উঠলো। ঈশা এক হাত শক্ত করে চেপে ধরে হেসে বলল
–ছোট বাচ্চার মতো কাদছ কেন? তুমি তো অনেক স্ট্রং।
ইভানের মা কাপা কাপা গলায় বলল
–কতদিন পর আসলি বল তো? আমাদের কথা মনে পড়ে না তাই না?
ঈশা হেসে দিলো। অমায়িক হাসি। বলল
–তোমাদের সবাইকে অনেক মিস করেছি বড় মা।
ইভানের মা কাদ কাদ কণ্ঠে বললেন
–তুই আর যাস না কোথাও মা। এখানেই থেকে যা।
–আমি কোথাও যাব না বড় মা। আমি একবারেই চলে এসেছি।
ঈশার কথা শুনে ইফতি হেসে বলল
–সত্যি আপু? তুমি আর যাবে না?
ঈশা মাথা নাড়িয়ে বলল
–আমার পড়ালেখা তো শেষ। আর গিয়ে কি করবো। এখন থেকে বাসাতেই থাকবো।
ঈশার কথা শেষ হতেই সবাই একে একে ঘরে ঢুকে পড়ল। ঈশা দরজার দিকে তাকিয়ে বলল
–দেখ বড় মা তোমার সাথে কে দেখা করতে এসেছে।
ইভানের মা ঘাড় ঘুরিয়ে সবাইকে দেখে কেদে ফেলল। সবাই এগিয়ে এসে তার চার পাশে দাড়িয়ে গেলো। সবার চোখেই পানি। ইভানের মা কাদতে কাদতে বললেন
–তোরা কেউ আর এই বাড়িতে আসিস না। সেই যে ইভান আর ঈশা চলে গেলো তারপর থেকে কেউ আমার কাছে আসে না।
ইভানের নাম শুনে ঈশার বুকের ভিতরে হাহাকার করে উঠলো। সবাই কথা বলায় ব্যস্ত। ঈশা ধির পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। ইভানের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এই ঘরে তারা দুজন একসাথে কত সময় কাটিয়েছে। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছনে ঘুরেই ইফতিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো
–তোর ভাইয়া কি একদমই বাসায় আসেনা? ফোনও করে না?
ইফতি মন খারাপ করে বলল
–ফোন করে। প্রতিদিন একবার মার খবর নেয়। সে তিন বছর আগের কথা বাবা মারা যাওয়ার পর একদিন থেকে গেছে। তারপর আর আসেনি।
ঈশা কিছু বলল না। ইফতি বলল
–তোমরা চলে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে রেখেছি। দুই একদিন পর বুয়া পরিষ্কার করে। দরজা খুলে দিবো? তুমি ঢুকবে?
ঈশা না সুচক মাথা নাড়াল। বলল
–না থাক। বড় মাকে ঔষধ খাওয়াতে হবে।
–আমি খাইয়ে আসলাম আপু। মা ঘুমাচ্ছে। সবাই সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। চল।
ঈশা আর ইফতি সোফায় গিয়ে বসলো। সেই আগের মতো প্রাণহীন বাড়িটা হঠাৎ করেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো। কত খুনসুটি চলছে। মন খুলে সবাই হাসছে। আর সেই হাসির শব্দে থেমে থেমে পুরো বাড়ি কেপে উঠছে। এর মাঝেই সায়ান আনমনে বলে উঠলো
–ইভান কে খুব মিস করছি।
কথাটা শেষ হতেই সবাই ঈশার দিকে তাকাল। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। সায়ান বুঝতে পারলো তার এই সময় ইভানের কথাটা বলা ঠিক হয়নি। ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–সরি ঈশা। আমি আসলে…।
ঈশা মৃদু হেসে বলল
–ইটস ওকে ভাইয়া। আমি চা বানিয়ে আনছি।
বলেই রান্না ঘরে চলে গেলো। সবাই আবার নিজের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঈশা রান্না ঘরে গিয়ে নিজের চোখের পানি ছেড়ে দিলো। এতদিনের জমানো কষ্টটা আজ বেরিয়েই এলো। নিজেকে আটকাতে পারলো না।
সেদিনের সব কথা ঈশার কানে এসেছিলো। সবটা শুনে ইভানের বাবা মা প্রথমে আপত্তি করলেও পরে সন্তানের সুখের কথা ভেবে কোন কথা বলেনি। আর ইভান সেদিন ঈশাকে বলেছিল এরপর আর কোনদিন এই বাড়িতে এই নিয়ে কোন কথা উঠবে না। ঠিকই এরপর কোন কথা উঠেনি। ঈশারও ট্রিটমেন্ট চলছিলো। সব মিলে তাদের জিবন ভালভাবেই কাটছিল। কিন্তু বাস্তবতা তো ভিন্ন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শুরু হয়ে গেলো মানুষের জল্পনা কল্পনা। নানা কথার ভাঁজে ঈশা অস্থির হয়ে উঠেছিল। সেদিনের ইভানের মায়ের কথা গুলো ঈশা ভালভাবে বুঝতে পারছিল। সমাজের কাছে জবাবদিহি করা আসলেই সহজ ব্যপার না। ইভান অতি বিচক্ষণতার সাথে সবটা সামলে নিয়েছিলো। ঈশার পাশে ঢাল হয়ে দাড়িয়ে সবার কথার উত্তর দিতো। কিন্তু তার অসহায়ত্ব ঈশার চোখ এড়ায় নি। সবার কথার তিক্ততায় ঈশা হাপিয়ে উঠেছিল। জীবনটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। আত্মীয় স্বজনের কথার তোড়ে ইভান দিনদিন অসহায় হয়ে উঠছিল। সেই বা আর কতদিকে সামলাবে। ইভান ঈশাকে কথা দেয়ার পরেও বারবার এই বিষয় নিয়ে কথা উঠছিল। যেই বাড়িতে আসছিলো সেই এসব নিয়ে কথা বলছিল। ইভানের অপরাধ বোধ দিনদিন বেড়েই চলেছিল। ঈশা ইভানের অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তাকে এই যন্ত্রণাময় জীবন থেকে মুক্তি দিতে। তাই খুব সাহস করে ইভান কে বলেছিল সে পড়ালেখা শেষ করতে দেশের বাইরে যেতে চায়। ঈশার এই সিদ্ধান্তটা ইভানের জন্য কতটা কষ্টের ছিল সেটা হয়তো কারো বোঝার ক্ষমতা নেই। কিন্তু ইভান কোন কথা বলে নি। সবটা ঈশার উপরে ছেড়ে দিয়েছিলো। কারন ঈশা ইভান কে খুলে না বললেও তার এই সিদ্ধান্তের পিছনের কারণটা ইভানের জানা ছিল। এই জীবনটার উপরে ঈশা যে অতিস্ট হয়ে উঠেছিল সেটা বুঝতে পেরেই ইভান কোন কথা বলেনি। ঈশাকে বারবার তার জীবনের কঠিনতম অপ্রিয় সত্যটার মুখোমুখি হওয়া থেকে বাচাতে না পারার শাস্তি হিসেবে দূরত্বটা মেনে নিয়েছিলো। নিজের অসহায়ত্তের শাস্তি। ঈশা যেদিন বিদেশে চলে যায় ইভান নিজেই তাকে এয়ারপোর্টে দিয়ে এসেছিলো। শুধু বলেছিল
–আমি কথা দিয়েছিলাম তোমাকে তোমার অক্ষমতার কথা তোমার সামনে কোনদিন উঠবে না। কিন্তু পারিনি রাখতে। তাই সেটার শাস্তি হিসেবে এই দূরত্বটা মেনে নিলাম। শুধু একটাই চাওয়া থাকবে তোমার কাছে। আমার আমানত তোমার হাতে তুলে দিলাম। খেয়াল রেখো। এমন ভাবে খেয়াল রেখো যেদিন আমি চাইব সেদিনই ঠিক যেমন তোমার হাতে দিয়েছিলাম ঠিক তেমনই পাই যেন। তার যদি কোন ক্ষতি হয় আমি তোমাকে কোনদিনও মাফ করবো না। মাথায় রাখবে।
আর নিজে সেদিন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে বাড়িতে ঈশা থাকবে না সেই বাড়িতে ইভানও থাকবে না। ঐ ঘরে ঈশার সমস্ত জিনিস নিজের মতো করেই সাজানো আছে এখনও। ইভানের কড়া নির্দেশ কেউ যেন কোন পরিবর্তন না করে। ঈশার যদি কোনদিন মনে হয় সে একবারেই আবার চলে আসবে সেদিন ইভানও তার বাড়িতে আসবে। ইভানের বাবা মা শত চেষ্টা করেও তাকে আটকাতে পারেনি। অন্য শহরে নিজের মতো করে জীবন গুছিয়ে নিয়েছে সে। তবুও যেই শহরে তার প্রিয়তমার অস্তিত্ব নেই সেই শহরে নিজের বিচরণ বন্ধ করে দিয়েছে। এই ৫ বছরে ইভান ঈশার সাথে কোন যোগাযোগ না করলেও ঈশার খোজ খবর ঠিকই নিয়েছে। ঈশার সাথে যোগাযোগ না করার প্রধান কারন হল সে যদি কোনভাবে ঈশার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে আর ঈশাকে আবারো জোর করে তার সাথে থাকতে তাহলে হয়তো ঈশার কষ্টটা আবারো তাকে দেখেতে হবে। ঈশা ভেঙ্গে পড়বে আবারো। ইভান সেটা সহ্যও করতে পারবে না। তাই দূরে থেকেই ভালবেসেছে তাকে।
বাইরে থেকে ডাক আসতেই ঈশা ভাবনার জগত থেকে বের হল। চায়ের কাপ গুলো সবার হাতে হাতে দিলো। নিজের কাপটা হাতে নিয়ে সোফায় বসতে যাবে ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো। ঈশা কাপটা রেখে দরজা খুলতে গেলো। দরজা খুলে আকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ঈশার বুকের ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। ইভান নিস্পলক ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের মাঝে এক অন্য রকম প্রশান্তি। ঈশা জানতনা ইভান আসবে। কিন্তু ইভান জানে ঈশা এসেছে। কোন কথা বলার আগেই ইরা দৌড়ে এসে ঈশাকে সরিয়ে দিয়ে ইভান কে জড়িয়ে ধরে বলল
–ভাইয়া তুমি এতো দেরি করলে কেন? কখন থেকে অপেক্ষা করছি তোমার। কতক্ষন আগে বলেছ তুমি বের হয়েছ।
ঈশা নিজের চোখের পানি লুকাতে ঘুরে দাঁড়ালো। কিছুতেই নিজেকে আটকাতে পারছে না। এতো বছরের আবেগ চোখ বেয়ে ঝরেই পড়ছে। ইভান মুচকি হেসে বলল
–রাস্তায় একটু কাজ পড়ে গিয়েছিলো রে। সরি।
ইরা হেসে ভিতরে আসতে বলল। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে ভিতরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। ইরার তার বোনের উপরে এক রাশ অভিমান। ইরা ভাবে তার জীবনে ভাইয়া আর আপুর এতো বছরের অভাবটার এক মাত্র কারন তার বোন। তার বোন চাইলেই এরকম কিছু হতই না। সবাই ইভান কে দেখে অনেক খুশি। ইভান ভিতরে গিয়ে সবার সাথে কথা বলতেই ব্যস্ত। কিন্তু ঈশা সেই জায়গায় দাড়িয়েই কাঁদছে। ইভান সবার সাথে ব্যস্ত থাকলেও তার মন মস্তিষ্ক সব কিছু ঈশার কাছে পড়ে আছে।
————-
সময় নির্দেশক যন্ত্রটা বড্ড চঞ্চল। একবার ছুটতে শুরু করলে তার কোন অবসর নেই। সকাল পেরিয়ে গোধুলি বেলা। ছাদে দাড়িয়ে নিকোটিনের পোড়া ধোঁয়া ছাড়ছে ইভান।
–আবার কবে থেকে সিগারেট খেতে শুরু করেছো?
ঈশার কথা শুনে ঘুরে তাকাল। একটু অপ্রস্তুত হয়ে সিগারেট টা ফেলে দিলো। কোন উত্তর দিলো না। ঈশা আবার বলল
–উত্তর দিচ্ছ না যে?
ইভান মাথা নিচু করেই বলল
–মাঝে মাঝে খাই।
মাথা তুলে ঈশার মুখে অবিশ্বাসের হাসি দেখে বলল
–এতো বছরে সব পরিবর্তন হলেও বিশ্বাসটা একই রকম থেকে গেছে।
ঈশা সহজ ভাবে বলল
–অজুহাতটাও তো একই আছে।
ইভান গভির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন। আবেগি কণ্ঠে বলল
–কেমন আছো?
ঈশা হাসল। বলল
–তুমি তো সবই জানো। তবুও কেন জিজ্ঞেস করছ?
ইভান রেলিঙ্গে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। হাত গুজে বলল
–জানি। কিন্তু তোমার কাছ থেকে জানতে ইচ্ছা করছে দূরে গিয়ে ঠিক কত ভালো থাকতে পেরেছ।
ঈশা খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–খোঁটা দেয়ার অভ্যাসটা এখনও আছে।
ইভান মৃদু হেসে বলল
–কিছুই তো পরিবর্তন হয়নি। না তুমি না আমি। আর না আমাদের ভালবাসা। শুধু কিছু দিনের দূরত্ব ছিল।
ঈশা কোন উত্তর দিলো না। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান বুঝতে পারলো ঈশার চোখে পানি। ঠোটের কোনে ক্ষীণ হাসি নিয়ে বলল
–কাদতে ইচ্ছা করলে আমার বুকে মাথা রেখে কাদতে পারো। আমি এখনও বেঁচে আছি ঈশা। আর জতদিন বেঁচে থাকবো আমার ভালবাসা আবেগ সব কিছুই তোমার জন্য।
ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–তুমি আবার চলে যাবে?
ইভান চুপ করে থাকলো। উত্তর না পেয়ে এবার ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। কিন্তু নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ল। ইভান ছোট্ট করে বলল ‘না’।
ঈশার মনের মাঝে অদ্ভুত রকমের ভালো লাগা ছুয়ে দিলো। সত্যিকারের ভালোবাসা শুধু ভালোবাসার মানুষটিকে সুখী করতে চায়; তার থেকে কোনো প্রতিদান আশা করে না। সেটা ইভানের নিঃস্বার্থ ভালবাসা দেখেই বোঝা সম্ভব। ঈশা ইভানের দিকে তাকাতেই আবারো চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল। ইভান মুচকি হেসে বলল
–তুমি কি জানো আজ আমি এতো সহজ এতো স্বাভাবিক কেন? আমার আর কোনো কিছুই হারানোর ভয় নেই যা হারানোর ভয় সব সময় করতাম তা আজ হারিয়ে গেছে।
ঈশার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। সে ঠোট চেপে কেদেই যাচ্ছে। ইভান স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–আমার মনে হয় আমার শাস্তির মেয়াদ শেষ। কিন্তু আমি তবুও তোমাকে জোর করবো না। তোমার যেদিন মনে হবে সত্যিই আমার শাস্তি পাওয়া শেষ। এখন যা হচ্ছে তা অন্যায়। সেদিন তুমি আমার কাছে আসবে। আমি অপেক্ষা করবো।
ঈশার কান্নার বেগ বেড়ে গেলো। ইভান হাসি মুখে আবার বলল
–কোনো মন খারাপের বিকেলে যদি ইচ্ছে করে তোমার সাথে ঘুরতে যেতে যেখানে রাস্তা এসে থেমে গেছে। তুমি কি যাবে আমার সাথে?
কথাটা শুনে ঈশা থেমে গেলো। এটা তার ডাইরির শেষ পাতায় রাখা চিরকুটে লেখা আছে। ইভান কিভাবে পেলো সেটা ভেবেই আশ্চর্য হয়ে গেলো। ঈশা প্রশ্ন করেই বসলো
–তুমি কিভা…।
শেষ করার আগেই ইভান বলল
–সব বিষয়ে এতো কৌতূহল ভালো না কিন্তু।
ঈশা হেসে ফেলল। ইভান মুচকি হেসে আবার বলল
–যাবে? যেখানে কষ্টের নীল রঙের সাথে শান্তির শুভ্র রঙ মিশে নতুন করে রচনা করব আমরা আমাদের প্রেমপ্রহর। শুভ্র_নিলের_প্রেমপ্রহর!
সমাপ্ত
(বাস্তবতা আর গল্পের মাঝে কোন মিল নেই। যদিও বা বাস্তবতা থেকে অভিজ্ঞতা নিয়েই আমি গল্পটা লিখেছি। তবুও এখানে বাস্তবতার কোন মিল নেই। শেষ টা পাঠকরা কতটুকু ধরতে পেরেছেন আমি জানিনা। এখানে আমি শেষটা অসমাপ্ত রাখতে চেয়েছি। তাদের শেষ পরিনতি দেখাতে চাইনি। অনেকটা ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’। পাঠক মনে একটা আকাঙ্ক্ষা থাক না ক্ষতি কি। বাস্তবতার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে দুজন প্রেমিক যুগলের বিয়ের পরের জীবনটা অতিশয় কষ্টে ভরপুর হয়ে উঠেছে। ইভান যতটা সহজ ভাবে নিয়েছিলো বিষয়টা তাদের পরিবেশ ঠিক ততটাই জটিল করে তুলেছে। নিজেদের এই অসহায়ত্ব আর কষ্টে ভরা জীবন থেকে পালিয়ে যেতেই ঈশার দূরে থাকার সিদ্ধান্ত। আর ইভান বারবার এই অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হওয়া থেকে বাঁচাতেই ঈশার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে। আমি ইভান কে নিঃস্বার্থ প্রেমিক হিসেবে দেখাতে চেয়েছি। যার ভালবাসার মানুষের কাছে থেকে কোন প্রত্যাশা নেই। শুধু ভালো রাখার চাহিদা আছে। শেষটা হয়তো অনেকের কাছেই ভালো লাগবে না। আমি তার জন্য খুবই দুঃখিত। এতদিন ধৈর্য ধরে গল্পটা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ সবাইকে।)