শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর ২ পর্ব-১০

0
1697

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর_২
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১০

রান্না ঘর থেকে ফুটন্ত পানির টগবগে আওয়াজ আসছে। সেই পানির ভাপে আশপাশটা একদম ভ্যাপসা গরমে ছেয়ে গেছে। সেই উত্তাপ রান্না ঘর ছাপিয়ে ডাইনিং পর্যন্ত চলে এসেছে। মশলার উটকো গন্ধটা বিশ্রীভাবে নাকে এসে লাগছে। মাঝে মাঝে সব কিছু ভেঙ্গে ভেতর থেকে হাঁচি এসে পড়ছে। ঈশা আচলে মুখ চেপে একটা হাঁচি দিয়ে নাক ডলে সামনে তাকাল। তার ঠিক সামনের চেয়ারে বসে আছে তার এক মাত্র ফুপু। সকাল সকাল ছোট মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছেন ভাইয়ের বাসায়। ঈশা ওনাকে এভাবে আশা করে নি। তাই একটু বিচলিত হয়ে পড়েছিলো। ঈশার ফুপু রহিমা বেগম নাস্তা করছেন টেবিলে বসে। পাশেই তার ছোট মেয়ে অরপা বসে আছে। ঈশা গলা তুলে বলল
–নাজমা চা দিয়ে যাও।

নাজমা রান্না ঘর থেকে চা নিয়ে এলো। ঈশা তার দিকে তাকিয়ে বলল
–তুমি একটু সামলে নাও আমি আসছি।

নাজমা কাটকাট জবাব দিলো
–আপনে রান্না ঘর যাবেন না ভাবী। ভাইয়া না করছে। আজ সারাদিন আপনাকে রান্না ঘর যেতে না করছে।

ঈশা ভ্রু কুচকে ফেললো। অবাক কণ্ঠে বলল
–কেন? আমাকে রান্না ঘরে যেতে নিষেধ করার কারন কি?

–আমি জানি না ভাবী। কিন্তু ভাইয়া আমারে নিষেধ করে গেছে। আমি যেন আপনার খাওয়ার সময় দাঁড়ায়ে দেখি। আর রান্না ঘরে যেন না আসতে দেই।

ঈশা বিরক্ত হল। রান্না ঘরে না যেতে দিলে এখন সে কি করবে? তার আর তো কোন কাজ নেই। রহিমা এতক্ষন চুপ করে শুনছিলেন। নাজমা চলে যেতেই তিনি বললেন
–ইভান তো দেখি তোর ভালই খেয়াল রাখছে। রাখবে না কতদিন পর বউ ফিরে পেয়েছে।

ওনার কথা শুনে ঈশা স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। কথার ধরন বুঝতে একটুও কষ্ট হলনা তার। মনে পড়ে গেলো ৫ বছর আগের সেই দৃশ্যপট। কোন এক অদ্ভুত কারনে রহিমা বেগম ঈশার প্রতি একটা বিরুপ মনোভাব পোষণ করেন। ঈশার অক্ষমতার কথাটা জানতে পেরেই তিনি এই বাড়িতে চলে এসেছিলেন। ঈশাকে নানা রকম কথা বলে ছোট করার চেষ্টা করেছিলেন। উঠতে বসতে তার কথার তোড়ে এই বাড়িতে ঈশার জীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিল। কোনভাবে ঈশাকে দমাতে না পেরে ইভানের মায়ের কাছে তার দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব করেন। বলেছিলেন ঈশা সন্তান দিতে না পারলে ইভানের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। তারা দুজন মরে গেলে তাদের আর কোন চিহ্ন থাকবে না। আর অনাথ আশ্রম থেকে কোন বাচ্চা এনে মানুষ করলেই সে নিজের বাচ্চা হয়ে যায় না। পরে যখন জানতে পারবে তখন অনেক ঝামেলা হবে। আর ইফতির বউ আসার পর বিষয়টা কেমন ভাবে দেখবে সেটা নিয়েও সংশয় রয়েছে। ইভানের মা বিষয়টা মাথায় ঢুকিয়ে নেন। কিন্তু ইভানের সামনে দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব রাখার মতো দুঃসাহস করে উঠতে পারেন নি। ইভানের বাবার সাথে এই নিয়ে অনেক ঝামেলা হতো। দুজনের মাঝে ঝগড়া অশান্তি লেগেই থাকতো। অবশেষে রহিমা বেগম নিজেই ঈশার কাছে এই প্রস্তাব রাখেন। ঈশা বিষয়টা গুরুত্ব না দিলেও পরে ঠিকই বুঝতে পারে যে বাড়িতে একটা অশান্তি চলছে। ইভানের মা আর তার বাবার মাঝে যে অশান্তি চলছে সেটা মুলত তার জন্যই। শুধু এই বাড়িতেই যে বিষয়টা সীমাবদ্ধ ছিল তেমন না। সেই অশান্তির ছটা ছড়িয়ে পড়েছিলো ঈশাদের বাড়িতেও। দুই পরিবারের মধ্যে একটা চাপা মন মালিন্য তৈরি হয়েছিলো। বড় ভাই হিসেবে ইভানের বাবাকে ঈশার বাবা মুখ ফুটে কিছু না বললেও মনে মনে তিনি ঠিকই নিজের মেয়ের ওপর এমন অত্যাচার নিয়ে ক্ষিপ্ত ছিলেন। মেয়েকে শান্তিতে সংসার করার জন্যই তিনি তুলে দিয়েছিলেন ইভানের হাতে। কিন্তু পুরোটাই উল্টা হয়ে গেলো। ঈশার জীবনে শান্তি তো হল না উল্টা সবার জীবনটাই অশান্তিতে ভরে গেলো। সবকিছু মিলে ঈশা ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল। তার মাথা কাজ করছিলো না। তাই সব কিছুর অবসান করতেই সে দূরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ভেবেছিল হয়তো তার এই সিদ্ধান্তের কারনে সবার ভালো হবে। হয়তো হয়েছে। কিন্তু যাকে ভালো রাখার উদ্দেশ্য ছিল সে ভালো থাকতে পারেনি। এতদিন যাবত ঈশা বিষয়টা বুঝেও বুঝতে চায়নি। কিন্তু এখন ভালভাবে বুঝতে পেরেছে তার এই সিদ্ধান্ত ইভানের উপরে কতোটা প্রভাব ফেলেছে। ইভান ভীষণ কষ্ট পেয়ছে। এমনকি সে বেপরয়া জীবন যাপন শুরু করে। বাচার ইচ্ছা একদম ছেড়ে দেয়। ঈশা আর কোনভাবেই তাকে কষ্ট দিতে চায় না। চোখ বন্ধ করে ফেললো ঈশা। একটা হতাশ শ্বাস ছাড়তেই রহিমা বেগম আবার বললেন
–শুনেছি তুই নাকি অনেকদিন এসেছিস। তো এতদিন কোথায় ছিলিস? আর হঠাৎ করে আবার এই বাড়িতে এলি যে?

ঈশা একটু ভাবল। এসব কথা এক সময় তাকে ভীষণ কষ্ট দিত। কিন্তু এখন আর এমন ভাবলে চলবে না। ভালো থাকতে গেলে মানুষের এসব কথাগুলোকে গুরুত্ব দেয়া যাবে না। তার একমাত্র গুরুত্ব হবে ইভানের কথার উপরে। এটা তার সংসার। মানুষের কথায় নিজের শান্তি নষ্ট করার কোন মানেই হয়না। অনেক হয়েছে। যে মানসিক সুখের আশায় ইভান তাকে বিয়ে করেছিল সেই সুখ ঈশা তাকে কোনদিন দিতে পারেনি। কিন্তু এখন আর সেই ভুল সে করবে না। বাইরের কারো কথার প্রভাব তাদের জীবনে পড়তে দেবে না। ঈশা মুচকি হেসে বলল
–আমি বিদেশে গিয়েছিলাম আমার পড়াশোনা শেষ করতে। শেষ হয়ে গেছে এখন ফিরে এসেছি। আর হঠাৎ করে কি বলছ। এটা আমার সংসার। এই সংসারে আমারই থাকার কথা ছিল ফুপু।

রহিমা বেগম পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন
–এতো বছর পর মনে হয়েছে এটা তোর সংসার? এতদিন কি হয়েছিলো? যদি ইভান বিয়ে করে নিতো? কমদিন তো আর দূরে থাকলি না।

ঈশা হেসে ফেললো। রহিমা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল
–হাসির কথা নয় ঈশা। ছেলেটা ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষ আফসোস করে বলে চাচাত বোনকে ভালবেসে বিয়ে করে ছেলেটার সংসার হল না।

কথাটা ঈশার বুকের ভেতরে গিয়ে বিধল একদম। ভেতরের কষ্টটা দেখার মতো কেউ নেই। অথচ এসব নিয়ে কথা বলার মানুষের অভাব নেই। নিজেকে সামলে নিলো ঈশা। বলল
–আমি মানুষের কথা নিয়ে ভাবিনা ফুপু। আর স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের সুতোই হল বিশ্বাস। বিশ্বাস না থাকলে সেই সম্পর্কের কোন ভিত্তি নেই। ইভান আমাকে খুব ভালবাসে। আর ওর উপরে আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। তাই তো এতো বছর ছেড়ে থাকতে পেরেছি। আর আমাদের সংসার আমরা বুঝে নেবো তুমি এতো ভেব না ফুপু।

ঈশার কথা শেষ হতেই ইফতি এসে দাঁড়ালো। বড় করে হাই তুলে বলল
–ভাবী আপু খেতে দাও। ক্ষুধা পেয়েছে।

বলেই সামনের দিকে তাকাল। চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–আরে ফুপু কখন এলে?

রহিমা হেসে বলল
–অনেক্ষন আগেই এসেছি। তুই কি মাত্র ঘুম থেকে উঠলি? আজকাল কার ছেলেরা কোন কাজ করে না। বসে বসে খায় আর এমন উচ্ছন্নে যায়। কি যে হল যুগটার।

বলেই তিনি গজগজ করতে করতে উঠে গেলেন ইভানের মায়ের ঘরের দিকে। ইফতি কি বলবে বুঝতে পারল না। ঘুম থেকে উঠে এসেই এরকম একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে সেটা ধারনাই করেনি সে। ঈশা ঠোট চেপে হাসল। কারন সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে তার রাগটা ইফতিকে হজম করতে হল। ইফতি কঠিন চোখে তার দিকে তাকাল। ঈশা হাসি থামিয়ে বলল
–বস। কি খাবি বল।

ইফতি হতাশ ভাবে বসে পড়লো চেয়ারে। খানিকবাদেই সামনে চোখ পড়তেই দেখল একটা কম বয়সী মেয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। খুব একটা ফর্সা না হলেও চেহারায় একটা মায়া আছে। ইফতি ঈশার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জানতে চাইল মেয়েটা কে। ঈশা বলল
–অরপার কথা ভুলে গেছিস?

ইফতি যেন আকাশ থেকে পড়লো। অবাক চোখে তাকিয়ে বলল
–তুমি অরপা?

অরপা অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নাড়ল। ইফতি হেসে বলল
–কেমন আছো অরপা?

অরপা মৃদু হেসে বলল
–ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?

ইফতি হাসল। বলল
–ভালো আছি।

————
রাত ১১ টা। ঈশা গেস্ট রুমটা ঠিক করে দিয়েই চলে আসলো নিজের ঘরে। ওখানে তার ফুপু আর অরপা থাকবে। ইভান এখনো বাসায় আসেনি। ঘণ্টা খানেক আগে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে আসতে নাকি দেরি হবে। অফিসে একটু জরুরী কাজ আছে। ঈশাকে খেয়ে নিতে বলেছে। সে নাকি বাইরে থেকে খেয়েই আসবে। ঈশা সবার সাথে বসে খেয়ে নিয়েছে। আজ সারাদিন কোন কাজ নেই তার। ইভান নাজমা কে বলে দেয়ার পর থেকে সে ঈশাকে রান্না ঘরে ঢুকতেই দেয়নি। তাই অলস সময় কেটেছে তার। এখনো বেশ বিরক্ত লাগছে। বিছানায় হেলানি দিয়ে ফোনে স্ক্রল করছে। কিছুক্ষন পরেই ইভান আসলো। সে কলিং বেল বাজায় নি। চাবি দিয়ে দরজা খুলেছে। ঈশা তাই বুঝতেও পারেনি। ইভান নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে ঈশার দিকে তাকাল। ভালো করে দেখে নিয়ে ভেতরে ঢুকে ব্যাগটা রাখতেই ঈশা চোখ তুলে তাকাল। বলল
–কখন এলে?

ইভান টাই টা খুলে বিছানায় পা ঝুলিয়ে শুয়ে পড়লো। বলল
–মাত্র আসলাম।

ইভান কে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে। ঈশা কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–কফি খাবে?

ইভান উঠে বসলো। একটু ভেবে বলল
–খাওয়া যায়।

–তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি কফি নিয়ে আসি।

ঈশা চলে গেলো কফি বানাতে। কফি বানিয়ে ঘরে এসে দেখে ইভান ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে কি যেন কাজ করছে। ঈশা কফির একটা কাপ তার দিকে এগিয়ে দিতেই ইভান সেটা হাতে নিয়ে বলল
–থ্যাংক ইউ!

ঈশা মৃদু হেসে সামনে বসল। ইভান ব্যস্তভাবে ল্যাপটপে কাজ করছে। একবার কফির কাপে চুমুক দিয়েই ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই বলল
–তোমার কি শরীর খারাপ?

ঈশা একটু থমকে গেলো। বলল
–না তো। কেন?

ইভান ল্যাপটপটা বন্ধ করলো। ঈশার একটু কাছাকাছি এসে মুখে পড়ে থাকা চূলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল
–তাহলে কয়েকদিন থেকে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করছ না কেন?

ঈশা অবাক চোখে তাকাল। বলল
–কে বলেছে তোমাকে?

ইভান হাসল। ঈশার গালে আলতো করে হাত রেখে বলল
–আমি তোমাকে না দেখেই সবকিছু বুঝে যাই আর দেখেও বুঝতে পারব না সেটা ভাবা বোকামি ঈশা পাখি। কয়েকদিন থেকেই তুমি ঠিক মতো খাচ্ছ না। আর শরীরটাও তেমন ভালো না। সব সময় টায়ার্ড থাকো। এখন বল কি সমস্যা তোমার?

এক অন্যরকম প্রশান্তি ছড়িয়ে গেলো সারা শরীর জুড়ে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ঈশার। ইভান বদলে যায়নি। তার ভালবাসা একই রকম আছে। এই ভালবাসাটা এতদিন ঈশা উপলব্ধি করতে পারেনি। কিন্তু আজ পারছে। ভালোভাবেই পারছে। মৃদু হেসে বলল
–কিছু হয়নি। কয়েকদিন এ বাড়ি আর ঐ বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করতে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। তাই একটু টায়ার্ড লাগে।

ইভান কঠিন গলায় বলল
–কয়েকদিন রেস্ট নেবে। কোন কাজ করবে না। আর ঠিক মতো খাবে। কেমন? আমি অফিসে থাকি বলে খেয়াল রাখতে পারি না। আর তুমি সেটারই সুযোগ নাও।

ঈশা মৃদু হাসল। ইভানের বুকে মাথা রাখল। ইভান আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল
–আমি সারাদিন কাজ করে যতই টায়ার্ড হয়ে যাই না কেন তোমার চেহারা দেখলেই আমার সব ক্লান্তি চলে যায়। কিন্তু তুমি যদি অসুস্থ থাকো তাহলে আমি এনার্জি কোথায় পাবো বল।

ঈশা মাথা তুলে বলল
–এতো ভাবতে হবে না। আমি নিজের খেয়াল রাখবো।

ঈশা উঠে গিয়ে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিলো। ইভান কৌতূহল বশত জিজ্ঞেস করলো
–বাসায় কি কেউ এসেছে?

ঈশা সহজ স্বাভাবিক ভাবে বলল
–ফুপু এসেছে।

ইভান ঈশার মুখের দিকে তাকাল। তার মুখভঙ্গি অতি স্বাভাবিক। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কারন কোন কিছুই ইভানের অজানা নয়। রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। অনেক কষ্টে ঈশাকে সে কাছে পেয়েছে। এবার আর কোন কষ্ট পেতে দেবে না সে। সকাল হলেই একটা ব্যাবস্থা করবে।

চলবে……

(রিচেক করা হয়নি। ভুল থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here