চলো রোদ্দুরে পর্ব-৩৩

0
1928

#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_33

মিসেস মেরিন খ্রিস্টীয় ধর্মের অনুসারী এবং সে অর্ধ বাঙালী। তাঁর বাবা বাংলাদেশী হলে ও তাঁর মা একজন বিদেশিনী। সেই কারনে ভদ্র মহিলার মুখের গড়নে বেশ ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। অদ্ভুত লাগে ভোর এর কাছে। মহিলার চঞ্চলতা ওকে হাজার বার বিমোহিত করেছে। প্লেনে বসে ও নানান কথা বার্তা চললো দুজনের মাঝে। একটা সংস্থার নামে গরিব দের থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেই বিষয়েই হাই কোর্ট এ মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে মিসেস মেরিন আশংকায় আছেন। তাঁর ধারনা কিছু অনৈতিক মানুষ প্রমান সরানোর ব্যবস্থা করতে পারে।

কক্সবাজার এসে মিসেস মেরিন বললেন
_ইনভেস্টিগেশন এর জন্য সেন্ট মার্টিন পাঠিয়েছিলাম চার জন কে।তবে এঁদের কার্যক্রম দেখে মনে হলো বিক্রি হয়ে গেছে ওরা।

_এর জন্য আপনি চিন্তিত ম্যাম?

_হ্যাঁ। আমি চাই না এতো গুলো মানুষের পেটে লাথি মারা হোক।

_ইয়েস ম্যাম আমি বুঝতে পেরেছি।

ছদ্দবেশ ধারন করে দুজনে সেন্ট মার্টিন এর রিসোর্টে প্রবেশ করলো। লক্ষ্য একটাই, দুষ্টের বিনাশ আর ন্যায় বিচার।

এক সপ্তাহের কাজ তিন দিনে হয়ে যাবে তা কেউ ই কল্পনা করে নি। ঢাকার মাটি তে পা ফেলে স্বস্তির নিশ্বাস নিলো ভোর। মিসেস মেরিন কে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলো হোস্টেলে।

রাতে তিন্নির সাথে ডিনার করলো। মেয়েটা বড় ভালো। ভোর নিজের সমস্ত খরচ এখন নিজেই চালায়। মেয়েটার এমন সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করে নি রাদ। বরং দেখে ভালোই লেগেছে মেয়েটা যে স্বনির্ভর কে গুরুত্ব দিচ্ছে।
_একটা কথা বলি ম্যাম?

_অনুমতি নেওয়ার কি দরকার আছে তিন্নি আপু?

সামান্য হাসলো তিন্নি। ভোর কে ছোট বোনের মতোই সমীহ করে ওহ। তিন্নির এমন নিরশ তাকানো দেখে ভোর বলল
_আপনি কি খুব চিন্তিত আপু?

_উহু তেমন নয়। তবে খুব দ্রুত গভীর ভাবনা তে পরে যাবো মনে হচ্ছে।

_নিশ্চিন্তে বলুন না।

_আপনার সাথে রাদ স্যার এর বৈবাহিক সম্পর্ক টা আমাকে ভাবাচ্ছে। সব টা আমি জানি তবু ও এর পরিনতি নিয়ে ভয়াবহ আতঙ্কে রয়েছি।

শীতল কন্ঠে উত্তর করলো ভোর
_সব কিছু সবার জন্য নয়। ডাক্তার সাহেব আমার কাছে অন্ধকার কাটানো রোদ্দুর স্বরূপ।

_সত্যিই কি আপনারা আলাদা হয়ে যাবেন?

_আমরা তো কখনো এক ছিলাম ই না।

তিন্নি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। কাল থেকে সাত দিনের ছুটি নিয়েছে মেয়েটা। তাই ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
_বয়সে আমার ছোট আপনি। বড় বোনের মতো একটা উপদেশ দিচ্ছি নিজের অনুভূতি কে গুরুত্ব দিবেন।
.

বিদ্যুৎ চমকানোর মতো বার বার চমকে যাচ্ছেন রামিসা। ডিবাইনে বসে মুখ টিপে হাসছে রাদ আর ইফতিহার। রামিসা বললেন
_এতো বড় ধোঁকা। মেয়ে সুন্দর , শুধু চামড়া সুন্দর হলেই মেয়ে সুন্দর হয়?

আইস ব্যাগ মাথায় দিয়ে ধপ করে বসলেন সোফাতে। ইফতিহার হো হো করে হেসে উঠলেন। রাদের দিকে অসহায় চোখে তাকালেন রামিসা। হাতের ইশারায় রামিসা কে শান্ত হতে বললো রাদ। খবরের কাগজ মেলে দিয়ে ইফতিহার বললেন
_সকাল সকাল খবর এলো দেশের সমস্ত সুন্দরী মেয়ের দাঁত বোকরা।

_তুমি আমাকে শোনাচ্ছো তাই না?

_উহুহ। তোমাকে কেন শুনাবো?

রামিসার চোখ থেকে যেন আগুনের ফুলকি ঝরছে। অবস্থা খারাপ দেখে রাদ বলল
_ রিলাক্স মম আমরা মেয়েই তো দেখেছি বিয়ে তো করে ফেলি নি?

_তবু ও এতো বড় কথা আগে কেন বললো না আমাদের? যেদিন দেখতে গেলাম সেদিন ও জানায় নি। কোনো মতে বিদেয় করেছে আমাদের। মেয়েটা তো কথা ও বলে নি। কে জানে বোবা নাকি।

_মম এটা ওনাদের মেন্টালিটির প্রবলেম। এসব ভেবে মন খারাপ করো না তো।

রামিসা বেশ দুঃখ পেয়েছেন। ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে দেখালো তবে মেয়েটার দাঁত সব পোকায় খেয়ে নিয়েছে সেটা বললো না?
চোখের পানি মুছে উপরে উঠে গেলেন তিনি। ইফতিহারের পাশে এসে বসলো রাদ। ইফতিহার বললেন
_তুমি আগে থেকেই জানতে সব টা?

_ইয়েস ড্যাড।

হাসতে হাসতে যা তা অবস্থা হলো। ইফতিহারের সাথে কিছু কথা বলে বেরিয়ে পরলো রাদ। রামিসার রাগ কখন যাবে কেউ বলতে পারে না। বোকরা মেয়ে ডাক্তারের বউ, এটা কি মানা যায়?
গার্ডেনে এসে ফিক করে হেসে উঠলো রাদ। দারোয়ান ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। রাদ সামান্য হাসার চেষ্টা করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলো।

নদীর পাড়ে এসে বসেছে রাদ আর ভোর। টলটলে পানি তে পা ভেজাতে দারুণ লাগছে। শিরশির রিনি ঝিনি বাতাসে কয়েক গাছি চুল উড়ে যাচ্ছে এলোমেলো হয়ে। মাথার উপর দিগন্ত আকাশের বুকে লেপ্টে আছে কতো গুলো মেঘ। এই সুন্দর পরিবেশের মাঝে খলবিলিয়ে হাসতে লাগলো এক তরুণী। ঝলকানো হাসি তে ঘোর লাগা দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইলো রাদ। হাসির এক পর্যায়ে রাদের হাত টা স্পর্শ করলো মেয়েটি। বলল
_ মেয়েটি যে বোকরা আপনি জানা সত্য ও আগে কেন বলেন নি?

_আমি বললে বিষয় টা অন্য রকম হতো। তাছাড়া আর্টিফিশিয়াল দাঁত লাগানো ও যেতো, তখন হয়তো মম ইমোশনাল হয়ে যেতো। হায় আফসোস করে বোকরা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিতো। বাট প্রতারিত হয়ে এখন রাগি মুডে আছে, এটাই ভালো হয়েছে।

_আপনি তো ভারী দুষ্টু।

_একটু আর কি।

হাসতে লাগলো ভোর আর রাদ। ভোরের হাত টা বার বার রাদ কে স্পর্শ করছে। মেয়েটার কোনো ধ্যান ই নেই। দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে রাদ বলল
_কেস টা জিতে গেছো শুনলাম।

_হুম অনেক ভালো লাগছে। পুরো ফ্রেস মাইন্ড এখন।

_পত্রিকায় তোমাদের ছবি বের হয়েছে। বেশ প্রশংসনীয় বিষয়।

_হয়তো। তবে সব টা মেরিন ম্যাম এর কারনে সম্ভব হয়েছে। আমি শুধুই তাঁকে সাহায্য করেছি।

কয়েক মুহূর্ত নীরবতা বিরাজ করলো। আড়চোখে ভোর কে দেখে চলেছে রাদ।বিধ্বস্ত চেহারা কেন মেয়েটার?
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা পরতেই মেয়েটার হাত ধরে টানতে লাগলো রাদ। তবে আশ্চর্য জনক ভাবে ঠায় বসে রইলো মেয়েটি। আকাশের দিকে এক পলক তাকিয়ে রাদ বলল
_কি হলো, আসো না কেন?

_না আসলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে কি ডাক্তার সাহেব?

থমকে গেল রাদ। মেয়েটার কথায় এতো ব্যথা কেন? বৃষ্টির পানির সাথে নোনা জলের ধারা একাকার হয়ে গেল। আজ বুক ফাঁটা আর্তনাদ করবে ভোর। অপেক্ষা শুধু মেঘ ডাকার। যেই না মেঘ ডাকলো চিৎকার করে উঠলো। প্রচন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রাদ। বৃষ্টির পানি গুলো যেন একে একে সমস্ত কাঁদা কে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। অন্ধকার ছাপিয়ে এনে দিচ্ছে ভালোবাসার রোদ্দুর। যে রোদ্দুরে রয়েছে প্রেম, প্রেম, আর প্রেম। এই প্রেমময় তৃষ্ণা রাদ কে ও স্পর্শ করেছে।
হয়তো এই প্রথম কিংবা প্রকাশ্যে প্রথম মেয়েটি কে ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরলো রাদ। মেয়েটির মাথায় পর পর চুমু খেয়ে বলল
_এই পাগলী এমন করো কেন? তুমি জানো কতো টা ভালোবাসি তোমায়?

_জানতে চাই না ডাক্তার সাহেব। আমি জানতে চাই না কিছু। আমাকে ছেঁড়ে যাবেন না আপনি। কোথাও যেতে দিবো না আমি। এই বৃষ্টি কে স্বাক্ষী রেখে আমি দাবী জানাচ্ছি। আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে হবে আপনাকে। আমি যেমনি হই না কেন আমাকে মেনে নিতে হবে। কোনো কিছুর বিনিময়ে আপনাকে ছাড়বো না আমি।

মেয়েটার কান্না জড়িত আকুলতা রাদের বুকে ঝড় তুলে দিয়েছে। বৃষ্টির পানি ছুঁইয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গে। উহহু সমস্ত আড়ালতা কে ধুঁয়ে মুছে সাফ করে দিচ্ছে। যাঁর ফাঁক ফোকর দিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে প্রেমময় রোদ্দুর। যাঁর বৈধ্যতা সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে গড়েছেন।

ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে থেকে ঠান্ডা লেগে গেল ভোরের। বার বার হাঁচি দিচ্ছে। বিজ্ঞ দের মতো রাদ বলল
_আজব ধাতু তে গড়া তুমি।

_আমি কি করেছি?

_অধিকার চাওয়ার জন্য বৃষ্টি কেই সঙ্গী মনে হলো?

লজ্জা পেলো ভোর। তবে সে লজ্জা কে ছাপিয়ে হাঁচি নেমে এলো। নাকের পাটা লাল হয়ে আছে মেয়েটার। যাঁর ফলে হেসে কুটি কুটি রাদ। মেয়েটার কপালে ভালোবাসার পরস দিয়ে বলল
_সৃষ্টিকর্তা বোধহয় সেদিন আমার কথা শুনেছিলেন। তাই আজ তুমি আমার। শুধু কাগজে কলমেই নয় মন থেকে তুমি আমার।

ছেলেটার কথা বুঝতে পারলো না ভোর। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। এক হাতে মেয়েটি কে জড়িয়ে ধরে বলল
_আজ আমরা ফিরছি না কোথাও।

_তাহলে কোথায় যাবো?

_পাশেই একটা কুটির আছে সেখানে থাকবো।

_কেন?

_আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো কোনো এক বৃষ্টি মাখা রাতে বউ কে জড়িয়ে ভাঙা কুটিরে ঘুমাবো।

_কি অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা!

হেসে কুটি কুটি হলো ভোর। রাদের মোহ মিশ্রিত চাহনি তে হালকা লজ্জা পেল। বার বার নিজেকে ঠিক ঠাক করছে ওহ। তা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসছে রাদ। মেয়েটির কানের কাছে মুখ নিয়ে আসতেই গরম নিশ্বাস এসে পরলো ওর ঘাড়ে।
যাঁর ফলে কেঁপে কেঁপে উঠলো ভোর। রাদ বলল
_আজ এক টা বহু পুরনো গল্প শোনাবো।

চমকায়িত কন্ঠে ভোর বলল
_গল্প?

_হুম গল্প।

মেয়েটার নেতিয়ে পরা চুল গুলো থেকে টপ টপ করে পানি পরছে। গাড়ির কাছে এসে রাদ তোয়ালে বের করলো। অবাক হলো না ভোর। কারন রাদ এর কাছে এমন উদ্ভট জিনিস থাকে যাহ ভাবনার অতীত। মেয়েটির ভেজা চুল গুলো নিজ হাতে মুছে দিলো রাদ। প্রতি টা মানুষের শরীরের একটা আলাদা গন্ধ থাকে। ভোর এর ওহ রয়েছে। রাদ বরাবর ই ভাবে মানুষ কতো পাগল হলে বউ এর গাঁয়ের গন্ধ শোকে। কিংবা লুকিয়ে থাকতে পারে কাবাডের ভেতরে। নিজ ভাবনায় হেসে উঠলো রাদ। ভোর বলল
_কি হলো?

_উহুহ কিছু না।

এতোক্ষন অবাক না হলে ও এবার অবাক হলো ভোর। কারন রাদ একটা শপিং ব্যাগ থেকে শাড়ি বের করে দিলো ওর হাতে। সামান্য হাসতেই ভোর বলল
_এটা কি করে?

_দুটো কপি মিসেস।

_বুঝি নি আমি।

_তোমার জন্মদিনে এই শাড়ি টা দিয়েছিলাম মনে আছে?

_হুম, কিন্তু এখানে কি করে এলো এটা? আমি তো কাবাডে তুলে রেখেছিলাম।

_একি রকমের দুটো শাড়ি ডিজাইন করিয়েছিলাম আমি। একটা কপি জন্মদিনের উপহার স্বরূপ দিয়েছিলাম। শুভ্র সাদা রঙের মিহি শাড়ি।

_আমি কিছুই বুঝলাম না ডাক্তার সাহেব।

_এতো শত বুঝতে হবে না এখন এটা পরে আসো।

ভ্রু জোড়া বেঁকে গেল মেয়েটির। রাদ বলল
_গাড়ি তে বসেই চেঞ্জ করতে হবে। এখানে আর কোনো প্লেস নেই।

মাথা ঝাঁকিয়ে গাড়ি থেকে চেঞ্জ করে আসলো ভোর। রাদ এক পলক দেখে নিয়ে নিজ হাতে কাজল পরিয়ে দিলো ওকে। অবাকের উপর অবাক হচ্ছে ভোর। এ যেন অন্য রকম একজন। ছেলেটার ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসি। এতো শতো আয়োজনের কারন কি তবে?

** গল্প যদি একান্তই ভালো না ই লাগে প্লিজ ইগনোর করবেন। একজন লেখিকা গল্পের প্লট আগেই খুব যত্ন নিয়ে ভেবে রাখে। সাজিয়ে দেখানোর জন্য কিছু টা সময়ের দরকার হয়। এই বিষয় গুলো আরো কয়েক পর্বের পর দিতে চেয়েছিলাম আমি। তবে আপনারা আমাকে আশাহত করেছেন। অধৈর্য হয়ে পরেছেন রাদ, ভোরের প্রেমের জন্য। রাদ ই যে নায়ক তা আমি বলেছি কখনো? গল্পের অনেক কিছু এখনো উল্লেখ করা হয় নি। অতি দ্রুত গল্প শেষ করে দিবো। আশা করি ভালোই হবে আপনাদের জন্য। দ্রুত গল্প শেষ। **

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here