#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_36
গাড়ির শব্দ শুনে গেট খুলে দেন দারোয়ান। ছাঁদে ছিলেন রামিসা।ছেলের গাড়ি দেখে ছুটে আসেন। ড্রয়িং রুম পার করার সময় ইফতিহার বললেন
_এভাবে ছুটছো কেন?
_রাদ এসেছে।
_ওহ তাই নাকি। ছেলেটা যে কি করে। ফোন টা সুইচ অফ রাখার কি প্রয়োজন ছিলো?
_সেটাই।
ওনাদের কথার মাঝেই চলে আসে রাদ। রামিসার কর্কশ কন্ঠ
_তুমি অসভ্য হয়ে গেছে রাদ। সাথে প্রচন্ড দায়িত্বজ্ঞান হীন।ফোন সুইচ অফ কেন?
_চার্জ ছিলো না।
_অন্য কারো ফোন থেকে কল করতে পারতে। তাছাড়া রাতে ফিরবে না বলা উচিত ছিলো। চিন্তা হয় না আমাদের?
কোনো উত্তর করছে না রাদ। রামিসা একের পর এক অভিযোগ করে যাচ্ছেন। কোনো টাই ভিত্তিহীন নয়।এই অল্প সময়ে অনেক গুলো কথা বললেন তিনি। এতো সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ইফতিহার কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলেন। ভদ্র লোকের জহুরির চোখ। ছেলের মনের ভেতর যে উথাল পাথাল ঢেউ নেমে যাচ্ছে তা খুব ভালোই বুঝতে পেরেছেন। রামিসা কে থামতে বললেন। ছেলের বাহু তে স্পর্শ করে শুধালেন
_কখনো আপসেট হবে না রাদ। বলো কি বলবে। এতো ভয় পাচ্ছো কেন?
বিস্ফোরিত চোখে তাকালো রাদ। প্রতি বার ই ইফতিহারের আচারন ওকে মুগ্ধ করে। রামিসা এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত এগিয়ে দিলেন। শরবত হাতে নিলে ও পান করলো না ছেলেটা। বরং গ্লাস টা ধরে রেখে কিছু ভাবতে লাগলো।
_তুমি কি এখন বলতে চাচ্ছো না রাদ?
_আসলে ড্যাড
_ভয় পাচ্ছো কেন?
নিভে গেল রাদ। সত্যিই তো এতো ভয় হচ্ছে কেন ওর? টেবিলে গ্লাস রেখে মাথা নিচু করে বলল রাদ
_আমি যদি এমন কিছু কথা বলি যা রাগ করার মতো।
_এমন কোনো কথা থাকতে পারে না বেটা।
_আছে মম।
_আচ্ছা বলো যা হবে দেখা যাবে।
_সেটাই। তুমি মন কে দৃঢ় রাখো বেটা।
_হুম।
শুকনো ঠোঁট টা ভিজিয়ে নিলো রাদ। হালকা স্বর টা উঁচু করে বলল
_ভেতরে আসো।
রামিসা , ইফতিহারে প্রবৃত্তি দৃষ্টি মেইন ডোরে তাকিয়ে আছে। মাথা নিচু করে ঘরে প্রবেশ করে ভোর। তবে দরজার কাছে এসে থেমে যায়। মেইন ডোরের চৌকাঠ পেরোয় না। রাদ কে আগেই বলেছে মেইন ডোর এর চৌকাঠ তখনি প্রবেশ করবে যখন বউ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে নয়তো না। মেয়েটার অদ্ভুত চিন্তা ধারায় পাত্তা দেয় নি রাদ। তবে এখন বুঝতে পারছে নিজের কথায় দৃঢ় ভোর।
_কে মেয়েটা?
_বউ।
_ একটু বুঝিয়ে বলো রাদ।
রামিসা আর ইফতিহার একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলেন। একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে রাদ বলল
_ওর নাম ভোর। আমার বিয়ে করা বউ।
হো হো করে হেসে উঠলেন রামিসা। রাদ এর দৃষ্টি নত। ভোর উসখুস করছে। ভোর কে এক পলক দেখে বললেন
_ওকে বিয়ে করতে চাও তাই তো? এতে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে বেটা?
_আসলে মম
_থামো তুমি। আগে দেখে আসি ওকে।
_দাঁড়াও রামিসা।
ইফতিহারের কন্ঠে থেমে গেলেন তিনি। রাদ এর কাছে এসে স্পষ্ট ভাষায় তিনি বললেন
_তুমি কি আরো কি বলবে রাদ?
প্রগাঢ় দৃষ্টি তে তাকালো রাদ। ইফতিহার যেন মনে মনে অনেক কিছুই ভেবে নিলেন। যাঁর কারনে কপালে চিন্তার ভাঁজ। রামিসা ও তাকিয়ে আছেন। ভোরের চোখ দুটো ছল ছল। কখন যেন টপ টপ পানি ঝরে যায়। ভোরের দিকে তাকালো রাদ। মেয়েটার এমন অবস্থা দেখে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে ওর। তাই চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে নিচু কন্ঠে বলল
_আমি ওকে বিয়ে করেছি। আর সেটা ও প্রায় ছয় বছর আগে।
কথা টা যেন ঝমঝমে শব্দ তুলে দিলো। রামিসা বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন। এমন টা কোনো বাবা মা আশা করেন না বোধহয়। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেন ইফতিহার। রামিসা কে বললেন
_এতো হাইপার হচ্ছো কেন? আগে পুরো বিষয় টা বলতে দাও। আমি জানি আমার ছেলে কোনো ভুল করতে পারে না।
বাবার মুখ থেকে এমন সাপোর্টেট কথা পেয়ে ধরে প্রান এলো রাদের। ধীর কন্ঠে বলা শুরু করলো সব টা। রামিসা আবেগ ধরে রাখতে পারেন না। তাই কেঁদে উঠলেন। ভেতর থেকে শান্তি পাচ্ছেন না। রাদ এর আচারনে প্রথমে দুজনেই কষ্ট পেলেন। আর যাই হোক বিয়ের পরেই তো জানাতে পারতো রাদ। রামিসা কে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু এঁকে বলল
_মম, মম প্লিজ ডোন্ট ক্রাই। আমার পুরো কথা টা শোনো। তখন আমি বা ভোর কেউ ই সম্পর্ক টা কে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিস্থিতি তে ছিলাম না। আর আমি মাত্র কেরিয়ার ধরার পথে, আর ভোর বাচ্চা একটি মেয়ে। এতো ঝড় ঝাপটায় কি করে ভাববো সংসার জীবনের কথা?
_তাই বলে আমাদের জানাবে না?
_স্যরি মম। পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে। তোমরা চাইলে আমি কান ধরে উঠ বস করবো।
কান্নার মাঝে হেসে উঠলেন রামিসা। ভোর দেখতে কেমন বা ওর পারিবারিক অবস্থা এসবের কিছুই ম্যাটার করে না ওনাদের কাছে। তাছাড়া ভালোবাসার মর্মার্থ বুঝেন ওনারা। ইফতিহার নড়ে চড়ে উঠলেন। ভোর এর মাথা নত। মুখ টা দেখা যাচ্ছে না ঠিক ঠাক। রামিসা কে ইশারা করে বললেন ভোরের কাছে যেতে। আঁচলে চোখ বুঝে রামিসা বললেন
_খালি হাতে ছেলের বউ কে বরন করবো নাকি? আমি মিষ্টি নিয়ে আসি।
কিচেনে গেলেন তিনি।রাদ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে চলেছে এমন বাবা মা দেওয়ার জন্য। অনেক টা দূরে দাঁড়িয়ে থাকায় সব কথা শুনতে পাচ্ছে না ভোর। তবে কিছু শব্দ কানে এসেছে। এর মধ্যে ভালো খারাপ দুটোই ছিলো। তাই আশংকা গ্রস্ত। এ দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস নেই।
রামিসা মিষ্টি নিয়ে এলেন। রাদ গোমড়া মুখ করে বলল
_বউ পেয়ে ছেলে কে ভুলে যেও না আবার।
ছেলেটার বাহু তে হালকা করে থাপ্পড় মারলেন রামিসা। বললেন
_বউ কেন হতে যাবে হু? এটা আমার মেয়ে।
কৃতার্থ হলো রাদ। চোখ দুটো ঝাপসা বর্ণ ধারন করেছে। সর্বশেষ শান্তি লাগছে এটা ভেবে যে ভোর কে একটা সুন্দর পরিবার দিতে পারবে।
ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে সবাই। তখনি তীব্র হাসাহাসির শব্দ কানে এলো। এতো জোড়ে হাসির শব্দ পেয়ে ভোর ওহ পেছন ঘুরে তাকালো। রনিত, সুপ্তি আর নাহিদ হাসতে হাসতে করিডোর দিয়ে আসছে।
ছুটে এলো রাদ। ভোর যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। ওদের কে এক পলক দেখে রাদ বলল
_মম ড্যাড তোমাকে মেনে নিয়েছে ভোর।
এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল ভোর। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। আঙুলের সাহায্যে পানি মুছে রাদ বলল
_ডোন্ট ক্রাই মিসেস। রোদ্দুরে শুধু হাসি হবে কোনো চোখের পানি নয়।
ভোর ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ছুটে গেল রাদ। সবাই কে দেখে প্রসন্ন হাসলো। কিছু খুনসুটি চললো সকলের মাঝে। ভোরের সাথে কথা বলছেন ইফতিহার আর রামিসা। মেয়েটা এতো ভালোবাসা পেয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারছে না। বার বার চোখ ভিজে যাচ্ছে।
সুপ্তির বাজ খাই গলা এতো বড় বাসার এই প্রান্ত থেকে সেই প্রান্ত অব্দি শোনা যায়। রামিসা হাসলেন। ভোর কে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। করিডোর দিয়ে ফাজলামি করতে করতে ড্রয়িং রুমে আসলো সবাই। স্বস্তির শ্বাস ফেলে রাদ বলল
_আজ আমি একটা সারপ্রাইজ রাখবো।
_শুধু তুই না আজ আমরা ও একটা সারপ্রাইজ রাখবো।
গর্ব করে বললো সুপ্তি। মেয়েটার বাচ্চামো দেখে হাসলো নাহিদ। কে বলবে উনত্রিশ বছরে পদার্পণ করেছে মেয়েটি। সকলের চিল্লা পাল্লায় ক্লান্ত রনিত। কাউচে গাঁ এলিয়ে বলল
_তোরা সারপ্রাইজ ঢালতে থাক আমি আমার বউ বাচ্চার সাথে গল্প করি।
ফোন নিয়ে বিজি হলো রনিত। প্রচন্ড জোড়ে হাসাহাসি করছে সুপ্তি। নাহিদ আর রাদ ও যেন বাঁধন খোলা হাসি তে মিশে গেছে। সকলের রিফ্রেসিং এর জন্য মিন্ট ড্রিঙ্কস দিতে বললো রাদ। ড্রিঙ্কস হাতে আড্ডা চললো। সুপ্তি বলল
_আগে আমরা সারপ্রাইজ দিবো।
_নো আগে আমি দিবো।
_না আমরা দিবো আগে।
_কান পঁচাবি না সুপ্তি। আমি আগে সারপ্রাইজ দিবো।
_দেখ রাদ আগে আমরা
_থাক না সুপ্তি। আগে বরং রাদ ই আমাদের সারপ্রাইজ দিক।
_ভালো হলো না নাহিদ।
মুখ গোমড়া করে ফেললো সুপ্তি। নাহিদ মৃদু হাসলো। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার গালে চুমু খেলো। এঁদের কান্ড দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলল রাদ
_ওরে এই চলছে এখন?
চোখ মারলো সুপ্তি। নাহিদের কাঁধে মাথা রেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। কাউচ থেকে এক পলক তাকালো রনিত। বলল
_ সারপ্রাইজ দিবি দিবি করে সারপ্রাইজ মাটি করে দিছ না আবার। দ্রুত দে তোর সারপ্রাইজ।
_ওয়েট গাইস। তোমরা একটু ওয়েট করো।
রাদ চলে গেল। সুপ্তি আর নাহিদের খুনসুটি চলছে। আর রনিত ফোনে ব্যস্ত।বউ বাচ্চার সঙ্গে কথা বলছে।
ভোর কে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছেন রামিসা। কপালে চুমু খেয়ে বললেন
_মাশআল্লাহ বলতেই হয় আমার ছেলের পছন্দ আছে।
সামান্য লজ্জা পায় ভোর। কাবাড থেকে গহনা বের করতে করতে রামিসা বলেন
_আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তবে আমার ছেলে টা আস্ত রাম ছাগল। একটা মেয়ে কে পছন্দ হয়েছে অথচ বুঝতেই পারে নি। সেদিন যদি বিয়ে টা হয়ে যেতো। আচ্ছা ভোর, তুমি তো পারতে ভালোবাসার কথা জানাতে।
_ আসলে আমি তখন ওনার মতি গতি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। ওনি আমাকে এতো টা সাহায্য করেছেন কি করে বলবো ভালোবাসি। তাছাড়া ওনি যদি নাকোচ করতেন।
_পাগল মেয়ে। ভালোবাসার কথা কখনো চেপে রাখতে নেই। না হলে হারিয়ে যায়। তাই যতো দ্রুত বলা যায় ততোই মঙ্গল।
_মম, মম ভোর কে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে দাও তো। ওদের সাথে দেখা করাবো।
বলতে বলতে ঘরে প্রবেশ করে ফেলে রাদ। রামিসা বললেন
_জানতাম, সেই কারনে আগেই রেডি করে নিয়েছি। শাড়ি টা সুন্দর না? দেখ বেশ মানিয়েছে ওকে।
হা হয়ে তাকিয়ে আছে রাদ। বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে ভোর। সেই হলুদের কথা মনে পরে যায় ছেলেটার। মেয়েটা কে নিস্তেজ অবস্থায় দেখে ওর আত্মা কেঁপে উঠেছিলো। তাঁর ই সাথে অনুভব হয়েছিলো যন্ত্রণা। ছেলে কে হা হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুম থেকে বেরিয়ে যান রামিসা।এই সময় গুলো তিনি ও পার করেছেন। তাই একটু ভঙ্গিমা তেই বুঝতে পারেন সব।
রাদ এগিয়ে যায়।ভোরের লজ্জা লাগছে। ভীষন লজ্জা হচ্ছে।যেন সমস্ত লাজুকতা ওকে জড়িয়ে নিয়েছে। হাত বাড়িয়ে দেয় রাদ। চোখে তৃপ্তির হাসি। ভোর আমতা আমতা করে বলে
_কোথায় যাবো?
_মনের ভেতরে আসো মেয়ে। দেখে যাও বিক্ষিপ্ত মন। আমার অন্ধকার মন টাকে রোদ্দুরে ডুবিয়ে দাও।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ভোর। রাদ কিছু টা কাছে এসে উষ্ণ অধরে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। সামান্য কেঁপে উঠে মেয়েটি। রাদের বাহু তে খামচে ধরে। বিষয় টা উপভোগ করলো রাদ। ফিস ফিস করে বলল
_বুকে নেমেছে প্রেমের রোদ্দুর। এতো প্রেম রাখি কোথায় বলো তো?
সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে সারপ্রাইজ হয়ে গেল রাদ। এতো ক্ষন ধরে অপেক্ষা করতে করতে এবার উঠে দাঁড়ায় সুপ্তি। মেয়েটা অত্যাধিক চঞ্চল। নাহিদ হাত টা খপ করে ধরে নিলো। পেছন ফিরে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে লাগলো সুপ্তি। ঠিক তখনি একটি কন্ঠ ভেসে আসলো।
‘গাইস রেডি ফর সারপ্রাইজ। লুক হার, সী ইজ মাই ওয়ান এন্ড অনলি ওয়াইফ।’
অবাক চোখে তাকালো সবাই। ভোর লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। হাসছে, রাদ। সুপ্তি এগিয়ে গেল। নাহিদের চোখ টা হঠাৎ করেই ঝাপসা হয়ে গেল। বুকের ভেতর অনুভব হলো নিদারুণ যন্ত্রণা। পুরো শরীর কাঁপছে।যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে একটি বিচ্ছেদ।
** গঠনমূলক মন্তব্য করুন। গল্প শেষের পথে। পরবর্তী গল্প #অভিমানী_সে। আশা রাখছি সবাই অনেক টাই সাপোর্ট করবেন। **
বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।
চলবে