#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৮
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)
বাসায় ফিরে মামীর সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয় অয়নন্দিতা। যাওয়ার দিন থেকে শুরু করে আসার দিন পর্যন্ত সব গল্প করে সে। মামীও আনন্দ নিয়ে তার সব কথা শোনে। অয়নন্দিতার চোখ জোড়া দেখলে যে কারো মায়া লাগবে। আয়শা বেগম চাইলেও মেয়েটার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারেন না। তার বিবেক তাকে বাধা দেয়। নইলে আয়শা বেগমকে তার বাপের বাড়ি থেকে অনেক নানান তান বোঝানো হয়েছিল তিনি কারো কথা শোনেননি। তিনি জানেন এবং দেখছেন, অয়নন্দিতা দ্বারা তার সংসারে কখনও ক্ষতি হয়নি। তাহলে যার দ্বারা কোনো ক্ষতির সম্ভাবনাই নেই সেখানে তার সঙ্গে খারাপ আচরণ কেন করবেন তিনি। মেয়েটা এতিম বলেই তার মামা তাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। মেয়েটাও নিজের মায়ের শোক ভুলতে মামীর কাছে এসেছে। সবদিক চিন্তা করেই এই দুইবছরে কখনও তিনি অয়নন্দিতার সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলেননি।
গল্প করার ফাঁকে অয়নন্দিতা খেয়াল করে তার মামী তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। মায়া মাখানো হালকা হেসে অয়নন্দিতা প্রশ্ন করে,
‘মামী, এইভাবে তাকিয়ে আছো যে?”
অয়নন্দিতার কথায় চোখের পলক ফেলেন আয়শা বেগম।
‘তোকে দেখছিলাম।”
“আমার দেখার কী আছে?”
দুইদিন পর দেখছি তো। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর দেখলাম।”
“কী যে বলো তুমি মামী। মামী জানো, ওইখানে রাতের বেলায় ঘুমোতে পারতাম না।”
“কেন রে?”
“সমুদ্রের গর্জনের শব্দে।”
“তাই বুঝি!”
”হ্যাঁ। জানো মামী, সমুদ্র দেখতে খুব সুন্দর। আর ঢেউগুলো, ঢেউগুলো আরও সুন্দর মামী।”
“তাই?”
“হ্যাঁ মামী।”
“মেডিসিনগুলো ঠিকঠাক মতো খেয়েছিলি?”
“হ্যাঁ। শাম্মি ছিল না সাথে, সে থাকলে আমার সব কিছুই সে দেখে রাখে।”
আয়শা বেগমের মনটা খচ-খচ করছে। অয়নন্দিতার অগোচরে তারা সবাই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কে জানে অয়নন্দিতা শোনার পর কী বলবে। অয়নন্দিতাকে জানানোর দায়িত্ব খাইরুল সাহেব আয়শা বেগমকে দিয়েছেন। আমতা-আমতা করে আয়শা বেগম অঅয়নন্দিতার মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘অয়নি, একটা কথা বলি তোকে?’
‘হ্যাঁ বলো।’
‘রাগ করতে পারবি না কিন্তু।’
‘তোমার কোনো কথায় কখনও রাগ করেছি আমি?’
‘নাহ। তা তো করিস না৷ তবে এবার করলেও করতে পারিস।’
‘কী হয়েছে গো মামী? সিরিয়াস কিছু?’
আয়শা বেগম বার কয়েক ঢোক গিয়ে সাহস সঞ্চয় করে বললেন,
‘অয়নি, তোর জন্য একটা প্রস্তাব এসেছে। তোর মামার শরীরটা তো দেখছিসই মা। ততটা ভালো না। তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা শুধু একটা ভালো মেয়ে চায়। তোর হাসান ভাইয়াও খোঁজ খবর নিয়েছে। ভালো পয়সাওয়ালা। মারে তুই আমাদের দায়িত্ব। তোর চাচা কিংবা ফুপুরাও তোকে দেখতে পারে না। আমরা কয়দিনই বা বাঁচবো। আর হাসানের বউকে তো চিনিসই। ওই শয়তান আজকেও দেখতে পারে না আমরা মরার পরে তো আরও দেখতে পারবে না তোকে। তাই ভাবছিলাম, আমরা থাকতে-থাকতে তোর একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারলে আমরা মরেও শান্তি পাব রে না।’
বিয়ের কথা শুনে মনটাই খারাপ হয়ে গেল অয়নন্দিতার। তার স্বপ্ন সে পড়াশোনা করবে। বড়ো চাকরি করবে। কিন্তু,,, আয়শা বেগম আবারও বললেন,
‘তোর যদি ছেলে পছন্দ না হয় আমরা এখানে এগুবো না মা। সবটাই তোর উপর নির্ভর করবে।’
অয়নন্দিতা এবারও চুপ। মাথাটা নিচু করে বসে আছে মামীর সামনে। আয়শা বেগম অয়নন্দিতার মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন আর সাথে বললেন,
‘ভাবিস না তুই এতিম বলে আমরা তোকে রাখতে পারছি না। এমন হলে এই দুই বছরও রাখতাম না। মামী কেমন এটা তুই ভালো করেই জানিস। তাই বলছি অমত করিস না মা।’
মামীর বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবল অয়নন্দিতা। ঠিকই তো। আজ যদি মামা-মামী না থাকত তাহলে তার কী হতো। কোথায় যেত সে। মামা-মামী যা করবে নিশ্চয়ই তার ভালোর জন্যই করবে। আর তাছাড়া আজীবন তো এখানে থাকা যাবে না। একদিন না একদিন বিয়ে তো তাকে করতেই হবে৷ এইসব ভেবেই হ্যাঁ বলে দেয় অয়নন্দিতা।
একদিন পর।
সন্ধ্যায় সব আয়োজন করা হয়। অয়নন্দিতাকে আজ দেখতে আসবে। ভাগ্যিস হাসানের বউটা তার বাপের বাড়ি গেছে। অবশ্য আয়শা বেগম সেই অনুযায়ী তাদের আসতে বলেন। তার ভাষ্যমতে হাসানের বউটা হারে হারামজাদা। এত শয়তানি তার মনের মধ্যে। যদি এখানে উপস্থিত থাকত তাহলে একটা না একটা আবল-তাবল বলতই। আয়শা বেগম হাসানকেও না করে দিয়েছে যেন, সে বউ নিয়ে না আসে।
অয়নন্দিতাকে পরিপাটি হয়ে থাকতে বলা হয়েছে। অয়নন্দিতাও মামীর কথানুযায়ী নিজেকে পরিপাটি করে রেখেছে। শাম্মিকে জানানো হলো না। সে চেয়েছিল জানাতে কিন্তু মামী বারণ করেন। তিনি বলেন, আগে সব ঠিক হোক। এরপর জানাবি৷ আগে জানালে বদ নজর পড়ে। পরে শুভ কাজ হয় না। সাত/পাঁচ বুঝিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দেন আয়শা বেগম।
সাড়ে সাতটা নাগাদ তিন থেকে চারজন মানুষ খাইরুল সাহেবের বাসায় উপস্থিত হোন। নতুন মেহমানদের নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী আপ্যায়ন করেন খাইরুল সাহেব এবং আয়শা বেগম। কথাবার্তার এক পর্যায়ে রমজান শেখ বলেন,
‘মেয়েকে তাহলে নিয়ে আসুন। আমরা একটু দেখি।’
তার কথায় সুর মিলিয়ে রওশন বেগমও বলেন,
‘হ্যাঁ। এবার মেয়েকে নিয়ে আসুন।’
মেয়ে দেখার পর্ব চুকিয়ে তারা চলে যান। যাওয়ার আগে জানিয়ে দিয়ে যান যে, মেয়ে ভীষণ পছন্দ হয়েছে তাদের। এবার যেন এইপক্ষ থেকে ছেলেকে দেখতে যাওয়া হয়। খাইরুল সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। তিনি এবং তার অন্য দুই ভাই যাবেন। ছেলেকে দেখে আসবেন। এরপর সেখানেই দিনক্ষণ পাকা করে আসবেন।
এদিকে ফারহানের কানে এই খবর যাওয়া মাত্রই সে রেগেমেগে অস্থির হয়ে গেছে। সে চায়নি তার বিয়ে হোক। সে চায়নি বন্দনার জায়গা অন্য কেউ নিক। তাকে না জানিয়ে কেন মেয়ে দেখা হয়েছে। আবার মেয়ের পরিবারকেও দাওয়াত করা হয়েছে। কেন এত কিছু করেছে তারা। জিদের বসে কিছু জিনিসপত্র ভেঙে ফেলে ফারহান। রওশন বেগমও এক পর্যায়ে রাগান্বিত হয়ে যান। তিনি বলেন,
‘এই ফারহানের বাবা, উনাদের ফোন করো। এক্ষুনি ফোন করো। বলে দাও উনাদের আসতে হবে না। ছেলে চায় আমরা মরে যাই। আমরা দু’জন মরে গেলে তাহলেই ছেলের শান্তি হবে৷’
স্ত্রীর কথা শুনে রমজান শেখও রেগে যান। রেগে গিয়ে বলেন,
‘আগেই বলেছিলাম, ছেলেকে জিজ্ঞেস করে যাও। ছেলে এখন আমাদের চাইতেও বড়ো হয়ে গেছে। আমাদের পাত্তা দেওয়ার মতো সময় আছে নাকি ছেলের। এখন আমাদের মান-সম্মান চলে যাক। বাইরের মানুষের কথা শুনুক এই রমজান শেখ। ছেলের কী তাতে? বহুত সময় দিলাম তো ছেলেকে, কোনো লাভ হয়েছে? ছেলে তার কথাতেই আটকে আছে। আমাদের কোনো মূল্য আছে ওর কাছে?’
আজ বাবা এবং মা দু’জনকে একত্রে রেগে যেতে নিজের রাগটা বশে আনে ফারহান। একপাশে ফারাশ আর সাজি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এবার ফারহান বলে,
‘আমি একবারই বলেছিলাম যে, আমি বিয়ে করব না?’
রমজান শেখ বলেন,
‘হ্যাঁ। তা করবা কেন? অনেক বেশি সুখ দিয়ে ফেলছ না নিজের বাবা মা’কে। এত সুখ কি আমাদের কপালে সয় নাকি? তাই তো সুখে থাকলে ভূতে কিলায় আমাদের দু’জনকে। আর তোমাকে বলে দিচ্ছি রওশন, ফের যদি ছেলের বিয়ে নিয়ে তুমি আমায় বিরক্ত করেছ তো তোমার একদিন কি আমার একদিন। কথাটা মনে রাখবে।’
রমজান শেখ নিজের ঘরে চলে যান। রওশন বেগমও চোখের পানি মুছতে-মুছতে উপরে চলে যান। সাজি আর ফারাশ একে অপরের দিকে তাকায়। সাজি বলে ওঠে,
‘মায়েরও আর তর সয় না। ওইখানেই উনাদের বলে এসেছে যে মেয়ে পছন্দ হয়েছে। এবার আপনারা আসেন। একবারও ভাবল না যে, বাসায় এসে ছেলেকে বোঝাতে হবে। এখন যদি না করে দেয় বেচারাদের মনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এমনিতেই মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ তারা।’
এবার ফারাশও বলে,
‘হ্যাঁ। দেখে তো মনে হয়েছে একেবারেই নিরীহ মানুষ।’
‘সেটাই তো বলছি ছোটো ভাইয়া। একবার আসতে বলে আবার না করে দিলে কতটা কষ্ট পাবে ভাবো তো।’
‘মেয়েটাও কষ্ট পাবে। মেয়েটাকে দেখতে খুব মায়াবী। বাদ দে, আমাদের কী আর? বাবা মা’কে ছোটো হতে হবে সবার কাছে৷ এই বয়সে এসে কথা শুনতে হবে। তাও ভাইয়ার জন্য। চল উপরে চল।’
কথাগুলো বলে সাজি আর ফারাশ নিজেদের মতো চলে যায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে তারা দু’জন একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসে। মূলত তাদের উদ্দেশ্য ছিল কথাগুলো ফারহানের কানে দেওয়া। আর তারা সেটা পেরেছে।
ফারহান সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ফারাশ আর সাজির কথাগুলো নিয়ে ভাবছে সে। না করে দিলে কি সত্যিই তারা কষ্ট পাবে? আর ওই মেয়েটা, সেও কি কষ্ট পাবে।
পরদিন বিকেলবেলা।
ফারাশ আর সাজি দু’জন ছাদে বসে চা খাচ্ছে। ভাইবোন হলেও তারা বন্ধুর মতো মেশে। প্রতিদিন না হলেও দুইদিন পর-পর তারা দুই ভাইবোন ছাদে চায়ের কাপ নিয়ে বসে পড়ে। আজও বসে-বসে গল্প করছে দু’জন।
ফারহান হুট করেই ছাদে আসে। ফারাশ আর সাজির নজর ভাইয়ের দিকে যেতেই সাজি বলে ওঠে,
‘ভাইয়া, আসো। চা খাবে?’
ফারহান তখন তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে ফারাশ বলে,
‘কিছু বলবা?’
ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে মুখ খোলে ফারহান।
‘বাবা আর মা’কে বলে দিস, তারা যেন উনাদের বারণ না করে। আসতে যখন বলেছে আসুক।’
ফারাশ আর সাজি আবারও একে অপরের দিকে তাকায়। মুচকি হেসে বলে,
‘তার মানে, তুমি রাজি?’
‘এখানে রাজির কথা কেন আসে? উনাদের আসতে বলা হয়েছে উনারা আসবে।’
‘উনারা তো আর এমনি-এমনি আসবে না। তোমাকে দেখতে আসবে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে আসবে।’
‘আসুক তবে।’
‘যাকে আমরা দেখতে গিয়েছিলাম সে কিন্তু মাশা-আল্লাহ অনেক সুন্দর। একবার ছবি দেখবে নাকি?’
‘এত কথা বলিস কেন? যা বললাম সেটা গিয়ে বাবাকে বলে দে।’
ফারহান সেখান থেকে বের হয়ে গেলে ফারাশ আর সাজি শব্দ করে হেসে দেয়৷ তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। এখন ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হলে হয়।
চলবে………………………….