দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব-১৮

0
1708

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১৮
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

ফারহান যেই ভয়টা সারাদিন যাবত পেয়েছে সেটাই হয়েছে। অয়নন্দিতা রুমে নেই। এদিকে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ম্যানেজার বলল অয়নন্দিতা রিসোর্টের বাইরে গেছে। ফারহান এটাই বুঝতে পারছে না যে, সে ম্যানেজারকে মানা করা সত্ত্বেও ম্যানেজার কী করে অয়নন্দিতাকে বের হতে দিয়েছে। এ নিয়ে কিছুক্ষণ ম্যানেজারকে ঝেড়েছে ফারহান। রিসোর্ট মালিক ফারহানের বাবার বন্ধু। খুব কাছের বন্ধু। সে হিসেবে ফারহান পূর্ণ অধিকার রাখে ম্যানেজারকে দুটো কথা শোনানোর।
অয়নন্দিতা নাকি একাই বের হয়েছে। আর ম্যানেজার না করার পরেও হাঁটতে বের হয়েছে। সঙ্গে একজনকে নিতে বলার পরেও সে না করেছে। এমনটাই ম্যানেজারের বক্তব্য। ফারহানের মাথা কাজ করছে না। এই অচেনা জায়গায় অয়নন্দিতা যাবে কোথায়। চারপাশে পাহাড়। আবারও যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়। নিজেকে সামাল দেবে কী করে ফারহান সেটাই ভাবছে সে।
কয়েকবার ফোন করার পর বুঝতে পারে অয়নন্দিতা তার ফোনটা রুমেই চার্জ দিয়ে গেছে। প্রচন্ড রাগে মাথা খারাপ হয়ে গেছে ফারহানের। বার বার বলেছিল সে, একা বের হয়োও না। তবুও মেয়েটা বের হয়েছে। এমন সময়ই ফোনটা বেজে ওঠে ফারহানের। অত্যন্ত উৎসুক দৃষ্টিতে ফোন হাতে নেয় সে। ভেবেছে, অয়নন্দিতা পথ ভুলে গিয়ে হয়তো কারো ফোন থেকে ফোন করেছে। কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে দেখে তার ধারণা ভুল। ফোন এসেছে ঢাকা থেকে। অয়নন্দিতার ভাই হাসান ফোন দিয়েছে। ফারহান মনে মনে একশো একবার নিজের ভাগ্যকে গালমন্দ করছে। এতদিন ফোন আসেনি। অথচ আজ এখানে এসে অয়নন্দিতা নিখোঁজ আর এখনই তার ভাইয়ের ফোন আসতে হলো। কিন্তু তাকে কেন ফোন করল। ফারহান দ্রুতই অয়নন্দিতার ফোনটা হাতে নেয়। ফোনে প্রায় দশটা মিসডকল। ছয়টা হাসানের ফোন থেকে আর চারটা তার ফোন থেকে। লজিক এখন কাজ করছে। অয়নন্দিতাকে না পেয়ে তার ভাই ফোন করেছে। কিন্তু হাসানকে এখন সে কী জবাব দেবে সেটাই ভাবছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে পুরো বিষয়টা ভেবে নেয় ফারহান। ফোনটা ক্রমাগত বেজেই যাচ্ছে। ফোনটা রিসিভ করে ফারহান। স্থির কন্ঠে বলে,
‘হ্যালো।’
‘হ্যালো ফারহান, কেমন আছেন?’
‘এইতো ভালো। আপনি কেমন আছেন?’
‘ভালো।’
‘আচ্ছা, অয়নি কোথায়? ওকে ফোন করলাম রিসিভ করল না যে।’
‘অয়নন্দিতা ঘুমাচ্ছে। একটু টায়ার্ড তো। ওর ফোন সাইলেন্ট করা৷’
‘ওহ। আচ্ছা ও উঠলে বলবেন। কেমন?’
‘হ্যাঁ অবশ্যই।’
ফারহান খুব নিখুঁতভাবে মিথ্যা বলল হাসানকে। ইচ্ছা করে বলেনি৷ বাধ্য হয়েছে বলতে। ফারহান যতটা সম্ভব নিজেকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। এদিকে পুরো রিসোর্ট এবং রিসোর্টের চারপাশটায় দেখাশোনা শুরু হয়ে গেছে।
পুলিশ অফিসার রাফি এসে হাজির হয়েছে রিসোর্টে। ফারহান অলরেডি রাঙামাটি থানায় খবর দিয়ে ফেলেছে। মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে। ফারহান পারছে না চিৎকার করে ডাকে অয়নন্দিতাকে। গাড়ি নিয়ে একবার টহল দেওয়াও হয়ে গেছে। কিন্তু খোঁজ পায়নি অয়নন্দিতার।

রাত আটটা। ফারহান আরও একবার গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। চারপাশটা দেখে এসেছে। কিন্তু অয়নন্দিতাকে পায়নি। রাগে, দুঃখে মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে তার। না করার পরেও অয়নন্দিতা কেন বের হলো এটাই তার রাগের কারণ।
আনুমানিক আটটা পনেরো হবে, অয়নন্দিতা রিসোর্টে ফেরে। ফারহান তখন রিসিপশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ অফিসার রাফির ফোনের অপেক্ষায় সে। ফোন এলেই সে বের হবে। কিন্তু তার আগেই অয়নন্দিতার পা পড়ে গেছে রিসোর্টে। দম বন্ধ করা পরিস্থিতি দেখে অয়নন্দিতা খানিক ঘাবড়ে যায়। আর তাকে দেখে ফারহান যেন নিজের প্রাণ ফিরে পায়। চোখ জোড়া বন্ধ করে একটা ঠান্ডা নিঃশ্বাস ছেড়ে সেখানেরই সোফায় বসে পড়ে ফারহান। একপাশে সকল স্টাফরা দাঁড়িয়ে আছে। ফারহানের পাশে ম্যানেজার দাঁড়িয়ে আছে।
অয়নন্দিতাকে দেখে ম্যানেজারও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। বাই এনি চাঞ্চ যদি কিছু হয়ে যেতো তাহলে তো তার চাকরি নিয়ে টানাটানি হতো। কপাল ভালো এ যাত্রায় তার চাকরি বেঁচে গেছে।
ফারহান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ধীর গতিতে অয়নন্দিতার সামনে এসে দাঁড়ায়। সবার সামনে অয়নন্দিতার বামহাতের বাহুতে স্পর্শ করে সে। এরপর হালকা টানে রুমের দিকে পা বাড়ায়।

মুখোমুখি দু’জন দাঁড়িয়ে আছে। রুমে এসি চলছে তবুও ফারহান ঘামছে। গলার নিচের রগগুলো তার ফুলে ফেঁপে আছে। রাগ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে এখন। ফারহান ভাবছে, তাদের যদি সাক্ষাৎ যদি আরও কয়েকবছর আগে হতো তাহলে হয়তো কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিত অয়নন্দিতার গালে। কিন্তু এখন তা করা সম্ভব না। এর কারণ সম্পর্কের বন্ধনে সবে মাত্রই পা রেখেছে তারা দু’জন।
ফারহানের রাগান্বিত বডি ল্যাংগুয়েজ দেখে অয়নন্দিতার কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে জানত এমন কিছুই হবে। কারণ সে বড্ড দেরি করে ফেলেছে। ইয়াসমিন নামের ওই নারীকে সে বার বার বলেছিল রিসোর্টে ফেরার কথা। কিন্তু সে কিছু শপিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তার সঙ্গে থাকতে হয়। আর সেই থাকাটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফারহান অয়নন্দিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?’
ফারহানের কন্ঠস্বরে কাঠিন্য। অয়নন্দিতা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ এই মুহুর্তে নীরবতাও ফারহানের কাছে বিরক্তি হয়ে যাচ্ছে। ফারহান আবারও বলে,
‘একটা প্রশ্ন করলে তার জবাব দিতে হয়। এতটুকু ভদ্রতা আমি তোমার কাছে আশা করতেই পারি। তাই না? কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’
‘আসলে আমি,,,।’
অয়নন্দিতাকে থামিয়ে দেয় ফারহান৷
‘ওয়েট। তুমি এখানকার কিছুই চেনো না। তবে এতক্ষণ কোথায় ছিলে। আর ম্যানেজার তোমায় না করেছিল নিশ্চয়ই। তবুও তুমি বের হয়েছ কেন?’
কম্পিত গলায় অয়নন্দিতা জবাব দেয়,
‘আমার ভালো লাগছিল না। খাওয়া দাওয়ার পর বোর লাগছিল৷ তাই বের হয়েছিলাম। আমি দূরে যেতাম না। আশেপাশের জায়গা থেকেই ঘুরে চলে আসতাম। কিন্তু,,,।’
‘কিন্তু,,, কীসের কিন্তু। কিন্তু কী, বলো।’
‘এই রিসোর্টেই উঠেছেন এমন একজন নাম ইয়াসমিন। আপনি রিসিপশনে গিয়ে চেক করতে পারেন। তিনি আমায় ডাকলেন। বললেন তার স্বামী বাইরে মিটিংয়ে গেছে। তিনিও একা আর আমিও একা। তাই দু’জন মিলে সামনে যাওয়া যাক। আমিও ভাবলাম এখানেই তো থাকব। যাওয়া যাক। কিন্তু সে এখানের মার্কেটে নিয়ে গেল। বলল এখানে নাকি ভালো ভালো জিনিস পাওয়া যায়। তাই গেলাম। দেরি হয়ে যাচ্ছিল। আমি বার বার বলছিলাম, চলুন আমাদের যাওয়া উচিত। আমার হাসবেন্ড চলে আসবে৷ কিন্তু তিনি শুনলেন না। তাই তার সঙ্গে আমায় থাকতে হলো।’
ফারহান এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল অয়নন্দিতার কথাগুলো। এখানে ভালো ভালো জিনসও পাওয়া যায় সে জানত না। পুনরায় প্রশ্ন করল,
‘তা ওই ইয়াসমিনের নামের ভদ্রমহিলা কোথায়? তোমাকে তো একা ঢুকতে দেখলাম।’
‘আমরা দু’জনেই রিসোর্টে ফিরেছি এক সঙ্গে। ওই সময়ই গেইটের সামনেই তার হাসবেন্ডের গাড়ি এসে থামে। তিনি তার স্বামীর সঙ্গে গাড়ি করে চলে যান।’
‘এভাবে কখনও একা একা বের হবে না তুমি। তোমার জন্য এটা নতুন জায়গা অয়নন্দিতা। প্লিজ, আমার ভয় হয়। তুমি বুঝতে পারবে না আমি কী পরিমাণ চিন্তায় ছিলাম।’
‘আমায় নিয়ে এত চিন্তা?’
‘অবাক হলে নাকি জানতে চাইলে?’
‘দুটো এক সঙ্গেই।’
‘ঘরপোড়া গরু আমি অয়নন্দিতা। হারানোর যন্ত্রণা আমার থেকে ভালো কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। আমার আর একদিন লাগবে সমস্ত কাজ শেষ করতে। পরশুদিন থেকে আমি ফ্রী। টানা এক সপ্তাহ তোমায় নিয়ে ঘুরব আমি। কথা দিলাম। কিন্তু প্লিজ, একা একা আর কোথাও বের হবে না। কেমন?’
ফারহানের চাহনিতে নিজের জন্য ভয় দেখতে পায় অয়নন্দিতা। সে খুশি হবে নাকি কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। ভাবছে যা হচ্ছে তা কি শুধুই দায়িত্ব নাকি দায়িত্বের আড়ালে ভালোবাসা নামক অনুভূতিও মিশ্রিত। ফারহান দ্বিতীয়বারের মতো কাউকে ভালোবাসবে? এটাও তার কাছে একটা প্রশ্ন। যার উত্তর হয়তো সময় বলে দেবে।

রাত দুটো। ফারহান ল্যাপটপে কাজ করছে৷ অয়নন্দিতার ঘুম আসছে না। নতুন জায়গায় ঘুম আসবে না এটাই স্বাভাবিক। এখানে ওয়াইফাই ব্যবস্থা ততটা ভালো না। তাই এমবি দিয়েই কাজ চালাতে হবে। এত রাতে ফেসবুকে এক্টিভ হতেও ইচ্ছে করছে না। গলা ছেড়ে গান গাইতে মন চাইছে তার। কিন্তু এখন গান গাইলে ফারহান বিরক্ত হবে সাথে অন্যান্য রুমের লোকজনের অসুবিধা হবে। কিন্তু এভাবে বোবার মতোও বসে থাকতে ভালো লাগছে না তার। বারান্দায় গিয়ে বসবে নাকি সেটাও ভাবছে সে।
ফারহান সামনে তাকিয়ে দেখে জানালার পাশে অয়নন্দিতা দাঁড়িয়ে আছে। সেও বুঝতে পেরেছে হয়তো ঘুম আসছে না বলেই দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে ফারহান নিজেও একটি হীনমন্যতায় ভুগছে। না চাইতেও সে খারাপ আচরণ করেছে অয়নন্দিতার সঙ্গে। এটাই তাকে লজ্জা দিচ্ছে। কাজে মন দিতে না পারলেও তাকে কাজ করতে হচ্ছে। কারণ সন্ধ্যের পর থেকে সে এতটাই ডিস্টার্ব ছিল যে কাজটা তখন গোছাতে পারেনি। তাই এখন যত রাতই হোক সব কাজ গোছাতে হবে। সকাল এগারোটায় আরেকটা মিটিংয়ে বসতে হবে তাকে। সেটা নিয়েই যত ব্যস্ততা তার। সব কাজ শেষ করে অয়নন্দিতাকে কিছুদিন সময় দেবে এটাই তার পরবর্তী চিন্তাভাবনা।
এদিকে অয়নন্দিতা ততক্ষণে বারান্দায় গিয়ে বসেছে। আহ, দখিনা বাতাসে শরীর তার জুড়িয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে আকাশটা খুব কাছে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু হাত দিয়ে ধরার উপায় নেই। চোখ জোড়া বন্ধ করে বাতাসের গন্ধ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অয়নন্দিতা। কন্ঠস্বরে উচ্চারিত হয়,
চোখে আমার তৃষ্ণা, ওগো তৃষ্ণা আমার
বক্ষ জুড়ে।

চলবে……………………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here