#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৪৯
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)
পায়ের উপর পা তুলে কফির মগে চুমুক দেয় জাহরাফ। মুখোমুখি বসে আছে বন্দনা। তার নজর জাহরাফকে দেখছে। ওই জাহরাফকে সে চিনতে পারে না। যেই জাহরাফ এক সময় তাকে ভীষণ ভালোবাসতো। যেই জাহরাফের ভালোবাসা পেয়ে একদিন সে ফারহানকে ভুলে গিয়েছিল। ফারহানের ভালোবাসা ভুলে গিয়েছিল। এর জন্য অবশ্য সে-ই দোষী। কারণ, ফারহানের কাছে সবই ছিল। টাকা-পয়সা, নাম-ধাম, সম্পত্তিসহ সব কিছুই ছিল। তবুও সে জাহরাফের ভালোবাসার ফাঁদে পা দিয়েছিল। আর সেটা স্ব-ইচ্ছায়।
টেবিলের ওপর কফি মগটা রেখে জাহরাফ বন্দনাকে বলে,
‘গতকাল দেখা হয়েছিল তোমার ফারহানের সঙ্গে।’
চমকে ওঠে বন্দনা। কপাল কুঁচকে তাকায় জাহরাফের দিকে।
‘আমার ফারহান! লাইক সিরিয়াসলি।’
‘এক সময় তো ছিল।’
‘এক সময় তো তুমিও থার্ড পারসন ছিলে। এখনও কি আছো?’
জাহরাফ হালকা দমে যায়। বন্দনা আবারও বলে,
‘যাই হোক, কিছু বলেছে নাকি?’
‘আমায় দেখে যে সে খুশি হবে না এটা তো জানা কথা।’
‘উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে নাকি?’
‘নাহ তেমন কিছু বলেনি। তবে ফারাশ বলেছে।’
‘কি বলেছে?’
‘উড়োভাবে বলে বুঝিয়েছে আমি চোর।’
‘ওর এমনিতেও ঠোঁট কাটা। মিটিংয়ে কী হলো, অর্ডার সাবমিট করেছে ওরা?’
‘আশা তো করা যায়।’
‘তোমায় একটা কথা বলি জাহরাফ। তার সঙ্গে সম্পর্কটা শুধুই প্রফেশনালি হবে। ব্যক্তিগত দিকে না যাওয়াই ব্যাটার।’
ম্যাগাজিন থেকে চোখ সরিয়ে বন্দনার দিকে তাকায় জাহরাফ।
‘দরদ হচ্ছে নাকি?’
‘যদি বলি হচ্ছে, তখন কি ডিভোর্স দিবা নাকি?’
‘নাহ। আগে এক চোট ঠ্যাঙাবো তোমায়। আর শোন, আমার শখ নেই ফারহানের সঙ্গে ব্যক্তিগত রেষারেষিতে যাওয়ার।’
‘ব্যাস, কথাটা মনে রাখলেই হলো। রাতে খাবে তো নাকি আজকেও ক্লাবে যাবে।’
‘ক্লাবে যাব।’
‘রোজ-ই তোমায় ক্লাবে যেতে হয়। তাই না?’
‘হ্যাঁ, যেতে হয়।’
‘আজকের বান্ধবীর নাম কী?’
‘তুমি গিয়ে দেখে এসো, আজকের বান্ধবী কে?’
বন্দনা একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস৷ বোঝাই যাচ্ছে ভেতরে অনেক কষ্ট লুকানো আছে।
মামীর হাতে ধরে বসে আছে অয়নন্দিতা। তার জন্য যে এত খারাপ খবর অপেক্ষা করে আছে সেটা তার অজানা আছে। মিলির ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ব্রেস্ট ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজ। বেশিদিন বাঁচবে না৷ হাসান নিজের জমা পূঁজি যা ছিল সবই খরচ করেছে। কিছুতেই লাভ হচ্ছে না। কেমো দেওয়া হচ্ছে মিলিকে। কিন্তু উন্নতি হচ্ছে না। মিলির সার্ভাইব করাটা একেবারেই অসম্ভব। অয়নন্দিতা জানতে চায় তাকে কেন জানানো হয়নি। জবাবে মামী বললেন,
‘তোর মামা বলতে বারণ করেছে। মিলিও বলল, থাক বলার দরকার নেই। হাসানও তাই চেয়েছিল। অসুখটা একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে ধরা পড়ল। মেয়েটার প্রতি কত রাগ করতাম। এখন দেখলেই মায়া হয়। আমার ছেলেটা একেবারেই ভেঙে পড়েছে।’
অয়নন্দিতার খারাপ লাগছে৷ কোনো এক সময় মিলি তার সঙ্গে অনেক খারাপ আচরণ করত। কিন্তু তার বিয়ের সময় একেবারেই স্বাভাবিক হয়ে গেল তবে কি মিলি মৃত্যুর ডাক শুনতে পেয়েছিল৷ কাছের মানুষগুলো কেন এইভাবে প্রতারিত করে চলে যায়। কেন তারা বোঝে না যে, তাদের চলে যাওয়ার পর জীবন কতখানি খালি হয়ে যায়। অয়নন্দিতা নিজের বাবা-মা’কে হারিয়ে ভীষণ খালি হয়ে গেছে। আর কিছুদিন পর হয়তো হাসানিকেও এমন শূন্যতা নিয়ে বাঁচতে হবে৷ আয়শা বেগম আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন,
‘কিছু খাবি?’
‘উহু৷ ভাইয়া আর ভাবী কোথায়?’
‘হাসান মিলিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। মেয়েটা যেতে চায় না তবুও জোর করে নিয়ে যায়।’
‘জোর করে না মামী। বলো, বাঁচানোর আশায়।’
‘একেবারেই শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে ফেরা আর সম্ভব না। হাসান এটা বুঝতেই চায় না।’
‘সম্ভব যদি হতো আমি আমার বাবা-মা’কে যেতে দিতাম না মামী৷’
‘ফারহান কেমন আছে রে?’
‘ভালো আছে। মামী আমার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আল্লাহ পাক কেন এইভাবে প্রতারিত করে আমাদের। প্রিয় মানুষগুলোকে কেন কেড়ে নেয় মামী।’
‘তার কাছ থেকে যে যতদিনের হায়াত নিয়ে এসেছে, এই দুনিয়ায় তার মেয়াদ ঠিক ততদিন। মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। ডাক পড়বে। এরপর অন্ধকার কবর। আমার ছেলেটা এই শোক কাটাতে পারবে তো অয়নি?’
‘জানি না গো মামী। জানি না।’
অয়নন্দিতার চোখে পানি। গলা ধরে আসছে তার। এমন সময় মিলি আর হাসান বাসায় পা রাখে। মিলিকে দেখে অয়নন্দিতা দাঁড়িয়ে যায়৷ এত সুন্দর মেয়েটার চোখের নিচে কালি পড়েছে। যেন দু’চোখে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। ঝড় আসবে। বড়ো ঝড়। যেই ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। মিলির পরনে সেই জামাটা যেটা হাসান সেদিন কিনেছিল। মিলিকে বেশ মানিয়েছে। অয়নন্দিতাকে দেখে মিলি জড়িয়ে ধরে।
‘কেমন আছো অয়নি?’
‘আমি কে তোমার? আমার খোঁজ খবর না নাও তুমি।’
‘এত রাগ কেন?’
‘আমায় জানাওনি কেন তোমরা? আমি কি পর?’
‘নতুন সংসার তোমার। বিরক্ত করতে চাইনি। হাসানকে আমিই মানা করেছিলাম যেন না বলে।’
অয়নন্দিতা চোখের পানি মুছে হাসানের দিকে তাকায়।
‘কী বলল ডক্টর?’
অসহায় দৃষ্টিতে অয়নন্দিতার দিকে তাকায় হাসান। মুখটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তার ভেতরটা কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। চোখের সামনে প্রিয় মানুষটা একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চোখ জোড়ায় পানি জমাট হয়েছে। হাসান কিছু বলার আগেই মিলি বলে,
‘ছাড়ো তো ডক্টরের কথা। লোকটা মহা বদমাশ।’
‘কেন, কী করেছে?’
‘এত এত মেডিসিন দেয়। সবাই জানে যে, আমি আর বেশিদিন নেই। তবুও সে মেডিসিন দিতেই থাকবে। আমার জামাইর টাকা-পয়সা সব শেষ।’
কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে হাসান ধমকে ওঠে।
‘চুপ করবে তুমি? বেশি কথা বোলো না। রেস্ট নাও। মা, আমি একটু আসতেছি।’
বোঝা যাচ্ছিল যে হাসানের সহ্য হচ্ছে না। সবার সামনে চোখ থেকে পানি ফেলবে না সে। তাই সবার আড়ালে চলে যায়। আয়শা বেগম মিলিকে তার খাবার এনে দেন। অয়নন্দিতা মিলির পাশে বসে তাকে খাওয়ানো শুরু করে।
‘ফারহান ভাই কেমন আছে গো?’
‘ভালো। সব কিছু ঠিকঠাক তো।’
‘হু।’
মিলি খেয়াল করে, অয়নন্দিতা নিঃশব্দে কাঁদছে। অবিশ্য কান্নার কারণ অজানা নয়৷ তার সময় ফুরাচ্ছে আর সবার চোখ ভারী হচ্ছে।
‘কেঁদো না তো৷ তোমরা কাঁদলে আমার খারাপ লাগে। বেশি খারাপ লাগে আমার জামাইটার জন্য। ও বেচারা এখনও কিছুই দেখল না। তার আগেই সব শেষ হতে চলেছে৷’
অয়নন্দিতা খাবারের প্লেটটা রেখে মিলিকে জড়িয়ে ধরে। চোখ জোড়া থেকে পানিগুলো অঝোরে ঝরে যাচ্ছে। কোনো কথা আসছে না মুখে। মিলির কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে যায় সে। আয়শা বেগম বার বার ডেকেছেন কিন্তু অয়নন্দিতা শোনেনি। মিলি একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে। দু’চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। শাশুড়ির দিকে তাকায় মিলি।
‘মা, আমার শরীর ভালো লাগছে না। একটু ঘরে যাব।’
আয়শা বেগম মিলিকে ধরলেন। মিলিকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে তিনি অন্য কাজে মন দেবেন৷
‘মা, আজকে আব্বু আর আম্মু আসবে। আমায় নিয়ে যেতে চাইবে। মা, আমি যেতে চাই না। আপনি বরং আব্বু আম্মুকে বলবেন, তারা যেন আমায় না নেয়। আমি শেষ কয়েকটা দিন হাসানের সঙ্গেই থাকতে চাই মা।’
আয়শা বেগমের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কান্না দমিয়ে রেখে তিনি বললেন,
‘আচ্ছা বলব৷’
‘মা, আরেকটা কথা।’
‘বলো৷’
‘আমি চলে যাওয়ার পর হাসান আরও ভেঙে পড়বে মা। আপনি তখন হাসানকে সামলে নিবেন। আর ওকে আবার নতুন করে সব সাজাতে বলবেন। আমি যতবার এই কথা বলি ততবারই হাসান আমায় ধমক দেয় মা।’
আয়শা বেগম মিলির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
‘শুয়ে থাকো চুপচাপ। বেশি কথা না। আমি তোমার খাবার ব্যবস্থা করি।’
মিলিকে শুইয়ে দিয়েই আয়শা বেগম দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে চলে আসেন। মুখে হাত দিয়ে শব্দ করে কেঁদে ওঠেন।
ফারহানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে অয়নন্দিতা। ফারহান তাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে সেটা জানা নেই। মিলি মেয়েটা বেশ ভালো। সে যতদিন দেখেছে বেশ হাসিখুশি দেখেছে৷ ফারহান বাড়ি এসে শোনে অয়নন্দিতা মামার বাসা থেকে ফিরেই কান্নাকাটি করছে। রওশন বেগমও দুঃখ প্রকাশ করলেন৷ ফারহান অয়নন্দিতাকে বোঝায়,
‘অয়নন্দিতা, আমি বা তুমি আমরা কেউই জানি না কার ভাগ্যে কী লেখা আছে। তাই না? কষ্ট পেয়ো না। প্লিজ।’
‘ভাইয়ার কী হবে, ভাবতে পারছ?’
‘সবটাই ভাবতে পারছি। এমন কি অনুভবও করতে পারছি। কিন্তু এটাই হয়তো বিধির বিধান।’
‘আল্লাহ পাকের সিদ্ধান্ত ওত কঠোর কেন হয়?’
‘আল্লাহ পাক তার মনুষ্য জাতিকে বেশি ভালোবাসেন। তাই।’
‘ভালোবাসলে এত কঠিন অসুখ কেন দেন। আবার নিজের কাছে নিয়েও যান। কেন?’
‘ওই যে, মনুষ্য জাতিকে পরীক্ষা করেন। ডক্টর কী বলেছে?’
‘লাস্ট স্টেইজ৷ একদম শেষ পর্যায়। কিছুই সম্ভব না। কোনো একদিন হয়তো ফাঁকি দেবে আমাদের সবাইকে।’
কথাটা শুনে ফারহান একটু দম নেয়। ছোটো করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে অয়নন্দিতাকে জড়িয়ে ধরে।
দরজার ওপাশ থেকে সাজি সবটাই শুনতে পায়। তার জানা ছিল না যে, হাসান এত বড়ো একটা বিপদে আছে। মিলির শারীরিক অবস্থা ভালো না। বেশিদিন সময় নেই। কথাটা তার জন্য কতটা পীড়াদায়ক। এটা সে বুঝতে পারছে। চোখের পানি মুছে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় সাজি।
পরদিন বিকেলে।
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে আয়শা বেগম দরজা খুলেন৷
দরজা খুলে অবাক হন তিনি। দরজায় সাজি দাঁড়িয়ে আছে। সাজি তেমন এক্যেই বাসায় আসে না। প্রথম প্রথম আসলেও পরবর্তীতে আর আসেনি। আয়শা বেগম আদর করে সাজিকে ভেতরে নিয়ে আসে৷ সাজি দেখতে পাচ্ছে আয়শা বেগমের চোখ মুখের অবস্থা ভালো না। ভেতরে প্রবেশ করেই সাজির দেখা হয় অয়নন্দিতার মামা অর্থাৎ হাসানের বাবা খাইরুল সাহেবের সঙ্গে। সালাম দিলে খাইরুল সাহেবও বিষন্ন মুখে সালাম নেন। এরপর বাইরে বের হয়ে যান। সাজি বুঝতে পারছে, এই পরিবারের সবাই ভীষণ রকম আহত। আয়শা বেগম প্রশ্ন করেন,
‘কেমন আছো মা?’
‘জি ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন আন্টি?’
‘আমরা ভালো নেই গো মা। আমাদের ভালো থাকা আল্লাহ পাক কেড়ে নিয়েছেন।’
কথাটা বলেই আয়শা বেগম কেঁদে দেন। সাজিরও খারাপ লাগছে। সে অনুরোধ করে,
‘আন্টি, আমি কি মিলি ভাবীর সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি?’
‘মিলি তার ঘরেই আছে। ওই পাশের ঘরটাই মিলির। যাও। দেখা করো গিয়ে।’
‘ধন্যবাদ আন্টি।’
‘অয়নি এলো না?’
‘ভাবী নিজেও জানে না যে আমি এখানে এসেছি। আসলে আমার একটা কাজ ছিল তো এখানে। ওটা সারতেই এসেছিলাম। ভাবলাম দেখা করে যাই।’
‘ওহ।’
সাজিকে মিথ্যা বলতে হলো। আসলে সে মিলিকে দেখতেই এসেছিল। অয়নন্দিতাকে সে ইচ্ছা করেই বলেনি। আয়শা বেগম আবারও বললেন,
‘যাও তুমি। আমি তোমার জন্য একটু নাস্তার ব্যবস্থা করছি।’
‘নাহ নাহ আন্টি। প্লিজ, ঝামেলা করবেন না।’
‘ঝামেলার কিছু নেই। তুমি যাও।’
সাজি ধীর পায়ে মিলির ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। পর্দা সরিয়ে বিছানায় নজর দেয় সাজি। কম্বল জড়িয়ে মিলি শুয়ে আছে খাটে। সাজি সাবধানতা অবলম্বন করে পা টিপে টিপে মিলির ঘরে প্রবেশ। কিন্তু সাজির পায়ের শব্দ মিলির কান অবধি পৌঁছে যায়। মিলি ওপাশে মুখ করেই প্রশ্ন করে,
‘কে?’
সাজি চমকে যায়। দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানে। জবাব দেয়,
‘আমি সাজি।’
মিলির কষ্ট হলেও সে উঠে বসে। সাজির দিকে তাকায়। মলিন হাসি দেয়।
‘ওহ তুমি। তা এত পা টিপে টিপে আসলে কেন? এসে ডাক দিলেই হতো।’
‘ভাবলাম তুমি হয়তো ঘুমাচ্ছ।’
‘তোমার আর হাসানের দেখি এক অভ্যাস। দু’জনেরই পা টিপে ঘরে ঢোকার স্বভাব।’
কথাটা শোনার পর সাজি নড়েচড়ে বসে। মিলির অবস্থা ভালো না৷ এত সুন্দর চুলগুলো পড়ে গেছে। স্কার্ল্প দেখা যাচ্ছে। কেমো দেওয়াতেই হয়তো এমন হয়েছে। চোখের নিচটায় কালি পড়ে গেছে। এত সুন্দর একটা মানুষকে অসুস্থতা কীভাবে গ্রাস করে ফেলল। হাসানের করুণ মুখটা চোখের সামনে ভাসছে সাজির। তার দিনগুলো না জানি কতটা কষ্টে অতিবাহিত হচ্ছে। গোলাপের তোড়াটা মিলির দিকে এগিয়ে দেয় সাজি৷
‘ফুলগুলো তোমার জন্য এনেছিলাম।’
‘বাহ, সুন্দর তো। আমার গোলাপফুল খুব ভালো লাগে।’
‘কারণ, তুমি গোলাপের মতোই সুন্দর।’
‘এটা ভালো বলেছ। আমি গোলাপের মতো সুন্দর কি না জানি না তবে গোলাপ আর আমার পরিণাম একই। তাজা গোলাপ ধীরে ধীরে নুয়ে যাবে। এক সময় ঝরে যাবে। আমিও তেমন। আর তো বেশিদিন নেই। আমিও ঝরে যাব।’
বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে সাজির। কতটা কষ্ট নিয়ে মিলি এমনভাবে কথা বলছে। তার সহ্য হচ্ছে না। এখানে থাকলে হয়তো কেঁদে ফেলবে। চলে যাওয়াটাই শ্রেয়।
‘আজ উঠি গো। আবার কোনো এক সময় আসব।’
‘চলে যাবে?’
‘হুম।’
‘যাও। আটকাব না। তবে আবার এসো। দেখ, এমন যেন না হয় তুমি আসলে আর আমি খাটিয়ায় শুয়ে থাকলাম।’
সাজি কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বের হয়েই চোখ বন্ধ করে পানি ছেড়ে দেয়। কয়েকটা ঢোক গিলে চোখের পানি মুছে দরজার দিকে যায়। দরজা খুলে বের হতে নিলেই হাসানের সঙ্গে ধাক্কা খায়। হয়তো হাসানেরও এই সময় বাসায় আসার কথা ছিল। হাসানকে দেখে মায়া হচ্ছে সাজির। মানুষটার চোখ-মুখ বলে দিচ্ছে সে কষ্টে আছে। হাসান সাজিকে দেখে অবাক হয়৷ চোখ কুঁচকে তাকায় সে। সাজি নিজেকে কন্ট্রোল করে বলে,
‘সরি।’
‘ইটস ওকে।’
পাশ কাটিয়ে সাজি বের হতে নিলে হাসান বলে,
‘চলে যাচ্ছ যে। বসবে না?’
‘বসেছি। আজ আসি।’
‘দাঁড়াও সাজি৷’
হাসান সাজিকে দাঁড় করায়৷ খোলা দরজাটা হালকা করে টেনে সাজির পাশে এসে দাঁড়ায়।
‘তুমি সেদিন শপিংমলে একটু অন্য ভঙ্গিতে কথা বলেছিলে। এর কারণ কী?’
সাজি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে হাসানের দিকে। এটা নিছকই নিজেকে স্বাভাবিক রাখার অভিনয় মাত্র।
‘আমি তো নরমাল ভাবেই কথা বললাম।’
হাসান প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয়।
‘মিলিকে দেখেছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘মিলিকে দেখতেই এসেছ। তাই না?’
‘আপনি চিন্তা করবেন না। ভালো হয়ে যাবে সে।’
‘এখন আর চিন্তা করি না। মেয়েটা আমায় ছেড়ে চলে যাবে। এটাই মানতে পারছি না। সে ভালো হবে এটাও আর আশা করি না। কারণ, মিথ্যা আশা বড্ড বেশি কষ্ট দেয়। যাই হোক। তুমি আর এখানে এসো না। আমার সামনেও এসো না।’
অবাক হয় সাজি। হঠাৎ এমন কথা।
‘আসব না কেন?’
‘আমি বলেছি। তাই আসবে না।’
‘যদি আসি তবে কী হবে?’
‘ক্ষতি হবে তোমার। এসো না প্লিজ। তোমার বডি ল্যাংগুয়েজ বলে দিচ্ছে তোমার ভেতরে কী চলছে।’
‘তবে বলব, উপায় নেই। আমার মন আটকে গেছে। আসি।’
সাজি আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায়নি সেখানে। সিঁড়িতে পা ফেলে নিচে নেমে যায় সে। হাসান সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। রেলিংয়ে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাসে বুকটা ভার করে ওঠে তার। নিয়তি একই সঙ্গে দুই রকম খেলা খেলছে তার সঙ্গে। যার কোনো অর্থই সে বুঝতে পারছে না।
‘আল্লাহ পাক, মিলিকে ভালো করে দেওয়া যায় না? মিলি চলে গেলে নিজেকে সামাল দিতে পারব না আমি। সাজির মনে যা চলছে তার পরিণাম আমার জানা নেই। আমায় সাহায্য করুন আল্লাহ পাক। সাহায্য করুন।’
চলবে…………………………….