জান্নাহ্ “পর্বঃ৪

0
5646

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

কৃষ্ণকায় আকাশে তারার ঝলকানি।তার মাঝে দাম্ভিকতার সাথে রাজ সিংহাসনে বসে আছে রূপালি চাঁদ।তার আশপাশ জুড়েও তার দাম্ভিকতার রূপ।এক ধ্যানে তাকালে এই তো মনে হবে যেনো ছুটে আসছে আকাশের রাণী।যেনো তার কিরণে অবগাহন করাবে।রাতের নিস্তব্ধতায় আলোড়ন সৃষ্টি করে অজানা প্রত্যঙ্গ।থমথমে বাতাসে ভেসে আসছে অদ্ভুত ফুলের ঘ্রান।আকাশ ঘুমোচ্ছে।তাকে পাহারা দিচ্ছে চাঁদেশ্বরী।দিনের আলোয় নীলাভ আকাশ রাতের মায়ায় এক কৃষ্ণ গহব্বর।সেখানেই উঁকি মেরে থাকে চাঁদ।

জান্নাহ্ এর ছোট্ট শরীরের উপর নিজেকে সমার্পিত করে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে সারহান।মোবাইলে ভ্রাইব্রেট হতেই চোখে টোকা পড়ে তার।চোখ দুটো কুঁচকে আবার মেলে ধরার চেষ্টা করে।চোখের পাতা হালকা প্রশ্বস্ত করে বেড সাইড টেবিল হাতড়ে মোবাইল নিয়ে কানে ধরে সারহান।কে কল করেছে তা দেখার প্রয়োজন বোধ করলো না।ঘুম জড়ানো গলায় একরাশ বিরক্তি অধরে নিয়ে সারহান বললো–

“হ্যালো।কে?

ওপাশের ব্যক্তিটি দ্রুত গতিতে বললো–

“স্যার আমি শায়িখ।”

সারহান বিরক্তিকর গলায় বললো–

“এতো রাতে কল করলে কেন?

“স্যার একটা জরুরি কথা ছিলো।”

তপ্ত গলায় সারহান বললো–

“বলো।”

শায়িখ জানে সারহানকে ছোটখাট বিষয় নিয়ে বিরক্ত করলে সে ক্ষেপে যায়।আর মেয়ে মানুষের সাথে থাকাকালীন তো আরো বেশি।তবুও একান্ত জরুরি খবর বলেই তাকে বাধ্য হয়ে কল করেছে শায়িখ।সারহানের নজর পড়ে ঘুমন্ত জান্নাহ্ এর উপর।কী অদ্ভুত নেশা এই মুখে!সারহান তার ঘ্রাণেন্দ্রিয় বুলাতে থাকে জান্নাহ্ এর গলার নিচ থেকে বুকের উপর। এক মিষ্টি সুবাসে উন্মত্ত হয়ে উঠে সারহানের শরীর। জান্নাহ্ এর ঘুমন্ত চেহারায় এক পশলা চাঁদের আলো পড়তেই ঝাঁঝিয়ে উঠে সারহানের চোখ।সারহান নিভু নিভু চোখে হাসে।দূর্বল হাতে কানে মোবাইল চেপে ধরেই জান্নাহ্ এর অধরে অধর মেশায়।নড়ে উঠে জান্নাহ্।তার শ্রান্ত দেহ নিয়ে বেশি নড়াচড়া করলো না সে।শায়িখ তার স্যারকে ভালো করেই জানে।তাই এই পাশের সেই অস্ফুট শব্দে সে অভিনিবেশ করলো না।নিজের গুরুত্বপূর্ণ কথা শেষ করে কল কেটে দেয়।মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলে সারহান।জান্নাহ্কে পুরো আড়ষ্ট করে নেয় তার বক্ষপিঞ্জিরায়।যেখানে জান্নাহ্ শুধু ডানা ঝাপটানো এক অসহায় পাখির ছানা।
,
,
,
সকালের প্রভাত কিরণ উঁকি দিয়।এক মুঠো হলদে রোদ এসে হানা দেয় জান্নাহ্ এর চোখে।চোখ কুঁচকে নেয় জান্নাহ্।সকাল হয়েছে বুঝতে পেরে ধীরগতিতে উঠে বসে।তার এলোমেলো শাড়ি কোনোমতে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।ঘর জুড়ে কোথাও সারহানকে দেখতে পেলো না।জান্নাহ্ অবগত হয় সারহানের ফিরে যাওয়ার বিষয়ে।বিছানা থেকে পা নামায় জান্নাহ্।শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে তার।শাড়িটা কোনোমতে গুঁজে ওয়াশরুমে যায়।

আজ জান্নাহ্ স্কুল যাবে।সকাল আটটায় তার স্কুল।এখন ঘড়িতে ছয় টা।ভালো করে ফ্রেশ হয়ে স্কুল ড্রেস পরেই বের হয় জান্নাহ্।আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।সারহান থাকলে নিজেকে দেখার সময়টুকুও পায় না সে।জান্নাহ্ খেয়াল করে তার চোখের নিচটা ঈষৎ কালচে।তার পেটটাও একটু উঁচু।জান্নাহ্ এর মন ক্ষুন্ন হয়।এই জন্যই সারহান তাকে এইসব বলেছে।আয়নায় অপলকে চেয়ে নিজেই নিজেকে শাসায়—

“জান্নাহ্,এখন থেকে কম খেতে হবে।বুঝলে।”

নিজের কথায় নিজেই খলখলিয়ে হাসে জান্নাহ্।যখনই একা থাকে নিজের সাথেই কথা বলে সে।বেশ লাগে তার কাছে।মাথাটা আয়নার সামনে এনে চোখটা ভালো করে দেখে।বললো–

“ইশ!কী বিদঘুটে!

ঘড়ির দিকে তাকায় জান্নাহ্।প্রায় পৌনে সাতটা।এখনো অনেক সময় বাকি।হঠাৎ একটা পাখির ডাক শুনতে পায় জান্নাহ্।ব্যস্ত হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ায়।একটা ঠান্ডা বাতাস এসে লাগে তার চোখে মুখে।বারান্দার সাথে শিয়র উঁচু করে দাঁড়ানো মেহগনি গাছটার পাতা গুলোয় ছোট ছোট পানির ফোঁটা।বোধ হয় বৃষ্টি হয়েছিলো খানিকটা।ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি যাকে জান্নাহ্ চোরা বৃষ্টি বলে।একটা লম্বা শ্বাস টেনে নেয় জান্নাহ্।ভোরের স্নিগ্ধ,ভেজা বাতাসে তার শরীর জুড়িয়ে আসে।শুভ্র আকাশে ঝিলমিলে নরম রোদ।এই রোদে অবগাহনে মনে প্রশান্তি জাগে।একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে।জান্নাহ্ ভাবে,”ইশ!সেও যদি উড়তে পারতো!তাহলে অনেক দূরে চলে যেতো।পৃথিবীর এই রাগ,হিংসা,ছলনা আর ধোঁকা থেকে অনেক দূরে।যেখানে শুধু সে আর তার প্রাণ থাকবে।”

কিন্তু তা হবার নয়।বিয়ের পর থেকে এই বাড়ির চৌকাঠেই বন্দি সে।স্কুল,টিউশন ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয় না।একটা শীতল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জান্নাহ্ এর হৃদয় গহব্বর থেকে।

ঘরে আসে জান্নাহ্।আবারো চোখ যায় সময় প্রহরির দিকে।আটটা পাঁচ।বিছানায় বসে জান্নাহ্।ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে।স্মৃতিমন্থনে ব্যস্ত হয় সে।

মনে পড়ে তার আর সারহানের প্রথম দেখা।যেদিন সারহান আর তার বাবা জান্নাহ্কে দেখতে গিয়েছিলো।জান্নাহ তখন চৌদ্দ বছরের কিশোরী।বাড়ন্ত শরীর তার।পদ্মলোচন দুই আঁখি।কিশলয়ের মতো কোমল দুই ঠোঁট।দুধে আলতা রঙ।পিতামাতাহীন জান্নাহ্ মামার পরিবারে মানুষ।মামি সদা তৎপর ছিলেন কী করে জান্নাহ্কে বিদায় করা যায়।আর হলোও তাই।প্রথম দেখায় সারহানের বুকে বিঁধে জান্নাহ্ নামের মেয়েটির ওই দুই চোখ।মাথায় দীর্ঘ ঘোমটা টানা জান্নাহ্ ওড়নার ফাঁক দিয়ে একবার দেখে সারহানকে।সেই এক পলকেই সারহানের ওই গভীর চোখ,কঠিন অভিব্যক্তি আর এক অজানা নেশা জান্নাহ্ এর বাড়ন্ত কিশোরী মনকে ঘায়েল করে।কিন্তু সারহানের নজর আটকে অন্য কোথাও।যা জান্নাহ্ জানতে পারে তাদের বাসর রাতে।সারহানকে যখন জান্নাহ্ এর সাথে একা কথা বলতে দেওয়া হয় তখন সারহান বলেছিলো,”আপনি আমাকে আপনার প্রাণসঞ্চারক হওয়ার অধিকার দিবেন,রজনীগন্ধ্যা?
আমার অন্তিম শ্বাস পর্যন্ত আপনাকে আমি আমার প্রাণের ডোরে বেঁধে রাখবো।”
ব্যস,এই দুটো লাইনই আজ জান্নাহ্ এর মৃত্যু যন্ত্রণার জন্য দায়ী।সেইদিন সারারাত ঘুমাতে পারেনি জান্নাহ্।শুধু সারহানকে ভেবেছে।একটা মানুষ এতো সুন্দর হয় কী করে!এতো সুন্দর করে অধিকার চায় কী করে!
দুই দিনের ভেতর একটা ছোট অনুষ্ঠান করে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় জান্নাহ্ আর সারহানের।কিন্তু বিয়ের রাতে সারহানের অদ্ভুত আচরণে সব ধারণা বদলে যায় জান্নাহ্ এর।সেই সুখের যন্ত্রণা আজও কাঁপিয়ে তোলে জান্নাহ্কে।

মোবাইলে এ্যালার্ম বাজতেই সপ্রতিভ হয় জান্নাহ্।ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা।ফটাফট তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হয় সে।স্কুল ড্রেসের উপর বোরখা পরে জান্নাহ্। ঘরের দরজায় আসতেই শুভ্রা বলে উঠে–

“না খেয়ে যাচ্ছিস কেন?

জান্নাহ্ মৃদু গলায় বললো–

“ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নিবো।তুমি চিন্তা করো না।”

সম্মতি দেয় শুভ্রা।সকালে ড্রয়ার খুলতেই সেখানে হাজার পাঁচেক টাকা দেখে জান্নাহ্।সারহান রেখে গেছে।যতবারই বাড়ি আসে যাওয়ার সময় টাকা রেখে যায়।অবশ্য এই টাকার তেমন প্রয়োজন পড়ে না জান্নাহ্ এর।কারণ তার আনুষঙ্গিক সকল খরচ সারহান নিজেই বহন করে।ছাদের ওপর থেকে দুই লোলুপ দৃষ্টি জান্নাহ্ এর দিকে চেয়ে আছে তা জান্নাহ্ টের পায় না।
,
,
,

স্কুল পৌঁছাতেই প্রফুল্ল হয় জান্নাহ্ এর মন।আজ তিনদিন পর স্কুল এসেছে সে।ঘরের সমস্ত অশান্তির মাঝে এই এক টুকরো সুখ তার।স্কুলের গেটের পাশেই একটা রেইন ট্রি।শুকনো পাতায় বিছিয়ে আছে গাছের নিচটা।আর্দ্রতায় জড়ানো তা।হঠাৎ একটা বাতাসেই নড়ে উঠে রেইন ট্রি পাতা।ঝমঝম করে কিছু পানি ছিঁটকে এসে পড়ে জান্নাহ্ এর শরীরে।কেঁপে উঠে জান্নাহ্।স্কুল গেইট দিয়ে ভেতর প্রবেশ করে সে।দুই ধারে বিল্ডিং মাঝে মাঠের মতো জায়গা।জান্নাহ্ এর স্কুলটা অনেকটা ইংরেজি শব্দের ইউ আকৃতির।প্রথম ভবনে মাত্র দোতালা।পরে যেই ভবনটা করা হয় তা পাঁচ তলা।।দোতালা ভবনটাই মূল ভবন।এখানেই অধ্যক্ষের জন্য বরাদ্দকৃত রুম,শিক্ষক মিলনায়তণ,লাইব্রেরি,অফিস রুম সব।জান্নাহ্দের ক্লাস পাশের ভবনে।মূল ভবনকে পার করেই সেখানে যেতে হয়।দ্বিতীয় ভবনের মধ্যখান বরাবর কৃষ্ণচূড়ার গাছ।ফেব্রুয়ারি আসলেই গাছের সাথের করিডোরে বিছিয়ে থাকে কৃষ্ণচূড়ার রক্ত লাল ফুলে।ভবনের কোনার দিকটায় শিমুল ফুলের গাছ।পাতাবিহীন গাছটায় লাল শিমুলে ভরে আছে।এই সময়টা বেশ লাগে জান্নাহ্ এর।

সিড়ি দিয়ে উঠতেই দেখা হয় জান্নাহ্ এর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী তিলের সাথে।তাকে দেখেই উচ্চলিত তিল খুশিতে গদগদ হয়ে বললো–

“কই ছিলি তুই!আছিস নি কেন এতোদিন?

জান্নাহ্ ইতস্তত করে বললো–

“একটু ব্যস্ত ছিলাম।”

তিল তার কোমর দিয়ে এক ধাক্কা মারে জান্নাহ্কে।আমুদে গলায় বললো–

“মিথ্যে বলিস কেন!আমি জানি না নাকি!সারহান ভাইয়া এসেছিলো তাই না?

অপ্রস্তুত হয় জান্নাহ্।ক্ষুন্ন গলায় বললো–

“দুর।তেমন কিছু না।চল ক্লাসে যাই।”

দুই বান্ধবী ক্লাসে ঢোকে।আজ তাদের প্রথম পিরিওড হায়ার ম্যাথ এর।এই ক্লাসটায় অস্বস্তি হয় জান্নাহ্ এর।মেঘনোলিয়া প্রথম প্রথম জান্নাহ্কে অনেক উৎসাহ দিলেও হঠাৎ করেই কেমন আজব আচরণ শুরু করে।অধ্যায়ের সব চেয়ে কঠিন অংক টায় জান্নাহ্কে করতে দেয়।তাও আবার বোর্ডে।না পারলেই এক ক্লাস শিক্ষার্থীদের সামনে অপমান করে।আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।তিনদিন ক্লাসে না আসার শোধ নেয় মেঘনোলিয়া।পুরোটা সময় জান্নাহ্কে দাঁড় করিয়ে রাখে।মেঘনোলিয়ার ক্ষীপ্র দুই চোখের তেজ যেনো জ্বলসে দিবে জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ যেনো মেঘনোলিয়ার চোখের বালি।কিন্তু জান্নাহ্ জানে না এর জন্য তার প্রানপ্রিয় স্বামীই দায়ী।
,
,
জান্নাহ্দের স্কুলের সামনে থামে একটা কালো গাড়ি।কিছুক্ষন পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসে এক সুদর্শন পুরুষ।কালো রঙের শার্টের উপর গাঢ় নীল রঙের ব্লেজার।চোখে কালো রঙের রোদচশমা।কালো হাতঘড়ি সাথে জুতো।দেখেই বুঝা যাচ্ছে কালো রঙ তার কতটা প্রিয়।

গাড়ি থেকে বের হয়েই দৃঢ় হয়ে দাঁড়ায় রাফাত।তার তেজস্বী অক্ষিযুগল বুলায় পুরো স্কুলে।উৎসুক স্কুলের শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে মেয়েরা একবার হলেও তাকাতে ভুললো না রাফাতের দিকে।রাফাত তার অধরে স্মিত হাসি ধরে রাখলো।বুকে হাত ভাঁজ করে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় রাফাত।রোদচশমার ভেতর দিয়েই মেয়েদের উদ্ভাসিত দুই চোখ এড়ালো না রাফাতের নজর থেকে।মুচকি হাসলো সে।একটু নিচু স্বরে গাঢ় গলায় বললো—

“আমি এসেছি।এইবার তোমাকে ফিরতেই হবে।আর কতো পালাবে তুমি!আমার শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকা তোমায় ছোঁয়ার অপেক্ষায়।আমার শ্বাসনালীর প্রতিটি নিঃশ্বাস তোমার জন্য ব্যাকুল।আমার শরীরে প্রতিটি অঙ্গ যে তৃষ্ণার্ত।তোমায় তাদের তৃষ্ণা মেটাতেই হবে জানেমান।তাদের তৃপ্ত না করে আমি তোমায় মরতেও দিবো না।”

চলবে,,,

(বিঃদ্রঃ
আজ মেঘোবতী কন্যা আসবে।ঠিক রাত আটটায়।আমার গ্রুপে।
হ্যাপি রিডিং)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here