#জান্নাহ্
#পর্বঃ২১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
ইহতিশাম বসে আছে তার ক্যাবিনে।সামনে থাকা ল্যাপটপে একটা ইমেল আসার কথা।টেবিলের উপর ফ্লাওয়ার ভাসে রাখা গোলাপের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে সে।রেড রোজ তার পছন্দ না।কিন্তু কেউ একজন আছে যার রেড রোজ দুর্বলতা আর সে ইহতিশামের।সেই মায়াবী মুখটাকে দেখে না হাজার দিবস পার হয়েছে।কিন্তু ইহতিশামের মনে হচ্ছে যেনো হাত বাড়ালেই তার রেশম কালো চুলে হাত গলাতে পারবে।ছুঁয়ে দিতে পারবে তার কমলার কোষার মতো ওষ্ঠাধর।চোখের সেই কাজল দিয়ে টিকা পড়িয়ে দিবে তার কানে।মৃদু হাস্যোজ্জ্বল গলায় বলবে–
“নজর না লাগে যেনো চাঁন্দেরও গায়।”
ইহতিশামের ব্ল্যাক রোজ আর হোয়াইট রোজ পছন্দ।ইহতিশাম মানব জীবনকে সাদা আর কালো রঙের সাথে তুলনা করে।ভালো তো সাদা আর খারাপ তো কালো।মানুষ তার পুরো জীবনে সাদাটাকেই চায়।কিন্তু তারা জানে না কালো আছে বলেই সাদা এতো প্রিয়।আঁধার আছে বলেই আলোর এতো মূল্য।দুঃখ আছে বলেই সুখের স্বর্ণকাঠি পেতে চায় সবাই।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইহতিশাম।স্বগতোক্তি করে বললো,,”আদৌ কী সারহান সেই কালো দিনের কথা ভুলতে পেরেছে।”নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাকে সাদায় পরিণত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেছে ইহতিশাম।কিন্তু সেই সুযোগ আর সারহান দেয় নি।ইহতিশাম জানে না এই জন্মে সে সত্যিই সারহানের সেই কালো অতীত কে সাদা তে রূপান্তর করতে পারবে কিনা!
নিজের ভাবনার অবসান ঘটায় সে।চোখে হাসে ইহতিশাম।প্রিয়তমাকে মনে করে ব্যথাতুর হয় তার মন।সামান্য ভুল বোঝাবুঝি জীবনের সবচেয়ে বড় মর্মান্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।তাতে মৃত্যু তো ঘটে না কিন্তু যন্ত্রণা হয় তারচেয়েও বেশী।
দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে বসে ইহতিশাম।কাঙ্ক্ষিত বার্তা পেয়ে গেছে।ইমেলটা প্রিন্ট আউট করে ইহতিশাম।সামিরার মোবাইল পাওয়া যায় নি।কিন্তু তার নাম্বার থেকে সকল ইনকামিং এবং আউটগোয়িং নাম্বারের লিস্ট পুলিশরাই বের করেছে।কিন্তু তাতে সাসপেশিয়াশ কিছু পায় নি।ইহতিশাম সামিরার এফ বি অ্যাকাউন্টের তেমন কিছু পায় নি।কিন্ত ইহতিশাম খুঁজছে অন্য কিছু।সামিরার মোবাইলে বিভিন্ন সময়ে আলাদা আলাদা নাম্বার থেকে কল এসেছে।কিন্তু তা ঢাকার নয়।বাইরের কোনো গ্রামের।পুলিশ গিয়েছিলো সেখানে।কিন্তু তেমন কিছুই করে উঠতে পারে নি।কারণ নাম্বারগুলো একটাও এক্টিভ ছিলো না।কিন্তু পুলিশ একটা জিনিস মিস করেছে।আর সেটাই ইহতিশাম করবে এইবার।হয়তো নাম্বারধারী ব্যক্তি এই খুনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে জড়িত।আবার তার ধারণা ভুলও হতে পারে।প্রিন্ট আউট করা কপিটি সযত্নে রাখে ইহতিশাম।ধীরপায়ে ক্যাবিনের পূর্ব পাশে যায় সে।তার জরুরি সব ফাইল সেখানে সারিবদ্ধ।ফাইলের তাক থেকে একটা ফাইল নিয়ে তার ভেতর থেকে একটা কয়েকমাস পুরোনো খবরের কাগজ বের করে।চকিতে জানালার দিকে তাকায় ইহতিশাম।দক্ষিনমুখী জানালা দিয়ে হুরহুর করে বাতাস ঢুকছে।পটপট করে উড়ছে শুভ্র পর্দা।ইহতিশাম নরম পায়ে জানালার পাশে গিয়ে ঠেস মেরে দাঁড়ায়।পর্দাটা হাত দিয়ে গুঁজে একপাশ করে দেয়।ফট করে বাইরের ঝলমলে আলো ক্যাবিনে প্রবেশ করে।ইহতিশাম চোখ বুজে নেয় আলোর অতর্কিত হামলায়।আবার ধীরেসুস্থে চোখের পাল্লা খুলে বাইরে তাকায়।আজকের বিকেল টা অদ্ভুত রকম সুন্দর।রোদের তাপটা আজ ম্রিয়মান।সূর্য যেনো আজ তার ক্রোধিত রূপ পাল্টে মিষ্টি হেসে দিনকে ধারণ করেছে তার বুকের মাঝে।চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকায় ইহতিশাম।কয়েকটা পাখি উড়ে যাচ্ছে।শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের ছড়াছড়ি।একটা ঠান্ডা বাতাস এসে চোখে লাগে ইহতিশামের।বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় ইহতিশাম।এই মিষ্টি বিকেলে তার প্রিয়তমা পাশে থাকলে বিকেলটা আরো মোহনীয় হয়ে উঠতো।মিচকি হাসে ইহতিশাম।কেসটা সলভ হলেই সে ফিরে যাবে তার সেই প্রিয় মানুষটির কাছে।
পর্দাটা ঠিক করে ভেতরে এসে বসে ইহতিশাম।পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে আশ্চর্য হলো না সে।তিথির খুনটাও একই পদ্ধতিতে।তবে একটা অমিল।তিথির শরীরটা মৃত অবস্থায় কাটা হলেও সামিরার দেহে তখনো প্রাণ ছিলো।কাটা দিয়ে উঠে ইহতিশামের শরীর।মানুষ আজকাল কতোটা ভয়ংকর হয়ে উঠছে।কিন্তু ইহতিশামের মনে একটা প্রশ্ন জাগে,”দুটো খুন ই একই উদ্দেশ্য করা নাকি দুটো খুনের খুনি একজন?
,
,
,
কয়েকটা কষে চড় বসিয়ে দিলেন অন্তরা জান্নাহ্ এর ফর্সা টলটলে গালে।কিঞ্চিৎ অশ্রু বিসর্জন দিয়ে চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলো সে।পাশে দাঁড়ানো জাবিন ক্ষীপ্ত কন্ঠে বলে উঠে–
“আরেকবার জান্নাহ্ এর গায়ে হাত দিবে না নানুমা।ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
অন্তরা খেটখেটে গলায় বললেন–
“যা এহান তে।বড়গো মুখে মুখে তর্ক।তোরে না কইছি এইসবে তুই নাক গলাবি না।এই মাইয়ারে আমি আইজই বিদায় করমু।রাখমু না ওরে।”
আওয়াজ করে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।ফোলা গালে হাত দিয়ে অানম্র গলায় বললো—
“আম্মা,আপনি ভুল বুঝছেন।স্যার শুধু বাবার কথা জিঙ্গেস করেছে..।”
অন্তরা দাঁতখামটি মেরে উঠলেন।জান্নাহ্কে বলার সুযোগ না দিয়ে বললেন–
“একদম মিছা কথা কবি না।এই কথায় এতো হাসার কী আছে!রাস্তায় খাড়াইয়া পরপুরুষের লগে এতো রঙ ঢঙ কেন?
জাবিন প্রদৃপ্ত গলায় বলে উঠে–
“জান্নাহ্ ঠিকই বলছে।স্যার নানাভাইয়ার কথাই জিঙ্গেস করেছে।”
অন্তরা খেকরি দিয়ে উঠে দারাজ গলায় বললেন–
“তুই যা এইহান তে জাবিন।”
জান্নাহ্কে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করলো অন্তরা।জমির কিছুতেই থামাতে পারছিলেন না।দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে ফোঁস ফোঁস করছে জাবিন।শরীরের শিরা যেনো ফেটে যাচ্ছে রাগে।কম্পন শুরু হয়েছে তার দেহে।হাত দিয়ে চিবুক আর ঠোঁটের উপরের ঘাম মুছে তীব্র ক্ষোভের সাথে।বিছানার কার্নিশে চোখ পড়তেই জমিরের মোবাইল দেখতে পায় জাবিন।অতি সন্তর্পনে তা নিয়ে সারহানের নাম্বারে ডায়াল করে সে।ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই তা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে গটগট করে রুম থেকে বের হয় জাবিন।
ক্ষুব্দ গলায় সেরাজকে শাসিয়ে যাচ্ছে শুভ্রা।রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাফাতের সাথে কথা বলার সময় সেই ছবি তুলে অন্তরার কানে বিষ ঢালে সেরাজ।গমগমে গলায় শুভ্রা বললো–
“পাগল হয়েছো তুমি?এইসব কেন করলে?সারহান যদি জানে তোমার জন্য মা জান্নাহ্ এর গায়ে হাত তুলেছে তাহলে তোমার কী অবস্থা করবে জানো!
সেরাজ দরজার অভিমুখে মুখ করে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে।শুভ্রার কোনো কথায় তার ভাবাবেশ হলো না।শুভ্রা আবারো রাগাম্বিত গলায় বললো–
“কথা বলছো না কেন?
সেরাজ শান্ত গলায় বললো–
“মিথ্যে কিছু বলিনি।”
শুভ্রা তেড়ে এসে বললো–
“সত্য মিথ্যার ফারাক তোমাকে করতে হবে না।সারহান জানলে কী হবে ভেবে দেখছো।দুধ থেকে যেমন মাছি উঠিয়ে ফেলে দেয় ঠিক সেইভাবে ফেলে দিবে তোমাকে।আর তুমি ভালো করেই জানো সারহান তা করার ক্ষমতা রাখে।”
সেরাজ দমদমে গলায় বললো–
“ভয় দেখাচ্ছো?
“নাহ,সতর্ক করছি তোমাকে।আর তুমি কী ভেবেছো!রাফাত তোমার ওই বোনকে বিয়ে করবে!রাফাত একজন ভবিতব্য ডাক্তার।কতো উচ্চ বংশ।আর তোমার বোন!
সেরাজ হিনহিনে গলায় বললো—
“বাজে কথা বলবে না।আমিও কম করিনি এই পরিবারের জন্য।এমনি এমনি তো আর তোমার বাবা আমাকে এই বাড়ির জামাই করেনি।”
শুভ্রা চাপা কন্ঠে বললো–
“সময় থাকতে সাবধান।তোমাকে এইসব ঝামেলায় জড়াতে হবে না।সারহান ক্ষেপা নেকড়ে।ওর রাগ সম্পর্কে তুমি যা জানো তা অনেক কম।নিজের আত্নসম্মানে লাগবে এমন কিছু কোনোদিনও ও সহ্য করবে না।সব গুঁড়িয়ে দিবে।
হাতি মরলেও লাখ টাকা বাঁচলেও লাখ টাকা।”
সেরাজ উদ্ভাসিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।শুভ্রার কোনো কথাই তার মস্তিষ্ক আলোড়িত করতে পারলো না।
চলবে,,,