জান্নাহ্ “পর্বঃ৩৫

0
3796

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৩৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

এলোথেলো বাতাস বইছে।তাতেও রাজ্যের উষ্ণতা।প্রকান্ড টিনের নিচে ঝুলানো ফ্যানের বাতাস যেনো প্রভাকরের রশ্মি টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছে।দ্রুতগতিতে ফ্যান ঘুরলেও তার বাতাসে শীতলতার চেয়ে উষ্ণতাই বেশি।

চৈত্রের শেষ হয়ে বৈশাখের শুরু।গুমোট গরমে হাঁসফাঁস করা জনজীবন।একটু প্রশান্তির জন্য বৈদ্যুতিক ঘূর্ণায়মান যন্ত্রের নিচে বসে আরামের জন্য।তা কি সূর্য্যি মামার সয়!গনগনে লাভায় যেনো ধরণী রুদ্ধশ্বাস।

বিছানায় শুয়ে আছে হুসনা।তাকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে জান্নাহ্।খাওয়া শেষে টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছে দেয়।ক্লান্ত গলায় জান্নাহ্ বললো–

“আজ আমি চলে যাবো মামি।”

হুসনার কিছু বলার ক্ষমতা নেই।তার চোখ দুটোই তার সহায়।চোখের পাতা উঠানামা করে তার ব্যগ্রতা বোঝালেন।ফিক করে হেসে ফেললো জান্নাহ্।আনন্দিত গলায় বললো–

“যেতেই হবে।দুদিন পর থেকে পরীক্ষা।পরীক্ষায় আন্ডা পেলে সারহান খুব রাগ করবে।”

হুসনা তার চোখ দিয়ে আবার কিছু বোঝাতে চাইলেন।জান্নাহ্ তাচ্ছিল্যের সুরে বললো—

“রিসিভ করিনি তো।কেন করবো?সে যদি আমাকে ভুলে থাকতে পারে আমি কেন পারবো না!সে থাক তার কাজ নিয়ে।তোমার এইসব ভাবতে হবে না।আমি সামলে নিবো।”

হুসনা অনেক কষ্টে গলায় অস্ফুট আওয়াজ তুললো।চোখের পাল্লা নাড়াতে থাকলো।জান্নাহ্ সরব গলায় বললো–

“হুম,হুম।আপু কালই আসবে।এইবার আপু আসলে ধরে বিয়ে দিয়ে দিবো।আর তোমাকেও ইটালি পাঠাবো।তোমার মনে আছে বাবার বন্ধু সম্রাট আঙ্কেলের কথা!আমি কথা বলেছি তার সাথে।সে সব ব্যবস্থা করে দিবে।তুমি একদম সুস্থ হয়ে যাবে।”

চোখ দিয়ে খুশির অশ্রু নির্গত করলেন হুসনা।জান্নাহ্কে দেখলেই তার সমস্ত কষ্ট যেনো খুশিতে পরিণত হয়।সে না হয় তার জীবন কাটিয়ে ফেলেছে।কিন্তু সেদিন যদি জান্নাহ্ এর সাথে কিছু হতো!
মোড়ার উপর বসা থেকে হালকা উঁচু হয় জান্নাহ্।দুই হাত আলতো করে হুসনার চোখের পানি মুছিয়ে কপট অভিমানি গলায় বললো—

“কাঁদছো কেন তুমি?একদম কাঁদবে না।কাঁদলে তোমাকে একদম ভালো দেখায় না।”

ঝকঝকে হাসে জান্নাহ্।হুসনার কানের কাছে গিয়ে নরম সুরে বললো—

“পরীক্ষা শেষ হলে আবার আসবো।আর সাথে গুড নিউজ নিয়ে আসবো।”

চমৎকার হাসে জান্নাহ্।হুসনার আগ্রহদীপ্ত চোখ দুটি যেনো চকচক করে হাসছে।পাশে দাঁড়ানো মহিলার দিকে তাকায় জান্নাহ্।শুক্তাকে রেখেছে হুসনার দেখাশোনা করার জন্য।তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেয় জান্নাহ্।সরস হেসে শুক্তা বললো–

“টাকা লাগবো না আফা।চাচা আমারে বেতন দিয়া দিছি।”

জান্নাহ্ স্মিত হেসে বললো–

“এগুলো বেতন না।তোমার বোনাস।আমি দিলাম।মামিকে এতো যত্ন করে রাখার জন্য।আজ আমি চলে যাচ্ছি।মামির খেয়াল রেখো।তোমার কিছু দরকার হলে মামাকে বলো।”

শুক্তা উচ্ছল হাসলো।প্রসন্ন গলায় বললো–

“আফনে যদি আমার ছোডো না হইতেন তাইলে আমনেরে সালাম করতাম।আফনে টাকা না দিলে আমার মায় তো মইরাই যাইতো।”

জান্নাহ্ গাঢ় গলায় বললো–

“তুমি আমার মায়ের খেয়াল রাখছো তাই আমি তোমার মায়ের খেয়াল রেখেছি।শোধবোধ।এই নিয়ে আর কোনো কথা হবে না।”

ঝকঝক করে হেসে উঠে শুক্তা।জান্নাহ্ তার মামির কপালে আলতো চুমু খায়।তার নিথর পা দুটো তে সালাম করে বিদায় নেয়।

,
,
,
দু’ধারে লম্বা লম্বা গাছ।সড়ক পথে ঝড়ো গতিতে চলছে গাড়ি।জানালা দিয়ে আসা ফুরফুরে বাতাসে শ্রীজার সিল্কি চুলগুলো উড়ছে।গাজীপুরে একটা কাজ আছে।সেই সূত্রে শ্রীজাকে জরুরি ভিত্তিতে যেতে হচ্ছে।তাই দেরি না করে শায়িখকে নিয়েই বের হয়।

স্বাভাবিক গতিতে চলছে শ্রীজার গাড়ি।হাতে থাকা জরুরি কাগজগুলো ভালো করে চেক করে নিচ্ছে যেনো কোনো ঝামেলা না হয়।গলাটা শুকিয়ে আসে শ্রীজার।খুসখুসে কাঁশি হতেই গলাটা কেমন জড়িয়ে আসে।শায়িখ সামনের সিটে থাকা পানির বোতলটা শ্রীজাকে এগিয়ে দেয়।খরা জমিনে বর্ষণের মতো ঝরলো তা।ঢকঢক করে পানি গিলে একটা বড় নিঃশ্বাসে নেয় শ্রীজা।মুহূর্তেই গা গুলিয়ে উঠে তার।মুখে হাত চেপে ধরে উ উ শব্দ করে গাড়ি থামাতে বলে শায়িখকে।শায়িখ গাড়িটাকে সাইডে চাপিয়ে ব্রেক লাগায়।দমদমিয়ে গাড়ি থেকে বের হয় শ্রীজা।মুখভর্তি বমি করে।ফোঁস ফোঁস করে দম ফেলছে।দাঁতখামটি মেরে পেছনে তাকিয়ে বললো—-

“শায়িখ,পানিতে কী মিশিয়েছো?

শায়িখের উত্তর শ্রীজার কানে পৌঁছানোর আগেই একটা মিষ্টি মেয়েলী সুর শুনতে পায় শ্রীজা।

“শ্রীজা।”

চকিতে পেছন ফিরে তাকায় শ্রীজা।কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই ধারালো কিছু একটা স্ষ করে চলে যায় শ্রীজার গলা ছুঁইয়ে।দুই হাতে গলা চেপে ধরে ছোট ছোট ঘাসের উপর বসে পড়ে সে।রাস্তার পাশে স্বল্পদৈর্ঘ্য জঙ্গল।বিকলে নেমেছে দিবসে।সূর্য্যটা হেলে পড়েছে পশ্চিমে।কমলা রঙের আভায় ছেয়েছে আকাশ।নীলাভ আকাশ কালচে নীলাভে রূপ নিয়েছে।তাতেই বেশ স্পষ্ট করে মেয়েটিকে দেখছে শ্রীজা।

শ্রীজার দুই উদ্ভাসিত নজর সামনের সেই নীল চোখের মেয়েটির দিকে।চোখের পাতা ভিজে উপচে পড়ছে আর্তনাদের পানি ।শ্রীজার মুখ দিয়ে গরগর শব্দ বের হচ্ছে।গলার মাঝ বরাবর সে বিভক্ত জায়গাটা হাত দিয়ে চেপে ধরেছে সে।সেখান থেকে গলগলিয়ে বের হচ্ছে উষ্ণ,ঘন,নোনতা তরল।গলার দুই পাশের ব্যাকবোনের সন্ধিস্থলের জায়গাটুকু একবার দেবে যাচ্ছে তো আরেকবার ফেঁপে উঠছে।তার শ্বাস ধীরে ধীরে তার গতি কমিয়ে ভারি হয়ে যাচ্ছে।

সামনে হাঁটু ভাঁজ মেয়েটি নিরুত্তাপ চোখে শ্রীজাকে দেখছে।তার অধরে হিংস্রতার তাচ্ছিল্য হাসি।শ্রীজার নিঃশ্বাস ক্ষীন হতে থাকে।মেয়েটির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা হুডি পড়া লোকটির বৃদ্ধা আঙুল সমানতালে কেঁপে যাচ্ছে।মৃত্যুর সাথে লড়াই করে কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই শ্রীজার আত্না তার দেহ ত্যাগ করে।মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়।কোমর পর্যন্ত ছড়ানো খোলা চুল,ভেতরে স্লিভলেস গেঞ্জি তার উপরে ফুল স্লিভের কালো জ্যাকেট।বুক পর্যন্ত জ্যাকেটের জীপার আনলক করা।একটা ব্রাশ জিন্স।উঁচু হাই হিল পড়া।
হাতের রক্ত মাখানো ছুরিটা ভাবলেশহীন ভাবে শ্রীজার নিথর দেহের উপর ছুঁড়ে ফেলে।

ফোঁস করে এক দম ফেলে মেয়েটি।চোখ দিয়ে পানি পড়ার আগেই দৃঢ়চিত্তে তা মুছে নেয়।সামনে এগোতে থাকে মেয়েটি।তার হাই হিলেও কোনোরূপ ছন্দপতন হলো না।ভেজা চোখ থেকে লেন্সগুলো খুলে রাস্তার উপর ছুঁড়ে ফেলে।গাড়িতে গিয়ে বসে মেয়েটি।ড্রাইভিং সিটে বসা অতি পরিচিত মানুষটি ফ্রন্ট গ্লাসে তাকাতেই মেয়েটির গম্ভীর মুখটি দেখতে পায়।মৃদুহাস্য অধরে তৃপ্তির চাহনিতে তাকায় মেয়েটির দিকে শায়িখ।

হুডিওয়ালা লোকটি শ্রীজার প্রাণহীন দেহটিকে জঙ্গলের একটু ভেতরের দিকে নিয়ে গেলো।তার ফর্সা মুখের উপর সামান্য এলকোহল ছিটিয়ে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।মানুষের মাংস পোড়ার অদ্ভুত,বিদঘুটে গন্ধটা এসে নাকে ঠেকে মেয়েটির।তার চোয়াল শক্ত হয়।শায়িখ নরম চোখে তাকিয়ে গাড়ির স্টেয়ারিংএ হাত দেয়।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here