জান্নাহ্ “পর্বঃ৬১

0
3144

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৬১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

বাংলোর বাগানে বসে আছে জান্নাহ্ আর সারহান।ম্রিয়মান সূর্যের আলোই আকাশ ধীরে ধীরে ধূসরের রঙে রাঙিয়ে যাচ্ছে।গাছপালায় আচ্ছাদিত বাগানের ভূমি নরম ঘাসে পরিপূর্ণ।বাতাসে ভেসে আসছে পাকা কাঁঠালের মিষ্টি ঘ্রাণ।এলোমেলো নাতিশীতোষ্ণ বাতাস।হালকা বাতাসেই দোদুল্যমান গাছের পত্রপল্লব।

জান্নাহ্ প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো সারহানের দিকে।আচমকাই মৃদু শীতল হাওয়া বইতে লাগলো।আমগাছটায় হঠাৎ করেই কাঠুরে পাখি ডেকে উঠলো।বিকেলের ম্রিয়মান রশ্মি পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে গলিয়ে পড়ছে।
সেই শীতল বাতাসেই নড়ে উঠে জাম গাছটার সদ্য কচি পাতা।নরম সবুজ ঘাসের উপর ঝড়ে পড়া শুকনো পাতা লেগে আছে সারহানের এলোথেলো চুলে।জান্নাহ্ আলতো হাতে তা সরিয়ে দেয়।শুষ্ক গলায় বললো—

“সারহান,একটা কথা বলবো?

সারহান নির্বিকার গলায় উত্তর করে—

“বলুন।”

“আপনি আমাকে রজনীগন্ধা কেন ডাকেন?

দুর্বোধ্য হাসে সারহান।মুগ্ধ গলায় বললো–

“কারণ আপনি আমার জীবনের সবচেয়ে সুবাসিত ফুল।আমার দুর্গন্ধ যুক্ত কলুষিত জীবন আপনার সুবাসে সুবাসিত করেছেন।”

জান্নাহ্ ধীম গলায় বললো—

“মানুষ কখনো ফুল হয়?

সারহান ঝলমলে হাসে।ফিচেল গলায় বললো—

“হয়তো।যেমন আপনি।আপনার ঘ্রাণ রজনীগন্ধার মতো।যেদিন আমি আপনাকে প্রথম দেখতে গিয়েছিলাম বিশ্বাস করুন,আপনার শরীরের সেই ঘ্রাণে আমারতো পুরো অবস্থাই খারাপ হয়ে গেছিলো।ভাগ্যিস আপনার মামা দুই দিনের মধ্যে আমাদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো।নাহলে আমার অবস্থা….।”

সারহানের কথা শেষ হওয়ার আগেই জান্নাহ্ অধৈর্য হয়ে সারহানের গলা চেপে ধরতেই ঘাসের উপর ঢলে পড়ে সারহান।তার উপর উপুর হয়ে তার গলা ধরে রেখেছে জান্নাহ্।অসহিষ্ণু গলায় বললো—

“অসভ্য লোক!

ফুরফুরে হাসে সারহান।সংক্ষিপ্ত সুরে বললো—

“আরে,আরে রজনীগন্ধা!কী করছেন?মরে যাবো তো!

“মেরে ফেলবো আপনাকে।”

সারহান গলা থেকে জান্নাহ্ এর হাত সরাতেই জান্নাহ্ পুরোদস্তুর ঝুঁকে পড়ে সারহানের উপর।জান্নাহ্ এর অধর গিয়ে ঠেকে সারহানের গলায়।নরম গলায় সারহান বললো—

“আমাকে মারতে পারবেন আপনি?

জান্নাহ্ মেকি হিংস্রতা দেখিয়ে বললো–

“পারবো,পারবো।”

“তাই না!

জান্নাহ্কে কিছু বোঝার সময় না দিয়ে তাকে নিচে শুইয়ে তার উপর নিজেকে ছেড়ে দেয়ে সারহান।নেশার্ত চোখে তাকিয়ে আছে সারহান।নিরাক পরিবেশে পবনের আন্দোলন শুরু হয়।তাদের ওপরে থাকা কদম গাছটায় কদমের মুকুল দেখা যাচ্ছে।সারহানের নেশাভরা চাহনি ফাঁকি দিয়ে জান্নাহ্ সেদিকেই তাকায়।মোহিত সারহান একের পর এক চুমু খেতে থাকে জান্নাহ্ এর ললাট,চোখ,কপোল আর গলাতে।জান্নাহ্ এর শ্বাস ভারি হতে থাকে।হালকা বাতাসে উড়ছে সারহানের এলোথেলো চুল।জান্নাহ্ ভ্যালভ্যাল দৃষ্টিতে সারহানের কর্মকান্ড দেখে।তার পুরুষালী স্পর্শের অদ্ভুত মাদকতায় ক্রমশ আচ্ছন্ন হতে থাকে জান্নাহ্।সলজ্জ চোখ দুটো আদুরে মায়ায় বুজে নেয়।জান্নাহ্ চকিত হয়ে তার অধরে ভেজা স্পর্শে।সারহানের অধরের গভীরতায় ধীরে ধীরে বিবশ হয়ে আসছে জান্নাহ্।তার চোখে মুখে সারহানের উষ্ণ নিঃশ্বাসের ছন্দপতন হতে লাগলো।

আচমকা সারহানের বুকে ধাক্কা মারে জান্নাহ্।সারহান হেলে পড়ে ঘাসের উপর।স্মিতহাস্য অধরে তাকায় জান্নাহ্ এর দিকে।জান্নাহ্ ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললো–

“সরুন এখান থেকে।দম বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার।”

সারহান ফচকে হাসে।আকাশে মেঘের ঘনঘটা শুরু হয়।কালো মেঘ জমাট বাঁধতে শুরু করে।বাতাসের তোড় বাড়তে থাকে সাথে শীতল পরশ।আশেপাশের শুকনো পাতা এসে পড়ে তাদের গায়ে।জান্নাহ্ ব্যস্ততা নিয়ে বললো—

“ঘরে চলুন বৃষ্টি আসবে।”

সারহান মৃদু গলায় বললো—

“আপনি যান আমি আসছি।”

জান্নাহ্ চোখ রাঙিয়ে বললো—

“একদম ভিজবেন না আপনি।”

সারহান চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেয়।চঞ্চল পায়ে ক্যাচিগেট খুলে ঘরে ঢুকে জান্নাহ।এখান থেকে সরাসরি তাদের বেডরুমে যাওয়া যায়।
আকাশ ধীরে ধীরে কালো হতে থাকে।সারহান ঘাসের উপর গা এলিয়ে দেয়।মাথার নিচে দুই হাত দিয়ে ওই মেঘভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ করে।তার জীবনটা এমন না হলেও পারতো!ওই রৌদ্রজ্জ্বল নির্মেঘ আকাশের মতো হলেও পারতো!ঝলমলে স্বচ্ছ আকাশের চাঁদ হয়ে তার রজধীগন্ধা থাকলেও পারতো!তবে কেন তার জীবনটা আঁধার ঘেরা আকাশ হয়ে গেলো?

,
,
,
তটস্থ হয়ে পায়চারী করছে রাফাত।কল করতে করতে ক্লান্ত সে।কোনোভাবেই জান্নাহ্ এর সাথে কন্টাক্ট করা যাচ্ছে না।রাগে দপদপ করছে তার মস্তিষ্কের শিরা।রাফাতের মা রিতা ছেলের এই অগোছালো ভাবগাম্বীর্যে বিরক্ত।রিতা তপ্ত গলায় বললেন—

“রাফাত,এইবার তোমার নিজেকে নিয়ে ভাবা উচিত।”

উন্মনা রাফাত শুনেও শুনলো না যেনো।সে ব্যস্ত তার কাজে।রিতা দৃঢ় গলায় ক্ষেপে বললেন—

“রাফাত!
কিছু বলছি তোমাকে আমি।”

রাফাতের কর্ণগোচর হতেই প্রত্যুত্তর করে সে—

“আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোমার।আমি ঠিক আছি।”

রিতা খলবলিয়ে বললেন—

“ঠিক নেই তুমি।ধূ ধূ মরুভূমির বুকে মরিচিকার পেছনে ছুটছিলে তুমি।কিন্তু আমি আশ্চর্য !যখন বুঝতেই পারছো এইটা কোনো তপ্ত মরুর বুকে শীতল জলের ফোয়ারা নয় বরং চোরাবালি।তাহলে কেনো ছুটে চলছো তুমি!হোয়াই রাফাত?

রাফাতের চোখে মুখে আগুন জ্বলে উঠে।কন্ঠের গাঢ়তা বাড়িয়ে নিমিষেই আগুনের ফুলকির মতো বিক্ষিপ্ত হয়ে বললো—

“বিকজ আই লাভ হার।ছাড়তে পারবো ওকে আমি ওই থার্ড ক্লাস বাস্টার্ডের সাথে।ও জান্নাহ্ এর যোগ্য নয়।শেষ করে দিবে ও আমার জান্নাহ্কে।আই সয়ের,আমার জান্নাহ্ এর যদি কিছু হয় ছাড়বো না ওকে আমি।”

ফোঁস ফোঁস করতে থাকে রাফাত।বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঝলকে উঠতে লাগলো রাফাতের শান্ত দেহ।শান্ত,সুধীর রাফাত মুহূর্তেই যেনো তার হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলো।রিতা আকাশসম বিস্ময় নিয়ে অতলান্তিক মায়ায় চেয়ে রইলেন।এ কোন রাফাতকে আবিষ্কার করলেন তিনি!

দমদমে পা ফেলে বেরিয়ে যেতেই রিতা প্রশ্ন করে—

“কোথায় যাচ্ছো তুমি?

রাফাত ভারি গলায় দৃঢ় হয় বললো—

“ইহতিশামের কাছে।ও নিশ্চয়ই জানবে জান্নাহ্ কোথায় আছে।”

,
,
,
নিশুতি রাতের মায়ায় মোহাচ্ছন্ন পরিবেশ।নিকষ কালো আকাশে উঁকি দিচ্ছে এক ফালি চাঁদ।ঝিমঝিম করে ঝরছে শ্রাবণের ধারা।উষ্ণ আবহাওয়া হাওয়ায় মিলিয়ে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে শীতল হাওয়া।চারদিকে ঝুমঝুম বৃষ্টির ছন্দে মুখরিত কালো আঁধার।

আধভেজা হয়ে ঘরে ঢোকে সারহান।মাথার চুল আর শরীরের আধ অংশ ভিজে আছে।কোনো রকমে নিজেকে সামলে লম্বা লম্বা পা ফেলে বেডরুমে চলে যায়।জানালার পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জান্নাহ্।ভেজা লেপ্টানো শার্টের বোতাম আনলক করতে করতে চোখ পড়ে জান্নাহ্ এর দিকে।বদ্ধদৃষ্টিতে জান্নাহ্ তাকিয়ে আছে জানালার ফাঁক গলিয়ে।রিনিঝিনি বৃষ্টিতে এতোটা আচ্ছন্ন জান্নাহ্ টের পায়নি সারহানের উপস্থিতি।দু’চোখের অক্ষিপুট মেলে সরব দৃষ্টি জান্নাহ্ এর যেনো এক বিন্দু বৃষ্টিও তার দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে ভূমি না ছুঁইয়ে ফেলে।বাংলোর পেছনের দিকের রুমদুটোর বারান্দায় টিনের চাল বিছানো। যাতে করে সেখানে দাঁড়িয়ে গ্রামের মতো টিনের চালের উপর পড়ন্ত সেই বৃষ্টির মাদকছন্দ স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যায়।এখান থেকে তা শোনা যায় না।এখান থেকে দেখা যায় বাংলো পেছন দিকের গাছপালা।শিরশির করে জানালা দিয়ে পবনের আন্দোলন শুরু হয়েছে।জান্নাহ্ এর চোখে মুখে অদ্ভুত মোহ।ডান হাতের তর্জনী দিয়ের গ্রীল ঘঁষে তার শীতল জল এনে অধর অবগাহন করায়।একটা দমকা হাওয়া আসতেই ঘাড় ঘুরায় জান্নাহ্।চকিতে দেখে তাকে নিবিড়ভাবে দেখছে সারহান।জান্নাহ্ প্রসন্ন হাসে।চোখে একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে এগিয়ে আসে সারহানের দিকে।খুশি খুশি গলায় বললো—-

“কোথায় ছিলেন?

সারহান চোখে হেসে নরম গলায় বললো—

“কাজ ছিলো।”

জান্নাহ্ গভীর চাহনিতে আবদ্ধ করে সারহানকে।খুসখুসে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে–

“ভিজলেন কেন আপনি?

সারহান অধর কোনে আলতো হেসে মোলায়েম গলায় বললো—

“ইচ্ছে করে ভিজিনি রজনীগন্ধা।”

জান্নাহ্ মেকি রাগ দেখিয়ে বললো—

“আজকাল অনিচ্ছায়ও ভিজতে হয় আপনার!

সারহান দীপ্ত হাসে।জিঙ্গাসু গলায় বললো—

“খেয়েছেন?

জান্নাহ্ ক্ষীন গলায় বললো—

“হুম।”

তাহলে জেগে আছেন কেন?শুয়ে পড়ুন।”

হাতে থাকা ধূসর রঙের ফাইলটা টেবলের উপর রাখে সারহান।ভারি তোয়ালেটা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়ে বললো—

“আমার লেট হবে।আপনি শুয়ে পড়ুন।”

জান্নাহ্ হালকা হাতে কৌতূহল নিয়ে ফাইলটা খুলে দেখে ব্যগ্র গলায় বলে উঠে—

“আপনি তো জব ছেড়ে দিয়েছেন।তাহলে এইগুলো কী?

সারহান ওয়াশরুম থেকে গলা ছড়িয়ে বললো—-

“জব ছেড়েছি। কাজ তো ভুলে যাই নি।”

ফোঁস করে দম ছাড়লো জান্নাহ্।লোকটা মাঝে মাঝে আজব কথা বলে।ফাইলটাতে কিছুক্ষন চোখ বুলায় জান্নাহ্।আন্ডারওয়ার্ল্ডের কতিপয় ড্রাগস ড্রিলারদের ইনফরমেশন আছে তাতে।

রাত জেগে তার একটা সুবিন্যস্ত অ্যাসাইমেন্ট তৈরি করলো সারহান।বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষন।এখনো তার রেশ রয়ে গেছে।বাতাসের শীতলতা জানান দিচ্ছে নতুন বর্ষণের পরশ।বেডরুমে আসতেই দেখে নীল রঙের ডিম লাইট জ্বলছে সগৌরবে।জান্নাহ্ গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।হালকা ঠান্ডা হওয়ায় গায়ে পাতল চাদর টেনে নিয়েছে।নিঃশব্দে বিছানার কাছ ঘেঁষে হাঁটু ভাঁজ করে বসে সারহান।জান্নাহ্ এর ভারি নিঃশ্বাসের শব্দে আলতো হাসে সারহান।তার শুকনো অধর ছোঁয়ায় জান্নাহ্ এর কপালে।ক্রমান্বয়ে চোখ,গাল,চিবুকে।অত্যল্প নড়ে উঠে জান্নাহ্।সারহানের চোখে ঘোর লাগে।মৃদু কম্পনে জাগ্রত হয় তার পৌরষীয় কামনা।জান্নাহ্ এর পদ্মকোমল ওষ্ঠাধরে গভীর চুমু খায়।সারহানের উষ্ণ শ্বাস আর আর্দ্র স্পর্শে চোখের পল্লব মেলে তাকায় জান্নাহ্।ঘুম জড়ানো চোখে বলল—

“কাজ শেষ আপনার?

সারহান ছোট্ট করে বললো–

“আপাতত।”

অধরের কোন প্রসারিত করে জান্নাহ্।তার উপর ঝুঁকে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে সারহান বললো—

“ম্যায় আই?

প্রশ্রয়ের হাসি হাসে জান্নাহ্।সারহান হৃদয়গ্রাহী হেসে তার অধর ডোবায় জান্নাহ্ এর গলায়।

বাইরে আবারো ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছ।খসে যাওয়া তারা যেনো মিলিয়ে গিয়েছে নিকষকৃষ্ণ আকাশে।আমগাছের সরু পাতা বেয়ে টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়ছে পানি।চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর সাথে বৃষ্টির হিমেল পরশে প্রকৃতি যেনো মন মাতানো নৃত্য করছে।মেলে ধরেছে নিজেকে।

জান্নাহ্কে নিজের বক্ষপিঞ্জিরায় আবদ্ধ করে সারহান।প্রগাঢ় মায়ায় তার বুকে আদুরে বিড়ালের মতো ঘাপটি মেরে নিজেকে সপে দেয় জান্নাহ্।একে অপরের ভালোবাসায় বর্ষণস্নাত রাতে অবগাহনে ব্যস্ত হয় প্রেমেমগ্ন দুই নর-নারী।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here