#জান্নাহ্
#পর্বঃ৬৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
চারপাশে মৃদুমন্দ হিমেল বাতাসে আজকের বিকেলটা অন্য বিকেল থেকে আলাদা।জৈষ্ঠ্য মাসের প্রভাকরের প্রখর রশ্মি জানান দেয় এইতো মধু মাস।
বাগানের দোলনায় বসে আছে সারহান।নিরুঙ্কুশ ভেবে চলা অতীত হাতড়ে খুঁজে চলছে বর্তমানের ছোঁয়া।মোবাইলের রিং অনবরত বেজে যাচ্ছে।অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিসিভ করলো সারহান।মোলায়েম গলায় প্রশ্ন করলো—
“কেমন আছো শায়িখ?
এপাশ থেকে শীতল শ্বাস ফেললো শায়িখ।নির্মল গলায় প্রত্যুক্তি করে বললো—
“ভালো আছি স্যার।আপনি কেমন আছেন?
সারহান হেয়ালি গলায় হতাশ শ্বাস ফেলে বললো—
“ভালো।কী মনে করে কল করলে?
শায়িখ চুপ করে রইলো।আচমকা বলে উঠে—
“ভাবীজান কেমন আছেন?
স্বশব্দে হেসে উঠে সারহান।অনেকটা অবিশ্বাস নিয়ে বললো—
“ধোঁকা দেওয়ার জন্য তুমিই বাকি ছিলে।”
মুহূর্তেই ধক করে উঠে শায়িখের হৃদয়টা।নিভে গেলো তার গলার ক্ষীন স্বর।আমতা আমতা করে আধ ভাঙা গলায় বললো—
“আমিইইইই….।”
মলিন হাসলো সারহান।বাঁধাহীন সুরে বললো—
“জান্নাহ্কে তুমি থামাতে পারতে ইচ্ছে করলে।”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো শায়িখ।তার বুকটা ভার হয়ে এলো অপরাধবোধে।অনুযোগের সুরে বললো—
“আমি আসলে স্যার….।”
“জান্নাহ্ তোমাকে ভাই বলে ডেকেছে।অন্তত সেই কারণেই তাকে থামাতে পারতে।আমার অন্যায়ের শাস্তি সে কেন পাবে!
ত্রস্ত গলায় বলে উঠে শায়িখ—
“বিশ্বাস করুন স্যার,জান্নাহ্ তেমন মেয়েই নয়।কী থেকে কী হয়ে গেলো।আমি…।”
সারহান একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বললো—
“তোমার মা কেমন আছে?
শায়িখ ক্ষণকাল চুপ থেকে শঙ্কামুক্ত হয়ে বললো—
“মা ভালো আছে স্যার।জান্নাহ্ কেমন আছে?
অধর কোণে হাসলো সারহান।তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক তার সাথে থেকেই এতবড় একটা খেলা খেললো তার কিছুই সে বুঝতে পারলো না।সাবলীল গলায় বললো—
“জান্নাহ্ ভালো আছে।”
স্বস্তির শ্বাস নিলো শায়িখ।মৃদু হাসলো সারহান।শায়িখ ব্যগ্র হয়ে আবার প্রশ্ন করে—-
“আপনি কেন নিজেকে আড়াল করেছেন স্যার?
সারহান শঙ্কিত গলায় বললো—
“আমার অতীত যে আমায় ছাড়ছে না শায়িখ।”
“কিন্তু স্যার,জান্নাহ্ তো সব জানে।আপনাকে কিছু লুকাতে হবে না।”
নিজের জীবনের উপর বিদ্রুপাত্মক হাসলো সারহান।থমথমে গলায় বললো—
“এখনো সব জানা হয়নি শায়িখ।জানি না আমার সেই অতীত আদৌ আমার রজনীগন্ধা মেনে নিবে কিনা!
শায়িখ অবগত নয় সেই মেহনাজ সম্পর্কে।হয়তো শায়িখ জানলে অনেক আগেই জান্নাহ্ এর সামনে চলে আসতো এই সত্য।চট করেই অদ্ভুত কথা বলে ফেললো শায়িখ—-
“এই জন্য আপনি জান্নাহ্কে সবার কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছেন?
নিজের কথায় নিজের জীভ কাটে শায়িখ।বৃহৎ ঢোক গিলে মিনমিনে গলায় আবার বললো—
“আসলে স্যাআআর,…..।”
অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললো সারহান—
“ঠিক বলেছো তুমি।তাকে আমি কোনো কিছুর বিনিময়ে হারাতে পারবো না।”
দুই পাশে নিরবতার বাতাস বইতে লাগলো।মৌনতা কাটিয়ে শায়িখ বললো—
“ইহতিশাম স্যার পাগর হয়ে খুঁজছে আপনাকে।আমাকেও বার কয়েক আপনার কথা জিঙ্গেস করেছিলো।আমি বলেছি আপনার সাথে আমার কন্টাক্ট নেই।”
স্মিত হাসলো সারহান।খসখসে গলায় বললো—
“তোমার কী মনে হয় ইহতিশাম আদৌ তোমার কথা বিশ্বাস করেছে?
খলখল করে হেসে উঠে শায়িখ।রসালো গলায় বললো—
“আমি আপনার একমাত্র অনুজ্ঞাবহ সহচর স্যার।এতো বোকা নই আমি।রাফাত গত দুই মাস ধরে আমাকে চুষে খাচ্ছে শুধু আপনার ঠিকানা জানার জন্য।”
“তো এখন কী করবে তুমি?
“এই মাত্র সিমটা অন করলাম।কথা শেষ করে এই যে হাতির ঝিল দাঁড়িয়ে আছি।সিমটা ডেসট্রয় করে এখানেই ফেলে দিবো।”
ম্লান হাসে সারহান।মখমলে গলায় বললো—
“রাফাত ছেলেটা কিন্তু খারাপ না।”
“অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ স্যার।সেদিন আমার কলার চেপে ধরলো।ইচ্ছে করছিলি ওর নাকটা ফাটিয়ে ওকে ওর বাবার পেশেন্ট বানাই।ছেড়ে দিলাম শুধু জান্নাহ্ এর জন্য।”
সরস গলায় বললো সারহান—
“রাফাতের চিন্তা কারণবিহীন নয়।আমার মতো একজনের সাথে সে তার ভালোবাসার মানুষকে কল্পনা করতে পারছে না।আর তা হওয়ারই কথা।আমি ভালো লোক নই শায়িখ।”
শায়িখ মুখ বিকৃত করে তীর্যক গলায় বললো—
“কিন্তু জান্নাহ্ তো আপনাকে ভালোবাসে।রাফাত এমন কোন দুধে ধোওয়া পুরুষ নয় যে জান্নাহ্কে তার ভালোবাসতে হবে।দীর্ঘ বারো বছরেরও যখন আম খেয়ে আঁটি গুনতে পারলো না ওই ছেলের কোনো অধিকার নেই জান্নাহ্ এর পেছনে আঠার মতো লেগে থাকার।”
সারহান নির্লিপ্ত হাসে।শায়িখ আগ্রহী হয়ে বললো—
“একটা কথা বলবো স্যার?
“হুম।”
“আমার মনে হয় আপনার জান্নাহ্কে সব বলে দেওয়া উচিত।ও যেহেতু সব মেনে নিয়েছে ও নিশ্চয়ই আপনাকে বুঝবে।আর আমার বিশ্বাস আমার স্যার জেনে বুঝে কখনো কোনো ভুল করবে না।”
সারহান দীপ্ত গলায় বলে উঠে—-
“মানুষ মাত্রই ভুল শায়িখ।এখনো সময় হয়নি তার সবটা জানার।জানোতো ক্ষুধার্ত পুরুষ বাঘ নিজের সন্তান কে ভক্ষন করতেও দ্বিধা করে না।।রাখছি আমি।বাই।”
,
,
,
মুখভর্তি বমি করতেই শ্বাসে টান পড়ে জান্নাহ্ এর।অধর চেপে ধরে বার কয়েক বদ্ধ শ্বাস টেনে চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে তাকায়।আজকাল কিছু মুখে দিলেই এমনটা হয়।তা নিয়ে বিচলিত নয় জান্নাহ্।একটু ধাতস্থ হয়ে গ্লুকোজ গোলা পানি পান করে মুক্ত শ্বাস নেয় জান্নাহ্।পাশে রাখা ফালুদা ভর্তি আইসক্রীম এর বাটির ট্রে টা হাতে নেয় জান্নাহ্।গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে বাগানে।সারহানের দিকে ট্রে এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো–
“নিন।খেয়ে ঠান্ডা হোন।”
সারহান শান্ত গলায় বললো—-
“আপনাকে তো রান্নাঘরে যেতে নিষেধ করেছি।”
জান্নাহ্ স্মিত হেসে ঝলমলে গলায় বললো—
“তাহলে ফ্রিজটা বেডরুমে এনে দিন।”
গম্ভীর মুখে চোখে হাসে সারহান।ছোট্ট করে বললো—
“বসুন।”
সারহানের পাশে বসেই তার কাঁধে মাথা রাখে জান্নাহ্।বাটি থেকে আইসক্রীম মুখে দিয়ে নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকায় সামনে সারহান।জান্নাহ্ কাতর গলায় প্রশ্ন করে—
“শুভ্রা আপু কেমন আছে সারহান?
সারহান ঝটকা মেরে বলে উঠে—
“জানি না।”
সারহানের কাঁধ থেকে মাথা উঠায় জান্নাহ্।ক্ষীণ গলায় বললো—
“তিতি খুব কাঁদছিলো।আপু নাকি খুব অসুস্থ।কারো সাথে কথা বলে না।শুধু তাকিয়ে থাকে।এমনটা কেন করলেন সারহান?
সারহান চুপ করে রইলো।গুমোট যন্ত্রণা বিক্ষিপ্ত হতে লাগলো।জল ছেপে আসে চোখের কোণে।রুষ্ট গলায় ঘোষণা করে—
“পাপের শাস্তি সবার প্রাপ্য।তার একটা মিথ্যে আমার পুরো জীবনটা অথৈ সাগরে তলিয়ে দিয়েছে।সেদিন যদি ওই বাড়ি থেকে আমি বেরিয়ে না আসতাম তাহলে ইহতিশামের সাথে কখনো দেখা হতো না আমার।না এমন হতো আমার জীবনটা।”
সারহানের কথার পিঠেই বেখেয়ালিভাবেই বলে উঠে জান্নাহ্—-
“তাহলে আপনার সাথেও আমার কখনো দেখা হতো না সারহান।”
সারহান ঘাড় বাকিয়ে তাচ্ছিল্য চোখে তাকিয়ে নিষ্প্রভ গলায় বললো–
“তাহলে আপনার জীবনটাও এমনভাবে নষ্ট হতো না রজনীগন্ধা।আপনি মানেন বা না মানেন এইটা সত্য যে আমি আপনার যোগ্য নই।”
জান্নাহ্ অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো।বিষয় বদলাতে সারহান বলে উঠে—-
“আপনাকে এমন লাগছে কেন?ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করেন না?দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছেন।খাওয়ার কষ্ট দিচ্ছি আপনাকে আমি?
জান্নাহ্ ঝট করেই বললো—-
“আমি কী আপনাকে বলেছি!
অধর কোণে সংকীর্ণ হাসে সারহান।আচমকা মাথা চক্কর দিয়ে উঠে জান্নাহ্ এর।মুখে আইসক্রীম দিয়ে তাকাতেই হেলে পড়তে গেলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে জান্নাহ্কে বুকের সাথে চেপে ধরে সারহান।উদ্বেলিত গলায় ডেকে উঠে—
“রজনীগন্ধা,রজনীগন্ধা!
,
,
,
ফট করে উঠেই সারহানকে ধাক্কা মারে জান্নাহ্।মেকি রাগ দেখিয়ে বললো—
“সরুন,অসভ্য লোক!
সারহান মৃদু ছন্দে হাসে।ফিচেল গলায় বললো—
“কী সমস্যা আপনার!এখনো হাত লাগাতেই ছ্যাত করে উঠেন!এতো সুড়সুড়ি কোথায় পান!
“আপনার মাথায়।”
সারহান জান্নাহ্ এর কপালে কপাল ঠেকিয়ে অভিমানি গলায় বললো—-
“আগে বলেন নি কেন আমাকে?
জান্নাহ্ প্রতিক্রিয়াহীন সুরে বললো—
“আমি কেন বলবো!আপনি বুঝে নিতে পারেন না।”
প্রাণখোলা হাসে সারহান।কৃতজ্ঞতার সুরে বললো—
“থ্যাংকস।”
“ভ্যা।”
ভেঙচি কাটে জান্নাহ্।খলখলিয়ে হেসে উঠে সে।সারহান জান্নাহ্ এর গালের উঁচু জায়গায় কামড় বসায়।অতর্কিত এই ভালোবাসার অত্যাচারে জান্নাহ্ নাক ফুলিয়ে বললো—
“অসভ্য লোক।”
সারহান ফিচেল হেসে চাপা গলায় বললো—
“অসভ্য বলেই তো এখন বাবা হবো।নাহলে তো সালমান খান হতাম।”
ঝুমঝুমিয়ে হেসে উঠে জান্নাহ্।তার হাসিতে সারহানের রুক্ষ বুকে প্রশান্তির হাওয়া বইতে লাগলো।দুই হাতে জান্নাহ্কে আলিঙ্গন করে বললো—
“আমার জানপাখি।”
সারহান জান্নাহ্ এর গলায়,গালে অধর ছোঁয়াতে থাকে।সারহানের হাত ধরে আনম্র গলায় জান্নাহ্ বললো–
“আপনি খুশি সারহান?
সারহান এক সমুদ্র হৃদয় ভেজা ভালোবাসা নিয়ে বললো—-
“আমার প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন আর আমি খুশি হবো না!
সোনালী রোদের মতো চকচক করে উঠে জান্নাহ্ এর দুই চোখ।তার মনে খুশির হাওয়া পালতোলা নৌকার মতো ফড়ফড় করে বইতে লাগলো।সারহানের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে একটু উঁচু হয়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় তার কপালে।বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সারহান।দুষ্টুমির ছলে বললো—
“পড়লেখা তো সব চাঁন্দের দেশে পাঠালেন।”
জান্নাহ্ চটপটে গলায় বললো—
“তা হবে কেন!বাবু আসলে আবার ভর্তি করিয়ে দিবেন।আমি পড়বো।আর বাবুকে আপনি সামলাবেন।বাবুর ন্যাপি চেঞ্জ করবেন,বাবুকে খাওয়াবেন,ওকে গোসল করাবেন।পারবেন না?
সারহান কিছুক্ষন চুপ থেকে রসালো গলায় বললো—
“পারবো না কেন!না পারলে শিখে নিবো।আর দরকার হলে একটা সুন্দরী আয়া রেখে দিবো।মেয়েরও সুবিধা,বাবারও সুবিধা।”
জান্নাহ্ চোখ মুখ খিঁচে সারহানের কলার চেপে ধরে।খরখরে গরায় বললো—-
“এরপর যদি কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়েছেন তাহলে আপনার চোখ তুলে ফেলবো আমি।”
সারহান শ্বাসবন্ধ করে মৃদু হাসে।জান্নাহ্ এর কোমরের দুই পাশে সুড়সুড়ি দিতেই অকস্মাৎ বিছানায় গড়িয়ে পড়ে জান্নাহ্।সারহান তার উপর ঝুঁকে জান্নাহ্ এর অধরে ভয়ংকর,দম বন্ধকর চুমু খায়।মোহবিষ্ট গলায় বললো—
“মাই লাভ বার্ড।”
“তোর পরাণে বাঁধিয়াছি ডোর
তোর হৃদয়ে জীবনের ঘোর
তোর শ্বাসেই আমার বাস
তোর ভালোবাসায় আমার সর্বনাশ।”
চলবে,,,