#জান্নাহ্
#পর্বঃ৬৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
টিনের চালে টুপটাপ বৃষ্টির ছন্দ।বাংলোর পেছন দিকের দুটো ঘরের বারান্দায় টিনের চাল।ঝমঝমিয়ে পড়ছে বৃষ্টি।শীতল,চঞ্চল বাতাস শনশন করে বইছে।ঝড়ো বৃষ্টির সাথে তীব্র বাতাসের আন্দোলন।
জান্নাহ্ হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁইছে।তার পাশেই তার দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারহান।অন্ধকার রাতের আকাশ ফুঁড়ে চলছে বৃষ্টির মাতম।এক পশলা বৃষ্টি এসে ঝপ করেই ছুঁয়ে যায় জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ মুগ্ধ হাসে।ঝুমঝুমিয়ে উচ্ছাসের সাথে বললো—
“আমার বৃষ্টি ভালো লাগতো না।ছোটবেলা বৃষ্টি হলেই বাবা আর মাম্মা আমাকে স্কুলে যেতে দিতো না।বড্ড মন খারাপ হতো আমার।”
সারসান ফিক করে হেসে ফেলে।জান্নাহ্ কপাল কুঁচকে ভ্রু নাচিয়ে বললো—
“হাসছেন কেন?
সারহান বেশ কিছুক্ষন আনমনে হাসে।পাতলা টিশার্টের সাথে পরেছে ছাই রঙা ট্রাউজার।বৃষ্টির ছটা লেগে পিঠের দিকটা ভিজে আছে।পকেটে দু’হাত পুরে মোলায়েম গলায় বললো—
“আমার তো সেই লাগতো।স্কুলে যাওয়ার তাড়া ছিলো না।সামান্য বৃষ্টি হলেই মা আর আমাকে স্কুলে পাঠাতো না।সারাদিন চলতো ইনডোর গেম।মা রান্নাও করতেন অনেক।”
অনর্গল বলতে থাকে সারহান।ছোটবেলাকার স্মৃতিমন্থনে ব্যস্ত সারহানের চোখ,মুখ নিশি রাতের মায়া কাটিয়ে জ্বলজ্বল করে উঠে।আচমকা থেমে যায় সারহান।উজ্জ্বল মুখটা মুহূর্তেই চুপসে যায়।জান্নাহ্ গাঢ় গলায় আবেগী হয়ে বললো—
“মায়ের কথা মনে পড়ছে সারহান?
তীব্র আক্রোশ নিয়ে সহজ গলায় বলে উঠে সারহান—-
“নাহ।”
জান্নাহ্ মৃদু হাসে।কোনোরূপ উচ্চ ভাবাবেশ ছাড়া পড়ন্ত বৃষ্টির দিকে মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টি দিয়ে বললো—
“আপনি মিথ্যে বলছেন সারহান।”
উন্মনা চোখে তাকায় সারহান।গম্ভীর গলায় বললো—
“কফি খাবেন?
জান্নাহ্ কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে অধর।হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেয়।সারহান দু কদম বাড়িয়ে কঠিন গলায় দৃঢ় চাহনিতে বললো—-
“বৃষ্টিতে ভিজবেন না।ঠান্ডা লাগবে আপনার।”
ঝরা হাসে জান্নাহ্।বারান্দায় বৃষ্টির পানি জমে আছে।তাতে একটু একটু করে নগ্ন পা ছোঁয়ায় জান্নাহ্।শিউরে উঠে তার রোম।আকাশে চমকে উঠে বিদ্যুৎ।নিকশকৃষ্ণ আকাশ মুহূর্তেই আলোকসভায় পরিণত হয়।ধোঁয়া উড়ানো কফির মগ নিয়ে হাজির হয় সারহান।জান্নাহ্ এর দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজের মগ নিয়ে তাতে চুমুক লাগায়।বৃষ্টি ভেজা শীতল পরশে কফির উষ্ণতা যেনো সোনায় সোহাগা হয়ে উঠলো।বৃষ্টির ছন্দের ফাঁক গলিয়ে বলে উঠে জান্নাহ্—-
“আপনি আমার বাবার মতো হবেন সারহান?
সারহান দুর্বোধ্য হাসে।বারান্দার হাফ দেয়ালের সাথে ঠেকানো পিঠ আলগা করে জান্নাহ্কে কাছে টেনে নেয়।নিজের কফির মগ পাশের ছোট্ট টেবিলটার উপর রাখে।জান্নাহ্কে পেছন দিক দিকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে উষ্ণ অধরের ছোঁয়া আঁকে।শুষ্ক,মোলায়েম চুলে মুখ গুঁজে ফিকে আওয়াজে বললো–
“উঁহু।জগতে কেউ কারো মতো হতে পারে না রজনীগন্ধা।সবারই নিজস্ব স্বকীয়তা আছে,আছে ব্যক্তিত্ব।কারো সাথে কারো একটা দিক মিললেই সে পুরোপুরি কখনো ওই মানুষটার মতো হতে পারে না।আমি কখনো আপনার বাবার মতো নই।না সে কখনো আমার মতো।কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি।হয়তো তার থেকে বেশি নাহয় তার থেকে কম।কিন্তু তার সমান নয়।”
সারহানের দেহের উষ্ণতায় জান্নাহ্ এর শীতল দেহ তপ্ত হতে থাকে।সারহান আদুরে মায়ায় জড়িয়ে নেয় জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ এর শরীরে কম্পন হয়।হাতে থাকা কফির মগটা আলগোছে নামিয়ে নেয় সারহান।জান্নাহ্ এর ঠোঁটে দীর্ঘ সময় নিয়ে চুমু খেয়ে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো—
“আমার পরীবউ।”
,
,
,
রেগুলার চেকাপের জন্য হসপিটালে এসেছে জান্নাহ্।গাইনোকলোজিস্ট মুনিরার কেবিন থেকে বেরিয়েই জান্নাহ্কে দাঁড় করায় সারহান।ছোট্ট শরীরে ভারি পেট নিয়ে চলতে কষ্ট হয় জান্নাহ্ এর।কিন্তু তার পাশে ছায়ার মতো থাকে তার প্রাণপুরুষ।হাতের ফাইলটা শক্ত করে ধরে জান্নাহ্কে বললো সারহান–
“আপনি এখানে দাঁড়ান,আমি আসছি।”
“হুম।”
জান্নাহ্কে দাঁড় করিয়ে করিডোর ধরে হসপিটালের উত্তর দিকে হেঁটে যায় সারহান।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই পা দুটো ভার হয়ে আসে।করিডোরে তেমন মানুষ নেই।কতিপয় ডক্টর,নার্স আর ওয়ার্ড বয়দের পদচারণা।জান্নাহ্ ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে।
অগোছালো পা বাঁড়াতেই সাদা ড্রেস পরিহিত নার্সের সাথে ধাক্কা লাগে।ব্যস্ত হাতে জান্নাহ্কে সামলায় নার্স।তটস্থ গলায় বললো—
“বি কেয়ারফুল ম্যাম।”
জান্নাহ্ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে প্রস্ফুরনিত কন্ঠে বললো—
“সসরি।থ্যাংক ইউ।”
“ইটস ওকে ম্যাম।”
কৃতজ্ঞতা জানায় জান্নাহ্ নার্সকে।জান্নাহ্ নৈঃশব্দে শ্বাস ফেলে।একটু ধাতস্থ হয়ে সামনে এগুতেই আবারো জোরালো ধাক্কা লাগতেই পেছন দিকে হেলে পড়ে জান্নাহ্।ভয়ে আঁতকে উঠা জান্নাহ্ চোখের পাতা বন্ধ করে সামনের মানুষটির বুকের দিকে খাঁমচে ধরে নিজেকে বাঁচানোর খাতিরে।জান্নাহ্ এর ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে এসে ঠেকে সেই পরিচিত পারফিউমের ঘ্রাণ।ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস ফেলে ভয়ে জড়সড় জান্নাহ্।নিমিঝিমি চোখ মেলে তাকাতেই চোখের পাতা ক্রমশ প্রশ্বস্ত হতে থাকে জান্নাহ্ এর।সামনের সুদর্শন ব্যক্তির চোখ ভরা উচ্ছ্বাস,ঠোঁটে হঠাৎ প্রিয় জিনিস ফিরে পাওয়ার আঁতকে উঠা খুশি।অবাক বিস্মিত গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—
“অর্নিশ!তুমি?
ছেলেটি মুখভর্তি উচ্ছলিত হাসে।কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া ছড়িয়ে গভীর দৃষ্টিতে দেখে জান্নাহ্কে।গাঢ় গলায় একবুক খুশি নিয়ে বললো—
“জান্নাহ্!
কোথায় ছিলে এতোদিন তুমি?
জান্নাহ্ এর শ্বাসের গড়পড়তা বাড়তে থাকে সাথে সংশয়।তাকে সোজা করে দাঁড় করায় অর্নিশ।মোহবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্ এর দিকে সে।এক পাশে ছড়ানো ওড়নাটা মেলে ধরে নিজের উদর ঢাকে জান্নাহ্।অর্নিশ উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো—
“কেমন আছো তুমি?
জান্নাহ্ নিষ্প্রভ গলায় বললো—
“ভালো।তুমি?
প্রাণখোলা হাসে অর্নিশ।প্রসন্ন গলায় প্রত্যুত্তর করে—
“ভালো।
কোথায় ছিলে তুমি?আমি তোমায় কত খুঁজেছি!অস্ট্রেলিয়া থাকতেই মম এর কাছে তোমার প্যারেন্টসের ডেথের খবর শুনলাম।বড় চাচ্চুর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিলো।তাকে দেখতে গিয়েছিলাম আমি।ফিরে এসে তোমাকে আর খুঁজেই পেলাম না।”
জান্নাহ্ গাঢ় চোখে তাকিয়ে রইলো।তার হাত পায়ে মৃদু কম্পন শুরু হয়েছে।কম্পনরত গলায় বললো—
“আমি..।”
“রজনীগন্ধা,এখানে কী করছেন?
সারহানের গলার আওয়াজে পরপর কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলে জান্নাহ্।তার দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভ্রু বাঁকায় অর্নিশ।উৎসুক গলায় মিইয়ে সুর তুলে—
“আপনি কে?
সারহান উষ্ণ হাসে।ঝরা গলায় বললো—
“সারহান।জান্নাহ্ এর হ্যাজবেন্ড।”
কৌতূহলী চোখ জোড়া ক্ষণকালেই প্রশ্বস্ত হয়।বিব্রত হয় জান্নাহ্।অপ্রস্তুত চাহনিতে বললো—
“সারহান,ও অর্নিশ।মাম্মার ফ্রেন্ডের ছেলে।”
“ও।আসসালামু আলাইকুম।”
অর্নিশের অবস্থা আকাশ গুড়ুম।জান্নাহ্ এর হ্যাজবেন্ড!হাউ পসিবল!অর্নিশ যেনো থমকে গেলো নিমিশেই।না শোনার মতো করে সালামের উত্তর করে।ব্যগ্রতা দেখিয়ে সারহান বললো—
“রজনীগন্ধা,আমাদের দেরি হচ্ছে।চলুন।”
“হুম।
আসি অর্নিশ।”
অর্নিশ ভ্যালভ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো।যতক্ষন পর্যন্ত তার দৃষ্টি সীমানায় ছিলো জান্নাহ্।জান্নাহ্ এর অবয়ব দৃষ্টির আড়াল হতেই চঞ্চল পা দুটো দপদপ করে ফেলে মুনিরার কেবিনে ডুকে অর্নিশ।অধৈর্য গলায় বললো—
“একটু আগে যে মেয়েটা এখান থেকে বেরিয়েছে ও কেন এসেছিলো?
মুনিরা আচম্বিত গলায় প্রশ্ন করেন—
“তুমি কেন জানতে চাচ্ছো?
“আন্টি ও জান্নাহ্।মনে পড়ছে তোমার !মম বলেছিলো ওর কথা তোমাকে। সংযুক্তার মৃত্যুর পর আমাকে ডিপ্রেশন থেকে বাঁচাতে মম জান্নাহ্দের বাসায় আমাকে পাঠিয়েছিলো।”
মুনিরা কিছু মনে করার চেষ্টা করে বললেন—
“আই সী।মনে পড়েছে।মেয়েটা বিবাহিত অর্নিশ।শী ইজ প্রেগন্যান্ট।ফাইভ মানথ রানিং।”
আঁতকে উঠে বললো অর্নিশ—
“হোয়াট?আর ইউ সিরিয়াস?শী ইজ অনলি সিক্সটিন!
“আই নো অর্নিশ।আর সে সেকেন্ড টাইম কনসিভ করেছে।প্রথমবার মিসক্যারেজ হয়েছিলো।”
অর্নিশ মুক্ত শ্বাস নিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।কিছুক্ষণ ধুম ধরে বসে থেকে বললো—
“ওর নাম্বার আছে তোমার কাছে?
“নাহ।ওর হ্যাজবেন্ডের আছে।বাট আমি তোমাকে দিতে পারবো না।এইটা রুলসের বাইরে অর্নিশ।”
অর্নিশ অসহায় গলায় বললো—
“প্লিজ আন্টি!
“ওকে মাই বয়।ওয়েট।”
চলবে,,,