#জান্নাহ্
#পর্বঃ৭৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
ছোট্ট লালচে গোলাপী নরম একদলা মাংস মনে হচ্ছে বাচ্চাটিকে।মেহনাজ পরম মমতায় তাকে কোলে তুলে নেয়।সকালের মিহি রোদ জানালা দিয়ে উষ্ণতা ছড়াচ্ছে।সেখানেই বাচ্চাটিকে রাখলো মেহনাজ।বাচ্চাটি তার কালো মারবেলের মতো মনির চোখ দুটো খুলে পিটপিট করে তাকায়।হালকা গোলাপী রঙের নখ যুক্ত ছোট্ট ছোট্ট হাত ঘষতে থাকে নাকের ডগায়।তাতে মুহূর্তেই রক্ত লাল হয়ে উঠে নাকের সম্মুখভাগ।মেহনাজ আদুরে হাসে।বাচ্চাটির ছোট্ট কপালে মায়াভরা চুমু খায়।
রোদের আঁচ চোখে লাগতেই পলক ঝাঁপাতে থাকে বাচ্চাটির।নিজের আঙুল পুরে দেয় মুখে।মেহনাজ হালকা হাতে তা সরিয়ে আনে।টসটসে গালে ঠোঁট চেপে চুমু খায়।আচমকাই চার হাত,পা ছোড়াছুড়ি করে স্বশব্দে কেঁদে উঠে বাচ্চাটি।ব্যস্ত হয়ে তাকে কোলে তুলে নেয় মেহনাজ।গভীর মোহবন্ধনে আবদ্ধ করে বাচ্চাটি মেহনাজকে।
,
,
,
ডোর বেলের আওয়াজ কানে আসতেই চমকিত হয় জান্নাহ্।তার ভারী চোখের পল্লব দুটো মেলে ধরে।ঢুলে ঢুলে উঠে দাঁড়ায়।দরজা খুলতেই চোখে উপচে আসে আষাঢ়ের শ্রাবণ ধারা।
“শায়িখ ভাইয়া!
করুণ শোনালো জান্নাহ্ এর মুখ নিঃসৃত শব্দ।শায়িখ ভেতরে এসে প্রশ্ন করে–
“স্যার কোথায়?
“ঘুমোচ্ছে।”
হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো শায়িখ।তাড়া দিয়ে বললো–
“কেন করলে তুমি এমন জান্নাহ্?মানুষটাকে জীবন্ত মেরে ফেললে কেন?
ঝমঝমিয়ে কাঁদে জান্নাহ্।শব্দ করে বললো–
“সবাই আমাকেই কেন দোষী ভাবছে শায়িখ ভাইয়া?আমার কী কষ্ট হচ্ছে না?মায়েদের কী কষ্ট হয় না?
ফোঁস করে দম ফেললো শায়িখ।বললো—
“তাহলে এমন কেন করলে?
কোথায় তোমার মেয়ে?ওই বাচ্চার জন্য স্যার কী না করেছে!আর তুমি ওকেই স্যারের কাছ থেকে দূর করে ফেললে!
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে জান্নাহ্।ক্ষণে ক্ষণে ধমকে যাচ্ছে তার বুক।নির্ঝরের মতো ঝরে যাচ্ছে তার চোখের বারি।নিরেট গলায় বললো জান্নাহ্—
“আমি ভাবতে পারি নি আপু এমন করবে।ছোটবেলা থেকে বাবাই তো আমার সব ছিলো।আপুও ভালোবাসতো আমায়।কিন্তু যখন থেকে মামা,মামী আমাকে তার চেয়ে বেশী স্নেহ করা শুরু করলো আপু ধীরে ধীরে কেমন যেনো হয় গেলো।তাই আমি মামা বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দেই।আপুর কথা তো আমি মামার কাছ থেকে জানতে পারি।আপু অনেক কষ্ট পেয়েছে।সুইসাইডও করতে চেয়েছে।আমি ভাবতেও পারি নি সেই মানুষটা সারহান যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি।”
এইটুকু বলেই থামে জান্নাহ্।লম্বা শ্বাস নেয় সে।শায়িখ মর্মাহত চোখে তাকিয়ে আছে।জান্নাহ্ আবারও ফুঁপিয়ে উঠে বললো—
“যাদেরকে আমি মেরেছি তারা সবাই সবকিছু জেনেও আমার সারহানকে ছাড়তে চাই নি।বাধ্য হয়েছি আমি।কিন্তু আপু!
আপুকে সারহান ধোঁকা দিয়েছে।আমি চাইনি আমার সারহানকে কেউ ঘৃণা করুক।আমি আপুকে বলেছি সারহানকে যেনো ক্ষমা করে দেয়।কিন্তু তার বদলে আপু আমাকে শর্ত দিলো।আমি বুঝতে পারি নি।সারহানকে ক্ষমা করার বদলে আপু আমার বাবুকে চেয়ে বসবে।বিশ্বাস করো,জানলে আমি আপুকে কখনো কথা দিতাম না।কখনো না।”
শায়িখ অচঞ্চল গলায় বললো–
“তাই বলে নিজের সন্তানকে দিয়ে দিবে!একবারও ভাবলে না বাচ্চাটাকে ছাড়া স্যার কী করে বাঁচবে!ভুল আমরা সবাই করেছি তাহলে স্যার কেন একা শাস্তি পাবে?মেহনাজের সাথে যা হয়েছে এতে স্যারের একার দোষ নেই।আর সবকিছু ভুলে ইহতিশাম স্যার মেহনাজকে বিয়েও করেছে।তাহলে এইসবের কী মানে?
“আমি জানি না।”
“ভুল আমিও করেছি।বাবা মাকে ছেড়ে গিয়েছিলো বলে নারী জাতির উপর ঘৃণা ধরে গেছে আমার।তাই তোমাকে বাঁধা দেওয়ার চিন্তা মাথায় আসে নি।বোন বলে ডেকে কত বড় বিপদের মুখে ফেলেছি তোমাকে।কিন্তু একটা কথা সত্য।এতো নারীর সাথে সম্পর্ক থাকলেও স্যার কিন্তু সত্যিই তোমাকে ভালোবেসেছে।সেই জন্যই তো নিজেকে বদলেছে।তুমি একটা সুযোগ কেন দিলে না তাকে?
হাউমাউ করে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।জমাট গলায় বললো—
“আমি কী করবো বলতে পারো?কোথায় যাবো আমি?কেন বারবার আমার সাথেই এমন হয়।”
“আমি শুধু একটা কথাই বলবো স্যারকে তার প্রাণ ফিরিয়ে দাও জান্নাহ্।নাহলে তাকে বাঁচাতে পারবেনা।সবকিছু হারিয়ে যে মানুষ একটা খড়কুটোকে আশ্রয় করে বাঁচতে চেয়েছে,সেই খড়কুটোকে তুমি অন্য কারো খোরাক বানিয়ে দিলে।এখনও সময় আছে জান্নাহ্।ফিরিয়ে আনো তোমাদের অস্তিত্বকে।”
গুমোট কান্নায় গলা জ্বলে উঠে জান্নাহ্ এর।হেঁচকি উঠে আসে তার।চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে উঠে।জান্নাহ্ তাকাতেই পারছে না।একসময় কান্নাও আসছে না জান্নাহ্ এর।সে বসে রইলো চুপচাপ।আবেগশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো উন্মনা হয়ে।তার অসাড় শরীরে সে কোনো অনুভূতি পাচ্ছে না।অনুভূতিশন্য,বিবশ,নিশ্চল জান্নাহ্ বসেই রইলো প্রস্তরমূর্তির মতো।তার মধ্যে কোনো ভাবাবেগ নেই,নিরাক পরিবেশে থমথমে ভাব।
নিজের প্রাণকে কারো মুখাপেক্ষী হতে দিবে না জান্নাহ্।তাই নিজের সন্তানকেও ত্যাগ করলো সে শুধুমাত্র তার প্রাণকে দায়মুক্ত করতে।কিন্তু এ দায় যে বড্ড বেশি ভারী হয়ে গেলো তার জন্য।যাকে দায়মুক্ত করতে এতো কিছু যদি সেই মানুষটাই না বাঁচে তাহলে কী হবে এই দায়মুক্ততা দিয়ে!
যে মানুষটাকে ভালোবেসে এতো বড় পাপ করে ফেলেছে সে আজ সেই মানুষটাই তার চোখের সামনে একটো একটু করে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।জান্নাহ্ আর সইতে পারলো না।নিজের অগোছালো মনের সমস্ত বাঁধা ডিঙিয়ে কল করলো মেহনাজকে।কয়েকবার কল হতেই রিসিভ করে মেহনাজ।খুশি খুশি গলায় বললো—
“জানিস,আজ বাবুর নখ কেঁটে দিয়েছি।বাচ্চাদের নখ অনেক ধারালো হয়।দেখ না ঘুমের মধ্যে আঁচড় কেটে নিজের গালের দফারফা করেছে।”
সোজা গলায় বলে উঠে জান্নাহ্—
“আমার পুঁচকো কে ফিরিয়ে দাও আপু।”
মেহনাজ বিভ্রান্ত গলায় বললো—
“এইসব কী বলছিস তুই?
“আমার পুঁচকো কে ফিরিয়ে দাও।আমার সারহান তার পরীকে ছাড়া বাঁচবে না আপু।”
তপ্ত গলায় বলে উঠে মেহনাজ—
“তুই আমাকে কথা দিয়েছিস জান্নাহ্।”
জান্নাহ্ জোর গলায় বলে উঠে—
” আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিলাম।ফিরিয়ে দাও আমার মেয়েকে।”
ধমকে উঠে মেহনাজ—
“জান্নাহ্!তুই ভালো করে জানিস সারহান কী করেছে আমার সাথে?
জান্নাহ্ উষ্ণ গলায় বললো—
“সারহান একা দোষ করে নি আপু।তোমার সাথে তো জোর করেনি।আর তিশাম ভাইয়া তো ভালোবাসে তোমাকে।সে বিয়েও করেছে তোমাকে।তাহলে?
আমার সারহান মরে যাবে আপু।প্লিজ ফিরিয়ে দাও আমার পরীকে।”
মেহনাজ কন্ঠে নমনীয়তা আনে।দূর্বল গলায় বললো—
“দেখ জান্নাহ্,তুই চাইলেই আবার মা হতে পারবি।কিন্তু আমি!
আমি কখনো মা হতে পারবো না।তুই সারহানকে বুঝিয়ে বল।দেখবি ও মেনে নিবে।”
“আমি পারবো না।কী করে দাঁড়াবো আমি ওই মানুষটার সামনে যার হৃদপিন্ডের স্পন্দনটাই আমি কেড়ে নিয়েছি!তুমি ফিরিয়ে দাও আমার মেয়েকে।”
মেহনাজ শক্ত গলায় বললো—
“নাহ।দিবো না আমি।ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না জান্নাহ্।তোর তো সব ক্ষমতা।তোরা দুইজন চাইলে আবার মা,বাবা হতে পারবি।আমি কখনো মা হতে পারবো না।উপর ওয়ালা সেই ক্ষমতা আমাকে দেন নি।তাই আমি দিবো না পুঁচকো কে তোকে।তুই তোর কথা ফিরিয়ে নিলেও আমি ফিরিয়ে দিবো না ওকে।”
টুক করেই লাইন কেটে দেয় মেহনাজ।এপাশ থেকে জান্নাহ্ বলতেই থাকে—
“আপু,আপু।প্লিজ ফিরিয়ে দাও আমার মেয়েকে।ফিরিয়ে দাও।ওকে ছাড়া আমার সারহান বাঁচবে না।”
জান্নাহ্ এর কথা তার কানেই প্রতিফলিত হলো।মেহনাজ সুইচ অফ করেছে তার মোবাইল।অনবরত কল করলেও নট রিচেবল।উন্মাদের মতো বিলাপ করে জান্নাহ্।তার জীবনে শুধু ভুলই কেন করলো!
এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত সে কী করে করবে।কী করে বাঁচাবে তার প্রাণকে।
আজ জান্নাহ্ তার বাবাকে দেখতে পাচ্ছে না।দেখতে পাচ্ছে তার মাকে।মৃণালিনী শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।নির্লিপ্ত মুখভঙ্গী।গভীর সে মনোভাব।জান্নাহ্ যেনো তার শেষ পরিণতি দেখতে পেলো তার চোখে।
চলবে,,,