জান্নাহ্ “পর্বঃ৭৬

0
4874

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৭৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

বাচ্চাটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে মেহনাজ।তার অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে ঝড়ের বেগে।গোলাপী হাওয়াই মিঠাইটিকে মেহনাজ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায় না।গত পনেরো দিনে যে অতলান্তিক মায়া,প্রগাঢ় ভালোবাসা,তীক্ষ্ম সূঁচালো অনুভূতি আর ঐন্দ্রজালিক মায়াডোরে বাচ্চাটি মেহনাজকে বেঁধেছে তা সে ছাড়তে পারছে না।জান্নাহ্ এর কথামতো বাচ্চাটির একটি নামও রেখেছিলো মেহনাজ।জান্নাতুল সারহান।কিন্তু ডাকা হয়নি কখনো।মেহনাজের চোখের পানি টুপ টুপ করে পড়ছে বাচ্চাটির গাঢ় লাল ঠোঁটের উপর।তার অশ্রু ধারা শীতল আর নোনতা স্বাদে অ্যাঁ শব্দ করে বাচ্চাটি জেগে উঠে তার ঘুম থেকে।মেহনাজ আরো জোরে জড়িয়ে নেয় বাচ্চাটিকে।বাচ্চাটির চোখে,মুখে চুমু খেয়ে শক্ত গলায় স্বগতোক্তি করে বললো—

“কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি তোকে ছাড়বো না পুঁচকো।আমি তোকে জন্ম না দিলেও আমিই তোর মা।আমার অনাস্বাদিত উরোজের প্রথম আস্বাদন করেছিস তুই।তোর স্পর্শে আমি মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করেছি।কী করে ছাড়বো তোকে আমি!

“ছাড়তে না চাইলেও ছাড়তে হবে তোমায় মেহনাজ।”

ইহতিশামের কঠিন গলার আওয়াজে হতচকিত মেহনাজ ভঁড়কে যায়।ভীত গলায় বললো—

“তুতততমি!

“কেন?ভয় পেলে?আশা করো নি তাই না?

মেহনাজ আঁতকে উঠা গলায় বললো–

“তুমি এখানে কী করে এলে?

ইহতিশাম চোয়াল শক্ত করে দাঁত কিড়মিড় করে বললো—

“আমি কী করে এলাম তা তুমি না জানলেও চলবে।তুমি এতোটা নিচে কী করে নামলে মেহনাজ?

মেহনাজ ফাঁকা ঢোক গিলে।মিনমিনে গলায় বললো–

“আমার কথা শোনো ইহতিশাম।”

“কোনো কথা শুনতে চাই না আমি।আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে আমি তোমার মতো মেয়েকে ভালোবেসেছি।কী করে পারলে তুমি নিজের বোনের কাছ থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নিতে?

মেহনাজ ক্ষীণ গলায় বললো—

“প্লিজ ইহতিশাম আমার কথা শোনো।আমি তো কখনো মা হতে পারবো না।”

ইহতিশাম দারাজ গলায় বললো–

“সবকিছু জেনেই আমি তোমাকে বিয়ে করেছি মেহনাজ।হাজারো বাচ্চা শহরের অলিতে গলিতে মানুষ হচ্ছে।এতিম খানায় হাজরো বাচ্চা।তাদের কাউকে দত্তক নিয়ে নিতাম আমি।তোমার খামতিকে কখনো তোমার চোখে আঙুল তুলে দেখাই নি আমি।তাহলে এতো বড় স্টেপ কেন নিলে তুমি?

শরীর ঝাঁকনি দিয়ে কাঁদতে থাকে মেহনাজ।তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না ইহতিশাম।জোর হাতে বাচ্চাটিকে কেড়ে নেয়।আর্তনাদ করে উঠে মেহনাজ।নিরেট গলায় বললো–

“ওকে নিওনা প্লিজ।ওরা তো চাইলেই আবার বাচ্চা নিতে পারবে।তুমি সারহানকে বুঝিয়ে বলো।”

ঝাঁড়া মেরে ইহতিশাম বললো—

“কী বুঝাবো ওকে আমি।যে মানুষটা অনেক আগেই মরে গেছে।
সত্যি করে বলোতো আদৌ তুমি ওকে ভালোবাসো বলে কেড়ে নিয়েছো!

মেহনাজ চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে পলক ঝাঁপাতেই নির্ঝরের ধারা বইতে লাগলো।ইহতিশাম তীর্যক হেসে বললো—

“তুমি আসলে ওদের শাস্তি দিতে চেয়েছো।এক ঢিলে দুই পাখি।জান্নাহ্কে তুমি সহ্য করতে পারতে না।তার উপর যোগ হয়েছে সারহান।জান্নাহ্ তো বাচ্চা একটা মেয়ে।যে বয়সে ওর দরকার ছিলো একজন ভালো গাইড, একজন শুভাকাঙ্ক্ষী,একজন নিজস্ব আপন মানুষ সে বয়সে শুধু ভুল করেছে একের পর এক।তোমার বাবা,শায়িখ কেউ জান্নাহ্কে সঠিক পথ দেখাতে পারে নি।যে মানুষটাকে বিশ্বাস করেছে,ভালোবেসেছে,সবটা দিয়ে তাকে চেয়েছে যখন তাকে হারানোর ভয় ওকে আচ্ছাদিত করলো তখন ওর দরকার ছিলো মেন্টাল সাপোর্ট,ওকে দেওয়া উচিত ছিলো সত্য মেনে নেওয়ার সাহস,বাস্তব বোঝার ক্ষমতা।কিন্তু তার কিছুই জান্নাহ্ পায় নি।তাই নিজের ভুলকে সঠিক মনে হয়েছে ওর।তবে এতো ভুলের মাঝেও সঠিক ছিলো ওর ভালোবাসা।সব ছাপিয়ে ভালোবেসেছে সারহানকে।ভালোবাসার সাগরে ডুবে মৃত্যু অনিবার্য জেনেও ডুবেছে সে।কিন্তু তুমি তাকে পাড়ে ভেড়ানোর নাম করে ওর বাঁচার অবলম্বন ভেলাটাই কেড়ে নিয়েছো।ছুঁড়ে ফেলেছো ওই অগাধ জলরাশির বুকে।
সারহানকে ক্ষমা করার বদলে ওদের মেরে ফেলার জাল ফেঁদেছো তুমি।এতোটা জঘন্য তুমি আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে মেহনাজ।”

মেহনাজ নিরন্তর তপ্ত শ্বাস ফেলতে থাকে।ভয়ে,রাগে,উৎকন্ঠায় তার চোখ,মুখ ফুলে উঠে।ইহতিশামের দিকে নজর রেখেই বিছানার পাশের টেবিলের উপর থাকা কাঁচের শোপিস টা ভেঙে বললো—

“পুঁচকো কে নিয়ে গেলে কিন্তু আমি নিজেকে শেষ করে ফেলবো ইহতিশাম।”

চমকে গলায় বললো ইহতিশাম —-

“মেহনাজ,পাগলামি করবে না।”

“বাবুকে ফিরিয়ে দাও আমায়।প্লিজ ইহতিশাম।”

“আমি সারহানকে কথা দিয়েছি।”

“ওকে ফিরিয়ে দাও আমায়।”

ইহতিশামের কোলে কেঁদে উঠে বাচ্চাটি।সেদিকে চোখ পড়তেই আকাশকুসুম কান্ড করে বসে মেহনাজ।
,
,
,
বারে একনাগাড়ে মদ গিলে টেবিলের উপর মাথা নুইয়ে রেখেছে সারহান।লাল,নীল বাতির ঝলকানিতেও অন্ধকার সারহানের প্রাণসত্তা।নেশায় মত্ত সকল মানব-মানবী নিজেদের ভুলে মদের প্রেমে মশগুল।সারহানের সামনেই ছলছল চোখে বসে আছে শায়িখ।জমাট গলায় বললো—

“চলুন স্যার,বাসায় চলুন।অনেক রাত হয়েছে।”

সারহান আলগোছে মাথা তুলে তাকায়।জমাট রক্ত যেনো তার চোখে বেঁধে আছে।কপালের সুক্ষ্ম ভাঁজগুলো ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে।নাকের পাটা ফেঁপে বেরিয়ে যাচ্ছে তপ্ত নিঃশ্বাস।নেশার্ত মস্তিষ্ক।বেসামাল চিত্ত।ঘোরের কন্ঠে বললো সারহান—

“কোথায় যাবো?বাসায়!কার বাসায়?কীসের জন্য যাবো?কে আছে আমার?

শায়িখ অচক্রী গলায় প্রত্যুক্তি করে—

“এভাবে বলছেন কেন স্যার?আপনার বাসা।আপনার ঘর।”

নেশাগ্রস্থ সারহান প্রতিবাদ করে বললো—

“নাহ।কিছুই নেই আমার।সারহান একা।সে সারাজীবন একাই থাকবে।”

শায়িখ মৃদু গলায় বললো—

“এভাবে বলবেন না স্যার।জান্নাহ্ ভুল করে ফেলেছে।আপনি তো জানেন ও অবুঝ।”

সারহান নেশার্ত হাসে।তার চোখ দুটো টিমটিম করে জ্বলছে।গ্লাসের ওয়াইন টুকু টুক করে গিলে বললো—

“অবুঝ!সত্যিই অবুঝ সে।আমার পরীকে কেড়ে নিলো আমার কাছ থেকে।আমাকে শাস্তি দিলো সে।এতোটা ঘৃণা তার আমার প্রতি।”

শায়িখ মুক্ত গলায় বললো—

“জান্নাহ্ এর কোনো দোষ নেই স্যার।মেহনাজই ওকে ভুলভাল বুঝিয়ে এমনটা করেছে।”

সারহান নির্বিঘ্ন গলায় বললো–

“আমার ভালোবাসা হেরে গেলো শায়িখ।চিরতরে হেরে গেলো।আমার ভালোবাসা আমার জীবনের মতোই কাঁচের ঘর।মৃদু পবনেই ঝনঝন করে ভেঙে গেলো।তা আর কোনোদিনও জোড়া লাগবে না শায়িখ।”

অটল গলায় ব্যস্ত হয়ে বললো শায়িখ—

“স্যার সব ঠিক হয়ে যাবে।আপনি বাসায় চলুন।আপনার যেমন কষ্ট হচ্ছে জান্নাহ্ এর কষ্ট হচ্ছে।ওর এখন আপনাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।প্লিজ স্যার।”

সারহান কিছু বলতে যাবে তখনই—

“কোনো দরকার নেই জান্নাহ্ এর জীবনে ওর।”

উৎকন্ঠিত চোখে তাকায় শায়িখ।রাফাতকে দেখেই মেজাজ বিগড়ে যায় শায়িখের।চোখের সাদা অংশ ফুলিয়ে বললো—

“এখানে কেন এসেছো তুমি?

রাফাত বাঁকা হেসে বললো—

“দেখতে এলাম দেবদাস কী করছে।”

সারহান স্বাভাবিক দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।রাফাত তেরছা সুরে বললো–

“এখন তো শুধু মেয়েকে হারিয়েছিস।জান্নাহ্কেও হারাবি তুই।”

সহ্য হলো না সারহানের।উন্মাদের মতো খাবলা মেরে ধরল রাফাতকে।তীক্ষ্ম গলায় বললো—

“কী বলতে চাস তুই?

দগদগে গলায় প্রত্যুত্তর করে রাফাত—

“কেন যেতে দিচ্ছিস না ওকে?আর কতো কষ্ট দিবি জান্নাহ্কে?কী না করেছে মেয়েটা তোর জন্য!

চোয়াল খিঁচে আসে সারহানের।অনমনীয় গলায় বললো—

“তাকে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।আমার স্ত্রীকে আমি সামলে নিবো।”

রাফাত অধরের কোনে তিরিক্ষি হাসে।কড়া গলায় বললো—

“সামলাতে হবে না তোকে।নিয়ে যাবো জান্নাহ্কে আমি তোর এই বন্দি দশা থেকে।”

রাগে হতবিহ্বল সারহান সজোড়ে ঘুষি মারে রাফাতের মুখে।ঘুষি গিয়ে লাগে রাফাতের ঠোঁটে।ঠোঁট কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়তেই তা আঙুলে স্লাইড করে নেয় রাফাত।পৈচাশিক হেসে বললো–

“দেখলি না মেহনাজ তোর মেয়েকে কী করে নিয়ে গেলো।জান্নাহ্কেও নিয়ে যাবো আমি।এখান থেকে দূরে,অনেক দূরে।তোর ছায়ায়ও পড়তে দিবো ওর উপর আমি।”

চিৎকার করে উঠে সারহান।উপস্থিত অনেকেই থমকে যায়।ডিজে বয় তার গান বন্ধ করে চকিত চোখে তাকিয়ে থাকে।দাম্ভিক গলায় বলে উঠে সারহান—

“আমার রজনীগন্ধা শুধু আমারই।তার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সে আমার।তাকে বাঁচতেও হবে আমার সাথে।মরতেও হবে আমার সাথে।আমার প্রাণদেবীকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।”

শব্দ করে শয়তানি হাসি হেসে উঠে রাফাত।কর্কশ গলায় বললো—

“তাহলে আটকা ওকে।আমিও দেখি কী করে তুই জান্নাহ্কে আটকাতে পারিস!
,
,
,
অনেকটা আনন্দ নিয়ে সারহানের পছন্দের খাবারগুলো তৈরি করেছে জান্নাহ্।এক সমুদ্র খুশি তার মনের আনাচে কানাচে উপচে পড়ছে।ইহতিশাম তাকে কথা দিয়েছে সে তাদের মেয়েকে ফিরিয়ে আনবে।জান্নাহ্ তার প্রানকে,প্রানসত্ত্বা ফিরিয়ে দিবে।একটা গাঢ় লাল রঙের জামদানি পড়েছে জান্নাহ্।চোখে গাঢ় কাজল।তার লম্বা চুলে বেনুনির ভাঁজে ভাঁজে ক্লিপের সাহায্যে রজনীগন্ধার গুঁজেছে সে।

বাড়ির দরজার চাবি সারহানের কাছে আছে।তাই তাকে নক করার প্রয়োজন পড়ে না।টেবিলে খাবার গুঁছাতে ব্যস্ত জান্নাহ্।আজ তার পরী তার কাছে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে।
পেছনে ভারী নিঃশ্বাসের শব্দে চকিতে তাকায় জান্নাহ্।সারহান গম্ভীর চাহনিতে দাঁড়িয়ে আছে।প্রাণখোলা হাসে জান্নাহ্।উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো—

“সারহান!

সারহান কিছু বললো না।ত্রস্ত পায়ে গিয়ে ঝাঁপটে ধরলো জান্নাহ্কে।তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে,রক্তে বয়ে গেলো শিহরণ।সারহান তার হাতের বাঁধন শক্ত করতেই আদুরে বিড়ালের মতো তার বুকে গুঁজে যায় জান্নাহ্।দুই হাতে প্রাণকে জড়িয়ে ধরে সে।আর কখনো সে তার প্রাণকে নিজের থেকে আলাদা হতে দিবে না।বেশ সময় ধরে জান্নাহ্কে জড়িয়ে ধরে নিরব হয়ে থাকে সারহান।মাথাটা তার কাঁধ থেকে সরিয়ে এনে গাঢ় দৃষ্টিতে দেখে জান্নাহ্কে।তার অধরে গভীর চুমু খায়।তারপর কপালে,গালে,গলায়।আচ্ছন্ন জান্নাহ্ ভরাট চোখে তাকিয়ে বললো—

“কী হয়েছে সারহান?

সারহান আবারও জান্নাহ্ এর অধর আঁকড়ে ধরে।শুষে নিতে থাকে তার অধরপল্লবের অধরামৃত।তার শার্ট খামচে ধরে জান্নাহ্।চমকিত গলাত প্রশ্ন করে জান্নাহ্—

“আপনার কী হয়েছে সারহান?এমন করছেন কেন?

সারহান মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থেকে বললো—

“আপনি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন রজনীগন্ধা?

বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে জান্নাহ্ বললো—

“এমন কেন বলছেন সারহান!কোথায় যাবো আমি?

“আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড আপনাকে কেড়ে নিবে আমার কাছ থেকে।আমি আপনাকে ছাড়া কী করে বাঁচবো রজনীগন্ধা?

জান্নাহ্ উপর্যুপরি দশেক চুমু খায় সারহানের চোখে মুখে।আশ্বাসিত গলায় বললো–

“কোথাও যাবো না আমি।কোথাও না।আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।”

অবিশ্বাসের সুরে বললো সারহান—

” আপনি মিথ্যে বলছেন রজনীগন্ধা।আপনিও আমার পরীর মতো আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন।আমাকে শাস্তি দিবেন তাই না রজনীগন্ধা!

জান্নাহ্ এর বাঁধ ভাঙে সারহানের মর্মান্তিক কথায়।তার চোখের টলটলে জল,বুকের আর্তনাদ,হৃৎপিন্ডের ভয়াল স্পন্দনে ভীতসন্ত্রস্ত জান্নাহ্।আচমকা অদ্ভুত কান্ড করে সারহান।চোয়াল শক্ত করে,দাঁতে দাঁত চেপে জান্নাহ্ এর গলা চেপে ধরে।আক্রোশ ভরা কন্ঠে বললো—

“আমি বেঁচে থাকতে আমার রজনীগন্ধা অন্য কারো হতে পারে না।”

দম বন্ধ হয়ে আসে জান্নাহ্ এর।তার প্রাণপাখি যেনো তার চোখ দিয়ে উড়াল দিচ্ছে।শ্বাস নিতে না পারাই নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারে সারহানকে।স্থির সারহান গিয়ে পড়ে ডাইনিং আর ড্রয়িং এর মাঝের বিভেদ দেয়ালে।লম্বা দম নেয় সারহান।কেঁশে উঠে জান্নাহ।ব্যগ্র হাতে জগ থেকে পানি ঢেলে সেকন্ডেই গিলে নেয়।সারহান দেয়ালের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে।ধীরে ধীরে তা ঘেঁষেই নিচে বসে পড়ে।জান্নাহ্ এর উদ্ভাসিত চোখ দুটো যেনো বের হয়ে আসছে কোটর থেকে।যেখানটায় সারহানের মাথায় ধাক্কা লেগে ছিলো তা দিয়ে লহুর রেখা এঁকে যায়।তটস্থ হয়ে সারহানের কাছে আসে জান্নাহ্।গুমোট গলায় বললো—

“সারহান!সারহান!
আমি ইচ্ছে করে করি নি।সারহান।”

সারহান মৃদু হাসে।তর্জনী দিয়ে লেপ্টে দেয় জান্নাহ্ এর ঠোঁটের লিপস্টিক।ক্ষীণ সুরে বললো—

“আমি ভালোবাসি আপনাকে রজনীগন্ধা।খুব ভালোবাসি।”

বিলাপ করে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।বললো–

“আপনার কিছু হবে না সারহান।কিছু না।”

স্মিতহাস্য অধরে সারহান বললো—

“তা কী করে হয় রজনীগন্ধা!আমি না মরলে তো আপনি মুক্তি পাবেন না।”

মুক্ত গলায় চিৎকার করে উঠে জান্নাহ্–

“সারহান!এইসব কী বলছেন?

সারহান তার মাথার পেছন থেকে হাত আনতেই দেখে তা রক্তে রাঙানো।সেই রক্ত আদরের সাথে মেখে দেয় জান্নাহ্ এর পাতলা ঠোঁটে।মৃদু গলায় বললো সারহান—

“আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে রজনীগন্ধা।আপনাকে ছাড়া এক মুহূর্ত বাঁচার চেয়ে আমি মরতে রাজি।”

অধর ছড়িয়ে বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কাঁদে জান্নাহ্।ফিরফিরে গলায় বললো—

“এমন বলবেন না সারহান।আপনার কিছু হবে না।আমি এখনই আপনাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো।”

তাচ্ছিল্য হাসে সারহান।নিরুদ্বেগ গলায় বললো—

“আপনি তা পারবেন না রজনীগন্ধা।দরজা আমি লক করে দিয়েছি।পার্সওয়ার্ড ছাড়া তা খুলবে না।আর আপনি আপনার কোমল হাত দিয়ে দরজা ভাঙতেও পারবেন না।”

ঝামটা মেরে উঠে জান্নাহ্।চোখের পানি দুই হাত দিয়ে টেনে মুছে ফেলে বললো—

“কী পাগলামো করছেন আপনি?কোথায় আপনার মোবাইল?আমি তিশাম ভাইয়াকে কল করবো।”

“মোবাইল তো আমি আনি নি রজনীগন্ধা।ফেলে দিয়েছি।আজকের পর তা আর কাজে আসবে না আমার।”

রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে জান্নাহ্।সারহানের বুকে কয়েকটা চাপড় মেরে বললো—

“কী শুরু করেছেন আপনি!কোথায় যাবেন আপনি আমাকে ছেড়ে?আমি আপনাকে কোথাও যেতে দিবো না।সব হারিয়ে আপনাকে পেয়েছি আমি।আমি থাকতে পারবো না আপনাকে ছাড়া সারহান।পারবো না আমি।”

ঝমঝমিয়ে কাঁদে জান্নাহ্।বেডরুমও লক।জান্নাহ্ এর আর কিছু করার নেই সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে সারহান।যেনো নিজের প্রাণ সে নিজেই উৎসর্গ করছে।বাচ্চাদের মতো গলা ফাটিয়ে কাঁদছে জান্নাহ্।তার কান্না শোনার জন্য তার প্রাণই আছে তার সাথে।সারহান নিরুত্তাপ গলায় বললো—

“আমি আমার নামের সব সম্পত্তি জাবিনের নামে করে দিয়েছে।ওর একুশ বছর হতেই এর মালিকানাসত্ত ওর হাতে চলে যাবে।বাড়িটা আমি তিতির নামে করে দিয়েছি।অনেক সহ্য করেছে ওরা আমার জন্য।মা,বাবাকে বলেছি আমাকে ভুলে যেতে।ভাববে সারহানে নামে তাদের কেউ ছিলই না।আপুর কাছে ক্ষমা চেয়েছি আমি।
কিন্তু আপনার ঋণ কী করে শোধ করবো আমি?বলতে পারেন রজনীগন্ধা?

“আমার শুধু আপনাকে চাই।আর কিছু চাই না আমার।কিছু না।”

জান্নাহ্ ঝাঁপিয়ে পড়ে সারহানের বুকে।সারহান জোড়ালো হাতে জান্নাহ্কে চেপে ধরে নিজের প্রশ্বস্ত বুকে।পাঁজর ভাঙা ক্রন্দনে বললো—

“কী করে বাঁচবো আপনাকে ছাড়া আমি রজনীগন্ধা?বলতে পারেন,আপনাকে ছাড়া আমি শ্বাস নিবো কী করে?ওরা যে আপনাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবে!

জান্নাহ্ সমাহিত হয়ে যায় সারহানের বুকে।কোনো কথা বললো না সে।সারহানের বুকের সেই ছোট্ট যন্ত্রটা ক্রমশ বেগবান হচ্ছে।

রাত গভীর হচ্ছে।আকাশ জুড়ে তারার মেলা।চন্দ্র তার আলো ছড়াচ্ছে।বাতাসে বইছে নীরবতা।ধীরে ধীরে সারহানের শ্বাস ভারী হতে লাগলো।জান্নাহ্ এর চোখের পানিতে ভিজে যায় সারহানের বক্ষ:স্থল।

“তুমি আমার এমনই একজন যারে
একজনমে ভালোবেসে ভরবে না এমন,
এক জনমের ভালোবাসা,এক জনমের কাছে আসা
একটি চোখের পলক পড়তেই লাগে যতক্ষন।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here