প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ২৩

0
2267

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ক্লাস ভর্তি স্টুডেন্টদের সামনে চওড়া গলায় কথা বলে যাচ্ছেন অ্যাকাউন্টিং ডিপার্টমেন্টের হেড অতুল প্রসাদ।ত্রস্তে সকল শীতল দৃষ্টি তার দিকে।শম্পার বেখেয়ালি চাহনিতে চোখে পড়ে নিষ্প্রাণ। শ্রেয়ার ক্লাসের দরজা থেকে কিঞ্চিৎ সরে দাঁড়িয়ে আছে সে। মধ্য সারিতে বসা শ্রেয়াখে কনুইয়ের গুতো দিয়ে সপ্রতিভ করে শম্পা। শ্রেয়া চোখে,মুখে বিরক্তি ছাপিয়ে নাক কুঁচকে কপালে প্রমত্তা সাগরের ঢেউ খেলিয়ে জানতে চাইলো কী কয়েছে। শম্পা সরস হেসে চোখ দিয়ে ইশারা করে।দরজার দিকে তাকাতেই নিষ্প্রাণের অনঢ় চাহনিতে আটকে যায় শ্রেয়ার নিটোল চোখ।

গত তিনদিনে অনেকটা ঝুঁকে পড়েছে নিষ্প্রাণের প্রতি শ্রেয়ার ভাবাবেগ। নিষ্প্রাণ চোখে হাসে। শ্রেয়াকে বুঝিয়ে দেয় সে তার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে। আজ নো ক্লাস। লজ্জাভর্তি হাসে শ্রেয়া। মানুষটাকে অকারণেই ভালো লাগে তার। অযথাই চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে ওই প্রাণহীন নামের সজীব মানুষটাকে।
,
,
,
ক্যান্টিনে বসে আছে আয়েন্দ্রি। তার অসাঢ়,নির্জীব দৃষ্টি ক্যান্টিনের কাঁচ গলিয়ে দোতলায় দাঁড়ানো নিষ্প্রাণের পিঠে। হলুদ রঙের শার্ট পরেছে নিষ্প্রাণ। হলুদ রঙটায় কেন যেনো নিষ্প্রাণকে আরো বেশি উজ্জ্বল লাগে।সোনা রঙে ধোয়া কোনো স্নিগ্ধ পুরুষ মনে হয় তখন তাকে! আয়েন্দ্রির সামনেই কৌতূহলী হয়ে চেয়ে আছে সীমান্ত। তার কর্কশ স্বরের প্রশ্ন—

“নিষ্প্রাইন্নারে ওই ছেঁড়াত্যানার পিছে লাগাইলি কেন তুই?

আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণের দিক থেকে চোখ সরিয়ে গুমোট শ্বাস ফেলে বললো—

“মেয়েটা ভালো।”

“ভালো হইলেই তুই ওরে নিষ্প্রাইন্নার লগে সেট কইরা দিবি! তুই আন্দি,আন্দিই থাকবি। ভালা হইতি না।”

আয়েন্দ্রি তার প্রস্তুত করা কথা বলতে পারলো না।ততক্ষণে উগ্রমূর্তির দুটো ছেলে হাতে রড নিয়ে ক্যান্টিনের ভেতরে প্রবেশ করে। অকস্মাৎ হামলা করে বসে সীমান্তের উপর। চকিতে ছেলে দুটোর হামলে পড়া আচরণ ঠাওর করতে না পারায় মর্মান্তিক ঘটনার স্বীকার হয় সীমান্ত। ছেলে দুটো সীমান্তকে উপর্যুপরি কয়েকটা আঘাত করতেই নেতিয়ে পড়ে সে। ভয়ে সিদিয়ে যায় বাকি স্টুডেন্টরা। তারা কোনো রা করলো না। সীমান্তের এই বিধ্বস্ত অবস্থায় নিজেকে সামলাতে পারলো না আয়েন্দ্রি। দুটো ছেলের মধ্যে যে ছেলেটা সীমান্ত কলার চেপে ধরে রেখেছে তার হাতে খাবলা মেরে ধরে সীমান্তকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। ছেলেটা এই অযাচিত বিরক্তি সহ্য করলো না। এক হাতে ধাক্কা মেরে বসে আয়েন্দ্রিকে। আয়েন্দ্রি উল্টে গিয়ে ছিঁটকে পড়ে নিষ্প্রাণ বুকের উপর। তার অধর জোড়া চুম্বকের মতো ঝাপটে ধরে নিষ্প্রাণের গলার সেই পোড়া দাগে। হিমশীতল অনুভূতির সুখ পায়রারা হঠাৎ ডানা মেলে উড়তে থাকে বিশাল নীলাভ অন্তরীক্ষের বুকে। ভয়চকিত শ্বাস ফেলে আয়েন্দ্রি।তার উষ্ণ নিঃশ্বাস নিষ্প্রাণের গলায় পড়তেই শ্বাস আটকে নেয় সে।আলগোছে হাতটা উঠিয়ে আয়েন্দ্রির কোমরে রাখে। নিষ্প্রাণের দৈবাৎ স্পর্শে অনুরণন শুরু হয় আয়েন্দ্রির শুষ্ক ওষ্ঠে।কম্পিত হয় তার পাতলা গড়নের দেহ। আয়েন্দ্রির কানের কাছে মুখ নিয়ে আলতো গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—

“ভয় পাস না ধ্রুবতারা। তোর প্রাণ সবসময় তোর সাথে।”

আয়েন্দ্রিকে বুকের কাছে থেকে সরিয়ে নেয় নিষ্প্রাণ।স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে সামনে এগিয়ে যায়। ক্রোধিত ছেলেটি জানে না অনুপলেই বদলে যাবে চিত্র। নিষ্প্রাণ ছেলেটার ঠিক পেছনে দাঁড়ায়। ছেলেটার হাঁটুর পেছনের দিকে খাঁজটায় নিষ্প্রাণ তার হাঁটু দিকে দুর্বল ধাক্কা মারতেই সামনে দিকে হাঁটু ভাঁজ হয়ে পেছন দিকে হেলে পড়ে ছেলেটা। নিষ্প্রাণ সম্পূর্ণরূপে ছেলেটাকে পেছনে হেলে যেতে দেয়নি। অর্ধ হেলে পড়া ছেলেটার মাথার চুল মুষ্টিবদ্ধ করে এক হ্যাঁচকা টান মেরে ফেলে দেয়। ছেলেটা সটান হয়ে পড়ে যেতেই তার গলায় পা দিয়ে পিষে ধরে নিষ্প্রাণ। ছেলেটার হাতের রডটাও নিয়ে নেয়।তা তার হাতের মধ্যে ধুম করে ঠেসে ধরে। কঁকিয়ে উঠে ছেলেটা। তার সহচর নিষ্প্রাণকে আঘাত করতে গেলে সেই রড দুই হাতে ভালো করে ধরে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে তার চোয়াল বরাবর আঘাত করতেই ছিটকে পড়ে আঘাতপ্রাপ্ত ছেলেটা। ঘটনার ক্রমশ বিস্ফোরণ ঘটে পুরো ভার্সিটি প্রাঙ্গনে। রাজনীতির সাথে জড়িতে আরো কিছু ছেলেপেলে ক্যান্টিনের কাছাকাছি আসতেই নিষ্প্রাণ হুংকার দিয়ে উঠে।

“আর একজন ভেতরে ঢুকলেই এই রড একদম ওর হৃদপিন্ডে ঢুকিয়ে দেবো আমি। সো,ডোন্ট মুভ।”

দশ বারোজন এসেছে ক্যান্টিনের বাইরে। নিষ্প্রাণের কড়া ঘোষণায় নীরব হয়ে যায় তারা। হাতে থাকা অস্ত্রগুলো ভয়ে ঢোক গিলে নিলো। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলতে থাকে আয়েন্দ্রি। হৃদগভীরে মাতম শুরু হয়েছে। উথলে উঠেছে ঢেউ। নিষ্প্রাণের এই ভয়াল রূপে চকিত আয়েন্দ্রি।থরথরিয়ে কাঁপছে সে । ভয়াতুর চোখে তাকিয়ে আছে সে নিষ্প্রাণে লুকোনো হাসির সেই বদনে। তটস্থ হয়ে ছুটে এসেছে প্রাবিশ। নিষ্প্রাণের পা এখনো নাম না জানা ছেলেটার গলার উপর। প্রাবিশ ধাক্কা মেরে সরায় তাকে। ব্যস্ত হয়ে বসে ছেলেটার মাথাটা নিজের হাতে নিয়ে নেয়। সীমান্তের মুখে রক্তের প্রলেপ। তাকে আলতো করে ধরে নিষ্প্রাণ।

ভার্সিটির প্রিন্সিপ্যাল এসে দাঁড়িয়েছে ঘটনাস্থলে।এসেছে সারকসহ অন্যান্য সিনিয়র শিক্ষকবৃন্দরা। ছেলে দুটোকে হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। নিষ্প্রাণকে আদেশ করা হয় প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কক্ষে আসার জন্য। নিষ্প্রাণ নির্ভয়চিত্তে বললো—

“পালিয়ে যাবো না আমি। সীমান্তকে ফাস্ট এইড করিয়ে আসছি।”

নিষ্প্রাণের এহেন দাম্ভিক স্বরে নির্লিপ্ত সকলে। আয়েন্দ্রি বরফ খন্ডের মতো স্থির। শ্রেয়ার দিকে নরম দৃষ্টিকে তাকায় নিষ্প্রাণ। তার চোখের তারায় জ্বলজ্বল করা প্রশ্নরা উত্যক্ত করছে নিষ্প্রাণকে।সীমান্তকে যত্নের সাথে নিয়ে যাচ্ছে প্রাবিশ।আয়েন্দ্রির সামনে এসে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ। চোখে হেসে বললো—

“চল ধ্রুবতারা।”

আয়েন্দ্রি সম্মোহিনী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।তার মনে হলো নিষ্প্রাণ তার নিঃসাড়,নিশ্চল,স্থির শরীরটাকে নিজের সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে।
,
,
,
বেডে শুইয়ে আছে সীমান্ত। তার চোয়ালের উপরের অংশে দুটো স্টিচের প্রয়োজন পড়েছে। কোমরের যে অংশে রডের আঘাত লেগেছে সেখানের হাড়ে দেখা দিয়েছে ফ্র্যাকচার। আপাতত তাকে মাস অতিবাহিত করতে হবে হসপিটালের শুভ্র বিছানায়।

তার পায়ের দিকের একটা চেয়ারে বসে আছে আয়েন্দ্রি। মুখে ফ্যাকাশে রঙ।নির্লিপ্ত চাহনি।শীতল অনুভূতি।প্রাবিশ খবর দিয়েছে সীমান্তের বড়ো ভাইকে।সে আসতে সময় নিচ্ছে।ঢাকা শহরের জ্যাম আমাজানের জঙ্গলের মতো।

নিষ্প্রাণের দিকে কেমন রাগাম্বিত চোখে তাকিয়ে আছে প্রাবিশ। সে শঙ্কিত,ভীত,সন্ত্রস্ত। নিষ্প্রাণ উঠে দাঁড়ায়।ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রাবিশের কাছে এসে অনুনয়ের সুরে বললো—

“সীমান্তের ভাই আসলে ধ্রুবতারাকে বাসায় পৌঁছে দিস।আমি ভার্সিটিতে গেলাম। আসি।”

প্রাবিশ নীরব সম্মতি দিলো। হসপিটালের করিডোর দিয়ে যখন উন্মনা পা দুটো চালাচ্ছে নিষ্প্রাণ পেছন থেকে পেলব গলায় ডেকে উঠে আয়েন্দ্রি।

“প্রাণ!

দমকে যায় নিষ্প্রাণ। কাতর চোখ দুটো দিয়ে ফিরে তাকায়। ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে আয়েন্দ্রির সামনে এসে আদুরে গলায় বললো–

“কিছু বলবি?

আয়েন্দ্রি কোনোরকম ভাবাবেশ ছাড়াই তীক্ষ্ম কন্ঠে প্রশ্ন করে—-

“ছেলেগুলোকে এভাবে কেন মারলি?

অধর কিঞ্চিৎ দুলিয়ে হাসে নিষ্প্রাণ। ভয়ংকর সুন্দর হাসি। হালকা ঝুঁকে আয়েন্দ্রির কানের কাছে গিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো—

“ছেলেটা ভুল করে তোকে ছুঁইয়েছে তাই শুধু ওকে মেরেছি। মেরে ফেলেনি।”

সোজা হয় নিষ্প্রাণ। কর্তৃত্বের সুরে বললো—

“বাসায় যা। আর সাবধানে যাবি।”

“তোকে ভার্সিটি থেকে বের করে দিবে!

নিষ্প্রাণ হৃদয় গলানো হাসে। বিগলিত গলায় বললো—

“দিলে দিবে।কিন্তু তোকে ছাড়া আমি কোথাও যাচ্ছি না। তুই আমারই থাকবি।এই নিষ্প্রাণের প্রাণ তুই।আমার বিভাবরীর একমাত্র ধ্রুবতারা।”

আয়েন্দ্রি ভয়াতুর চোখে তাকিয়ে থাকে। তার বুকের ভেতরের সুপ্ত বালিকা বলে উঠে–

“এমন বুকের ভেতর উম,তোমার হৃদপ্রকোষ্ঠে ঘুম,
এমন আদরে জড়ানো মন,আমার কাটছে দ্বিপ্রহর,
তোমার অতন্দ্রিত নক্তের শ্বাস,আমার করেছে সর্বনাশ,
আমার শোধিত অঙ্গের ক্ষরণ,তোমার দৈবাৎ ত্রসনে মরণ।”

—- আইশা

নিষ্প্রাণ চলছে। দ্বিধাহীন,নির্বিঘ্ন,নিরুদ্বেগ পথচলা।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here