#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
নির্বাক পরিবেশ । মৌনতায় আচ্ছন্ন রাজন শিকদার ।তার গম্ভীর ভাবাবেশে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই নিষ্প্রাণের । পর্দা কাঁপিয়ে প্রবিষ্ট হওয়া প্রভঞ্জনে নির্বাক পরিবেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয় । মৌনতা ভাঙলেন রাজন শিকদার । থমথমে গলায় বললেন—
“তুমি কি আমাকে দেওয়া কথা ভুলে গিয়েছো?”
নিষ্প্রাণ অনমনীয় গলায় বলল—
“না ।”
“তাহলে? কোন সাহসে তুমি মারামারি করেছো?”
কাউচে বসে আছে নিষ্প্রাণ । অবনত মস্তিষ্ক । রাজন শিকদার নিষ্প্রাণের চোখ দেখতে পারছেন না । দেখতে পেলে হয়তো তিনি অবগত হতেন, কী ভয়াল ধ্বংস যজ্ঞের পায়তারা করছে নিষ্প্রাণ!
নিষ্প্রাণ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল—
“ওরা আমার বন্ধুকে মেরেছে । একজন দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন বন্ধুর মতো আমি শুধু তার প্রতিবাদ করেছি ।”
রাজন শিকদার ক্ষেপে উঠলেন । রিনরিনে গলায় বললেন—
“আমি তোমাকে পড়তে পাঠিয়েছি । প্রতিবাদ করতে নয় ।”
নিষ্প্রাণ নির্বাক রইল । শিরায় শিরায় ধাবমান রক্তকণিকায় ঝড় উঠেছে । কিন্তু তার ছিঁটেফোটাও বাইরে প্রকাশ করল না নিষ্প্রাণ । নিগূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন রাজন শিকদার । নিষ্প্রাণকে বোঝার চেষ্টা করছেন তিনি । কিন্তু ব্যর্থ হলেন ।
রাজন শিকদার তেঁতে উঠলেন । দারাজ গলায় বললেন—
“আর যেন কোনো ভুল না হয় । তোমাকে আমি দ্বিতীয় সুযোগ দেবো না ।”
নীরবতা নেমে এলো । এলোমেলো চিন্তা ভর করল নিষ্প্রাণের মস্তিষ্কে । মনে পড়ল তাকে ফিরতে হবে । তার ধ্রুবতারার কাছে ফিরতে হবে । ঢাকা শহরের কাছাকাছি একটা মফস্বলে থাকে নিষ্প্রাণের দাদু । এখানে আসতে দুই ঘন্টা সময় লেগেছে । নীরবতায় ছন্দ তুললেন রাজন শিকদার । বললেন—
“মেয়েটার সাথে কী সম্পর্ক তোমার?”
নিষ্প্রাণ নিম্নমুখী শিয়রে চোখের জায়গা পরিবর্তন করল । আঁখিপল্লব প্রশস্ত করে দাদুর দিকে তাকাতেই নিষ্প্রাণের ললাটে ভাঁজের রেখা অঙ্কিত হলো । ভারী গলায় বলল—
“ভালোবাসি ওকে আমি ।”
রাজন শিকদার ক্ষেপাটে গলায় বললেন—
“পড়তে পাঠিয়েছি তোমাকে আমি । ভালোবাসতে নয় ।”
নিষ্প্রাণ অধর ছড়িয়ে শ্বাস ফেলল । নাকের ডগা ফুলিয়ে ধৈর্যহারা গলায় বলল—
“ভালোবাসি ওকে আমি । বিয়ে করিনি । আপনাকে যা কথা দিয়েছি তা আমি রাখব । দুই বছর সময় চেয়েছি ওর কাছে আমি । ততদিনে আপনাকে দেওয়া শর্তও পূরণ হয়ে যাবে । অনার্স কমপ্লিট হবে আমার ।”
রাজন শিকদার রঞ্জিত চোখে তাকালেন । রাগে থরথরিয়ে যাচ্ছে তার শরীর । উত্তাপিত গলায় শাসিয়ে উঠলেন—
“ভুলে যেও না তুমি কী করেছো!”
নিষ্প্রাণ দুর্বোধ্য হাসল । মিহি গলায় বলল—
“ভুলিনি । ভুলবো না ।”
“নিষ্প্রাণ!”
রাজন শিকদার ভয়ংকর হুংকারের সাথে উঠে দাঁড়ালেন । নিষ্প্রাণ নিরুত্তেজ । রাজন শিকদার অশিথিল স্বরে বললেন—
“তুমি এখনও সুস্থ নও । নিজের দিকে নজর দাও নিষ্প্রাণ ।”
“ধ্রুবতারাকে আমি ভালোবাসি ! ওকে বিয়ে করবো আমি ।”
রাজন শিকদার বিতৃষ্ণা হয়ে উঠলেন । কর্কশ কন্ঠ আওড়ালেন—
“তারা বেঁচে নেই নিষ্প্রাণ ।”
“ও নয়নতারা নয় । ও আমার ধ্রুবতারা । নয়নতারার মতো ওকে আমি ঝড়ে যেতে দেবো না । ধ্রুবতারার মতো আমার অন্ত:পুরের আকাশে অবিরত, অহর্নিশ জ্বলবে । কী রাত, কী দিন! এই নিষ্প্রাণের প্রাণস্পন্দন ও । ওর দিকে হাত বাড়াবেন না দাদু । ওর গায়ে একটা টোকা পড়লে আমি ভুলে যাবো আপনি আমার দাদু । বারো বছর আগে যা হয়েছে তা আমি ভুলতে চাই । প্লিজ হেল্প মি ।”
নিষ্প্রাণের প্রতিটি শব্দ যেন এক একটা বিষাক্ত বাণ হয়ে বিঁধলো রাজন শিকদার কর্ণরন্ধ্রে । আঁতকে উঠলেন তিনি । নিষ্প্রাণ অনুপল ব্যয় ব্যতিত রাজন শিকদারের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো । সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পুরো হলরুমে চোখ বোলালো নিষ্প্রাণ । হলরুমের একপাশে সুবিশাল ডাইনিং টেবিল । অন্যপাশে বসার জায়গা । এই অট্টালিকার মতো বাড়িতে রাজন শিকদার একাই থাকেন । আর তার দেখাশোনার জন্য আছে কিছু ভৃত্য । নিষ্প্রাণ ধীর পায়ে নেমে আসে নিচে । বাড়ির বাইরে আসতেই এক ঝলক ভানুপতির তীক্ষ্ম কিরণ তার চোখে হানা দেয় । নিষ্প্রাণ একটা লম্বা শ্বাস টেনে বামদিকে তাকায় । সেখানে আরও একটি দালান আছে । পুরোনো, প্রায় নিঃশেষিত । নিষ্প্রাণ অধর কোণে হাসল । ওই দালানে কেউ থাকে না । রাজন শিকদার তাতে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন । সেখানে কারো প্রবেশাধিকার নেই ।
নিষ্প্রাণ বাম হাতের সাহায্যে তার ঝাঁকড়া চুলগুলো পেছনে হেলিয়ে দেয় । সূর্যের প্রখর তাপে ঘাম জমেছে তার চোখে, মুখে । ফোঁস করে শ্বাস ফেলল নিষ্প্রাণ । নরম পায়ে এগোতে থাকে বাড়ির পেছনের দিকে । নিজের কক্ষের জানালা থেকে নিষ্প্রাণের প্রতিটি প্রতিক্রিয়া গভীরভাবে অবলোকন করলেন রাজন শিকদার । মোবাইলে ডায়াল অপশনে গিয়ে সেই পরিচিত নাম্বারে কল করলেন । ওপাশ থেকে রাশেদের ব্যতিব্যস্ত জবাব—
“বলুন, জনাব।”
“ডক্টর সার্জিও বর্তমানে করাচিতে । তাকে খবর দাও । নিষ্প্রাণকে আরেকবার স্ট্যাডি করতে বলো । সুন!
রাশেদ শশব্যস্ত গলায় বললেন—
“জি, জি জনাব।”
রাজন শিকদার কল কাটতেই যেন রাশেদের গলা থেকে মাছের কাঁটা নামল।
,
,
,
বাড়ির পেছনে বুনো গাছপালায় ভরা । নিষ্প্রাণ সন্তর্পনে এগিয়ে যাচ্ছে । একটা বিশাল আমগাছের নিচে উঁচু ঢিবির মতো জায়গা । নিষ্প্রাণ থামল । ঢিবিটি কারো কবর । নিষ্প্রাণ বসল । কবরটি প্রায় সমান হয়ে গিয়েছে । এখন আর তাকে উঁচু ঢিবি বলা যাবে না । বুনো লতাপাতায় বোঝার উপায় নেই কারো কবর ছিল এখানে !
নিষ্প্রাণ কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে স্যাঁতসেঁতে মাটির উপর রাখল । হাত দিয়ে কবরের উপরের লতাপাতা সরিয়ে নিমেষহীন চোখে চেয়ে রইল । খানিক সময় পরে উঠে এসে অদূরে থাকা অলকানন্দা গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াল । মুচকি হাসে নিষ্প্রাণ । কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে কবরের উপর একটা একটা করে রাখে । নিষ্প্রাণের অধরে লুকায়িত হাসি । সেই হাসিতে তাচ্ছিল্যতা । পাশ থেকে ব্যাগটা নিয়ে তার চেইন খুলে গোলাপের গুচ্ছ বের করে । পাঁপড়িগুলো প্রায় ঝড়ে গিয়েছে । হতপ্রায় ফুলগুলোর পাঁপড়িতে হাত লাগাতেই তা আপনাআপনিই ঝড়ে পড়ে । নিষ্প্রাণ আদুরে হাতে তা কবরের উপর ছিটিয়ে দেয় । একটা বইয়ের ভেতর থাকা শুকনো বেলি, রজনীগন্ধা, রঙ্গন একের পর এক ছড়িয়ে দিতে থাকে অনুরূপভাবে । ঝরা গলায় বলল–
“কেমন আছো তারা? জানি ভালো নেই ? একা কেউ ভালো থাকে? থাকে না । আমিও ছিলাম না । কিন্তু এখন থাকবো । আমার ধ্রুবতারা এসেছে । ওকে নিয়ে ভালো থাকবো আমি ।”
ঝরঝর করে হেসে ফেলে নিষ্প্রাণ । অদ্ভুত সেই সিটির সুর বেজে উঠে তার গোলাকার ওষ্ঠাধরে । ঘাড় বাঁকিয়ে আরেকটি কবরের দিকে তাকায় নিষ্প্রাণ । যেখানে সমাহিত তার চোখের সামনে আত্মাহুতি দেওয়া সেই নারী । যার জঠর থেকে জন্ম নিয়েও সে একটা রাতের জন্যও তার বুকে ঘুমাতে পারেনি।
চলবে,,,