প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ৩০

0
2219

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

গম্ভীর চোখে চেয়ে আছেন আলফাজ সাহেব। তার চাহনিতে নিষ্প্রাণের হাবভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। সে নির্দ্বিধায় খেয়ে যাচ্ছে। টেবিলের একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন ঝুমা। তার পাশ ঘেঁষেই আয়েন্দ্রি। আলফাজ সাহেব বেজায় বিরক্ত হলেন নিষ্প্রাণের এহেন আচরণে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন—

“কী করা হয়?”

মুখে দেওয়া খাবারের লোকমা গেলতে পারল না নিষ্প্রাণ। চোখ তুলে তাকিয়ে আনম্র গলায় বলল—

“খেয়ে নেই স্যার? তারপর কথা বলি।”

চোখের কোণ বাঁকিয়ে আয়েন্দ্রির দিকে তাকাল নিষ্প্রাণ। চতুর চাহনি। আলফাজ সাহেব চড়া হলেন। অসহ্যকর চাহনিতে মেয়েকে দেখলেন। আয়েন্দ্রির কাতর চোখে শান্ত হলেন তিনি। খাবার টেবিলে আর কোনো কথা হলো না।

খাওয়া শেষে নিজের ঘরে গেলেন আলফাজ সাহেব। বসার ঘরে বসে আছে নিষ্প্রাণ। অনুদ্বেগ, নিরুত্তেজ, স্থির। চট করে তার পাশে বসে আরিশা। একগাল হেসে বলল—

“থ্যাংক ইউ! জানো? অলিক স্যারকে কোচিং থেকে বের করে দিয়েছে! আই এম সো হ্যাপি।”

নিষ্প্রাণ চোখে হেসে স্নিগ্ধ স্বরে বলল—

“অলওয়েজ বি হ্যাপি!”

আরিশা ফিক করে হেসে ফেলে। চটপটে গলায় বলল—

“এই তুমি বিয়ে করছো কবে? আমি আপুকে বলেছি। আমাকে বিয়েতে একটা লাল শাড়ি কিনে দিতে। লাল টুকটুক সাজবো আমি। ইশ! কবে হবে তোমার আর আপুর বিয়ে?”

নিষ্প্রাণ মিষ্টি করে হেসে ঝরা গলায় বলল—

“যখন তোমার আপু কবুল বলবে!”

আরিশা উচ্ছ্বাসিত গলায় বলে উঠে—

“আরে, আরে জলদি, জলদি করো। ইশ! আমি কিন্তু খুব সাজবো!”

“ওকে কিউটি।”

তীক্ষ্ম স্বর ভেসে আসে আয়েন্দ্রির। রঞ্জিত চোখে কাটকাট গলায় বলল—

“এক চড় মেরে দাঁত ফেলে দেবো। যা এখান থেকে।”

আরিশা মুখভর্তি হাসি নিয়ে ফিচেল গলায় বলল—

“এমন করছো কেন? তোমার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে যাচ্ছি না- কি?”

আয়েন্দ্রি রাগ দেখিয়ে বলল—

“বেয়াদব মেয়ে কোথাকার! যা এখান থেকে।”

দুই বোনের কথায় মুচকি হাসে নিষ্প্রাণ। তার চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় কাতর হয় আয়েন্দ্রি।
কিছু সময় পর আলফাজ সাহেব আসেন। নিষ্প্রাণ তাকে দেখেই বিগলিত হাসে। সম্মানপূর্বক ওঠে দাঁড়ায়।
নিষ্প্রাণকে বসতে বলেন আলফাজ সাহেব।

ঘড়ির কাটা টিকটিক করে চলছে। সন্ধ্যারাত ক্রমশ নিশুতি রাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আলফাজ সাহেব ভারী গলায় প্রশ্ন করলেন—

” ফ্যামিলিতে কে কে আছে?”

নিষ্প্রাণ আলতো চোখে তাকায় আয়েন্দ্রির দিকে। তার এ চাহনির মানে, “আয়েন্দ্রি কী বলেনি তার সম্পর্কে?। নিষ্প্রাণ মোলায়েম গলায় প্রত্যুত্তর করে।

“সবাই আছে।”

আয়েন্দ্রি ভড়কে যায়! দমবন্ধ করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আলফাজ সাহেবের কঠোর দৃষ্টিতে থমকে যায়। নিষ্প্রাণের দেওয়া উত্তরে ক্ষুব্ধ হলেন আলফাজ সাহেব। ক্ষুণ্ণ গলায় বললেন—

“মানে কী?

নিষ্প্রাণ শীতল চোখে চেয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল—

“যার কেউ নেই পুরো দুনিয়াটাই তার। সেক্ষেত্রে সবার পরিচয় দেওয়া কী আদৌ সম্ভব?”

আলফাজ সাহেব মুখ বিকৃতি করলেন। মনে মনে রাগ চড়ে গেল তার। তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন—

“আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাও। আর সেই মেয়ের বাড়িতে এসেই খাওয়া দাওয়া!
বিয়ের পর আমার মেয়ের ভরণপোষণ করতে পারবে তুমি?

নিষ্প্রাণ তার মায়ময় চোখের নিগূঢ় চাহনি আবদ্ধ করল আয়েন্দ্রির তরল মুখে। তারপর ঠোঁটে। এই ঠোঁটের জন্যই এতকিছু। ওই ঠোঁটের মালিকানাসত্ত্ব তাকে পেতেই হবে। তার ধ্রুবতারাকে তার চাই। তার অমারজনীর একমাত্র তারা করে চাই।

নিষ্প্রাণ নজর ঘোরায়। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে নিরুদ্বেগ গলায় বলল—

“আমি তো এখানে আপনার জামাই হয়ে আসিনি! ধ্রুবতারার বন্ধু হয়ে এসেছি। মায়ের ছেলে হয়ে এসেছি। আরিশার ভাই হয়ে এসেছি। একবেলা খাওয়ার জন্য কাউকে খোঁটা দেওয়া কোনো ভদ্রলোকের কাজ বলে আমি মনে করি না। ”

তেঁতে উঠলেন আলফাজ সাহেব। ক্ষোভিত গলায় বললেন—

“কী বলতে চাও তুমি? কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে আমি আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দেবো?”

“ভালোবাসার যোগ্যতায়।”

তীব্র রাগের পরিস্ফুটন ঘটালেন আলফাজ সাহেব। রিনরিনে গলায় বললেন—

“তুমি আমার মেয়েকে ভালোবাসো। শুধু এই একটা কারণে আমি আমার মেয়েকে তুলে দেবো! ভাবলে কী করে তুমি?”

আলফাজ সাহেবের বিস্ফোরিত রাগে ধুকপুক করে ওঠে আয়েন্দ্রির অন্ত:রিন্দ্রিয়। ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস ফেলে বলল—

“বাবা, তুমি একটু ওর কথাটা শোনো।”

আলফাজ সাহেব কর্কশ স্বরের বর্ষণ ঘটালেন। নিষ্প্রাণ সমাহিত। তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আয়েন্দ্রির চোখ ভিজে উঠে। তার দিকে একবার পলক ফেলে তাকায় নিষ্প্রাণ। চোখের কোণ সংকুচিত করে তীক্ষ্ম চাহনিতে তাকিয়ে থাকে। আলফাজ সাহেব উগ্রমূর্তি ধারণ করলেন। বললেন—

“কারো দায়িত্ব নিতে হলে নিজেকে আগে তার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। ধরণীর মাটিতে দাঁড়িয়ে চাঁদকে সবাই দেখে। কিন্তু তাকে পাওয়া আশা করতে নেই।”

নিষ্প্রাণ মনোষ্কোনে হাসে। যোগ্যতা! তার যোগ্যতাকে টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা হচ্ছে! কিন্তু ওই মানুষটা জানে না, যে অর্থের বড়াই সে করছে নিষ্প্রাণের কাছে তার মূল্য জিরো! তিনজন আলফাজ সাহেবকে কেনার ক্ষমতা রাখে নিষ্প্রাণ। কিন্তু আপাতত সে তার পরিচয় সকলের অগোচরে রাখবে। রাজন শিকদার নিষ্প্রাণকে শর্ত দিয়েছে, একজন সাধারণ মানুষের মতোই তাকে তার জীবন অতিবাহিত করতে হবে। অনার্স কমপ্লিট হওয়ার আগ পর্যন্ত সে কাউকে তার পরিচয় দিতে পারবে না। নিষ্প্রাণ এইটাকে তার করা অন্যায়ের মাসুল মনে করে। কিন্তু রাজন শিকদার ভেবে রেখেছেন অন্যকিছু।

তিনি নিষ্প্রাণের সুস্থ মস্তিষ্কের প্রমাণ চান। এক প্রাণহীন পুরুষের মাঝে প্রাণের সঞ্জারণ চান। যে মানুষ নিজের হাতে তার জন্মদাতা পিতাকে খুন করেছে!
চিকিৎসার জন্য নিষ্প্রাণকে পাঠানো হয় ইংল্যান্ড। বারো বছর সেখানেই কাটায় নিষ্প্রাণ। তাকে স্বাভাবিক জীবন কাটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে আসতে হয় নিজের দেশে।

নিষ্প্রাণ বেশ কিছু সময় নীরব থাকল। নীরবতা কাটিয়ে সহজ গলায় বলল—

“আমি আপনার কাছে সময় চাইছি। মাত্র দুটো বছর দেবেন আপনি আমাকে। আমি কথা দিচ্ছি। আপনার মেয়েকে আমি রাণি বানিয়ে রাখব। যদি সে যোগ্যতা আমি অর্জন করতে না পারি, তাহলে আমার আকাশের ধ্রুবতারাকে আমি আপনারে হাতে সৌপর্দ করে যাব।”

বিতৃষ্ণ চোখে তাকালেন আলফাজ সাহেব। তার ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো। নিষ্প্রাণের আস্ফালন দেখে তিনি রীতিমতো বিস্মিত হলেন! নিষ্প্রাণ আনম্র গলায় বলল—

“সব বাবা, মা- ই তার সন্তানের ভালো চায়। মেয়েদের বাবা, মা আরো একধাপ এগিয়ে। তাদের অনেক কিছু ভাবতে হয়। দুই বছর অনেকটা সময়। ভাবুন, দেখুন, সঠিক সিদ্ধান্ত নিন। চাঁদ সবাই চায়। তাকে পাওয়া সম্ভব নয় তা জেনেও তাকে পেতে চায়। এসব মানুষের স্পর্ধা নয়, তাদের অনুরক্তি, প্রেম! চাঁদকে পাওয়া জরুরি নয়। চাঁদের অনুরূপ যে কেউ তার জ্যোৎস্নায় আকাঙ্ক্ষীত মানুষটির অমানিশিকে আলোকিত করতে পারে। ”

আলফাজ সাহেব কথা বাড়ালেন না। দ্বিরূক্তি করলেন না কোনো। কিন্তু নিষ্প্রাণ বিচলিত নয়। তার ধ্রুবতারাকে তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। তার ছায়াও নয়।

আঁধার কালো নভোলোকে রুপার থালার মতো চাঁদ। ঝকমকে তারা। কৃষ্ণকায় নভোলোক ভেদ করে স্মমহিমায় উঁকি দিচ্ছে। খিলখিল করে যেন হাসছে! তার নিচে দাঁড়িয়ে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির কঠোর দৃষ্টি হৃদপিন্ড ফুঁড়ে দিচ্ছে তার। জ্বলন্ত গলায় বলল—

“সমস্যা কী তোর? ভালোভাবে কথা বলতে পারিস না? এইসব কী বলছিলি বাবাকে?”

নিষ্প্রাণ একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নেয়। অধর ছড়িয়ে তা নিঃসৃত করে। মিহি গলায় বলল—

“যা সত্যি তাই বলেছি। এর চেয়ে ভালো জবাব আমার কাছে ছিল না।”

“তাই বলে তুই…।”

আয়েন্দ্রির কথার মাঝপথেই তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিষ্প্রাণ। অপাংক্তেয় কাজ করে বসে। আয়েন্দ্রির হাতে শক্ত করে অধর চেপে ধরে। হতভম্ব হয়ে যায় আয়েন্দ্রি। তরলে ভরে ওঠে আঁখিদ্বয়। চন্দ্রিকার ক্ষীণ আলোতে তা চিকচিক করে ধরা দিচ্ছে নিষ্প্রাণের চোখে। অপ্রমেয় মায়ায় নিজের হাত ছোঁয়ায় আয়েন্দ্রির গালে। ঝনঝনিয়ে ওঠে আয়েন্দ্রির নিদ্রিত নারীমন। ভারী শ্বাস ফেলে আচ্ছন্ন চাহনিতে তাকাতেই সরব গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে নিষ্প্রাণ—

“ভালোবাসিস আমাকে?”

ডুকরে উঠে আয়েন্দ্রি। ভারী বর্ষণ ঝরিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল—

“হুম।”

নিষ্প্রাণ চোখে হাসে। আয়েন্দ্রির ‘হুম’ শব্দেই নিষ্প্রাণের পুরুষমনে কাতরতা দেখা দেয়। দাম্ভিকতার সাথে বলল—

“ভরসা রাখ আমার উপর।”

আয়েন্দ্রি তার চোখের ধারা দমন করে। ঝাপসা চোখ দুটো মুছে নিয়ে নিরেট গলায় বলল—

“বাসায় যা। অনেক রাত হয়েছে।”

“যাচ্ছি।”

“সাবধানে যাবি।”

“ওকে মাই লাভ। বাই। সি ইউ সুন।”

আয়েন্দ্রিকে বিদায় জানিয়ে চলতে শুরু করে নিষ্প্রাণ। ছোট ছোট পা ফেলে অদম্য চলা। আয়েন্দ্রি অনিমেষ চেয়ে থাকে আবছায়াতে। একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে নিষ্প্রাণ তমসাচ্ছন্ন, নীরব পরিবেশে।
,
,
,
সেই গলিতে ঢুকে চঞ্চল মনে হাঁটতে থাকে নিষ্প্রাণ। তড়াক করে মস্তিষ্ক ঝেঁকে ওঠে সেই কুকুরের কথা। নিষ্প্রাণ তার শুষ্ক অধরের বলয় করে সিটি বাজাতে থাকে। কিন্তু কুকুরটিকে কোথাও দেখল না সে। থমকে যায় নিষ্প্রাণ। সোডিয়াম বাতির আলোতে এধার ওধারে তাকিয়েও কোনো কিছু তার দৃষ্টিগোচর হলো না। পাশ দিয়ে একটা লোক যাচ্ছিল। নিষ্প্রাণ আনম্র গলায় তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে কুকুরটির কথা। লোকটি জানায় আজ সকালেই একটা গাড়ির নিচে চাপা পড়ে কুকুরটি। সারাদিন রাস্তায় পড়েছিল কুকুরটির প্রাণহীন দেহটি। সন্ধ্যার দিকে সিটি কর্পোরেশনের লোক এসে দেহটিকে নিয়ে যায়।

বিষণ্ণ শ্বাস ফেলল নিষ্প্রাণ। লোকটি চলে যায় তার গন্তব্যে। নিষ্প্রাণের মনে হলো, সেই কালো কুকুরটি লেজ নাড়াতে নাড়াতে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিষ্প্রাণ বিনা দ্বিধায় বসল। কুকুরটির মাথায় হাত বোলাল। নরম গলায় বলল—

“তোর সাথে শেষবারের মতো দেখা হলো নারে! ক্ষমা করিস আমায়।”

কুকুরটি সশব্দে ডেকে ওঠে। নিষ্প্রাণ অদ্ভুতভাবে ঘাড় নাড়িয়ে সিটি বাজাতে থাকে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here