#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
দুই পাশের হাই বেঞ্চের মাঝে লো বেঞ্চ। তার উপরেই হাত, পা মুড়িয়ে রোদনে আচ্ছন্ন আয়েন্দ্রি। ঘণ্টা ধরে চলা নিরবধি ক্রন্দনে গলা জমে এসেছে তার। পাতলা ঠোঁট দুটো ফুলে উঠেছে। কালো মনির সফেদে ভাসমান চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কুসুম চিন্তিতচিত্তে চেয়ে আছে আয়েন্দ্রির রোদনভরা আননে।
অনায়তন গলায় বলল—
“কেঁদে কী হবে বল্?”
ভ্যা ভ্যা করে চোখের শ্লথ ধারা স্ফীত ধারায় রূপ নেয়। ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায় কুসুম। কান্নার তোড়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আয়েন্দ্রির। হেঁচকি তুলে বলল—
“বাবা এমন কেন করছে?”
কুসুম স্বভাবসুলভ আচরণ করে বলল—
“তা আমি কী করে বলব বল্! আঙ্কলের মাথায় কোন ভূত চেপেছে কে জানে!”
শূন্য ক্লাস রুমে আয়েন্দ্রি আর কুসুম ছাড়া কেউ নেই। ক্লাসের দরজায় আচমকা করাঘাত পড়ে। চকিতে ফিরে তাকায় দুজন। নিষ্প্রাণকে দেখেই ঝমঝমিয়ে ফের বর্ষণ শুরু হয় আয়েন্দ্রির নেত্রযুগলে। কুসুম ওঠে আসে বেঞ্চ থেকে। নিষ্প্রাণের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ গলায় বলল—
“তোরা কথা বল্। আমি বাইরে যাচ্ছি।”
নিষ্প্রাণ ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকায়। আয়েন্দ্রির মাথায় যেন বাজ পড়ল! হুড়মুড়িয়ে উঠে এসে ঝপাৎ করে জড়িয়ে ধরল নিষ্প্রাণকে। চমকিত হয় নিষ্প্রাণ। কাঁপা কাঁপা হাতটা আয়েন্দ্রির পিঠে উপর রাখতেও সংকোচ হচ্ছে তার। সে সোজা দাঁড়িয়ে রইল। মখমলে গলায় বলল—
“কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?”
আয়েন্দ্রি হালকা করে মাথাটা আলগা করে নিষ্প্রাণের বুক থেকে। ঠোঁট ভেঙে বাচ্চা বাচ্চা কন্ঠে বলল—
“বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে প্রাণ।”
এক শীতল ধারা বয়ে গেল নিষ্প্রাণের শিড়দাঁড়া বেয়ে। অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল—
“তো?”
আয়েন্দ্রি চমকে গিয়ে কান্না থামায়। নিষ্প্রাণ থেকে সরে এসে অনুরক্তির গলায় বলল—
“তো! বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দেবে প্রাণ!”
নিষ্প্রাণ বিগলিত হাসে। আয়েন্দ্রিকে বেঞ্চের উপর বসায়। হাঁটু ভাঁজ করে তার সামনে বসে। কৌতূকমাখা গলায় বলল—
“বিয়ে দেবে তার জন্য কাঁদছিস না- কি অন্য কারো সাথে বিয়ে দেবে তাই কাঁদছিস?”
নিষ্প্রাণের বুকে চট করে এক ঘুষি বসায় আয়েন্দ্রি। গা দুলিয়ে হেসে ওঠে নিষ্প্রাণ। নৈঃশব্দে নির্নিমিখ চেয়ে থাকে আয়েন্দ্রির ভেজা মুখটার দিকে। দুই হাত দিয়ে প্রখাঢ় মায়ায় মুখটা মুছে দেয়। আয়েন্দ্রি শান্ত হয়। ধাতস্থ হয় সে। মনে আশ্বাস জাগে। সাহস সঞ্চারিত হয়। আয়েন্দ্রির দুই হাত নিজের প্রশস্ত পাঞ্জায় লুফে নেয় নিষ্প্রাণ। আলতো করে চুমু খায় তাতে। মিষ্টি করে হেসে বলল—
“চিন্তা করিস না। আমি স্যারের সাথে কথা বলব।”
“যদি বাবা না মানে?”
“মানতে হবে।”
“যদি সত্যিই বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়?”
ফিক করে হেসে ফেলে নিষ্প্রাণ। ফিচেল গলায় বলল—
“তাহলে বিয়ে হবে। কিন্তু বাসর আমার সাথেই হবে।”
নাক- মুখ কুঁচকে নিজের অস্বস্তি প্রকাশ করে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের ঝাঁকড়া চুল থেকে এক দলা খাঁমচে ধরে টান মারে। হেসে ওঠে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির হাতের কবজিতে কাটা দাগ। সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে নিষ্প্রাণ—
“হাত কাটল কী করে?”
“গ্লাস ভেঙে গেছে।”
সেই কাটা দাগে আলগোছে অধর ছোঁয়ায় নিষ্প্রাণ। অতলান্ত মায়ায় চেয়ে নরম গলায় বলল—
“ক্লাস করিসনি কেন?”
আয়েন্দ্রি সোজাসাপ্টা উত্তর দেয়।
“ইচ্ছে করছিল না।”
“লাভ কী বল্? শুধু শুধু ক্লাস মিস দিলে পড়ার ক্ষতি হবে। তোকে আর চিন্তা করতে হবে না। আমি কথা বলব স্যারের সাথে।”
“তুই বাবাকে রাজি করাতে পারবি তো?”
নিষ্প্রাণ সাবলীল গলায় বলল—
“চেষ্টা করব।
আজ প্রাবিশের বার্থ ডে মনে আছে তোর?”
আয়েন্দ্রি মিনমিনে গলায় বলল—
“হুম।”
নিষ্প্রাণ উৎসুক গলায় বলল—
“স্যার তোকে আসতে দেবে? এতগুলো ছেলের মধ্যে? সীমান্তও আসবে। আর আমিও থাকব।”
আয়েন্দ্রি ভারাক্রান্ত চোখে চাইলো। নিষ্প্রাণ সরস গলায় বলল—
” আরাজকে নিয়ে আসিস সাথে। তাহলে নিশ্চয়ই স্যার মানা করবে না?”
আয়েন্দ্রির চিত্ত দুলে ওঠে। এই একটা মানুষ যার কাছে তার সমস্ত সমস্যার সমাধান আছে।
“চল্। ক্লাস শেষ। তোকে বাসায় পৌঁছে দেই।”
আয়েন্দ্রি ওঠে দাঁড়ায়। নির্মল হাসে। হট করেই নিষ্প্রাণের ব্যাগ টেনে ধরে বলল—
“তোর এই ব্যাগের মধ্যে কী আছে রে? সারাক্ষণ কাঁধে নিয়ে ঘুরিস!”
নিষ্প্রাণ স্নেহার্দ্র গলায় বলল—
“এখন না। বিয়ের পর দেখাব। এখন চল।”
মুখ বিকৃত করে আয়েন্দ্রি। এই ব্যাগটা এক মিনিটের জন্যও কাছ ছাড়া করে না নিষ্প্রাণ!
ক্লাসরুম থেকে বের হতেই নিষ্প্রাণের ধারালো চোখ জোড়া বদ্ধ হয় সারকের দিকে। নিজের ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসছিল সে। নিষ্প্রাণের শ্বাস ভারী হয়। আয়েন্দ্রি চেয়ে আছে মাঠের দিকে। নিষ্প্রাণের পাশ ঘেঁষে চলে যায় সারক। সারক খানিকটা পেছনে যেতেই নিজের মাত্রাতিরিক্ত রাগের বহিঃপ্রকাশ করে নিষ্প্রাণ। অতি সন্তর্পনে বাম হাত উঠিয়ে পেছন থেকে আয়েন্দ্রির কোমর আঁকড়ে ধরে। হতভম্ব হয়ে যায় আয়েন্দ্রি। চকিতে নিষ্প্রাণের মুখের দিকে তাকায়। নিষ্প্রাণ অরব, নিশ্চল, শান্ত। সারকের পূর্ণ নজর পড়ল সেই অপ্রিয় দৃশ্যে। ভার্সিটি ছুটি হয়েছে অনেকক্ষণ। তাই শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ নিচে নেমেছে। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরাও ব্যস্ত বাড়ি ফেরাতে। করিডোর ফাঁকা। পুরো ভবনে দুটো সিঁড়ি একটা উত্তরে অন্যটা দক্ষিণে। সময় ও সুবিধা অনুযায়ী যার যেইটা পছন্দ সে সেইটা ব্যবহার করে। সারক দক্ষিণ দিকের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে। নিষ্প্রাণ তার হাত সরিয়ে আনে। ছেলেটার অদ্ভুত কান্ডে আয়েন্দ্রি যারপরনাই বিস্মিত হয়!
চলবে,,,