#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
নিষ্প্রাণকে নিয়ে চিন্তিত রাজন শিকদার একটা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন। নিষ্প্রাণ আপত্তি করল না। তাকে পাঠানো হবে মানসিক হাসপাতালে। ডাক্তার সার্জিও এর ওপর আর ভরসা করতে পারলেন না রাজন শিকদার। কিন্তু নিষ্প্রাণ শর্তারোপ করল। সে তার চিকিৎসা করাবে বিনিময়ে তাকে তার ধ্রুবতারাকে এনে দিতে হবে। বংশের প্রদীপ রক্ষার্থে মেনে নিলেন সেই শর্ত রাজন শিকদার। শুরু হলো নিষ্প্রাণের নতুন জীবন। খাঁচায় বন্দি জীবন!
সেই ট্রমা আয়েন্দ্রিকে চুষে খাচ্ছিল। ভুলতে পারিনি সেই বিভীষিকাময় রাত! সেই দৃশ্য! সেই রঞ্জিত প্রেমিক পুরুষকে।
মেন্টালি ভেঙে পড়ে আয়েন্দ্রি। রাত- বিরাতে চিৎকার করে ওঠে। এই বুঝি নিষ্প্রাণ চলে এলো! ঘুমাতে পারে না আয়েন্দ্রি। না পারে খেতে! সেই রক্ত! গা গুলিয়ে ওঠে আয়েন্দ্রির। ছয় মাসে যেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসে আয়েন্দ্রি। তাকে অবজারবেশনে রাখা হয় টানা ছয় মাস। সীমান্ত, প্রাবিশ, কুসুম সবাই মিলে তাকে আশ্বাসিত করে। ভুলে যেতে সেই ভয়ানক দিন। ভুলে যেতে নিষ্প্রাণ নামের মানুষটিকে। নিষ্প্রাণের মেসে গিয়ে বিস্মিত হয় তারা। ঘরের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের রাসায়নিক পদার্থ। প্র্যাকটিকেল ক্লাসগুলো কখনো মিস যেতো না নিষ্প্রাণের। হয়তো সেখান থেকেই কালেক্ট করা বিভিন্ন রাসায়নিক তরল! সীমান্ত আর প্রাবিশ অনুতপ্ত। এইজন্যই হয়তো নিষ্প্রাণ কখনো তাদের ঘরের ভেতরে আসতে দেয়নি। কতটা বোকা ছিল তারা!
ছয় মাস পর আয়েন্দ্রিকে বাসায় আনা হয়। রোজ সীমান্ত, প্রাবিশ, কুসম এসে মন ভোলাতো আয়েন্দ্রির। আয়েন্দ্রি ততক্ষণই সুস্থ থাকত যতক্ষণ তার আশেপাশে মানুষের বিচরণ থাকত। একা হলেই ভয়ে কুঁকড়ে যেতো। এই বুঝি নিষ্প্রাণ এলো!
আয়েন্দ্রির সাথেই ঘুমাত ঝুমা। সারারাত লাইট জ্বালিয়ে রাখত। অন্ধকার সহ্য হয় না আয়েন্দ্রির। মাঝে মাঝে-ই ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে ওঠে। নিষ্প্রাণের নাম আওড়াতে থাকে। ঝুমা নিজের বুকের মাঝে নিয়ে নিতেন মেয়েকে। আবেশিত মায়ার বুক পাঁজরে গুঁজে রাখতেন। কাঁদত আয়েন্দ্রি! একটা প্রাণহীন মানুষকে ভালোবেসে হেরে গেছে সে।
আয়েন্দ্রির বাবাসহ তার বন্ধুরা খোঁজ নিয়েছিল নিষ্প্রাণের। ইন্সপেকটর জানিয়েছিল তাকে ট্রান্সপার করা হয়েছে অন্য সেলে। কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলেন আলফাজ সাহেব।
একবছর লেগে যায় আয়েন্দ্রির সুস্থ হতে। নিষ্প্রাণকে ভুলতে চায় সে। আসলেই কি ভালোবাসার মানুষকে ভোলা যায়? যার চলাচল রন্ধ্রে রন্ধ্রে! শিরা- উপশিরায় যার বহমানতা! হৃদপ্রকোষ্ঠে যার বসবাস! শরীরে রক্তবিন্দু যখন তার নাম জপে, তখনও কী ভোলা সম্ভব সেই মানুষটাকে? যাকে এই হৃদয় দিয়ে চেয়েছে, অন্ধকারে জ্যোৎসা করে চেয়েছে, নিগূঢ় প্রেমের প্রমত্তা ঢেউ করে চেয়েছে, তাকে কী এত সহজে ভোলা যায়? রাতভোর হতেই যার বাহুতে নিজেকে এলোমেলো আবিষ্কার করতে চেয়েছে, যার স্পর্শে নিজের তপ্ত দেহের শীতলতা চেয়েছে, অমোঘ মৃত্যু পর্যন্ত যার প্রাণস্পন্দন হয়ে বাঁচতে চেয়েছে, এত সহজে তাকে ভোলা যায়?
আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একাগ্রচিত্তে দেখছে আয়েন্দ্রি। ভাঙা চোয়াল, ডেবে যাওয়া চোখ, শুষ্ক ঠোঁট, খড়ের গাদার মতো একরাশ চুল। গলার পাশের হাড়ের উপস্থিতি বলে দিচ্ছে এক প্রাণশূন্য মানবী দাঁড়িয়ে আছে ওই আরশির বিপরীতে। নিজেকে কোনো অপার্থিব সত্ত্বা মনে হলো আয়েন্দ্রির। সব শেষ হয়ে গেছে তারা। আশা, ভরসা, ভালোবাসা ! সব। মায়া আর বাস্তবতার কষাঘাতে নিষ্পেষিত হচ্ছে আয়েন্দ্রি। চকিতে গলার সেই চেইন চোখে পড়ে তার। থিতিয়ে থাকা রাগটা যেন উগরে এলো! একটানে ছিড়ে ফেলে দিলো সেই চেইন। ফোঁপাতে থাকে আয়েন্দ্রি। কী দোষ ছিল তার!
চেইন ফেলে দেওয়াতে বিপাকে পড়ে নিষ্প্রাণ। ভালোই কাটছিল তার দিন। হসপিটালের সবচেয়ে ভদ্র আর শান্ত রোগীর খেতাব অর্জন করেছে সে। নার্সরা পর্যন্ত হতবাক! নিজেই সময় মতো মেডিসিন নিয়ে নিত। যেন সুস্থ হওয়ার অনেক তাড়া তার। কিন্তু সেইসবে জল ঢেলে দিলো আয়েন্দ্রি। শান্ত নিষ্প্রাণ আবার হিংস্র হয়ে উঠল। তার মস্তিষ্ক জুড়ে চলতে থাকল আরেক খেল। একদিন হুট করেই ডাক্তারের কেবিনে পৌঁছে যায় নিষ্প্রাণ। সিনিয়র নার্সের সাথে অন্তরঙ্গ দৃশ্য ক্যাপচার করে সেখানকার এক ওয়ার্ডবয়ের মোবাইলে। ব্ল্যাকমেল করে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট করীম হাসনাতকে। বাধ্য হয়ে ডাক্তার নিষ্প্রাণের প্ল্যানে হাত মেলায়। বেশিকিছু চায়নি তো সে! চেয়েছে একটা মোবাইল যাতে করে নির্বিঘ্নে সে তার ধ্রুবতারার খেয়াল রাখতে পারে। যোগাযোগ করে রাশেদের সাথে, আর বলে যেন তার দাদুকে এসব জানানো না হয়। ভীত রাশেদ তাই ই করে। নিষ্প্রাণের পাগলামো সম্পর্কে অবগত হয়েছে সে। শুরু হয় আয়েন্দ্রিকে দেওয়া নিষ্প্রাণের মানসিক যন্ত্রণা !
রোজ কেউ আয়েন্দ্রিকে কল করে! কোথাও গেলে মনে হয় কেউ তাকে ফলো করছে! আবারো শুরু হয়ে সেই বীভৎস দিন! আয়েন্দ্রির মনে ঝেঁকে বসে নিষ্প্রাণের ভয়। রং নাম্বারে কল করা অজ্ঞাত মানুষটি শুধু তীক্ষ্ম সিটির আওয়াজে আয়েন্দ্রি মন, মস্তিষ্ক কাঁপন তুলে দেয়! এরই মধ্যে শিমুল নামের একটি ছেলেকে বাসায় নিয়ে আসে আলফাজ সাহেব। ছেলেটি অনাথ। একটা দোকানে কাজ করত। মিথ্যে চুরির অপবাদ দিয়ে তাকে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়। ঠিকানা হয় আয়েন্দ্রিদের বাসা। কিন্তু শিমুলের ইগল দৃষ্টি সর্বক্ষণ আয়েন্দ্রির ওপর। যার জন্য তাকে এখানে পাঠানো হয়েছে।
রং নাম্বারের নিরন্তর রহস্যঘন কলে অসুস্থ হয়ে পড়ে আয়েন্দ্রি। নাম্বার পরিবর্তন করেও তার থেকে পরিত্রাণ পেল না সে। অবশেষে সারক এলো সেই সমস্যার সমাধান নিয়ে। নাম্বার ট্রেস করে বের করা হলো সেই অপরিচিত লোকটিকে। কিন্তু মৃত!
নিষ্প্রাণের ভয় ঘিরে ধরে আয়েন্দ্রির পুরো পরিবারকে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে রং নাম্বার থেকে কল আসা বন্ধ হয়ে যায়। আয়েন্দ্রির অন্ত:করণ হতে নিষ্প্রাণের ভয় দূরীকরণে প্রগাঢ় উপস্থিতি থাকে সারকের। আয়েন্দ্রির প্রতি তার ভালো লাগাটাও প্রকাশ পায় ততদিনে। আলফাজ সাহেবকে আশ্বস্ত করেন আয়েন্দ্রিকে দেশের বাইরে নিয়ে যাবে যাতে করে এই ট্রমা থেকে সে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারে।
আয়েন্দ্রি কোনোভাবেই বিয়ের জন্য রাজি হচ্ছিল না। ততদিনে বন্ধুমহল শূন্য। আয়েন্দ্রিকে সাপোর্ট করার জন্য সারকই ছিল একমাত্র। সারক তার বদ্ধ অনুভূতির প্রস্ফুটিত করে। যা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে আয়েন্দ্রিকে।
দুই বছর লেগে যায় সমস্ত কিছু ভুলে নতুন প্রভাতের দ্বার খুলতে। পান- চিনি সম্পন্ন হয় সারক আর আয়েন্দ্রির। বিয়ের তারিখও ঠিক হয়।
ঠিক বিয়ের দুই দিন আগে ঘটে সেই অপ্রত্যাশিত, অত্যাশ্চর্য, কল্পনাতীত ঘটনা!
সান্ধ্যকালীণ অস্তাভা সূর্যের আলোক ছটায় যখন ধূসর আকাশ ক্লান্ত, নীড়ে ফেরা পত্রীরা যখন ব্যস্ত কুজনে, মেদিনীর বুকে প্রবাহিত যখন মৃদু সমীরণ, তখনই অদৃশ্য সত্ত্বার ত্রসনের ন্যায় আবির্ভাব ঘটে নিষ্প্রাণের।
বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন সাজানো আয়েন্দ্রির বুক ধড়ফড় করে উঠে নিষ্প্রাণকে দেখে! ভয়ে সিটিয়ে যায় পরিবারের বাকি লোক। নিষ্প্রাণ শান্ত, দুর্ভেদ্য, দুর্দমনীয়। তার সেই কালো ব্যাগের মধ্যে অতি যত্নের সাথে নিয়ে আসে আয়েন্দ্রির জন্য বিয়ের শাড়ি, গয়না। বাধ্য করে তাকে বধূ বেশে আসতে তার সামনে।
নিজের করে নেয় তার ধ্রুবতারাকে। বাধ্য করে তিন কবুল বলে নিজেকে সমর্পণ করতে নিষ্প্রাণের ভয়াল আগ্রাসনে। ডাক্তার করীম হাসনাত থেকে মিথ্যে সার্টিফিকেট নিয়ে দেখায় তার দাদুকে। দাদু চেয়েও থামাতে পারেনি অপ্রতিরোধ্য নিষ্প্রাণকে। নিষ্প্রাণ সত্যিই সেদিন প্রাণহীনের মতো কিছু করেছিল যার ভুক্তভোগী স্বয়ং রাজন শিকদার।
চলবে,,,
(বি.দ্র: আগামী পর্ব থেকে আসবে বর্তমান নিষ্প্রাণ। অতীত আজকেই শেষ।)