প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ৪৫

0
1998

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

প্রত্যুষের মিহি হলদে রোদে ঝলমলিয়ে আছে ধরিত্রী। শান্ত বহ্নিসখে উত্তাল পত্রীদের কিচিরমিচির। ধরিত্রী মাতাকে অসিত আচ্ছাদন থেকে মুক্তি দিয়েছে বিবস্নান। তরল আভায় সিক্ত করেছে কচি পত্রপল্লবকে। শিখর উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সুপারিগাছটায় বসে আছে দুটো কাক। কা কা কর্কশ ধ্বনিতে কাঁপিয়ে তুলছে প্রভাতের নৈঃশব্দ।

রাজন শিকদার তার চিরায়ত কাজে ব্যস্ত। নির্লিপ্ত, নির্বাকভাবে বসে আছেন। বাম পায়ের নিচের অংশ কনকন করছে। ব্যথায় কাতর হলেও তা প্রকাশ করার অবকাশ নেই। গুমড়ে যাচ্ছেন নিজের অন্ত:করণে। আয়েন্দ্রির ত্রস্ত দৃষ্টি। কোমল গলায় শুধায়—

“বেশি ব্যথা হচ্ছে দাদু?”

রাজন শিকদার কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না। থমথমে মুখে বসে রইলেন। তার চোখের কাতরতা মিলিয়ে গেল। হাসমুল দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনেই। আতঙ্কিত সে। দুরুদুরু বুকে বলল—

“আফনে ঘরে যান নয়া বউ। বরো সাহেবরে আমি দেখতাছি।”

আয়েন্দ্রি মৃদু রাগ দেখিয়ে বলল—

“কেন? আমি থাকলে কী সমস্যা?”

আমতা আমতা শুরু করে হাসমুল। মিনমিনে গলায় বলল—

“জে…না…মানে…।”

বিরক্ত হয় আয়েন্দ্রি। ছেলেটাকে অদ্ভুত লাগে তার। সারাক্ষণ চুপকে থাকে রাজন শিকদারের সাথে। তার খাওয়া, গোসল, ঔষধ সব কিছুতেই হাসমুলের একচ্ছত্র অধিকার। আয়েন্দ্রি ভ্রু-বিলাস করে কড়া গলায় বলল—

“আপনি যান, কুসুম গরম করে সরিষার তেল নিয়ে আসুন। আমি দাদুর পায়ে মালিশ করে দেবো।”

হাসমুল ভয়াতুর চোখে চেয়ে অবিশ্বাস্য গলায় বলল—

“কী কইতাছেন নয়া বউ! আফনের করন লাগতো না। আমি মালিশ কইরা দিমু নে। আফনে যান।”

আয়েন্দ্রি ওঠে দাড়ায়। চক্ষু গরম করে বলল—

“আপনাকে আমি যা বলেছি তাই করুন। যান। তেল নিয়ে আসুন।”

থতমত খেয়ে যায় হাসমুল। আয়েন্দ্রির চোখের আগুন বিদীর্ণ করে তার বুক। ভয়ে থরথরিয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশ্য ছুটে। আয়েন্দ্রি শান্ত ভঙ্গিতে রাজন শিকদারের পায়ের কাছে বসে। রাজন শিকদারের হাত কাঁপছে। হাতটা ওঠানোর আপ্রান চেষ্টা অব্যাহত। আয়েন্দ্রি মিষ্টি করে হাসল। সন্তর্পনে রাজন শিকদারের হাতের নিচে নিজের শিয়র অবনত করল। রাজন শিকদার নিজের ঠোঁট চেপে ধরলেন। কান্না পাচ্ছে তার। ধীরে ধীরে তার হাতও নড়াচড়ার শক্তি হারাচ্ছে। হয়তো একদিন সবকিছুই বিলীন হয়ে যাবে। আয়েন্দ্রি উজ্জ্বল চোখে তাকায়। শরতের কাশফুলের অনুরূপ দুই চোখের শুভ্রতায় আপ্লুত হয় রাজন শিকদার। মেয়েটাকে প্রাণ ভরে দোআ করতে ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু তার শরীর সঙ্গ দিলো না।

আয়েন্দ্রি আলতো হাতে রাজন শিকদারের পায়ে মালিশ করতে থাকে। অবিরত গলায় বলল—

“দাদু, একটা কথা বলব?”

রাজন শিকদার স্পষ্ট আওয়াজ করতে না পারলেও মুখের গোঙানিতে অনেক কিছুই সামনের ব্যক্তিকে বোঝাতে সক্ষম হন। আয়েন্দ্রি নতজানু মুখটা উঁচু করে রাজন শিকদারের চোখের দিকে তাকাল। তিনি তার পাঁপড়ি ঝাকালেন। প্রশ্রয় পেয়ে প্রশ্ন করল আয়েন্দ্রি।

“প্রাণকে আপনি কেন বাড়ন করেছিলেন যেন সে কাউকে তার সত্যিকারের পরিচয় না বলে?”

হাসফাস শুরু হয় রাজন শিকদারের। গলায় শুষ্কতা অনুভব করেন তিনি। বিপদের আভাস ছুটে আসছে তীরের বেগে। ব্যবচ্ছেদ ঘটাবে সব সত্যের। রাজন শিকদার অদ্ভুত আচরণ শুরু করেন। খিঁচুনি দিয়ে ওঠে তার শরীর। ভয়ংকর, ভয়াল শ্বাস ফেলতে শুরু করেন, যেন কেউ তার গলা চেপে ধরেছে। হাসমুল কক্ষে প্রবেশ করেই রাজন শিকদারের এমন অবস্থা দেখে ব্যগ্র হয়ে ছুটে আসে। তার বুকের মাঝে হাত ঘষতে ঘষতে বলল—

“আফনে যান নয়া বউ। যান তারাতারি। তাঁরে আমি দেখতাছি।”

আয়েন্দ্রি ছলছল চোখে ত্রাসিত গলায় বলল—

“কী হয়েছে দাদুর? এমন করছেন কেন?”

“তাঁর খিচুনি ওঠছে। আপনি যান। ভয় পাইয়েন না। জলদি যান।”

আয়ন্দ্রির যেতে ইচ্ছে হলো না। বুড়ো লোকটার জন্য মায়া হলো তার। কেমন তরপাচ্ছে! রুদ্ধশ্বাসে বেরিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে আয়েন্দ্রি। করিডোরে ব্যাকুল হয়ে ছুটছে সে। আচমকা তার নাক গিয়ে ঠেকে কোনো শক্ত পাটাতনে। আয়েন্দ্রি সপ্রতিভ হয়। সচকিত চোখে তাকাতেই দেখে নিষ্প্রাণের বক্ষস্থলে ঠাই হয়েছে তার। নিষ্প্রাণ প্রাণবন্ত হাসে। আয়েন্দ্রির কপালে অধর বিলাস করে বলল—

“কী হয়েছে? এভাবে ছুটছিস কেন?”

আয়েন্দ্রি উদ্বেলিত গলায় বলল—

“প্রাণ! দাদু কেমন করছে!”

চোখ পিটপিট করে নিষ্প্রাণ। গাঢ় স্বরে বলল—

“আমাকে ছেড়ে ওই বুড়োকে পছন্দ হয়েছে তোর?”

আয়েন্দ্রির টলটলে চোখের কাতর চাহনি শিথিল হয়। সিক্ত আঁখিপাল্লা নড়ে ওঠে। নিষ্প্রাণ আশ্বাসের সুরে বলল—

“ঘরে যা। আমি দেখছি। এন্ড ডোন্ট ওয়ারি।”

“হুম।”
,
,
,
রাজন শিকদারকে বিছানায় শুইয়ে দেয় হাসমুল। ব্যস্ত হয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ছোট্ট শিশি বের করে হাতে নিতেই নিষ্প্রাণের ভরাট কন্ঠে থমকে যায় সে।

“হাসমুল!”

হাসমুল ফিরে তাকায়। নিষ্প্রাণ এগিয়ে এসে তার হাত থেকে শিশিটা নিয়ে দৃঢ় গলায় বলল—

“তুমি বাইরে যাও। ”

“জে।”

রাজন শিকদার দম বন্ধ করে চেয়ে আছেন। নিষ্প্রাণ একটা সিরিঞ্জে শিশি থেকে তরল নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হাসে। রাজন শিকদার বিচলিত চোখে চাইলেন।
তার দুই পাশে হাত রাখে নিষ্প্রাণ। ঝুঁকে যায় তার মুখের ওপর। ক্লান্তিহীন গলায় বলল—

“কেন করছেন এসব? ওই মেয়েটাকে কেন জড়াতে চান এসবে? জড়াবেন না ওকে এসবের মধ্যে।”

রাজন শিকদারের নিশ্চল দেহটার দিকে পূর্ণ নজর বিছিয়ে পূনরায় বলল সে—

“এই মেয়েটাকে-ই বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলেন আপনি। দেখুন, আজ সে কত চিন্তিত আপনার জন্য। আমি কিন্তু আপনাকে আঘাত করতে চাইনি। তবে ধ্রুবতারাকেও হারাতে চাইনি। তবে আপনার কপাল বলতে হয়! এই বয়সেও সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়ে দিব্যি বেঁচে আছেন! আমি কেন আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেছি জানেন?”

বাঁকা হাসে নিষ্প্রাণ। ভয়ংকর পৈচাশিক হাসি। রাজন শিকদারের কানের কাছে মুখটা নিয়ে চাপা স্বরে বলল—

“মরার আগে আমার সন্তানকে অন্তত দেখে যাবেন। আমার ধ্রুবতারা আমার সন্তানের মা হবে। আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, ওই আগুনে আপনার অনাগত নাতিকেও আমি জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। অবশ্য দোষটা ওর-ই ছিল। ওর জন্যই আমার তারাকে মরতে হয়েছে।”

রাজন শিকদার ক্লান্ত চোখে চেয়ে রইলেন। নিষ্প্রাণকে মনুষ্যত্বহীন এক দানব মনে হলো তার কাছে। নিষ্প্রাণ সিরিঞ্জটা পুশ করে দেয় রাজন শিকদারের হাতে। সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে তেজহীন গলায় বলল—

“ধ্রুবতারাকে এসবে জড়াবেন না। আর মাত্র তিনটা ডোজ। তারপর আপনার এই আওয়াজ চিরতরে শান্ত হয়ে যাবে। সে কয়েকদিন নিজেকে কন্ট্রোল করুন। অযথা ঝামেলা করবেন না। অযাচিত ঝামেলায় নিজের আর ধ্রুবতারা দুজনের প্রাণ সংকটে নিয়ে আসবেন আপনি।”

রাজন শিকদার নিমগ্নচিত্ত চেয়ে রইলেন। নিষ্প্রাণ গম্ভীর গলায় বলল—

“মেয়েটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। দয়া করে আমার হাতে আর খুন করাবেন না। প্লিজ দাদু! ইউ লাভ মি, তাই না?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here