প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ৫১

0
2088

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৫১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

কচি কচি অরঞ্জিত জলদের অবাধ অবিশ্রান্ত বিচরণে মুখর হয়ে উঠেছে নভোলোক। সোনা গলা প্রভাকরের তীর্যক রশ্মি মেদিনীর বুকে হানা দিয়েছে স্বগৌরবে। তাল মেলানো মলয়ে মিশিয়েছে দীপ্ত বদনের উষ্ণতা। নভোলোকে বিছিয়েছে প্রভাকর তার শখের তপ্ততা। ছিন্নভিন্ন করে দেবে সকল স্তিমিত নীরবতাকে।

রাজন শিকদারের চোখের জল বইছে বর্ষণের শ্রাবণ সন্ধ্যার মতো। তিনি চেয়েও কিছু করতে পারেননি সেদিন। সন্তানের প্রতি অন্ধপ্রেম তাকে বাধ্য করেছে চুপ থাকতে। বেঁধে রাখতে হয়েছিল দুই হাত। শুনতে হয়েছিল ছেলেদের ভুলের স্বীকারোক্তি। মানতে হয়েছিল তাদের কথা। ভুলতে হয়েছিল ন্যায়নিষ্ঠতা।
তার অনুতপ্ততা তাকে ঘুমোতে দেয়নি। দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন অন্তর্দহনে। নিষ্পেষিত হচ্ছেন অন্তরিন্দ্রিয়ের প্রশ্নের কাঠগড়ায়। কত রাত কাটিয়ে উপরওয়ালার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন! কত দান করেছেন সেই পাপের ভার লঘু করতে! আদৌ কী তিনি মুক্তি পাবেন?

রাজন শিকদার চাননি আয়েন্দ্রিকে বিয়ে করুক নিষ্প্রাণ। নিষ্প্রাণ সুস্থ নয়। তাই তিনি চাননি নিষ্প্রাণের সাথে জড়িয়ে আয়েন্দ্রির জীবন বিপন্ন হোক। ভুল তিনি করেছেন তার মাশুলও গুনছেন। হাসপাতাল থেকে ফিরে যখন আয়েন্দ্রিকে বিয়ে করার কথা বলে নিষ্প্রাণ, তৎক্ষণাৎ তা সশব্দে নাকচ করেন রাজন শিকদার। ফলস্বরূপ তার স্থান হয় হুইল চেয়ারে। মেয়টার জন্য বড্ড মায়া হচ্ছে রাজন শিকদারের। নিষ্প্রাণ যতই নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করুক, ক্ষেত্রে বিশেষে তা নিস্ফল। আয়েন্দ্রি যদি সবটা জেনে যায়, আর নিষ্প্রাণ যদি জানতে পারে যে আয়েন্দ্রি অন্য কারো সাথে মিলে এসব করছে তাহলে মেয়েটাকে ছাড়বে না নিষ্প্রাণ। ডুকরে ওঠেন রাজন শিকদার। তার অন্তরিন্দ্রিয়তে উথালপাথার ঝড় বইছে। আরও একটা মৃত্যু তাকে দেখতে হবে। এর চেয়ে তার নিজের মরে যাওয়াই ভালো।

এক তারাকে মেরে নিষ্প্রাণ প্রাণহীন হয়েছে আরেক তারাকে মেরে না নিষ্প্রাণ তার প্রাণটাই দিয়ে দেয়। রাজন শিকদার যত কিছুই করেছেন, তবুও নিষ্প্রাণকে ভালোবেসেছেন নিঃস্বার্থভাবে। সে ভালোবাসায় খাদ ছিল না। তা ছিল অপরিমেয়, অকৃত্রিম, অসন্দিগ্ধ, নিগূঢ়।
তাই তো তাকে রক্ষার্থে বিদেশ পাঠিয়ে দীর্ঘদিন দূরে থেকে তাকে আগলে রেখেছেন। চোখের জল ফেলেছেন, প্রার্থনা করেছেন নিষ্প্রাণ সুষ্ঠু, সুন্দর জীবনের। হয়তো নিষ্প্রাণও সেই সুপ্ত ভালোবাসা খানিক আঁচ অনুধাবন করেছে। তাই তো এখনো জীবিত রাজন শিকদার। হয়তো এটাই তার সবচেয়ে বড়ো শাস্তি। নিজের চোখে সব শেষ হতে দেখবেন। অন্তর্জালায় ধুঁকে ধুঁকে মরবেন তিনি।

সব শাস্তি চর্মচক্ষুতে দেখার প্রয়োজন পড়ে না। কিছু শাস্তি থাকে শুভ্র, সতেজ মেঘের মতো। কারো জন্য ঝলমলে দিনের আহ্বান তো কারো জন্য লুকিয়ে রাখে আঁধারের বিষবাণ।
,
,
,
আয়েন্দ্রির শ্বাস গুনে যাচ্ছে নিষ্প্রাণ। সংকীর্ণ, ক্ষুদ্র শ্বাস। চোখে হাসল নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির ভোলা ভোলা মন্থর চাহনি। মোলায়েম গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—

“তুই ভাবলি কী করে? তুই এত কিছু করবি আর আমি কিছুই জানব না?
তোর প্রতি শ্বাসে আমি, তোর প্রতি রক্তবিন্দুতে আমি। তোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমি বহমান। তোর পড়ন্ত প্রতিটি চোখের পল্লবে আমি, তোর বাড়ন্ত প্রতিটি নেশায় আমি। সাশ্রুনেত্রের প্রতিটি ফোঁটায় আমি। আমাতেই সৃষ্টি তুই, আমাতেই ভ্রংশ তুই। আমার প্রাণস্পন্দন তুই।”

বাতাস কাঁপিয়ে বিক্ষিপ্ত হাসির জলপ্রপাতে আয়েন্দ্রির প্রতিটি শ্বাসের মৃত্যু ঘটাচ্ছে নিষ্প্রাণ। নিষ্প্রাণ সরল গলায় বলল—

“দাদুর চোখে চশমা দেখেছিস? ওটার মাঝখানে যে খাঁজটা আছে ওখানে স্পাই ক্যামেরা লাগানো। তুই আমাকে এখনো বুঝতে পারিসনি ধ্রুবতারা। তোর ক্ষণে ক্ষণে নিঃসৃত প্রতিটি শ্বাসও আমার। একা ছাড়ি কী করে তোকে আমি? ”

আয়েন্দ্রি প্রকম্পিত শ্বাস ফেলল। গোঙানি দিয়ে বলল—

“প্রাআআআণ!”

ফিক করে হেসে ফেলে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির জমাট রক্তের গালিচাওয়ালা কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল—

“তারা ঠিক-ই বলেছে। তুই আমাকে ভালোবাসতে পারিসনি। আমার তারা ছাড়া কেউ আমাকে ভালোবাসতে পারেনি। দেখ, ওই যে ওখানে বসে আছে তারা। তোকে দেখছে। ”

আয়েন্দ্রি বিভ্রান্ত হয়। বিমূঢ় চোখে তাকায় নিষ্প্রাণের দিকে। নিষ্প্রাণের সরস হাসিতে বৃহৎ ঢোক গিলে আয়েন্দ্রি। ঘনঘন শ্বাসের ঝর্ণা বইয়ে সন্তর্পণে পাশ ফিরে তাকায়। আয়েন্দ্রির আঁখিপল্লব কাঁপছে। ভীত সে, স্তিমিত সে। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ সরব গলায় বলল—

” বাংলাদেশ ফিরে আসার পর সব ঠিক ছিল। তারা আমার স্মৃতির অগোচরে রয়ে গেল। কিন্তু..কিন্তু যেদিন তোকে দেখলাম, তারা আবার আসতে লাগল আমার কাছে। মেয়েটা অনেক কষ্টে আছে রে ধ্রুবতারা। তোকে দেখার পর আমার তারা আবার আমার কাছে এসে ধরা দিল। আবার আশেপাশে হাসতে লাগল, কথা বলতে লাগল।”

আয়েন্দ্রি টিমটিমে চোখে চেয়ে আছে। রাজন শিকদার ঠিক বলেছে। নিষ্প্রাণ অসুস্থ। মৃত মানুষ কখনো ফিরে আসে না। কিন্তু নিষ্প্রাণ এখনো তারাকে অনুভব করে।

নিষ্প্রাণ পুরো কক্ষে চোখ বুলাতে থাকে। দেয়ালে, জানালায়, মেঝেতে। স্নেহসিক্ত গলায় বলল—

“তুই ওকে দেখতে পারবি না। আমি দেখি। তোর পাশেই বসে আছে।”

নিষ্প্রাণ ছোট্ট শ্বাস ফেলল। বলল—

“বল, এখন কী করব তোর সাথে আমি? মেরে ফেলব না-কি মরে যাব?”

আয়েন্দ্রি ভয়ার্ত চোখে তাকায়। তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। গরগর করতে লাগল। নিষ্প্রাণ চঞ্চল হাসল। কোনো জড়তা নেই সেই হাসিতে। সুখকর গলায় বলল—

“তারা আমার প্রথম খুন ছিল। ওকে মারতে আমার সত্যিই কষ্ট হয়েছে। কিন্তু ওর হয়নি। ও মরতে চেয়েছিল। এই দূষিত, দুর্গন্ধ, অসুস্থ পৃথিবীতে ও বাঁচতে চায়নি। আমি ওকে মুক্তি দিয়েছি। কিন্তু এরপর যাদেরই মেরেছি কারো জন্য এক ইঞ্চিও কষ্ট হয়নি আমার। আমার তারা কোনো শব্দও করেনি। তাই কাউকে আমি শব্দ করার সুযোগ দেই না। তোর মনে আছে, সেই পার্টি। ভেবেছিলাম শুধরে যাব। কিন্তু দিলো না ওরা। আমি কী করব বল? আজ তো আমি ছোটো নই। পৃথিবীতে হাজারো নারী এইভাবে মরে নিজের আত্মমৃত্যুতে। নিজের সত্ত্বার মৃত্যুতে। সবাইকে আমি বাঁচাতে পারব না। কিন্তু যারা এসব করবে তাদের শেষ পরিণতি এমনই হবে। তারারা বাঁচবে। তাদের আলো কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারো নেই।”

শেষের লাইন দুটো আকাশসম ক্রোধ নিয়ে উগরায় নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির শান্ত দেহে আবারও ঝংকার ওঠে। নিষ্প্রাণের বিশাল পাঞ্জার আঘাত হানে তার তুলতুলে গালে। কোনো শব্দ করল না আয়েন্দ্রি। সে শক্তি নেই তার কাছে। অক্ষিপুট চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে জল।

আয়েন্দ্রির চুলের গোছা পূনরায় নিষ্প্রাণের দখলে। ক্রোধান্ধ হয়ে বলল—

“কেন এসেছিষ এখানে তুই? এই ঘরের প্রতিটি দেয়াল বিষাক্ত! এই ঘরের বাতাসে শুধু মৃত্যুর গুঞ্জন! কেন ওদের কথা শুনলি তুই? সারককে আমি মারিনি। কারণ, ও তোকে সাপোর্ট করেছে। কিন্তু আমি বোধহয় ভুল করেছি। ওকে তো সেদিন আমার মেরা ফেলা উচিত ছিল। মিশকাত! ওকে কী করব আমি?”

নিষ্প্রাণের দাঁতে দাঁতে নিষ্পেষণে কড়কড় ধ্বনিতে প্রাণশ্বাস কমে আসছে আয়েন্দ্রির। অকস্মাৎ আয়েন্দ্রির গলদেশ চেপে ধরে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি জলহীন মাছের মতো শুধু অধর ছড়িয়ে যাচ্ছে। মৃত্যু দেখছে তার দুই চোখ। আর দেখছে তার প্রেমিক পুরুষকে যে কখনো তাকে বুকে আগলে রেখেছে, আদর করেছে অতলস্পর্শী ঘোরে, ছুঁয়েছে তার হৃদপ্রকোষ্ঠ, কাঁপিয়েছে তার দেহের গহীনতা, ছাপিয়েছে তার আঁখিজল সুখের প্রখর চোরাবালিতে। আজ সে তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে। তার স্বয়ং হাতে। আয়েন্দ্রির জলসিক্ত লোচনে বাঁচার আকুতি। কিন্তু মুখে রা নেই। কার কাছে করবে সে প্রাণ ভিক্ষা? যে নিজেই প্রাণহীন! নিষ্প্রাণ প্রকুপিত গলায় বলে উঠে—

“তোকে তো মরতে হবেই ধ্রুবতারা। না হলে যে তোর বাঁচতে কষ্ট হবে। আমার তারা বাঁচতে চায়নি। তোর কথাও আমি শুনব না।”

আয়েন্দ্রি ছটফটাতে থাকে। তার প্রাণ বের হচ্ছে তার সুডোল নেত্রযুগল দিয়ে। কিছুক্ষণ ছটফটিয়ে সহসা শান্ত হয়ে যায় আয়েন্দ্রি। স্থির, শীতল, সমাহিত চাহনি। হাত সরায় নিষ্প্রাণ। হঠাৎ করে এলোমেলো হয় তার অনুভূতি। সম্বিৎ ফিরে পায় সে। আয়েন্দ্রির মুখের দিকে পূর্ণ নজরে তাকিয়ে আদুরে গলায় নিম্ন স্বরে বলল—

“ধ্রুবতারা! এই ধ্রুবতারা! কথা বলছিস না কেন তুই? কথা বল। ব্যাথা পেয়েছিস? আমি তোকে ব্যাথা দিতে চাইনি রে। কেন এলি তুই এখানে? এই ঘর আমাকে পাগল করে দেয়। এই, এই ওঠনা! কথা বল না ধ্রুবতারা। বল না।”

আয়েন্দ্রি অসাড়। তার সারা অঙ্গ শান্ত। প্রভঞ্জনে নেই আলোড়ন। নিষ্প্রাণ ক্ষেপে গিয়ে বলল—

“কথা বল বলছি। ওঠ বলছি। তোর কিছু হলে আমি ওদের কাউকে ছাড়ব না। যারা তোকে এখানে এনেছে তাদের কাউকে ছাড়ব না আমি।”

আয়েন্দ্রির সাড়াহীন কায়া বক্ষ:স্থলে জড়িয়ে ধরে নিষ্প্রাণ। তার প্রাণস্পন্দন আজ কম্পিত হচ্ছে না।

“ধ্রুবতারা কথা বল প্লিজ। তারার মতো আমাকে ছেড়ে যাস না। প্লিজ।”

আয়েন্দ্রির মাথাটা নিজের বাহুর উপর রাখে নিষ্প্রাণ। সপ্রতিভ চোখে চেয়ে আরেক হাত দিয়ে আয়েন্দ্রির কপালের জমে যাওয়া লহুতে ঘষা মারে। দলা দলা লহুর চাক এবড়ো থেবড়ো হয়ে ছড়িয়ে যেতে থাকে। আয়েন্দ্রির পুরো শরীরটাকে নিজের মাঝে নিয়ে নেয় নিষ্প্রাণ। ঠোঁটের লহুতে নিজের অধর রাঙিয়ে নেয়। আয়েন্দ্রির উলুথুলু চুল সুন্দর করে গুছিয়ে তার কানের পেছনে গুঁজে দেয়। আয়েন্দ্রির শাড়ির আঁচল থেকে তার সৌরভ নিতে থাকে। নিষ্প্রাের মন্থর পাগলামি যে তার ধ্রুবতারা দেখতে পাচ্ছে না তা কি ধ্রুবতারার প্রাণ বোঝে?

” ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান
ঘুমাও আমার কোলে…
ভালোবাসার নাও ভাসাবো
ভালোবাসি বলে…।।

তোমার চুলে হাত বুলাবো
পূর্ণ চাঁদের তলে…
কৃষ্ণচূড়া মুখে তোমার
জোছনা পড়ুক তোলে…
আজকে তোমার মনকে জড়ায়
ধরবে আমার মন…
গাছগাছালি গাইবে জোনাক
গাইবে আমার মন…
এত ভালোবাসা গো জান
রাখিও আঁচলে…
দোলাও তুমি, দুলি আমি
জগত বাড়ি দোলে…..

নিস্তব্ধ আয়েন্দ্রির দেহটা বুকস্পন্দনের সাথে চেপে ধরে নিষ্প্রাণ। দুই পা ছড়িয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে আয়েন্দ্রিকে অনুভব করছে সে। আয়েন্দ্রি নীরব, নিশ্চল। অনুভূতিশূন্য নিষ্প্রাণের আজ কিছু একটা হলো। কেঁপে উঠল এক ভয়ংকর আত্মগ্লাণিতে, নিমগ্ন হলো একাকিত্বে, স্তব্ধ হলো তার ভয়ংকর আগ্রাসন।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here