আফিম_বড্ড_নেশালো পর্বঃ০৭

0
3255

#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ০৭
লেখিকাঃমাহযাবীন

বাচ্চাদের কাছে খুব প্রিয় একটি দিন হচ্ছে শুক্রবার।ঠিক তেমনই কিছু আরাম প্রিয় মানুষের কাছে শুক্রবারের আরেক নাম “প্রেম”।বাচ্চারা শুক্রবার পছন্দ করে পড়াশোনা দিয়ে একটি দিন রেহাই মিলবে বলে আর আরাম প্রিয় মানুষেরা শুক্রবারে প্রেম খুঁজে পায়।তাদের প্রেম হয় সকালের এক লম্বা ঘুমের সাথে।আহা,সকালের ঘুমটা সে যে কি শান্তিময়!
নাফিয়া আরাম প্রিয় মানুষের কাতারেই পরে।আজ শুক্রবার!সে তো কোনোভাবেই ১০ টার আগে বিছানা ছাড়তে রাজি নয়।কিন্তু ৫ টা ৪০ মিনিটেই তার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।এমন প্রেমময় ঘুমের মায়া কাটিয়ে দরজার ওপাশের ব্যক্তিকে সাড়া দেওয়ার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে তার নেই।ওদিকে দরজার ওপাশের মানুষটি কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে নিয়ে দরজার কড়া নেড়ে চলছে।একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে দরজা খোলে নাফিয়া।চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ ফেলে বলে ওঠে,
-আজ শুক্রবার,আমি ঘুমবো!
নাফিয়ার উক্তি শুনে গৃহ পরিচারিকা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
-ম্যাম,আপনি এখন ছাত্রজীবনে নেই যে শুক্রবার ছুটির দিন উদযাপন করবেন।
বিরক্তিভাব বজায়ে রেখে নাফিয়া বলে ওঠে,
-কি বলতে চাইছেন?
-দাদী ডাকছেন আপনায়।
এবার ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে নাফিয়া বলে ওঠে,
-আসছি!
অতঃপর তৈরি হয়ে সে দাদীর কক্ষে উপস্থিত হয়।দাদীর কক্ষে সানিয়া বেগম এবং দাদী উভয়ই বড় এক জানালার ধারে পাতানো দু’জোড়া সোফায় দুজনে বসে আছেন।নাফিয়া তাদের সালাম দিয়ে তাদের কাছে গিয়ে বসে।
সানিয়া বেগম নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-নাফিয়া,পায়ের ব্যথা তো মনে হয় এখন আর নেই?
-জ্বি আন্টি।
-শুক্রবার আর শনিবার আফিম অফিসে যায় না।ওর আলাদা কিছু কাজ থাকে তার জন্য এই দু’দিন বরাদ্দকৃত।ভাবছি ওকে বলবো আজ কাজ বাদ দিয়ে আমাদের নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে!
ঘুরতে যাবার কথা শোনা মাত্রই সকালে হওয়া তার প্রেমের বিচ্ছেদের সব শোক ভুলে গেলো নাফিয়া।তার মুখে ফুটে ওঠা সেই লম্বা হাসিটি সাক্ষ্য দিচ্ছে সে কতোটা উচ্ছ্বসিত।নাফিয়া,সানিয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-কখন যাবো আমরা?
নাফিয়ার এমন আগ্রহ দেখে আলতো হাসেন সানিয়া বেগম এবং উত্তরে বলেন,
-দেখি আফিম কি বলে!
সাথে সাথেই মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেলো নাফিয়ার।সে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-গোমড়ামুখো নিয়ে যাবে বলে মনে হয় না।
-কিছু বললে?(সানিয়া বেগম)
-নাহ আন্টি।দাদী রাজি তো যেতে?
-হ্যা।(দাদী)

!!
নীল পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা পরিহিত আফিম সিঁড়ি বেয়ে নিজ কক্ষ হতে হল রুমের উদ্দেশ্যেই আসছে।হল রুমের সোফাতে বসে ছিলো নাফিয়া ও দাদী।পায়ের শব্দ পেয়ে নাফিয়া সিঁড়ির দিকে তাকায় ।এলোমেলো ভেজা চুল,নীল পাঞ্জাবির হাতাটি কনুই অব্দি উঠানো সেই সাথে সাদা পায়জামা পরিহিত এই সুদর্শন যুবকটিতে চোখ আঁটকে যায় নাফিয়ার।
আফিম খুব বেশি লম্বা না হলেও ৫ ফিট ৮ ইঞ্চি কম নয়।দুধে আলতা গায়ের রং তার।মুখে চাপ দাড়ি।চোখ গুলো খুব বড় না হলেও পাপড়ি গুলো বেশ ঘন।সেই সাথে চোখের মনি একদম গাঢ় খয়েরী রঙের।ঠোঁট টা নাও পাতলা নাও মোটা একদম “সম্পূর্ণ ঠোঁট” যাকে বলে।চেহারাটা কিছুটা লম্বাটে।স্বাস্থ্য নাও মোটা,নাও হ্যাংলা।
আফিমকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখতে এতোটাই মগ্ন ছিলো নাফিয়া যে যখন তার ধ্যান ভাঙে দেখতে পায় আফিম এক ব্রু উঁচু করে তার দিকেই চেয়ে আছে।অপ্রীতিকর এক পরিস্থিতিতে পরে যায় নাফিয়া।আফিমের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মনে মনে নিজেকে কঠিন কঠিন কিছু গালি শুনিয়ে দেয়।সেই সাথে তার মনে প্রশ্ন জাগে এতো দিন ধরে দেখছে লোকটাকে কই আগে তো এভাবে চোখ আঁটকে যায়নি তার উপর তবে আজ কি হলো?
নিজের মনে মনেই উত্তরটি বানিয়ে নিলো সে,হয়তো আফিমের সৌন্দর্য এতোদিন তার মনে জমে থাকা সেই ঘৃণানুভূতিই আড়াল করে রেখেছিলো।
সোফায় বসে আফিম একজন সার্ভেন্টকে কফি আনার আদেশ করে।সার্ভেন্টটি আদেশ পেয়ে রান্নাঘরে যেতেই নাফিয়া কিছু একটা ভেবে বলে ওঠে,
-আমি একটু আসছি।
বলেই উঠে যায় সে।নাফিয়ার হুট করে এভাবে উঠে যাওয়ার বিষয়টি আফিমের কাছে সন্দেহের মনে হলো।
রান্নাঘরে এসে নাফিয়া সার্ভেন্টটিকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-কফিটি আমি বানিয়ে দিচ্ছি আপনি ততক্ষণে আমার রুমের বিছানাটি পরিষ্কার করে দিয়ে আসুন।একটু বিশ্রাম নিতে চাইছি কিন্তু বিছানাটি অপরিষ্কার।
-ঠিক আছে ম্যাম আমি অন্য কেউকে বলছি আপনার বিছানাটি পরিস্কার করে দিতে।শুধু শুধু কষ্ট করে আপনর কফি বানাতে হবে না।
-যা বলেছি তাই করুন।কফি বানানো শেষ হলে আপনাকে ডেকে নিবো,যেয়ে কফিটা দিয়ে এসেন।
মেয়েটি আর কিছু না বলে রান্নাঘর ত্যাগ করে।এদিকে মেয়েটি যেতেই নাফিয়া ঝটপট কফিটি বানিয়ে নেয়।অতঃপর ঠোঁটে এক শয়তানি হাসি ফুটিয়ে লবণের ডিব্বাটি হাতে নিয়ে বলে ওঠে,
“স্যরি আফিম কিন্তু আপনাকে একটু না জ্বালালে শান্তি পাবো না।বদ অভ্যেস হয়ে গিয়েছে আপনাকে জ্বালানো!”
কথাটি শেষ করে নাফিয়া যেই কফিতে লবণ ঢালতে যাবে ওমনি কেউ একজন তার হাত ধরে নেয়।চমকে হাতের মালিকের দিকে তাকাতেই আফিমকে দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে যায় তার।আফিম নাফিয়ার হাত থেকে লবণের ডিব্বাটি নিয়ে জায়গা মতো রেখে নাফিয়ার দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হতে বলে ওঠে,
-তো কি বলছিলেন মিস.শেখ?আমায় না জ্বালালে আপনি শান্তি পাবেন না?
উত্তরে কিছু না বলে এক পা এক পা করে পিছিয়ে যায় নাফিয়া।আফিম অগ্রসর হতে হতেই আবারও বলে ওঠে,
-আমায় জ্বালানোর বদ অভ্যেসে পরে গিয়েছেন?
কথাটি শেষ করে এক হাতে নাফিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে নাফিয়াকে নিজের কাছে নিয়ে আসে আফিম।আফিমের কাছে আসতেই নাফিয়া এক অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করতে আরম্ভ করে যা সে আগে কখনো অনুভব করেনি।আফিম,নাফিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-যদি বলি,এ বদ অভ্যেসে আমিও অভ্যস্ত?(ঠোঁটে বাঁকা হাসি তার)
আফিমের শরীরের মাতাল করা ঘ্রাণে নাফিয়া আবেশে নিজের চোখজোড়া বুজে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে তা নিজের নিঃশ্বাসের সাথে নিজের মাঝে টেনে নিচ্ছে সেই সাথে আফিমের মৃদু কন্ঠস্বর ও তার বলা উক্তিটি নাফিয়ার হৃৎস্পন্দন কয়েকশো গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।আর একটু বাড়লেই হয়তো মরে যাবে সে ঠিক এমনটিই অনুভব করছে নাফিয়া।
এরই মাঝে সার্ভেন্টির পায়ের শব্দ কানে আসতেই আফিম নাফিয়াকে ছেড়ে কিছুটা দুরত্ব বজায়ে রেখে দাঁড়ায়।নাফিয়াও ঠিক হয়ে দাঁড়িয়ে কফিটি হাতে নিয়ে আফিমের দিকে এগিয়ে দেয়।সার্ভেন্টটি রান্নাঘরে প্রবেশ করে আফিমকে দেখে ঘাবড়ে যায় এবং বলতে আরম্ভ করে,
-ক্ষমা করুন স্যার।আসলে আমিই কফি বানাতাম কিন্তু ম্যাম…
মেয়েটির কথা শেষ হওয়ার আগেই আফিম বলে ওঠে,
-ইট’স অলরাইট!
মেয়েটি যেনো হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।অতঃপর নাফিয়া এবং আফিম উভয়ই হল রুমে এসে বসে।এতোক্ষণে সানিয়া বেগমও হল রুমে এসে বসেছেন।আফিম আসতেই তিনি আফিমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-আফিম!
-ইয়াহ মম।
-আজ বাইরে কোথাও ঘুরতে যেতে চাইছি।
-যাওয়া যায়।
-ভাবছি আমাদের পুরান বাড়িটায় যাই?দু’বছর হলো যাওয়া হয় না।
-ঠিক আছে।রবি মামাকে বলে দিচ্ছি বাড়িটি পরিষ্কার করিয়ে রাখতে।
-বেশ।(ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলে ওঠে সানিয়া বেগম)

!!
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসলো আফিম।আজ সে ই ড্রাইভ করবে।তার পাশের সিটে বসলো সানিয়া বেগম এবং পেছনের সিটে দাদী এবং নাফিয়া।ঠিক ৩ টা বাজতেই রওয়ানা হলো তারা আফিমদের পুরোনো বাড়ির উদ্দেশ্যে।প্রায় ২/৩ ঘন্টার রাস্তা।শহর ছাড়িয়ে একটি মফস্বল এলাকাতেই আফিমদের পুরোনো বাড়িটি অবস্থিত।
শহর পেরিয়ে সেই এলাকাটির কাছাকাছি আসতেই দেখা যায় রাস্তার দুপাশে জনবসতিহীন বিরাট জায়গা জুড়ে শুধু হরেকরকমের গাছপালা।রাস্তাটি একদম পাকাপোক্ত হলেও আশেপাশের দৃশ্যমান সব কিছুই নাফিয়াকে গ্রামের অনুভূতি দিচ্ছে।এতোগুলা বছর পর সে গ্রামের মতো একটি জায়গায় যাচ্ছে ভাবতেই একরাশ ভালোলাগা এসে নাফিয়ার মনে জায়গা করে নেয়।বাইরের দৃশ্য নাফিয়ার ভেতরে যে মুগ্ধতা সৃষ্টি করছে তার বহিঃপ্রকাশ তার ঠোঁটের হাসির মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে।লুকিং গ্লাসের সাহায্যে আফিম ও নাফিয়ার সেই মুগ্ধতার হাসির সাক্ষী হয়ে রয়।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here