‘অসুখের নাম তুমি’ (পর্ব-০৯)
#সোনালী_আহমেদ
যথাসময়ে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় সুমিকে। সবার অবস্থা বেশ ভয়াবহ। সুমির জন্য সবাই অধিক মাত্রায় চিন্তা করছে। এক একেক জনের চেহারার কি বিচ্ছিরি হাল হয়েছে! কারো মুখের অবস্থা তাকানোর মতো নয়। রেশমির মনের অবস্থাও সবার মতো বেগতিক। তবুও সে নিপুণ দক্ষতার সাথে সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে সামলে যাচ্ছে। সৌহার্দকে এত টা ভেঙ্গে যেতে দেখে তার ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তার খুব খারাপ লাগছে।
বেশ খানেক সময় ডাক্তারবাবু বেরিয়ে এসে প্রথম যে কথা টা বলে তা হলো,
—‘রোগীর স্বামী কে?’
প্রশ্ন টা সবাইকে নিরব করে দিলো,কেননা সজীব তো এখানে নেই। আশ্চর্য বিষয় হলো,কেউ সে কথা টাও বলছে না। বোধ হয়, মুখে তালা আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
একই প্রশ্ন আবারো বলেন ডাক্তার। তার ২য় উচ্চারণে যেনো সবার সম্মতি ফিরে আসে। সৌহার্দ প্রশ্ন করে ওঠে,
—‘কেনো ডাক্তার?কি হয়েছে? আমার বোন ঠিক আছে তো? তার কিছু হয় নি তো?
রেশমি বাদে বাকিরাও একই প্রশ্ন করে। ডাক্তার হয়তো তাদের অস্থিরতা টের পেয়েছেন, তাই তো তিনি হেসে বলে ওঠেন,
—‘ তিনি বাবা হবেন সেজন্যই প্রথমে উনার খোঁজ করলাম।’
ডাক্তারের সহজ-সরল জবাব সকলকে চূড়ান্ত বিষ্মিত করে দিলো মুহূর্তেই। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর কথাটির অর্থ বুঝতে সক্ষম হলো সবাই।
বেশ সময় পর ডাক্তারকে দাদী প্রশ্ন করে,
—‘ সুমির কি অবস্থা?’
—‘ রোগী আপাতত ঠিক আছেন। অতিরিক্ত চিন্তার ফলে জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি। কিছুদিন বিশ্রাম নিলেই দ্রুতই উনার দূর্বলতা কেটে যাবে। কিছুদিন পর যখন তিন মাস হবে তখন কিন্তু প্রায়ই এই ধরনের সমস্যা দেখা দিবে। তাই বিশ্রামের পাশাপাশি, উনার দূর্বলতা কাটানোর জন্য বেশি বেশি ভিটামিন জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। আর বিশেষ করে চেষ্টা করবেন উনি যেনো সবসময় চিন্তামুক্ত থাকে। ‘
—‘ তিনমাস হবে মানে?’
—‘জ্বি,উনি এখন আড়াই মাসের প্রেগন্যান্ট। ‘
—‘ কিহ! কি বলেন ডাক্তার?’
—‘ জ্বি, রোগী হয়তো তার উপসর্গ গুলো আপনাদের জানায় নি। কিংবা তিনিই বুঝে উঠতে পারেন নি।’
বিছানায় বসে আছে সুমি। আজ তার কাছে অন্যরকম লাগছে।
মেয়েরা যখন প্রথমবারের জন্য মা হওয়ার সু-সংবাদ শুনে তখন তার অনুভূতি টা হয় আকাশচুম্বী! হবে না ই বা কেনো? মা হওয়ার অনুভূতি টা ই যে এমন স্নিগ্ধ। সেই সময় খুশির অঢেল বন্যা বইতে থাকে মনে। পবিত্র সেই অনুভূতি টা খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে শরীর জুড়ে। এ এক এমন অমূল্য সুখ যা পৃথিবীর অন্য কোথাও টর্চ দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।
বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে এক বন্ধ্যা নারীর কাহিনী না হয় শুনে নিয়েন। তার মা না হওয়ার আক্ষেপ, বাচ্চা না দিতে পারার অক্ষমতা কতটা কষ্ট আর যন্ত্রণা দেয় তাকে।
বাড়ীর লোকের দিকে লজ্জায় সে তাকাতেও পারছে না। দাদীর দেখা পেলে সাথে সাথে মাথা লুকানোর জায়গা খুঁজে বেড়ায়। এই দাদীমার লাজ-লজ্জা কিছুই নেই। তিনি দিব্যি সুমিকে এই সেই বলে লজ্জা দিয়ে যাচ্ছেন।
সজীবকে জানানোর কথা হতেই,দাদী সাফ না করে জানিয়ে দেন যে,” কেউ জেনো কিছু না বলে,সুমি যেনো নিজে জানায়।”
ঘরের প্রত্যেক টা ব্যক্তির মুখে বাচ্চার সংবাদ শুনার পর হাসি ফুটলেও ফুটে নি লিনার মুখে। তার মুখের বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে আছে, সে কারো সাথে কথা বলছে না। পাশের বাড়ীর ইনি, উনি এসে দেখা সাক্ষাত করে যাচ্ছে, লিনা সেসব মুখ তুলেও দেখছে না।
বেশ রাত করেই রুমে আসে সজীব। বাড়ীতে আজ ও যথাসময়ে এসেছিলো,কিন্তু রুমে যাওয়া হয় নি। কারন আজ তাকে মায়ের রুমে যেতে হয়েছিলো। সেই থেকে মুখের অবস্থা বেশ বেগতিক। তাকে দেখলে মনে হবে,বোধ হয় কেউ জোর করে তাকে তিতা রস খাইয়ে দিয়েছে।
আট- দশ টা স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চার সংবাদ দিতে পারে নি সুমি। তার আগেই সজীব কীভাবে যেনো জেনে গিয়েছে,যা তার অজানা।
—” আমি বাবা হবো, নাকি তুমি মা হবে?”
সজীবের এমন প্রশ্নে বিচলিত হয়ে যায় সুমি। সে ধরতে পারছে না কথা দুটোর ভিন্নতা। তার মাথা কেমন ভোঁ ভোঁ করছে।
শূন্য দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।
—‘কি হলো বলছো না কেনো?”
—” জ্বি,আমরা বাবা-মা হবো।”
—” কার বাচ্চা গর্ভে নিয়ে আমার নামে চাপিয়ে দিতে চাও? কার পাপের ফসল বুনতে চাও?”
—‘ এসব কি বলছেন আপনি?”
সজীব জবাব দেয় না। তার মেজাজ বিচ্ছিরি ভাবে বিগড়ে আছে। লাথি দিয়ে টুল টা ফেলে দিলো। দুই হাত মাথার ঝাঁকড়া ভর্তি চুলে দিয়ে খামছে ধরলো। অনেক্ষণ এদিক-ওদিক হেটে বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
সুমি চুপ করে আছে, কিছু বললে হয়তো লোকটা ক্ষেপে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাই তর্ক করলো না। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে বিছানায় সে ও এসে জায়গা করে নিলো।
—” সরে ঘুমা, গায়ে লাগবি না। নাহলে খবর করে দিবো।”
সুমি বেশ দূরত্ব রেখেই শুয়েছিলো। এ কথা শুনে সে আরো ছিটকে সরে পড়লো। লোকটা এমন কেনো? তার ভেতর ছোট্ট একটা প্রাণ বেড়ে ওঠেছে। ভেবেছিলো মানুষ টা বুকে শুয়ে সারা রাত তার গল্প করবে। মানুষ টাও বুঝি পরম আদরে তার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবে।
সে প্রায়শই নিজেকে বলে,’জেগে জেগে স্বপ্ন দেখবি না সুমি,এসব তোর জন্য হারাম।’ তবুও দেখো একটু সুখের আভাস পেলেই সে একই ভুল করে বসে। সে বড্ড বোকা, বড্ড! তাই তো বারংবার একই ভুল করে বসে। স্বপ্ন ভাঙ্গা সংসার তার। এ তো জোড়া লাগবার নয়। কেনো স্বপ্ন দেখে সে? কাঁদতে কাঁদতে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো সে আর স্বপ্ন দেখবে না, কোনোদিন না।
৪.
বিছানায় গালে হাত দিয়ে বসে আছ রেশমি। দৃষ্টি তার হাস্যজ্জ্বোল সৌহার্দের দিকে। লোক টা বোনের বাচ্চার সংবাদ শুনার পর থেকেই বাচ্চার মতো ব্যবহার করছে। খুঁজে খুঁজে তাদের ছোট বেলার এবং বাবা-মায়ের দেওয়া জিনিসপত্র বের করছে। আর একটার পর একটা দেখিয়ে রেশমিকে নানান কথা বলে যাচ্ছে। বোনের প্রতি কতটা টান আর মমতা রেশমি বুঝতে বেগ পেতে হলো না। তার ও যদি একটা ভাই থাকতো সে বোধ হয় এমন করতো।
বাচ্চা বউ বাচ্চামি করলে মানা যায়,কিন্তু বুড়ো দামড়া ব্যাটা বাচ্চামি করলে মানা যায় কি! রেশমি এসব মানতে পারছে না।
তার মন হঠাৎ করে ভেবে উঠে, যখন এই বুড়ো দামড়া বাবা হবে তখন জানি কী করবে?
কথাটা ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে আসলো তার মুখ। ছিঃ, সে এসব কি ভাবছে!
আবার ভাবলো আচ্ছা লোকটাকে একবার বলেই দেখি কী করে সে!মনের কৌতূহল মেটাতে সৌহার্দে একদম গা ঘেষে দাড়ায় রেশমি। খুব অস্বাভাবিক ভঙ্গিমায় ভাব ধরলো। সৌহার্দ অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। এ মেয়ে হঠাৎ এমন করছে কেনো?
সৌহার্দের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
—” আপনাকে কিছু বলার ছিলো,,,,,!!”
—“কী?”
—” আ আ আপনি,,!!”
—“আমি কী?”
—“আপনি বাবা হবেন।”
কথাটা বলেই সৌহার্দের কানের থেকে মুখ সরিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। সৌহার্দের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য একটা চোখ অল্প খুলে তার দিকে তাকায়।
সৌহার্দের মুখের অবস্থা দেখে রেশমি না হেসে পারলো না। ইয়া বিশাল বড় হা করে তাকিয়ে আছেন তিনি। মনে হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় শুনেছে।
তব্দা লেগে যায় সৌহার্দ। বিয়ের এক টা সপ্তাহ না হতেই সে বাবা হবে? এসব কোনো কথা?
নিজেকে সামলে রেশমির দিকো তাকাতেই দেখলো সে নাই। ফুড়ুৎ করে বিছানায় কম্বলের ভেতর ডুকে পড়েছে। সৌহার্দ নিঃশব্দে হেসে ওঠে।
দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হতেই রেশমি ফট করে ওঠে আসলো। সৌহার্দের আগে ঝড়ের গতিতে এসে দরজা খুললো। এবার ও যদি দরজার ওপাশে বুড়ি হয় তাহলে কয়েক টা কথা শুনিয়ে দিবে সে।
পর পর দুবার এসে সৌহার্দকে এটা সেটা বলে নিয়ে গেছে তিনি। এ নিয়ে তিনবার হবে।
দরজা খুলতেই জমিলা কে দেখে রেশমি একদম বলে,
—-” এতবার দরজায় কড়া নাড়েন কেনো? নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে আমাদের, বুঝেন না এখন ব্যস্ত থাকবো। এভাবে বারবার এসে ব্যাঘাত ঘটান কেনো?”
রেশমির নির্লজ্জের মতো জবাবে রোবটের মতো হয়ে যায় সৌহার্দ। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে পারলে সে শান্তি পেতো। ছিঃ, দাদীকে এই মেয়ে মুখের উপর কীভাবে এসব বলছে?
রেশমি যে এমন কথা বলতে পারবে জমিলার ধারনার বাহিরে ছিলো। নাতির সামনে এভাবে লজ্জা দিলো। তিনি নিজের শরমকে প্রকাশ না করে, উল্টো রেশমিকে লজ্জা দিতে বলে,
—” স্বামীকে ছাড়া বুঝি থাকতে পারছো না? বাহ,বেশ তো।”
—” হ, থাকতে পারছি না। আপনি বলেন এবার আপনার কোন স্বর্ণের ধন নামিয়ে দিতে হবে উনাকে?”
—” না,কিছু নামিয়ে দিতে নয়। সূচনার মাথা ব্যাথা করছে। বেচারি বিছানা থেকে নড়তে পারছে না। তাই,,”
—” এখন উনি গিয়ে কি সূচনার মাথা খাবে?”
জমিলা থতমত খেয়ে যায়, এ মেয়ে খুব কথা বলছে। সময় আসুক,হাড়ে হাড়ে সব বুঝিয়ে দিবে। আর মাত্র কয় টা দিন বাচাধন, তোমার কপালের ভাত যদি না উঠাতে পেরেছি আমিও জমিলা বেগম নয়।
—” না,সৌহার্দ নয় তোমার কথা বলছি। একটু ওর মাথাটা টিপে দিলে বেশ উপকার হতো। সুমি তো অসুস্থ না হয় তাকেই বলতাম।”
—” আপনি কী করবেন? আপনি টিপে দেন।”
রেশমির কথা শুনে সৌহার্দ ভেতর থেকে ধমক দিয়ে বলে,
—” রেশমি!!! বড়দের সাথে এসব কি ধরনের কথা? যাও দাদী যা বলে করে দিয়ে আসো।”
—” আরে,আপনি বুঝতেছেন না…!”
—“আমার বুঝার দরকার নেই। তোমাকে আমি বলেছি যেতে তারপরেও মুখের উপর কথা বলছো কেনো?”
রেশমি রাগে গজগজ করতে বেরিয়ে গেলো। দাত চেপে বুড়িকে বিরবির করে বলে,
—‘ আসেন,আপনার কোন সূচনা,ফূচনার গলা টিপে দিতে হবে?”
জমিলা বেগম ক্ষেপে যান। আজ এই মেয়ের এক ব্যবস্থা না করে দম নিবেন না তিনি। মুখে খই ফুটেছে। বেশ কথা বলা,তাই না? আজ বের করছি কথা বলা। জমিলা বেগম ফুসে ওঠে হাত মুষ্টিবদ্ধ করলেন।
চলবে!
সবার মন্তব্যের অপেক্ষায় আছি।