মোহঘোর”পর্বঃ৩

0
820

#মোহঘোর
#পর্বঃ৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

আঁধারিয়া অম্বরে চেয়ে আছে রেহাংশী। তার দুই চোখের পাতায় অবসাদ, ক্লান্তির পাহাড় শরীর জুড়ে। তবুও ঘুমপরীরা লুকোচুরি খেলছে তার সাথে। আজ খাওয়া হয়েছে তার। নির্নিমিখ চাহনিতে ওই ভরাট চাঁদকে দেখছে সে। চাঁদ সবসময়ই তার কাছে তাচ্ছিল্যের পাত্র। কারণ চাঁদও তার মতো। অন্যের আলোয় আলোকিত।

ছাদের বাউন্ডারির সাথে চেপে দাঁড়িয়ে আছে ইনজাদ। আধো আলোছায়াতে অদূরের আবছা অবয়বটিকে দেখার অক্লান্ত প্রয়াস। কিন্তু তাতে সাফল্য নেই।অবয়বটির চেহারা আজও অস্পষ্ট। তবে ইনজাদের চেতনা বিভ্রান্ত। আদৌ সে অবয়বটি যাকে সে খুঁজছে তার না কী অন্য কারো?

সহসা রেহাংশীর চোখ যায় ইনজাদের দিকে। তাকেও সে স্পষ্ট দেখতে পারছে না। তবে সে নিশ্চিত অন্ধকার অবয়বটি ইনজাদের। রেহাংশী চোখ সরাল। তার দীর্ঘ আঁখিপল্লব বন্ধ করে মায়ের চেহারা মনে করার চেষ্টা করল। সুশ্রী মুখটি সে শুধু ছবিতেই দেখেছে। বাস্তবে যা দেখেছে বয়সের সাথে তা ভুলে বসে আছে। রেহাংশী তার বাবাকে মনে করতে চায় না। তার বাবা আরও একটা বিয়ে করেছে। শুনেছে সে ঘরে তার একটা ছেলেও আছে। রেহাংশী কখনো সেই ছেলেকে দেখেনি। দেখবে কী করে? এই বাড়ি থেকে যাওয়ার পর দুই একবার এসেছিল তার বাবা, কিন্তু ধীরে ধীরে এই বাড়ির পথও হয়তো তিনি ভুলে গেছেন।

চোখ খুলে তাকাল রেহাংশী। গুমোট শ্বাস ফেলল। অদূরের অবয়বটি এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে। হাতে জ্বলন্ত কিছু একটা। রেহাংশী আর দাঁড়াল না। চাঁদের আলো কাটা দেয় তার গায়ে।

রেহাংশীর প্রস্থানে ইনজাদ তটস্থ হলো। সেও নিচে নেমে আসে। অপেক্ষার অবসান না ঘটিয়ে শেষ হলো আরেকটি প্রহর।
,
,
,
প্রত্যুষের মিষ্টি রোদে প্লাবিত ধরনী। সোনা রোদে ঝলমল করছে পত্র-পল্লব। পাতার ফাঁক-ফোকর গলিয়ে তিরতিরে রশ্মি ঢুকে যাচ্ছে জানালা দিয়ে। ঝিনুক বেগম চা বানাতে গিয়ে চিৎকার শুরু করলেন। চিনি পেলেন না কোথাও। টেবিলে খাবার দিয়ে রান্নাঘরে পা রেখেছে রেহাংশী। পাটায় মসলা পিষছে সোমা। ঝিনুক বেগম রেহাংশীকে বললেন—

“যা তো পাশের দোকান থেকে চিনি নিয়ে আয়।”

রেহাংশী চমকে উঠে বলল—

“আমি?”

“তুই না তো কি আমি? দেখছিস না সোমা কাজ করছে। আর তোকে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার পাঠাচ্ছি না। পাশেই দোকান। যা নিয়ে আয় জলদি। ওরা কাজে বের হবে।”

রেহাংশী কিছুক্ষণ ইতি-বিতি করে দাঁড়িয়ে রইল। ঝিনুক বেগম একটা বাটি করে কিছু খাবার দিয়ে বললেন—

” এগুলো ওই পাগলা মামুনরে দিবি। আর বলবি নুপূর বাসায় নাই। ও ফিরলে যেন আসে।”

“আচ্ছা।”

,
,
,
বাড়ির বাইরে আসতেই পিপলু আর তার বন্ধুদের দেখল রেহাংশী। সমস্বরে বলে চলছে—

” পাগলা তোর দাঁড়িতে কী? তেতুল গাছের চাটনি। ভুতনীর লগে করে ভাব, আমি তোর নাটাই বাপ।”

রেহাংশীর মেজাজ চড়া হয়। মামুনকে একা পেলেই পিপলু তার শয়তানির বাক্স খুলে বসে। পাড়ার সবচেয়ে বিচ্ছু ছেলে পিপলু। রেহাংশী টগবগে চোখে তাকিয়ে আবার নিভে যায়। মামুনেকে বাটি দিয়ে বলল—

“নুপূর আপু নেই।”

মামুনের শার্টের হাতা তার কব্জি ছুঁইয়ে বেরিয়ে আছে। তা দিয়ে গাল ঘষতে ঘষতে বলল—

“কোথায় গেছে, কোথায় গেছে?”

“মামার বাড়ি। চলে আসবে। তুমি আজ আর এসো না।
মামুন ভাই, তুমি কী নুপূর আপুকে বিয়ে করবে?”

বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেল মামুন। দাঁত কেলিয়ে বলল—

“বিয়ে, বিয়ে। আমি বিয়ে করব।”

“তাহলে এসব কেন পরো? তুমি যদি এমন নোংরা থাকো তাহলে নুপূর আপু তোমাকে বিয়ে করবে না। সে কোনো সুন্দর ছেলেকে বিয়ে করে তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে।”

নুপূর চলে যাবে কথাটি শোনা মাত্র রেগে আগুন হয়ে যায় মামুন। খাবার-সহ বাটি ছুড়ে ফেলে বলল—

“না, নুপূর যাবে না। নুপূর যাবে না। মেরে ফেলব আমি।”

ভয়ে আঁতকে উঠে রেহাংশী। মামুনকে শান্ত করার জন্য বলল—-

“আরে, আরে তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? আপু যাইনি তো। শান্ত হও। তুমি বাড়ি যাও। তুমি আজও ব্রাশ করোনি। ছিঃ! নুপূর আপু জানলে তোমার সাথে কথাই বলবে না।”

“আমি ব্রাশ করব, আমি ব্রাশ করব।”

“খাবার ফেলে দিলে কেন?”

মামুন আবার সেই খাবার কুড়িয়ে নিতে গেলে রেহাংশী বাঁধ সাধে। শান্ত স্বরে বলল—

“তুমি বাসায় যাও। ব্রাশ করে,গোসল করে, খেয়ে ঘুমাবে। নুপূর আপু আসলে আমি তোমাকে জানাব। কেমন?”

“হু, হু।”

মামুন উঠে দাঁড়ায়। হেলেদুলে চলতে থাকে। তার দিকে তাকাতেই রেহাংশী দেখল ইনজাদ তাদের বাড়ির দরজায় দাঁড়ানো। পিপলু কুটকুট করে হেসে যাচ্ছে। তাকে ধরার জন্য হালকা ছুট লাগাতেই পিপলুকে আর পায় কে! দলবল নিয় দৌড়। কিন্তু তাকে আটকাল ইনজাদ। রেহাংশী তপ্ত আভা ছড়ানো মুখশ্রীতে ইনজাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইনজাদ বিগলিত হাসে । বলল—

“নিন, কী সাজার দেবার দিন। আমি ধরে রেখেছি।”

রেহাংশীর মাথায় অন্য কিছু আসলো না। তার একমাত্র লক্ষ্য পিপলুর কাল মলে দেওয়া। করলও তাই। পিপলু খেমটি মেরে বলল—

“ভুতনী!”

রেহাংশী ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেয়। অকস্মাৎ ঘটা ঘটনায় ইনজাদ ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। হাত শিথিল করতেই পিপলু ছুট লাগায়। তার মুখ নিঃসৃত ধ্বনি—

“ভুতনী, ভুতনী, ভুতনী। তেতুল গাছের ভুতনী।”

জিব দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভেঙচিও কাটল। রেহাংশী জোর গলায় বলল—

“আরেকবার পাই তোকে, তোর ঘাড় ভাঙব আমি।”

ইনজাদ ঢোক গিলে বলল—

“সত্যিই কী ঘাড় ভেঙ্গে দেবেন না কী?”

“প্রয়োজন পড়লে দেবো।”

গটগট করে হাঁটা ধরে রেহাংশী। তার পিছু নেয় ইনজাদ। পেছন থেকে পাশে। রেহাংশী প্রতিক্রিয়া করল না। ইনজাদ ইতস্তত করছে। বলবে বলবে বলেও বলা হচ্ছে না। কী বলবে সে?

মিইয়ে গলায় বলল—

“মামুনকে আজ তোমার আপু খাবার দেয়নি কেন?”

” আপু বাসায় নেই।”

“কোথায় গেছে?”

ইনজাদ প্রশ্নটা এত দ্রুত করল যে থমকে গেল রেহাংশী। সন্দিহান গলায় বলল—

“তা দিয়ে আপনার কী দরকার?”

ইনজাদ মৃদু গলায় বলল—

“আমার না। মামুনের দরকার।”

“তো আপনি প্রশ্ন করছেন কেন?”

ইনজাদ বিরক্ত হলো। মেয়েটা কী ভালো করে কথা বলতে পারে না। দেখতে তো সুন্দরী, কথাবার্তা কেন এমন!
আসলেই পৃথিবী জোড়া মানুষের সবাইকে সব গুণ দেওয়া হয় না। কোনো না কোনো খামতি তো থাকেই। মেয়েটার রূপে যেমন কেউ ঝলসে যাবে, তেমন কথার ছুরিতে তার কলিজাও চিড়ে দেবে।
ইনজাদ অসহ্য গলায় বলল—

“আপনার মা কী জন্মের সময় মুখে মধু দেয়নি?”

রেহাংশী তাচ্ছিল্য চোখে তাকিয়ে কটাক্ষ করে বলল—

“না, বিষ দিয়েছে। ”

হনহন করে চলতে শুরু করে রেহাংশী। ইনজাদের পা আর বাড়ল না। সেখানেই থমকে গেল এক অভূতপূর্ব ভয় আর জড়তায়।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here