মোহঘোর”পর্বঃ২৬

0
515

#মোহঘোর
#পর্বঃ২৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ভাসছে শহর দিনের প্রভায়। স্নিগ্ধ, তরল, সতেজ মলয়ে আবৃত মেদিনীর বুকে হেমন্তের জয়গান। তিরতির করে প্রবাহিত সমীরণের শীতলতায় মৃদু কাঁপন ধরেছে ইনজাদের দেহ প্রকোষ্ঠে। চার ফিটের বিস্তৃত বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টেনে যাচ্ছে সে। পূর্বাকাশে উদিত অর্যমা স্বগৌরবে মেলে ধরেছে নিজেকে। শুভ্র আকাশের বুকে উদ্ভাসিত কিরণের মাখামাখি।

ইনজাদের কর্ণরন্ধ্রে ভেসে এলো কলিং বেলের শব্দ। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে নিচে ফেলল। পলেই হেসে ফেলল সে। রেহাংশী নিশ্চয়ই রাগ করবে!
নতুন বাসায় আসার পর মেয়েটা আরও বেশি চঞ্চল হয়েছে। ঘরের সব জিনিসপত্র টিপটপ রাখে। পরিষ্কার, ঝকঝকে।

কলিং বেলের আওয়াজ পেয়েও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেহাংশী। ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা পানির জগে হাত রেখে অনিমেষ চেয়ে আছে দরজার দিকে। কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসলো ইনজাদ। সে ভালো করেই জানত রেহাংশী দরজা খুলবে না। ইনজাদ নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে গিয়ে দরজা খুলল। অস্থির চোখে চেয়ে আছে রেহাংশী। কিছুক্ষণ পর দরজা বন্ধ করে ভেতরে এলো ইনজাদ। টেবিলের ওপর একটা বাটি রাখল। তাতে চার-পাঁচটা মিষ্টি। রেহাংশী ঝোঁক গলায় বলল—

“কীসের মিষ্টি?”

ইনজাদ ছোট্ট হেসে বলল—

“তাদের ঘরে নতুন মেহমান এসেছে।”

রেহাংশী বিস্মায়াবিষ্ট চোখে চেয়ে উৎসুক গলায় বলল—

“শহরে বুঝি মেহমান এলেও মিষ্টি দেয়?”

ইনজাদ ফিচেল হাসল। ধীর পায়ে রেহাংশীর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। রেহাংশীর ভ্রমরকৃষ্ণ কুন্তলে নাক ডুবিয়ে এক লম্বা নিঃশ্বাস টেনে নিল। রেহাংশী হাসল। অস্পষ্ট, নিগূঢ়, ব্রীড়াময় হাসি। আচ্ছন্ন মস্তিষ্কে মত্ত ইনজাদ হালকা হাতে রেহাংশীর চুলের বহর সরিয়ে তার কাঁধের কাছের জামার গলা খানিক নামিয়ে এনে ঠোঁট ছোঁয়াল। আবেশিত, সঞ্চরিত চোখ নিমীলিত করে রেহাংশী। ইনজাদের উষ্ণ শ্বাসের বেগ তরতরিয়ে ছড়াতে লাগল রেহাংশীর কম্পিত দেহের কোণে কোণে। ইনজাদ ছোট্ট করে হাসল। মখমলে গলায় বলল—

“হ্যাঁ, এইটা স্পেশাল মেহমান। আসতে দশমাস সময় তো লাগেই।”

চট করে রেহাংশীর স্থির মস্তিষ্কের স্নায়ু ধরতে পারল না ইনজাদের নিঃসৃত কথার অর্থ। ইনজাদ টাউজারে হাত পুরে উলটো হাঁটা ধরল। রেহাংশী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল—

“তারা বুঝি বিদেশে থাকে?”

ইনজাদ চলনভঙ্গি বদলাল না। দুলতে দুলতে বলল—

“না, অন্য কোথাও থাকে। তাদের আসার জন্য বিয়ের প্রয়োজন, আদর প্রয়োজন।”

রেহাংশী দ্বিধান্বিত গলায় তাড়া দিয়ে বলে উঠল—

“আদর?”

“হ্যাঁ, এই যে তোমাকে আমি যেমন করি; তেমন আদর। ওটা ছাড়া তাদের আসার সম্ভাবনা নাই।”

রেহাংশী তখন মুখভর্তি পানি নিয়েছে পান করার জন্য। চকিতে পানি গলায় আটকে গেল। মুখের পানি চট করে বাইরে বেরিয়ে আসলো তার। হতভম্ব হয়ে গেল নিজের নির্বুদ্ধিতায়।

চা নিয়ে ঢুকল রেহাংশী। মোবাইলে কারো সাথে কথা বলে তা পকেটে রাখল ইনজাদ। রেস্তোরাঁয় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে সে। রেহাংশী চায়ের কাপ হাতে রেখে জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে বলল—

“কে ফোন করেছে?”

সহজ গলায় প্রত্যুক্তি করে ইনজাদ—

“তোমার বড়ো আব্বু।”

রেহাংশীর চোখ-মুখ খেলে উঠল ফুটন্ত গোলাপের মতো। তার সুগন্ধ ছড়িয়ে উচ্ছলিত গলায় বলল—

“কী বলেছে বড়ো আব্বু?”

ইনজাদ টাইয়ের নব ঠিক করল। হাতা ফোল্ড করে বিছানায় রাখা হাতঘড়িটা হাতে পরে বলল—

“কাল রাতে যে ফাইল এনেছি সেইটা কোথায়?”

রেহাংশী মৃদু গলায় বলল—

“দিচ্ছি।”

চায়ের কাপ বেড সাইড টেবিলের ওপর রেখে আলমিরা থেকে একটা ফাইল বের করে ইনজাদের হাতে দেয়। সেইটা হাতে নিয়ে খুলে দেখতে থাকে ইনজাদ। রেহাংশী দুই চোখ নিবদ্ধ করে চেয়ে আছে ইনজাদের দিকে। সরস গলায় বলল—

“কী বলেছে বড়ো আব্ব?”

ইনজাদ যেন শুনেও শুনল না। সে চেয়ে রইল ফাইলের ছোটো ছোটো ইংরেজি অক্ষরগুলোতে। রেহাংশী চোখ পিটপিট করে চাইল। প্রবল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন ইনজাদ তার প্রশ্নের জবাব দেবে! কিন্তু তেমন কিছুর আভাস না পেয়ে ফের বলল—

“কী হলো! বলুন না, বড়ো আব্বু কী বলছে?”

ইনজাদের কর্ণকুহর হলো সেই শব্দ। সে ভাবনা কেটে চাইল রেহাংশীর দিকে। ললাটের মধ্যভাগে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফুটিয়ে অস্বচ্ছ স্বরে বলল—

“হু, উহু। কিছু বলেনি তো।”

রেহাংশী ঝলসে উঠল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল—

“দুর! মিথ্যে বলছেন কেন? বলুন না কী বলেছে।”

ইনজাদ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করল। ফাইল বন্ধ করে হাতে রাখল। নিভুনিভু চোখে বাম হাতের তর্জনী দিয়ে বাম ভ্রুয়ে আঁচড় কেটে বলল—

“সরি, ভুলে গেছি কী বলেছে তোমার বড়ো আব্বু।”

“আপনি আবার মিথ্যে বলছেন?”

“একদম না।”

অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল রেহাংশী। ধুম করে এক কামড় বসাল ইনজাদের হাতে। ইনজাদ মৃদু শব্দ করল। ছিটকে সরে পড়ল রেহাংশী। ইনজাদ চোখের সামনে হাত এনে দেখল, দাঁত বসিয়ে ফেলেছে রেহাংশী। হাত থেকে চোখ সরিয়ে রেহাংশীর দিকে তাক করল। রেহাংশী ভয়ে ভয়ে কুণ্ঠিত চোখে তাকাল। থমথমে, ম্লাণ চাহনি। ইনজাদ গাঢ় কণ্ঠে বলল—

“সাহস তো তোমার কম না। রিটার্ন নেওয়ার ক্ষমতা আছে?”

“তাহলে বলছেন না কেন?”

“কী বলব?”

“বড়ো আব্বু কী বলেছে।”

ইনজাদ এগিয়ে গেল রেহাংশীর কাছে। তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলল—

“কামড় দিলে কেন?”

রেহাংশী মাথা নত করল। ছোটো বেলা থেকে এক বাজে অভ্যাস তার। কোনো কিছু নিয়ে বারংবার পায়তারা করলে দাঁত শিরশির করে রেহাংশীর। একবার নুহাশের হাতে বসিয়েছিল কামড়। তাকে গজ পর্যন্ত বাঁধতে হয়েছিল। ইনজাদ হাতের বেড় শক্ত করল। সতেজ গলায় বলল—

“এই নিয়ে তিনবার। আমি কিন্তু একবারেই শোধ করব। তখন কান্নাকাটি করলে চলবে না।”

রেহাংশী মাথা উঁচু করল না। স্তব্ধ হয়ে রইল সে। ইনজাদ হাসল। ঘার বাঁকিয়ে নিচু হয়ে বর্ষণ করল প্রেমাত্মক বৃষ্টির। সিক্ত হলো প্রবল বর্ষণে প্রেয়সী। তুষ্ট হলো দেহ-মন। ইনজাদ সাবলীল গলায় বলল—

“পায়েলের বিয়ে ঠিক হয়েছে। যেতে বলেছে আমাদের।”

রেহাংশীর আড়ষ্ট দেহ মুহুর্তেই তারল্যতায় টগবগিয়ে ওঠল। শ্বাসে দীপ্ততা নিয়ে বলল—

“নুহাশ ভাইয়ার সাথে?”

ইনজাদ অবিশ্বাস্য চোখে চাইল। সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন ছুড়ে—

“তুমি কী করে বুঝলে নুহাশের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে?”

রেহাংশী ঠোঁট চিপল। কণ্ঠ রোদ করে মাথানত করল। ইনজাদ বাঁকা হেসে বলল—-

“বাহ! তোমার বোনেরা দেখি সুপার ফাস্ট। তুমি পিছিয়ে পড়লে কেন? খুঁজে পাওনি কাউকে?”

সশব্দে হেসে উঠে ইনজাদ। রেহাংশী আনম্র দৃষ্টিতে তাকাল। ইনজাদ কণ্ঠ নরম করল। বলল—

“সামনের সপ্তাহে বিয়ে।”

“আমরা যাব?”

“হ্যাঁ। ”

রেহাংশীর মন উৎফুল্ল হলো। গ্রামের সুমিষ্ট বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার জন্য ইতি-বিতি করছে তার অন্তঃকরণ। প্রিয় মুখগুলো দেখার জন্য ছটফটিয়ে যাচ্ছে মন। এবার শুধু অপেক্ষা। রেহাংশীর পুরো দেহে প্রশান্তি ছেয়ে গেল। ইনজাদ মৃদু গলায় বলল—

“সারা ঢাকা শহর ঘুরিয়ে দেখাব তোমাকে। একটু সময় দাও আমায়। রেস্টুরেন্টের নতুন কাজটা একটু গুছিয়ে নেই।”

“কবে যাব আমরা?”

“আগামী শুক্রবার।”

রেহাংশীর চিত্ত দুলে ওঠল। ঝিলিক দেয়া রোদের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে বলল—

“কতদিন থাকব আমরা?”

“দুই দিন।”

“মাত্র দুই দিন? বিয়ের অনুষ্ঠান-ই তো তিনদিনের। হলুদ, বিয়ে, বৌভাত। তাহলে দুই দিন কেন?”

“সময় নেই আমার হাতে। বললাম তো রেস্টুরেন্টে কাজ আছে।”

“তাই বলে মাত্র দুই দিন! কতদিন বাড়ি যাই না!”

ইনজাদ গম্ভীর মুখে বলল—

“তাহলে থেকে যেয়ো। বাড়িতে থাকার এত শখ যখন।”

রেহাংশী খুশি হলো। হেসে হেসে বলল—

“তাহলে আমাকে রেখে আসবেন। পরে গিয়ে নিয়ে আসবেন। কতদিন ফুফুর বাসায় যাই না। বিয়ের দিন যাব।”

ইনজাদের মেজাজ বিগড়ালো। বলে কী এই মেয়ে! যাকে ছাড়া সে চোখ বন্ধ করতে পারে না তাকে রেখে আসবে ক্রোশো দূর! এও কী সম্ভব? আচানক রেহাংশীকে চূড়ান্ত বিস্ময়ে আবিষ্ট করল ইনজাদ। একটানে বুকে পাটায় ফেলে তার গাল চেপে ধরল। ইনজাদের এহেন আচরণে হতবাক হয়ে গেল রেহাংশী। ভয়ে কেঁপে উঠল তার হৃৎপ্রকোষ্ঠ। ইনজাদ চোখ বড়ো করে রাগ দেখিয়ে বলল—

“আরেকবার এই কথা বললে একদম সারাজীবনের জন্য রেখে আসব। তখন অন্ধকারে ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেট ভরে বাতাস খেয়ো। এতটা পাষাণ কেন তুমি? একটু্ও মায়া লাগল না আমার জন্য? থাকতে পারবে আমাকে ছাড়া?”

ছলছল করে উঠর রেহাংশীর হাস্যোজ্জ্বল চোখ দুটো। নিভে গেল তার খুশির প্রদীপ। নিজের ওপর কেমন আঁছোয়া রাগ হলো তার। এই মানুষটাকে ছাড়া সে আদৌ থাকতে পারবে না। তবুও কী করে বলে ফেলল এসব!
ইনজাদ হেসে ফেলল। রেহাংশীর কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বলল। শিমুল ফুলের মতো রক্তিম হয়ে উঠল রেহাংশীর ম্লান মুখচ্ছবি। নিজেকে ছাড়াতে তৎপর হয়ে উঠল তার ইন্দ্রিয়। ইনজাদ রাশভারী গলায় বলল–

“যাচ্ছি আমি। খেয়ে নিয়ো দুপুরে। খাওয়ায় অনিয়ম করে অনেক ভুগিয়েছ আমাকে। এবার এমন কিছু করলে বাড়ি যাওয়া ক্যান্সেল। মনে থাকে যেন।”

স্বামীর আদরে মাখা ধারলো শাসনে সায় দিলো রেহাংশী। ইনজাদ চোখে হাসল।

“আসি আমি।”

“হুম।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here