#মোহঘোর
#পর্বঃ২৮
লেখনীতেঃতাজররিয়ান খান তানভি
রেস্তোরাঁয় ঢুকেই অবাক হলো ইনজাদ। সামনের টেবিলেই তার দুই পরিচিত মুখ বসে আছে। ইনজাদ চমকিত হাসল। চোখে দেখা গেল বিস্মিত ভাব। মেহমাদ সতেজ হেসে নিজের উপস্থিতি জাহির করল। তার পাশেই সিন্ধুজা। তূরন্ত যৌবনে দোল খেলানো এক মনোহারিনী নারী।
ইনজাদ ধীরপায়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল। মোলায়েম গলায় কৌতূহল মিশ্রণ করে বলল—
“হঠাৎ এখানে?”
মেহমাদ উত্তর দিলো। সে এগিয়ে দিলো মিহি হলুদ রঙের একটা কার্ড। ইনজাদ দেখেই চমৎকার হাসল। কৌতুকমাখা গলায় বলল—
“ব্যাচলর লাইফের সমাপ্তি টানছিস তাহলে!”
মেহমাদ স্বর ভারী করে বলল—
“তুই বউ বিলাস করিস, আর আমি বিয়ে করতে পারব না?”
ইনজাদ ঠোঁট ভর্তি হেসে বলল—
“শীতকাল তো তোদের জন্য এসেছে। ”
সিন্ধুজা মজা করে হাসল। দুই বন্ধুর খুঁনসুটি সে উপভোগ করছে। দৃঢ় হলো মেহমাদ। শক্ত গলায় বলল—
“রেহাংশীকে আগে থেকেই পাঠাবি। আবার বলিস না রাতে ঘুম আসবে না তোর।”
ইনজাদ কথায় বেগ লাগাল। প্রানোচ্ছ্বাস নিয়ে বলল—
“বউ একা যাবে কেন? আমার সাথে যাবে। বিয়ে করেছি কী বউ ছাড়া থাকতে?”
সিন্ধুজা শব্দ করে হেসে ফেলল। মেহমাদ আর ইনজাদের অধরেও ঝরঝর করে হাসি ঝরতে লাগল। ইনজাদ হাসি চাপল। নম্র স্বরে বলল—
“অবশ্যই যাব। বাড়ি থেকে আসি আগে। রেহাংশীর কাজিনের বিয়ে। আর তিয়ার বিয়ে হয়ে যাবে। ইশ ! বেচারিকে হালাল হওয়ার আগে একবার দেখতে হবে আমার। কতদিন দেখি না ওর চাঁদমুখ।”
মেহমাদ টগবগিয়ে বলল—
“শালা, একদম যাবি না তুই ওর সামনে। তোর জন্য আমাকে অনেক ভুগতে হয়েছে।”
ইনজাদ গা দুলিয়ে হেসে বলল—
“মাই গড! আমার অপেক্ষাতরীটার বিয়ে হয়ে যাবে, আর আমি তার সাথে দেখা করব না?”
মেহমাদ উঠে এলো। ইনজাদের গলার দিকে চেপে ধরে গটগট করে বলল—
“বউ ছাড়া এসেছিস তো এক লাথি দিয়ে বের করে দেবো। আর যদি ওকে ফোন করেছিস, অনিতার সাথে কী করেছিস মনে আছে? রেহাংশীকে গিয়ে বলব। তখন দেখবি কেমন লাগে। চাঁদনী রাত, তুমি আমি সাথ! বুঝবি তখন।”
ইনজাদ হাসতে হাসতে হুটোপুটি খেলো। মেহমাদ থেকে গলা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল—
“বল গিয়ে। আই ডোন্ট মাইন্ড। আমার বউ তোর ললিপপের মতো না। ”
“একদম ওকে কল করবি না তুই। গেলাম আমি। হলুদের আগের দিন রেহাংশীকে পাঠাবি। মনে থাকে যেন।”
“হ ভাই, শীতকালের কম্বল কেনার টাকা বাচঁব। যা ভাগ।”
মেহমাদ খলখল করে হাসল। সিন্ধুজার দিকে তাকিয়ে বিদায় ভাষণ দিয়ে বলল—
“আসি সিন্ধুজা। এসো কিন্তু বিয়েতে। সবাইকে সাথে নিয়ে। তিয়া তোমার কথা বলেছে।”
চোখে সম্মতি দিলো সিন্ধুজা। মেহমাদ যেতেই কৌতূহল জাগল সিন্ধুজার চোখের পাতায়। ঐৎসুক্য গলায় বলল—
“কী হয়েছে বলোতো তিয়ার সাথে তোমার?”
“আরে তেমন কিছু না। একদিন রাতে তিয়া ফোন করেছিল। মেহমাদ তখন ওয়াশরুমে। আমি ফোন রিসিভ করেছিলাম। তিয়া বুঝতে পারেনি। ওকে আমি পরদিন সকালে হাতিরঝিলে আসতে বলেছিলাম সকাল সাতটা। বেচারি, দুই ঘণ্টা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। মেহমাদের মোবাইল থেকে রাতে নাম্বার ব্লক করে রেখেছিলাম। গাধাটা নয়টা পর্যন্ত সেই ঘুম। আমার নাম্বারে কল করলে ওকে ধরিয়ে দেই। গাধাটা উঠেই ছুট লাগায়। আর পরে জানতে পেরে বেচারাদের ব্রেক-আপ হতে হতে প্যাচ-আপ হয়।”
সিন্ধুজা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে শ্বাস রোধ করে বলল—
“হাউ ফানি!”
কিছুক্ষণ হাসির শব্দহীন তান্ডব চলল। ইনজাদ সহসা বলে উঠে—
“কিছু খেয়েছ?”
“আরে না। খাবো না কিছু। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।”
“তা তো জানি ম্যাডাম। প্রথমে কিছু খেয়ে তো নাও।
“উঁহু।”
ইনজাদের দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দেয় সিন্ধুজা। ইনজাদ সেদিকে নজর ফেলতেই সিন্ধুজা অবারিত গলায় বলে যায়—
“একটা রিসোর্ট দেওয়ার কথা ভাবছি। ড্যাডের সাথে কথা বলেছি। তুমি একটু দেখে বলোতো জায়গাটা কেমন হবে?”
ইনজাদ দাঁতের সাথে দাঁত চেপে ধরে ভাবছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কপাল চুলকে বলল—
“আই থিংক না দেওয়াটা বেটার।”
সিন্ধুজা হতবাক গলায় বলল—
“কেন?”
“গাজিপুর! গাজিপুরে রিসোর্টের অভাব নেই। চৌরাস্তা থেকে শুরু করে…। স্প্রিং ভ্যালি রিসোর্ট, রাজেন্দ্র ইকো, পুষ্পদাম পিকনিক স্পট, হ্যাপি ডে ইনন, অঙ্গনা, আরশিনগর হলিডে। আরো আছে। আই থিংক তোমার এমন জায়গা রিসোর্ট প্ল্যান করা উচিত যেখানে চাহিদার তুলনায় প্রাপ্যতা কম। ”
সিন্ধুজা গভীর ভাব নিয়ে বলল—
” তো?”
ইনজাদ চেয়ার থেকে পিঠ আলগা করে। চটপটে গলায় বলল—
“তুমি নারায়ণগঞ্জ ট্রাই করতে পারো। সায়রা গার্ডেনের নাম শুনেছ? ইটস আমেজিং! এইটা যখন স্থাপিত হয় তখন এর আয়তন ছিল ত্রিশ বিঘা। এখন আরো বিস্তৃত হয়েছে। কী নেই সেখানে! ফুল গাছ থেকে ঔষধি গাছ, সুইমিংপুল থেকে পুকুর, রেস্টুরেন্ট, বাচ্চাদের জন্য খেলার মাঠ সব আছে। কটেজগুলোও দারুন। সাজেক ভ্যালি ফিলিংস দেবে। পুরো না হলেও কিছুটা। নামগুলোও জোস! মাধবীলতা, কুঞ্জলতা, কলমিলতা। ইচ্ছেকরলে কাপলদের জন্য এইরকম কটেজ স্পেশাল অফারে রাখা যায়। ওখানে রিসোর্টের স্বল্পতা আছে। তোমাকে অবশ্য আরো অনেক কিছু আমলে নিতে হবে। নাহলে প্রথম ধাপে ফেল করবে। তবে আগে তোমাকে সেখানে গিয়ে জায়গা দেখে আসা উচিত। আর রিসোর্টে ডেবলপ সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা।”
“তুমি গিয়েছিলে না কি?”
ইনজাদ ছোট্ট করে হেসে বলল—
“বন্ধুদের সাথে গিয়েছিলাম।”
“আমি তো ভাবলাম রেহাংশীকে সাথে নিয়ে গেছ।”
ইনজাদ লাজুক হেসে বলল—
“না, ওকে নিয়ে কোথাও যাওয়া হয়নি। সময় পাইনি আসলে।”
“সো স্যাড! ওকে থ্যাংস আ লট। ড্যাডের সাথে বসতে হবে। তোমাকে পরে জানাচ্ছি আমি। ”
ইনজাদ ঘাড় নাড়াল। সিন্ধুজা হাসি হাসি মুখে উঠে যায়। দরজা কাছে গেলেই ডেকে উঠে ইনজাদ। থমকে যায় সিন্ধুজা। ইনজাদ একটু এগিয়ে গিয়ে কৃতজ্ঞতার সুরে বলল—-
“ধন্যবাদ।”
সিন্ধুজা অবাক বিস্ময়ে তাকাল। ভ্রূ জোড়া কুঞ্চি করে চোখের পাতা প্রশস্ত করল। ইনজাদ গাঢ় মায়ায় বলল—
“ছুটির ব্যবস্থা করে দিলে তাই। আমার প্রক্সি তো তোমাকেই দিতে হবে।”
সিন্ধুজা হেয়ালি গলায় বলল—
“ইটস ওকে ইয়ার। এখানে ধন্যবাদের কী আছে। ইনজয়! বাই অ্যান্ড টেক কেয়ার।”
সিন্ধুজার অধরের কোণে এক সুপ্ত হাসির ঝিলিক ওঠল।
,
,
,
নিশুতি রাত। ঘনালো তমসার আকাশ জুড়ে নেই কোনো তারার ফুলকি। বাসায় ফিরেছে ক্লান্ত ইনজাদ। ঘর্মাক্ত দেহ থেকে শার্ট খুলতেই চোখে পড়ে বিছানার পাশে থাকা গুছানো ব্যাগ। ইনজাদ ভ্রু নাচায়। জোরালো কণ্ঠে রেহাংশীকে ডাকল। স্বামীর কণ্ঠ পেয়ে শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এলো রেহাংশী। ইনজাদ কপালে ভাঁজ তুলে বলল—
“এসব কী?”
ব্যাগের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল রেহাংশী। লাজুক স্বরে বলল—
“কাল বাড়ি যাব। তাই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি।”
ইনজাদ তপ্ত শ্বাস ফেলল। বুক টানটান করে বলল—
“বাড়ি যাওয়ার জন্য এত উতলা কেন তুমি? আমার কাছে থাকতে ভালো লাগে না?”
রেহাংশীর চোখে নেমে এলো কাতরতা। নিস্পৃহ গলায় বলল—
” আমি কী তা বলেছি।”
ইনজাদ কদম বাড়িয়ে এগিয়ে গেল। ঘাঢ় নিচু করল। তার শার্ট এখনো গায়ে ঝুলছে। বোতাম খোলা থাকায় অসংবৃত প্রশস্ত বুক দেখা যাচ্ছে। ইনজাদ চাপা স্বরে বলল—
” আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে?”
রেহাংশী মাথা উঁচু করল। দিঘীর জল কাণায় কাণায় পূর্ণ। ধরা গলায় অব্যক্ত অনুভূতির অকাট্য যুক্তি —
“রাতের আলো কখনো চাঁদকে ছাড়া থাকতে পারে? দিনের শুরুতে চাঁদ হারিয়ে গেলেও, আঁধার কালো যখন জাগ্রত পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তখন স্বমহিমায় প্রস্ফুটিত হয় জ্যোৎস্নানাথের। অন্ধকার আকাশকে পৃথিবীর কোনো শক্তি চাঁদ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। আপনি আমার জীবনের সেই চাঁদ। আপনার আলোয় আমার অন্ধকার জীবন আলোয় উদ্ভাসিত। এখন বলুন, আপনাকে ছাড়া আপনার বিষবাণ থাকতে পারবে? তার মূল্য দেবে এই পৃথিবী?”
ইনজাদ গভীর, নিচ্ছিদ্র, অতলস্পর্শী মায়ায় জড়িয়ে ধরল রেহাংশীকে। শ্বাস অবরোধ করে স্বামীর বুকে মাথা রাখে রেহাংশী। থমথমে গলায় বলল—
“আপনি তো নুপূর আপুকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন তাই না? নুপূর আপুতো আমার থেকে সুন্দরী!”
ইনজাদ চোরা হাসল। হাতের বেড় শক্ত করল। বুকে চাপ লাগে রেহাংশীর। কোনো শব্দ করল না সে। ইনজাদ নিষ্কম্প গলায় হিসহিসিয়ে বলল—-
“বাহ্যিক সৌন্দর্য শুধু চর্মচক্ষুতে হানা দেয়। এক নিমিষে যেমন বিদীর্ণ করে চোখের আরশি তেমন তা খানখান করে দেয় তার অস্তিত্ব। হৃদয়ের আরশিতে যে প্রণয়ের সূত্রপাত তার প্রতিফলণ ঘটে হৃদয়াক্ষীতে। যার প্রস্ফুটিত রূপ ধীরে ধীরে প্রণয়কাননে রূপ নেয়। সেই কাননের সমস্ত ফুলের সৌরভ তুমি। আমার বিষবাণ! যার নেশায় নেশাক্ত আমি, আমার আমি আসক্ত। কাটবে না এই নেশা আমার, আসক্তিহীন এই আমি জীবন্মৃত।”
চলবে,,,