#মোহঘোর
#পর্বঃ৩১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পেলব, শুদ্ধ, শীতল প্রভঞ্জনের মিহি পরশ চুমু এঁকে দিচ্ছে রেহাংশীর উষ্ণ দেহের কাঁপনে। প্রিয় মানুষদের দেখার অগাধ তৃষ্ণা তার চোখের মনিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। কুয়াশার শুভ্র চাদর ভেদ করছে নির্মোহ চিত্রভানুর কাঁচা সোনা রঙের স্নেহার্দ্র রোদ। প্রকৃতিতে জাগরণ উঠেছে এক পশলা গুড়ি বৃষ্টির সিক্ত সকাল। সফেদ কুয়াশার আচ্ছন্ন ধরণীর বুকে ঝিরিঝিরি জলদ কন্যার মুহূর্ত ধরে চলা অবিশ্রান্ত জল। থেমে যেতেই পা বাড়ায় রেহাংশী। কর্দমাক্ত আধপাকা পথে সাবধানী পা ফেলছে সে। দম যেন গলায় আটকে যাবে! বাড়ির কাছে এসে বুক ভরে শ্বাস নিল সে। বাড়ির সদর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই শিউরে উঠে তার কায়া। এক ঝাঁক জড়তার নভোলোক বিদীর্ণ করা রোদ তার ললাটে চুম্বন করল। রেহাংশী আপ্লুত হলো। বাড়ির উঠোন জুড়ে জেগে থাকা সিক্ত মৃত্তিকার ঘ্রাণ ঠেসে ধরল ঘ্রাণেন্দ্রিয়। বাড়ির আমগাছার পত্রপল্লবে গহন দোল। সীমাহীন উচ্ছ্বাসের ভরা জোয়ারে যেন ভেসে যাচ্ছে রেহাংশী। হাজার দিবসের চেনা বাড়িটি আজ কেন অচেনা,অজ্ঞাত, অপরিচিত লাগছে! জুলহাস খন্দকার হাঁক ছাড়তে ছাড়তে বাড়ির বাইরে এলেন। তাকে দেখেই উচ্ছলিত হলো রেহাংশী। গালভর্তি সজীব হাসল। অবহেলিত পাতলা চাদর টেনে নিল গায়ে। চপলতায় বিভোর পা দুটো রুখে যেতে নারাজ। রেহাংশীর হাঁটার বেগ বাড়াল। জুলহাস খন্দকারকে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে ফেলল। তিনি অবাক হলেন। ঝমঝম বৃষ্টি শেষে পানি শুষে নেওয়া মাটির মতো জমাট গলায় বলে উঠে রেহাংশী—
“কেমন আছ বড়ো আব্বু? একবার আমাকে দেখতেও গেলে না? বিয়ে হয়েছে বলে পর করে দিলে?”
জুলহাস খন্দকার পরম মমতায় রেহাংশীর মাথায় হাত রাখলেন। চোখের কোটরে নমনীয়তা এনে বললেন—-
“মায়েরা কখনো ছেলেদের পর হয়?”
রেহাংশী অনুযোগের সুরে বলল—
“তাহলে গেলে না কেন?”
“সময় পাইনি রে মা। এদিকটায় এত ঝামেলা হয়েছিল! যাব তো। তোর নতুন সংসার দেখতে। পায়েলের বিয়েটা দিয়ে নেই। তোর দাদী, বড়ো আম্মু সবাইকে নিয়ে যাব। অনেকদিন থাকব। আর রাগ করিস না মা।”
রেহাংশী ছোটো বাচ্চাদের মতো মন ভুলানো হাসল। চট করে হাতের উলটো পাশ দিয়ে চোখ -মুখ মুছে ফুরফুরে হাসল। বলল—
“দাদী কেমন আছে? বড়ো আম্মু, পায়েল আপু? সবাই ভালো আছে তো?”
“আছে, আছে। সবাই ভালো আছে। তুই একা কেন? জামাই কোথায়?”
রেহাংশী ঠোঁট ভর্তি লাজুক হাসল। মৃদু সুরে বলল—
“বাজারে গেছে।”
জুলহাস খন্দকার অপ্রত্যাশিত বিস্ময় নিয়ে বললেন—
“বাজারে কেন?”
রেহাংশী অধর বিস্তৃত করল। চোখে খুশির আবেশ মাখিয়ে বলল—
“প্রথম শ্বশুরবাড়ি আসবে। খালি হাতে আসা যায়!”
কথা শেষ করেই খিলখিলিয়ে হাসে রেহাংশী। জুলহাস খন্দকার প্রসন্ন হাসলেন। মেয়েটা সুখে আছে! শেষ মুহূর্তে নেওয়া সিদ্ধান্ত ভুল হয়নি তার। তিনি গলা প্রশস্ত করে তাড়া দিয়ে বললেন—
“তুই ঘরে যা। ওরা ঘরেই আছে।
ডেকোরেশন আর লাইটিং এর লোক আসবে। দেখি ফোন করে কোথায় ওরা।”
রেহাংশী মাথা ঝাঁকাল। চটপটে অনুভূতিতে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। ঘরের প্রতিটি জড়বস্তু যেন তাকে দেখে হাসছে। কোমল স্বরে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। মোলায়েম চোখে সবকিছু অবলোকন করছে রেহাংশী। একরাশ প্রফুল্লতা টগবগ করে ফুটছে তার চিত্তে। রেহাংশী শব্দহীন পা ফেলে পায়েলের ঘরে ঢুকল। তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই চকিতে চিৎকার করে উঠল পায়েল। রেহাংশী খিলখিল করে হেসে বলল—
“আরে থামো, থামো। আমি। ”
পায়েলের প্রাণটা যেন আরেকটু হলে উড়াল দিতো! সে আড়ষ্ট গলায় বলল—
“তুই! এমন কেউ করে?”
রেহাংশী ঝুমঝুম করে হেসে বাতাসে আলোড়ন তুলে। পায়েল আলতো করে জড়িয়ে নেয় রেহাংশীকে। সরল গলায় বলল—
“কেমন আছিস তুই? এত দেরি করলি কেন?”
রেহাংশীর জমাট হৃদয় বিগলিত হলো স্নেহার্দ্র আচরণে। কণ্ঠ সহজ করে বলল—
“ভালো আছি। কাল রাতে এসেছি। ”
“আয় বস।”
রেহাংশীকে হাত টেনে বিছানায় বসায় পায়েল। পায়েলের খুশির পায়রারা যেন তাকে ঘিরে আনন্দ উৎসব করছে। চোখের তারায়, ঠোঁটের ভাঁজে অফুরন্ত খুশির স্রোতোস্বিনীর তীব্র উত্তাল ঢেউ। রেহাংশী ক্ষীণ গলায় বলল—
“নুপূর আপু এসেছে?”
পায়েল সংকীর্ণ হেসে বলল—
“হ্যাঁ, গতকাল-ই এসেছে। জানিস আপু মা হতে চলেছে। এক সপ্তাহ আগেই আমাদের জানিয়েছে।”
সীমাহীন আকাশের শুভ্র মেঘের মতো চঞ্চল হয়ে উঠল রেহাংশীর অন্তরিন্দ্রিয়। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল—
“সত্যি? ”
“হ্যাঁ। ”
রেহাংশীর খুশির ফোয়ারা তূরন্ত বেগে ছুটতে লাগল। সতেজতায় প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় লালিমা ফুটিয়ে বলল—
“আমি যাই, আপুকে দেখে আসি।”
“যা।”
চপল পায়ে পায়েলের ঘর থেকে বের হতেই সামনে পড়ে রওশন আরা। তিনি ক্ষ্যাপাটে গলায় বললেন—
“এমন ছুটতাছস ক্যান? দাদীরে ভুইলা গেলি?”
রেহাংশী চঞ্চল স্বরে বলল—
“ভুলব কেন? কেমন আছ দাদী?”
“তুই একা কেন? নাতজামাই কই?”
“সে পরে আসবে।”
“তাইলে তুই আইলি ক্যান? জামাইরে ছাইড়া আইলি ক্যান? জামাইরে আঁচলে বাইন্ধা রাখবি। ভালো কইরা শুইনা রাখ, তোর মায় আমার পোলাডারে খালি রুপের নেশা লাগাইছে, বাইন্ধা রাখতে পারে নাই। নিজে তো মইরা গিয়া বাঁচছে, আমারে পোলা হারা করছে। পোলাডা আমার সেই যে গেল আর আইলো না। শুন মাইয়া, জামাইরে ধইরা -বাইন্ধা রাখবি। নাইলে নিজের কপাল নিজে খাবি। পুরুষ মানুষ বিলাইয়ের জাত। কাঁঢা পছন্দ অইলেও তাজা মাছ পাইলে তা আর মুখে রুচে না। মনে রাখিস।”
রওশন আরার ভয়ংকর কথাবার্তায় রেহাংশী ভীত চোখে তাকিয়ে রইল। সে কখনো চায় না তার স্বামী তার বাবার মতো হোক। স্বামীর ভালোবাসার নিচ্ছিদ্র চাঁদোয়া আবৃত করে রাখুক তাকে। এই তার প্রার্থনা।
,
,
,
দরজায় কড়া নাড়ল। সোফায় বসে থাকা এহসাস উঠে এসে শব্দহীনভাবে দরজা খুলল। রেহাংশী মিহি হেসে বলল—
“কেমন আছেন?”
এহসাস পলক ফেলে ঈষৎ ফাঁক করা অধরে বলল—
“ভেতরে এসো।”
রেহাংশী বিনা ছন্দপতনে ভেতরে ঢুকল। বিছানায় তাকাতে দেখল ঘুমের দেশে তলিয়ে আছে নুপূর। মুখটা কেমন ফ্যাকাশে! জ্বলজ্বলে রূপে ম্লানতা। শুষ্ক অধরে খসখসে ভাব। চোখের নিচটা প্রাণহীন। রেহাংশী চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল এহসাসের দিকে। এহসাস মুখ খুলল—
“একটু আগেই বমি করেছে। শরীর ভালো নেই।”
রেহাংশী চাপা স্বরে বলল—
” ডাক্তার দেখিয়েছেন?”
“হুম। কিছু হালকা পাওয়ারের ঔষধ দিয়েছে। বাইরে চলো, কথা আছে আমার।”
রেহাংশী নির্বিকার ভঙ্গিতে মাথা হেলিয়ে কক্ষের বাইরে আসে। এহসাস নিঃশ্বাস নিল। গাঢ় স্বরে বলল—
“ক্ষমা করে দিয়ো রেহাংশী। সেইদিন যা করেছি শুধু নুপূরের কথা ভেবে করেছি। ভাবিনি তারপর তোমার সাথে কী হবে! আমি তো অবাক হয়েছি তোমার সাথে ওর মা এত কিছু করার পরও ও বাঁধা দিলো না কেন?”
রেহাংশী নতমুখে চুপ করে রইল। কী বিদঘুটে দিন ছিল! বিয়ে বাড়ির মানুষ তাকে কত কথা শুনিয়েছে। ওইটুক বয়সে প্রেম, তার ওপর তার মাকে নিয়েও গুঞ্জন উঠিয়েছে। বলেছে হয়তো মায়ের সাথেও কারো এমন সম্পর্ক ছিল। তাই তার বাবা মাকে ছেড়ে চলে গেছে। মেয়েটাও মায়ের মতো হয়েছে। নুপূরের মা দুইদিন রেহাংশীকে ঘরবন্দি করে রেখেছিল। খেতে দেইনি পর্যন্ত।
রেহাংশী আর ভাবতে চায় না। তার কষ্টের অবসান ঘটেছে। এখন শুধু সুখের পায়রাদের প্রবেশাধিকার তার ছোট্ট প্রেমপূর্ণ নীড়ে।
“আসলে…।”
“কেমন আছেন?”
এহসাসের কথার মাঝখানে এসে দাঁড়াল ইনজাদ। স্বাভাবিক আননে অমায়িক হাসি। এহসাস নির্মল গলায় প্রত্যুক্তি করল—-
“ভালো, আপনি কেমন আছেন?”
ইনজাদ কপালের মধ্যখানে কিঞ্চিৎ ভাঁজ তুলল। চোখে হাসল প্রেমময় ভঙ্গিতে। পুরু অধর বিস্তৃত করে সচ্ছল গলায় বলল—
“ভালো। আর ভালো বলেই এত দূর আসতে পেরেছি।”
মৃদু হাসল এহসাস। লজ্জার ভঙ্গিতে চোখ নাড়াল। অপরাধি মুখ করে বলল—-
“একটা কথা বলতে চাই। ক্ষমা চাইতে। না বুঝে একটা ভুল করে ফেলেছিলাম।”
ইনজাদ অনড় গলায় বলল—
“থামুন, আমি জানি আপনি কী বলবেন। রেহাংশীর অতীত আমার অগোচরে। আমি তা শুনতে বা জানতে চাই না। আমি ওর বর্তমান। এবং ভবিষ্যতের সারথি। তাই আমি ওর ভবিষ্যৎ নিয়েই ভাবব।”
এহসাস একগাল প্রশ্রয়ের হাসি হাসল। সশব্দে বলল—
“ধন্যবাদ। নিজেকে হালকা লাগছে।”
ইনজাদ চোখে হেসে বলল—
“বাড়ি আসবেন আমাদের। পাশেই তো। দু ‘কদম হেঁটে চলে আসবেন। এসো রেহাংশী।”
রেহাংশী আপ্লুত গলায় বলল—
“চলে যাবেন কেন? বড়ো আব্বু আপনাকে খেয়ে যেতে বলেছে।”
ইনজাদ অনায়তন গলায় বলল—-
“না। দুই দিনের জন্য বাড়িতে এসেছি। আম্মার হাতের রান্নাই খাবো। আর আমরা তো সন্ধ্যায় আবার আসব এখানে। তুমি চাইলে থাকতে পারো।”
রেহাংশী মাথা ঝাঁকিয়ে না বোধক সম্মতি দিলো। ইনজাদ প্রশ্রয় দিলো তার সম্মতিকে।
চলবে,,,