#মোহঘোর
#পর্বঃ৩৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
ম্লান অংশুমালী! তার দাম্ভিকতার সাথে বিদীর্ণ করা লাভায় আজ ভাটা পড়েছে। মৃদু শীতলতায় আচ্ছন্ন মধ্য প্রহরের ভূতল বাহ্যজগৎ। ফিনফিনে সমীরণে মন্থর অনুরণন পত্রপল্লবে।
ছায়া ঢাকা বাড়ির পেছন দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে ইনজাদ। প্রকাণ্ড ছায়াতরুর ফাঁক গলিয়ে কিঞ্চিৎ আলোক শিখার দুর্গম প্রবেশ। সেই দুর্বোধ্য আলোকরশ্মির ক্ষীণ তাপে বহু শাখা বিশিষ্ট গাছগাছালির ছায়া পড়েছে মৃত্তিকার বক্র বুকে।
নিরুদ্বেগ চিত্তে এক হাতের মুষ্টি পেছন দিকে রেখে অন্য হাতের আঙুলের ভাঁজে থাকা সিগারেট গৌরবের সাথে টেনে যাচ্ছে ইনজাদ। শুভ্র ধোঁয়ার পাক উড়ে যাচ্ছে বাতাসে। পায়ের কাছে স্তুপাকারে থাকা শুকনো, পঁচা পাতার বহরে তাকায়ে সে। হেয়ালি স্বভাবের পরিস্ফুটন ঘটিয়ে তাতে ধীর লাথি বসায়। সামনে থাকা ডোবায় পড়ে পাতার ঝরঝরে ধারা। চকিতে ইনজাদের কানে ভেসে আসে কুহরণ। সে সচকিত চোখে তাকায়। নাম না জানা পত্রীদের মিষ্টি ডাকে কূজিত হচ্ছে নিস্তব্ধ চারপাশ। ইনজাদের কর্ণকুহর হলো অদ্ভুত এক শব্দ। বিনা শব্দে উৎকর্ণ হয়ে রইল সে। ঝিঝিঝি… শব্দের এক নিরবচ্ছিন্ন সুর। তাতে নেই কোনো প্রতিরোধ। ইনজাদের মনে হলো বাতাসেরও শব্দ হয়। মিহি, স্নিগ্ধ, মধুমাখা শব্দ! ইনজাদের মস্তিষ্কের স্নায়ুতে প্রতীত হচ্ছে সেই অদৃশ্য, আছোঁয়া, অদেখা ধ্বনি। ইনজাদ স্থির হলো। প্রকৃতির কলধ্বনির এই নিস্তেজ কিন্তু জাগ্রত, অরব কিন্তু প্রান জুড়ানো, গহন কিন্তু অনুভবনীয় মাহাত্ম্যকে সংবরন করছে সে গভীর আশ্লেষে।
দৈবাৎ গা ঝাকুনি দিয়ে পেছনে ফিরল ইনজাদ। শুষ্ক, সিক্ত পাতার শ্রান্ত মর্মরধ্বনি ! সচল চোখে দেখতে পেল প্রিয়পাত্রীকে। ইনজাদ ঠোঁট ভর্তি হাসল। সিগারেটে টান লাগালো সজোরে। ধোঁয়া ছড়িয়ে ঠোঁটের বলয়ে খেয়ালিপনা রেখে চোখে হাসল। নির্বিকার গলায় বলল—
“তুমি এখানে?”
রেহাংশী নিশ্চল রইল। তেজদীপ্ত নজর ক্ষেপন করল ইনজাদের দিকে। ঝাঁঝ মাখা কণ্ঠে বলল—
“এখানে কী করছেন?”
ইনজাদ স্বত:স্ফূর্ত গলায় বলল—
“দেখছ তো কী করছি।”
“এখানে কেন?”
ইনজাদ শেষ টান দিলো সিগারেটের ফিল্টারে। বাকিটুকু ছুড়ে মারল সামনের ডোবায়। নিভে গেল জ্বলন্ত সিগারেট। কাঁদাজল ভরা ডোবায় ভাসতে লাগল নিভন্ত ফিল্টার। একটু পরেই একটা পাতার সাথে জড়িয়ে গেল তা। ইনজাদ নিরুত্তেজ গলায় বলল—
“শ্বশুরবাড়িতে মান-সম্মান যাবে আমার।”
রেহাংশী তাচ্ছিল্যের সাথে বলল—
“তাই বুঝি বাড়ির পেছনে এই ডোবার কাছে এসেছেন? সিগারেটের মিষ্টি গন্ধে বুঝি ডোবার গন্ধ নাকে লাগছে না আপনার!”
ইনজাদ গাঢ় মায়ায় হাসল। সবুজ শাড়ি পরিহিত নারীর রাগের আস্ফালণ তার হৃদয়ে গেঁথে গেল। হলকে উঠা গলায় ইনজাদের নীরবতায় সূঁচ বিধালো রেহাংশী।
“এত মান-সম্মানের চিন্তা থাকলে খাচ্ছে কেন? এমন কাজ করবেন কেন যা বুক ফুলিয়ে করতে পারবেন না?”
ইনজাদ অধর বিস্তৃত করল বিনা ছন্দপতনে। নরম স্বরে বলল—
“কেন এসেছ বলো।”
দপদপিয়ে ইনজাদের কাছে এসে দাঁড়াল রেহাংশী। শিশির ভেজা মাটিতে তার পায়ের চাপ খুব করে লাগল। তবুও শিথিল হলো না বেগ। তড়িৎ বেগে ইনজাদের পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে ছুড়ে ফেলল ডোবাতে। ইনজাদ ভড়কে যায়। হতবুদ্ধি গলায় বলল—
“এইটা কী করলে?”
“বেশ করেছি।”
ইনজাদ ভ্রূ-বিলাস করল। চোখ-মুখ শক্ত করে আচানক রেহাংশীকে টেনে নিল নিজের ওষ্ঠাধরের ভাঁজে। স্বামীর এহেন কাজে বর্ষায় সর্ষে ফুল দেখল রেহাংশী। নিজের মত্ততায় লাগাম লাগিয়ে রেহাংশীর কটিদেশ চেপে তাকে বুকের কাছে ঠেসে নেয় ইনজাদ। এভারেস্ট জয় করা হাসি তার মুখচ্ছবিতে। জয়ী হওয়ার আনন্দের ফিনফিনে বার্তায় বলল—
“টিট ফর ট্যাট।”
জবরদস্তি নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় রেহাংশী। ফুঁসতে থাকে গহনক্রিয়ায়। ইনজাদ ভ্রূ নাচিয়ে নীরব প্রশ্ন করল। জানতে চাইছে,কেন এসেছে সে? রেহাংশী দগদগে গলায় বলল—
“মোবাইল রেখে এসেছেন। মনে আছে? মেহমাদ ভাইয়া ফোন করছে সে কখন থেকে!”
“দাও মোবাইল।”
ইনজাদ হাতের তালু মেলে ধরে। দপ করে তার হাতে রাখে মোবাইল রেহাংশী। হনহন করে চলতে শুরু করে। ইনজাদ সেদিকে চাইল। রেহাংশীর কাঁধ থেকে শাড়ি সরে এসেছে। তৎক্ষণাৎ মোবাইলের ফোন বেজে ওঠে। ইনজাদ মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে আওয়াজ করে বলল—
“আঁচল ঠিক করো রেহাংশী। পিন লাগিয়ে নিয়ো।”
রেহাংশী থামল না। বাড়ন্ত পদযুগলে কণ্ঠের প্রখরতা বাড়িয়ে বলল—
“লাগাব না। আঁচল খুলেই হাঁটব।”
ইনজাদ চোখ তুলল। রেহাংশীর পিষ্ঠদেশ তার চোখের দর্পণে। চট করে হেসে বলল—
“ঘুরে-ফিরে আমার কাছেই আসতে হবে। আমার একশ বিশ টাকা ডোবায় ফেলেছ। সব উসুল করে নেবো।”
“যা ইচ্ছে করুন।”
ইনজাদ শব্দ করে হাসল। কল রিসিভ করে ধমকে উঠে বলল—
“শালা, মীর জাফর! ফোন করার সময় পাস না? তোর জন্য আমার একশ বিশ টাকা জলে গেল!”
মেহমাদ উৎসুক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করতেই ইনজাদ সবটা খুলে বলল। গা দুলিয়ে হেসে উঠল মেহমাদ। হাসির সাথে শ্বাস টেনে টেনে বলল—
“তোর ভাগ্য ভালো যে তোকে ফেলে দেয়নি। ”
“প্যাঁচাল রাখ, ফোন করেছিস কেন সেইটা বল।”
মেহমাদ হাসি থামাল। রয়ে সয়ে বলল—
‘বিয়ে খাচ্ছিস না কী বাসর করছিস?”
“তোর কী দরকার? ফোন কেন করেছিস সেইটা বল।”
“তাহলে শোন, সিন্ধুজাকে তুই নারায়ণগঞ্জ যেতে বলেছিস?”
“বলেছি। তো?”
“ও আমাকে সাথে যেতে বলেছে।”
“যাবি, সমস্যা কী তাতে?”
মেহমাদ বিস্ফোরিত গলায় বলে উঠে—
“পাগল হয়েছিস! তিয়া জানলে জ্যান্ত কবর দেবে আমাকে। আমি পারব না যেতে। আর আমাদের শপিং বাকি। তুই জানিস ও নিজের পছন্দ নিয়ে কতটা পজেসিভ।”
ইনজাদ মুচকি হেসে বলল—
“তাতো তোর অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছি। কী করতে হবে সেইটা বল।”
“তোকে ওর সাথে যেতে হবে।”
“আমাকে যেতে হবে মানে?”
“মানে নারায়ণগঞ্জ তুই ওর সাথে যাবি। আমি ওকে বলে দিয়েছি তোর সাথে কথা বলতে।”
“কিন্তু ও তো আমাকে কিছু জানায়নি।”
” ও দ্বিধায় আছে। তুই একবার কল করে দেখিস।”
“আচ্ছা।”
“রাখি এখন। তাড়াতাড়ি ফিরে আয়। আম্মা বলেছে রেহাংশী যেন বিয়ের দুই দিন আগেই আসে। চাচার বাসায় উঠবে সবাই।”
“অসম্ভব! বউ ছাড়া শীতকাল অনেক কাটিয়েছি। আর হবে না।”
“শালা,লাথি মারব তোর কোমরে।”
সশব্দে হেসে উঠে ইনজাদ।
,
,
,
হৈ-হুল্লোড়ে ব্যস্ত সবাই। পিপলুর মুখে একটা বাঁশি। সারা পাড়ায় ভোঁ ভোঁ শব্দে তা বাজিয়ে চলছে। বিয়ে বাড়ির আনাচে-কানাচে ভনভন করছে মানুষ। ক্যাটারিং এর লোকের হুলস্থুল অবস্থা। আগত মেহমানদের এক সারি খেয়ে উঠেছে। তোড়জোড়ে চলছে বিয়ের অন্যান্য নিয়ম-নীতি।
এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে নুপূর। তার থেকে একটু দূরত্বে এহসাস। উঠোন জুড়ে করা শামিয়ানার অভিমুখে তার সতর্ক নজর। কিন্তু তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জুড়ে নুপূরের বসবাস। আচানক ভগভগ শব্দে দৌড়ে আসে এহসাস। মুখভর্তি বমি করে গা ছেড়ে দেয় নুপূর। হেলে পড়ে শূন্যে। তাকে কাঁধের ওপর চেপে ধরে এহসাস। রাগমিশ্রিত গলায় বলল—
“বলেছিলাম আসার দরকার নেই। তোমার শরীর মানছে না। তবুও এলে।”
বুক পাঁজর ভেঙে আসছে নুপূরের। তেতো অনুভূতির প্রকট প্রকাশ তার আননে। শ্রান্ত গলায় বলল—
“পায়েলের বিয়ে! কী করে না আসি?”
“এখন তো নিজেকে সামলাতে পারছ না।”
“আমাকে একটু ঘরে দিয়ে এসো। ভালো লাগছে না আমার।”
এহসাস দুই পাশ থেকে আঁকড়ে নিল নুপূরকে। অতি সাবধানে ঘরের ভেতরের দিকে নিয়ে চলল।
,
,
,
শেষ দুপুর! মলয় আবৃত ধরণী থমথমে। নিরাক, নিস্তব্ধ। তবুও আছোঁয়া শীতলতা। বর এসেছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। ব্যস্তসমস্ত হয়ে পাড়ার মেয়েরা গেইট ধরল। সেই অগনিত চেনা মুখের মাঝে একটা অতি পরিচিত মুখ নুহাশের বুক ভার করে তুলল। রেহাংশীর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা আজ পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে নুহাশের কাছে! টলটল চোখের গতি পরিবর্তন করল নুহাশ।
হাসি হাসি মুখে সামনে এগিয়ে এলো রেহাংশী। টুপ করে ফিতার ওপাশে গিয়ে বলল—
“আমিও ছেলেপক্ষ।”
মেয়েপক্ষের সকলের মাঝে আলোড়ন ওঠল। রেহাংশী চিটিং করছে। টুকটুক করে হাসছে রেহাংশী। ভীড়ভাট্টায় আজ নিজেকে পৃথিবীর স্বপ্লীল কন্যা মনে হচ্ছে তার। রেহাংশী মুখ বাড়াল। মিহি সুরে নুহাশের কানের কাছে বলল—
“কেমন আছ নুহাশ ভাইয়া?”
বরফ শীতল স্রোত তরতর করে বয়ে গেল নুহাশের শিড়দাঁড়া বেয়ে। রুদ্ধ হয়ে এলো তার শ্বাস। পাশে দাঁড়ানো বন্ধুর কানে কিছু একটা বলল। বন্ধুর চোখ হেসে ওঠে। রঙিন ফিতার ওপাশে দাঁড়ানো ললনাদের দাবি পূরণ করে পদার্পণ হলো বরপক্ষের কনের পিত্রালয়ে। সকলের চাপা উত্তেজনা ছড়াতে লাগল শব্দের মূর্ছনায়। রেহাংশী ভরাট সাগরে নিশ্চিত ডুবে যাওয়া মানুষের মতো স্থির হয়ে রইল।
তাকে মৃদু ধাক্কায় ডাকল ইনজাদ। সম্বিৎ ফিরে পায় রেহাংশী। চোখভর্তি জল নিয়ে তাকাল সে। জলসিক্ত যোষিতার রোদনের অর্থোদ্ধার করতে পারল না প্রণয়ী। ইনজাদ কৌতূহলী গলায় বলল—
“কাঁদছ কেন?”
রেহাংশীর জোয়ার ছুটল অবিশ্রান্ত ধারায়। সময় ব্যয় না করে ছুট লাগাল। ইনজাদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
,
,
,
ঝরঝর করে কেঁদে যাচ্ছে রেহাংশী। ছাদের পাটাতনে তার স্থির পা, রেলিং এ হাত আর রোদনে আচ্ছন্ন কম্পিত দেহ। তার কাঁধে হাত রাখল ইনজাদ। উষ্ণ ছোঁয়ায় সমূলে উপরে যাওয়া গাছের মতো ইনজাদের বুকে হামলে পড়ল রেহাংশী। মেঘমন্দ্রের মতো তীক্ষ্ম স্বরে ক্রন্দনে বিহ্বল সে। তার নিরবধি কান্না ভিজিয়ে তুলল ইনজাদের গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি। ইনজাদ আলতো করে জড়িয়ে ধরল প্রাণনারীকে। বাঁধা দিলো না। মেঘশূন্য অম্বুরের হঠাৎ বর্ষণ চলল দীর্ঘ সময়। সময়ের আবর্তে তার রেশ কমতে লাগল। ইনজাদ ঝুকল। রেহাংশীর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল—
“খোঁপা খুলে ফেলব?”
রেহাংশী মাথা ঘষতে লাগল ইনজাদের বুকে। অস্ফুট স্বরে বলল—
“না।”
“তাহলে কান্না থামাও।”
ইনজাদের বুক থেকে মাথা তুলল রেহাংশী। একটু সরে দাঁড়াল। চোখ -মুখ মুছে নিতেই তার বাজু ধরে রেলিং এর সাথে ঠেস দেওয়ালো ইনজাদ। রেহাংশীর দুই পাশে রেলিং চাপকে হাত রাখল। ডান পা পেছন দিকে নিয়ে অন্য পা অটল রাখল পূর্বের স্থানে। হালকা ঝুঁকে রেহাংশীর মুখের কাছে এলো। সরল গলায় বলল—
“তাকাও আমার দিকে।”
নত মাথা এপাশ-ওপাশ করে অসম্মতি দিলো রেহাংশী। ইনজাদ ফের বলল—
“তাকাও আমার দিকে বিষবাণ।”
আলতো করে মাথা তুলল রেহাংশী। ইনজাদ হাসল। মিহি গলায় বলল—
“চোখ মুছ।”
রেহাংশী ঝাপসা চোখে সামনে দাঁড়ানো পুরুষটির দিকে তাকাল। সমান্তরাল প্রশস্ত ললাটে ভ্রমরকালো দুই বঙ্কিম ভ্রূ, তার নিচে ঘন পল্লবে আচ্ছাদিত গহীন, দুর্বোধ্য, প্রেমময়ী দুই চোখ, তীক্ষ্ম নাক, তার সমান্তরালে দ্বিখণ্ডিত ভাঁজের নিচে পুরু অধর। রেহাংশী মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল ইনজাদের সহজ, স্নিগ্ধ, শীতল আননের দিকে। হলুদাভ উজ্জ্বল গায়ে গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি। গলার দিকটায় বোতাম লাগানো। ইনজাদ অনিমেষ চেয়ে আছে অতি সন্নিকটে দাঁড়ানো লাস্যময়ীর মুখে দিকে। সাবধানে ঢোক গিলছে ইনজাদ।তার কণ্ঠমনির পরিবর্তন তৃষিত করছে রেহাংশীকে। চোখের পানির স্রোত থেমে গেল অচিরেই। সমীরণের মৃদু কম্পনে নেচে উঠল ইনজাদের সাজানো চুল। ইনজাদ গাঢ় মায়ায় প্রশ্ন ছুড়ল—
“কাঁদছিলে কেন?”
রেহাংশী কথা বলতে গেলে তার গলা কেঁপে ওঠে। ইনজাদ ধপ করে বলে উঠে—-
“একদম না। আগে কান্না বন্ধ করো। তারপর বলো।”
রেহাংশী বার দুয়েক নাক টেনে গলা ঠিক করল। চোখে-মুখের আর্দ্রতা শুষ্ক করে বলল—
“নুহাশ ভাইয়া আমার সাথে কথা বলছে না!।”
ইনজাদ ছোট্ট দম ফেলল। কোনো কথা বলল না। চেয়ে রইল অনিমিখ। রেহাংশী পূনরায় বলল—
“ফুফু আমাকে কখনো মেনে নিতো না। তার ধারণা আমার জন্যই ফুফার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আমার জন্য তার স্বামী পা হারিয়েছে।”
ইনজাদ সংকীর্ণ গলায় বলল—
“পায়েল জানে?”
“না।”
ইনজাদ দম নিল। ভাবলেশহীন গলায় বলল—
“আচ্ছা…..তো এখন বলো কাকে ধন্যবাদ দেবো? তোমার পায়েল আপুকে না কী নুহাশপল্লীকে?”
“কেন?”
“এই যে, ওদের কেমিস্ট্রির জন্য আমি আমার বায়োলজি বুকটা খুঁজে পেলাম।”
রেহাংশী বুঝল না। ভাবুক চোখে চেয়ে জিজ্ঞাসু গলায় বলল–
“কীসের বুক?”
ইনজাদ ফিচেল হাসল। রেহাংশীর কানের কাছে মুখ নিলো সন্তর্পণে। কিছু একটা বলতেই পলাশ ফুলের রক্ত লাল আভার মতো লাল হয়ে উঠল রেহংশীর মুখ। সে ঝপ করে বুকে পড়ল ইনজাদের। ইনজাদ আলগোছে বক্ষস্থলে সমাহিত করল তাকে। খানিক সময় কেটে যায় মোহাচ্ছন্ন নীরবতায়। ইনজাদ সপ্রতিভ হলো। শিরশিরে হিমেল হাওয়ার আনাগোনা শুরু হয়েছে। ইনজাদ আরও ঘনিষ্ঠ হলো। রেহাংশীর কর্ণরন্ধ্রে উষ্ণ প্রশ্বাস বিক্ষিপ্ত করে, শুষ্ক অধরে ছোঁয়া লাগিয়ে বলল—
“ঠান্ডা লাগছে?”
রেহাংশী অনুরক্তি মাখানো অস্পষ্ট স্বরে বলল—
“হু।”
ইনজাদ অধর কোণে হাসল। দৃঢ় করল হাতের বেষ্টনি। ফিচেল গলায় বলল—
” বিয়ে বাড়িতে এত সুন্দরী মেয়ে দেখে আমার গরম লাগছে। পাঞ্জাবিটা কী খুলে ফেলব?”
রেহাংশী আদর মাখা কিল বসাল ইনজাদের বুকে। ঘুরে দাঁড়াল সে। তার পিঠে বুক মেশাল ইনজাদ। দুই হাতে হ আবদ্ধ করল স্নেহসিক্ত বলয়ে।
পেলব গলায় বলল—
” ওইদিকে দেখো।”
রেহাংশী সতর্ক চোখে তাকাল। সামনের নিমগাছটায় পাখি বাসা বেঁধেছে। ইনজাদ নম্র গলায় বলল—
” কী দেখছ?”
রেহাংশী সতেজ গলায় বলল—
“দুটো বড়ো পাখি আর…।”
“আর?”
“আর একটা ছোটো পাখি।”
“আমাদেরও একটা ছোটো পাখি চাই। যে আমার বিষবাণকে আম্মু বলে ডাকবে আর আমাকে আব্বু।”
রেহাংশী শিউরে উঠল। হঠাৎ আগমন ঘটা এক পশলা শরৎ বৃষ্টির মতো ঝপঝপিয়ে পড়ল ইনজাদের বলিষ্ঠ দেহের ওপর। কিশোরী বিকেলের আকাশ ফুড়ে আসে এক চিলতে সোনালী রোদের মতো একে অন্যের উষ্ণতায় বিগলিত হতে লাগল দুই যুবক-যুবতী।
চলবে,,,