#মোহঘোর
#বোনাস_পর্ব
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
টঙ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইনজাদ। কটকটে হলদে রঙের বাল্ব জ্বলছে স্বগৌরবে। পান, বিড়ি, সিগারেটের বহর। দোকানদার গাঢ় হাসল। চাঁদের কোমল আলো নিকষকালো আকাশ ভেঙ্গে তার আত্ম প্রকাশ ঘটিয়েছে। আধপাকা উঁচু-নিচু পথের দিকে তাকিয়ে আছে ইনজাদ। তার হাতের ভাঁজে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটে টান মেরে বা’হাতে চুল ফেরাল সে। আকাশের দিকে আস্ত নজর ক্ষেপন করে। কিছু সময় মোহবিষ্ট হয়ে চেয়ে সামনে পা বাড়াতেই ঝপ করে নিচে পড়ে ইনজাদ।
দোকানদার হুটোপুটি করে দোকান থেকে নেমে এলো। ইনজাদের বাহুতে হাত রেখে ভীত গলায় বলল—
“মামা ঠিক আছেন তো?”
ঘন ঘন শ্বাস ফেলে ইনজাদ। ডাগর ডাগর চোখে টিমটিমে চাঁদের আলোয় সে স্পষ্ট দেখতে পেলো রতনের বাইক। তূরন্ত বেগে রাস্তা কাঁপিয়ে যাওয়া বাইকের চাকার অকস্মাৎ ধাক্কায় ইনজাদের হাঁটুর দিকটা ছুঁলে শোণিতে মেখে গেল।
,
,
,
বিছানা ঝাঁড়া দিয়ে তা ঠিকঠাক করে নিল রেহাংশী। তমালিকা আর পারভেজ মির্জা একটু আগেই তার কক্ষ থেকে বেরিয়েছেন। ইনজাদ শান্ত স্বভাবের হলেও মাঝে মাঝে ক্ষেপে যায়। তার অন্যতম বদ অভ্যাস হলো, কেউ যখন তার প্রশ্নের উত্তর দিতে গড়িমসি করে, রাগে বিহ্বল হয়ে ভাঙচুর করে সে। এ সম্পর্কে অবগত রেহাংশী। তাই তা নিয়ে আর কোনো প্রতিক্রিয়া করল না সে।
আচানক রেহাংশীর মোবাইল বেজে ওঠল। ব্যস্ত হয়ে তা রিসিভ করে সে।
“দরজা খোলো রেহাংশী।”
রেহাংশী নাক কুঁচকাল। তড়িৎ গলায় বলল—
“কোথায় আপনি? বেল না বাজিয়ে ফোন করলেন কেন?”
“দরজা খুলতে বলেছি। আম্মা-বাবা যেন বুঝতে না পারে।”
রেহাংশী ঢোক গিলল। মানুষটা কী বলছে!
মোবাইল ফোন রেখে আস্তে আস্তে কক্ষের বাইরে এসে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। বিনা শব্দ করে দরজা খোলে রেহাংশী। প্রশ্নাত্মক চোখে চেয়ে বলল–
“এমন চোরের মতো করছেন কেন? বেল না বাজিয়ে…।”
রেহাংশীর নজর গিয়ে থামে ইনজাদের পায়ের কাছে। আর্ত গলায় চিৎকার করে উঠার আগেই তার মুখ চেপে ধরে ইনজাদ। হিসহিসিয়ে বলল—
“চুপ! একদম শব্দ করবে না। একদম না।”
ইনজাদ ধীরেসুস্থে রেহাংশীর মুখ থেকে হাত সরাল। রেহাংশী ভয়ে আড়ষ্ট গলায় বলল—
“এসব কী করে হলো? কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?”
ইনজাদ বিদুর স্বরে বলল—
“পরে বলছি। ঘরে এসো। আর আওয়াজ করবে না। আম্মা আর বাবা কোথায়?”
“তারা ঘরে গেছেন।”
“আসো তুমি।”
ইনজাদের বাম পায়ের হাঁটু থেকে নিচের অংশ রক্তে ভিজে আছে। হাঁটুর জায়গা টুকুর প্যান্ট ছিঁড়ে এবড়োথেবড়ো। জিন্সের মোটা কাপড় ফেড়ে ফুড়ে আছে। রেহাংশী চাপা শ্বাস ফেলছে। ধীর হাতে দরজা বন্ধ করল সে। ইনজাদ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। সাদা মেঝেতে রক্তের ছাপ পড়ে যাচ্ছে।
বিছানায় বসল ইনজাদ। কাতর চোখে চেয়ে বলল—
“রক্তগুলো মুছে ফেলো। আর কাউকে কিছু বলবে না।”
“এসব হলো কী করে?”
“বলছি, আগে যা করতে বলেছি তা করো।”
রেহাংশী দ্রুত পায়ে কক্ষ থেকে বের হয়। তড়িঘড়ি করে মেঝের বুকে থাকা রক্তের দাগ মুছে ফেলে। গজ কাপড়, স্যাভলন, তুলো নিয়ে পূনরায় নিজ কক্ষে ঢুকল। ইনজাদ পা ছড়িয়ে হাতে ভর দিয়ে বিষণ্ণ মনে বসে আছে। ভেতরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো রেহাংশী। ইনজাদের পায়ের কাছটায় রক্তের স্তুপ জমছে।পায়ের গোড়ালি রঞ্জিত। রেহাংশী ওয়াশরুম থেকে মগ ভর্তি পানি আনে। ড্রয়ার হাতড়ে কেঁচি বের করে। হাঁটুর কাছ থেকে প্যান্টের নিচের অংশ সাবধানে কেটে ফেলল। আলতো হাতে তুলো দিয়ে রক্ত মুছে নেয়। কম্পিত কণ্ঠে বলল—
“এসব কী করে হলো?”
ইনজাদ নরম স্বরে বলল—
“বাইকে ধাক্কা লেগেছে।”
হুট করেই কিছু একটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল রেহাংশীর। রক্ত চক্ষুতে চেয়ে বলল—
“ওই রতইন্না করেছে তাই না?”
ইনজাদ তার ব্যথা কাতর অধরে হাসি টানল। ফিচেল গলায় বলল–
“বাহ! এমন করে ডাকলে তো রতন শেষ!”
“চুপ করুন! কোথায় ওই রতন? আপনি কিছু বলেননি তাকে?”
ইনজাদ ফোঁস করে দম ফেলল। সশব্দে বলল—
“কুকুরের কাজ কুকুর করেছে, কামড় দিয়েছে পায়। তাই বলে কী কুকুরকে কামড়ানো মানুষের শোভা পায়!
আর আই এম নট শিউর, আদৌ ও ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছে কী না! আমি-ই বেখেয়ালি হয়ে হাঁটছিলাম। হয়তো লেগে গেছে।”
“তাই বলে আপনি তাকে কিছু বলবেন না?”
“কী বলব?”
“আমার মাথা!”
ইনজাদ গা দুলিয়ে হেসে ওঠে। রেহাংশী যত্নের সাথে রক্তু মুছে অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে দিয়ে গজ বেঁধে দেয়। অরব কান্নায় গাল ভেসে যাচ্ছে রেহাংশীর। তার দীর্ঘ চোখের পল্লব সিক্ত। নাকের ডগায় ঘাম জমেছে। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে হীরের নাকফুল। ইনজাদ নিচু হয়ে তীক্ষ্ম ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের ডগায় ঠোঁট ছোঁয়াল। রেহাংশী জলসিক্ত গলায় বলল—
” আর আহ্লাদ করতে হবে না আপনাকে।”
ইনজাদ সোজা হলো। পা ঝুলিয়ে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।
“ব্যথা পেয়েছি আমি, কাঁদছ তুমি? ঘটনাটা কী বিষবাণ!
পোড়ে আমার জন্য?”
রেহাংশী ক্ষুণ্ণ গলায় অভিমান করে বলল—
“না, পোড়ে না। পুড়বে কেন? কে আপনি আমার? চিনি না আপনাকে আমি।”
ইনজাদ একটু উঁচু হয়ে রেহাংশীর হাত টেনে তাকে বুকের ওপর ফেলল। আচম্বিতে চাইল রেহাংশী। ইনজাদ প্রগাঢ় নেশায় বুঁদ হয়ে গেল নিমিষেই। ধীর হাতে রেহাংশীর চুলের খোঁপা খুলে দিলো। চুলের পসরা ঝরে পড়ল ইনজাদের বক্ষ পাটাতনে। আলতো চাপে বুকে গেঁথে নিল প্রিয়পাত্রীকে। রেহাংশী মিইয়ে গেল। নত করল চাহনি। অতল ব্রীড়ায় তার দেহে কম্পন শুরু হলো। ইনজাদ হাত গলাল রেহাংশীর ঝরঝরে কুন্তলে। গভীর আশ্লেষে অধরপল্লবের অধরামৃতে নিমগ্ন হলো সময়ের বিস্তৃতিতে। ইনজাদ কোমল স্বরে বলল—
“সব গুছিয়ে নাও। কাল সকালেই বের হবো আমরা।”
রেহাংশী চমকিত গলায় কাতরতা লেপে বলল—
“কাল সকালে? এ পা নিয়ে যাবেন কীভাবে?”
ইনজাদ চোখে হাসল। গাঢ় প্রণয়ে অভিষিক্ত হয়ে বলল—
“পা ছুঁলে গেছে, ভেঙ্গে যায়নি যে হাঁটতে পারব না! আম্মা আর বাবাকে কিছুই জানাবে না। টেনশন করবে।”
রেহাংশী আলতো গলায় শ্লেষ মিশিয়ে বলল–
“তা করবে কেন? আপনি তো গরীবের রবিনহুড! আপনার কী ব্যথা হয়?”
“মেয়ে মানুষ নই। এতটুকু সহ্য করার ক্ষমতা আমার আছে বিষবাণ।
কাল সকালেই ফিরতে হবে। কাজ আছে আমার।”
“কী কাজ?”
“সিন্ধুজার সাথে নারায়ণগঞ্জ যেতে হবে। অফিসিয়াল কাজ। তোমার কোনো আপত্তি নেই তো রেহাংশী?”
চলবে,,,