মোহঘোর #পর্বঃ৪৪

0
682

#মোহঘোর
#পর্বঃ৪৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ইনজাদকে ড্রেস চেঞ্জ করতে দেখে রেহাংশীর সরল চোখ জোড়ায় কৌতূহলের বর্ষণ শুরু হয়। ত্রস্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে—

“কোথায় যাচ্ছেন?”

বেগুনি রঙের চেক শার্টের কব্জির দিকটা দুটো ভাঁজ দিয়ে চাইল ইনজাদ। সহজ গলায় বলল—

“আম্মা-বাবাকে আনতে যাচ্ছি। ফোন করেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে টার্মিনালে পৌঁছে যাবে। বাবা এর আগেও শহরে এসেছে। কিন্তু রাতের বেলা আম্মাকে নিয়ে একা আসতে সমস্যা হতে পারে। তাই তাদের আনতে যাচ্ছি।”

রেহাংশীর বিস্ময় আকাশ ছুঁল। চোখের কোটর পূর্ণ প্রশস্ত করে বলল—

“কী বলছেন এসব? আম্মা আসছেন? বাবা আসছেন? কই আপনি তো কিছু বলেননি! মামা-মামির কথা যখন বললেন, তখনও তো কিছু বলেননি! আপনি সবাইকে কেন ডেকে আনছেন? সবাই কোথায় থাকবে? আর এত রান্না! কখন করব আমি? আপনি আমাকে আগে কেন বলেননি?”

ইনজাদ চোখে হাসল। পেলব অভিব্যক্তিতে বলল—

“তোমাকে এত ভাবতে হবে না। আমার আম্মা আর বাবা আসবে। পাড়া-পড়শী নয় যে তোমার নামে বদনাম করে বেড়াবে।
আর এত টেনশন করতে হবে না। যা করার আস্তে ধীরে করো। কোথায় থাকবে তা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। শহরের সীমাবদ্ধতা তাদের জানা আছে।

“তাই বলে…।”

ইনজাদ লম্বা শ্বাস ফেলল। রেহাংশীর সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখের চাহনিতে নির্মোহ প্রণয়ের জল ঢেলে বলল—

“এত কেন ভাবছ? ভেবো না। ডার্ক সার্কেল পড়ে যাবে। আমার বিষবাণকে ভালো লাগবে না তাহলে। আম্মা এসে বলবেন, তার ছেলের বউয়ের যত্ন নিইনি আমি।”

রেহাংশী সংকীর্ণ চোখে তাকিয়ে বলল—

“আসার সময় চিংড়ি মাছ নিয়ে আসবেন। ত্রিনার চিংড়ি মাছ পছন্দ।”

“এত রাতে ভালো মাছ পাওয়া যাবে না।”

“কেন? আপনাদের শহরে তো টাকা দিয়ে বাঘের চোখও পাওয়া যায়!”

গা দুলিয়ে হাসল ইনজাদ। অধর বিস্তৃত করে বলল—

“তা পাওয়া যায়, হয়তো। কিন্তু রাতের বেলা তাজা মাছ পাওয়া যাবে না। সকালে এনে দেবো। আপাতত যা আছে তাই রান্না কোরো।”

রেহাংশীর ছোট্ট কপালে অধর ছোঁয়ায় ইনজাদ। মিষ্টি হেসে বলল—

“আসি আমি। ডোন্ট ওয়ারি।”

স্থবির হয়ে রইল রেহাংশী। তার মস্তিষ্ক জুড়ে ঝিলিক দিচ্ছে চিন্তার উল্কাপিণ্ড।

রান্নাঘরে মশলার ঝাঁঝানো গন্ধ। অবিশ্রান্ত শব্দ। সুরমা কড়াইতে ইলিশ মাছের টুকরো দিয়েছেন। ছ্যাত, ছ্যাত নিরবধি শব্দ। তার পাশে এসে দাঁড়াল রেহাংশী। ম্লান চোখে চেয়ে রইল। সুরমা রেহাংশীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। সতেজ গলায় বললেন—

“তুমি কিছু মনে করো না বউমা। আজ আমি রান্না করি। কাল না হয় দুই শাশুড়ি মিলে তোমার হাতের রান্না খাবো।”

“আপনারা জানতেন, আম্মা আর বাবা আসবেন?”

সুরমা চোখ পিটপিট করে তাকালেন। মৃদু হেসে বললেন—

“ইনজাদ তোমাকে বলেনি?”

রেহাংশী নীরস গলায় বলল—

“আপনাদের ছেলে আপনাদের আসতে বলেছে, তাই না?”

সুরমা চুলোর আঁচ কমালেন। রেহাংশীর কোমল, অপ্রভ, শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—

“আমাদের ছেলে খারাপ নয় বউমা, ওকে একটু বিশ্বাস করে দেখো। আমাদের ছেলেকে আমরা খারাপ শিক্ষা দিইনি। আপার একটা মাত্র ছেলে। ইনজাদের আর কোনো ভাই-বোন হয়নি। তাই নিজের বুকে রেখে ওকে বড়ো করে তুলেছেন আপা। দুলাভাইও কম করেননি। ইনজাদ ছোটোবেলা থেকেই অসুস্থ থাকত। জ্বর, ঠান্ডাসহ কোনো না কোনো অসুখ বাঁধিয়েই রাখত ছেলেটা। আপা তবুও হাল ছাড়েননি। সময়ের সাথে সাথে ইনজাদ বড়ো হতে লাগল। গ্রাম থেকে পড়ালেখার জন্য ওকে শহরে পাঠায়। আপা দুঃচিন্তায় থাকতেন, ছেলে কোনো অঘটন না ঘটিয়ে ফেলে। আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের ছেলে আজ পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা ঘটায়নি যার জন্য আমাদের লজ্জা পেতে হবে। সব শিক্ষা আপা-দুলাভাই ইনজাদকে দিয়েছেন। তুমি একটু ওকে সময় দাও। ও সব সামলে নেবে।
মনে রেখো বউমা, স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্ক আঁধার আর চাঁদের মতো। আঁধারকে আলোকিত করতে চাঁদ আসবেই।”

রেহাংশী বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে শুরু করল। সুরমাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। ক্রন্দনে আচ্ছন্ন হয়ে বলল—

“আমি আমার চাঁদকে হারাতে পারব না মামি, হারাতে পারব না।”

“এমন বলে না মা। জীবনের অনেক সত্য তেতো হয়। তাই বলে কী মানুষ সত্যের মুখোমুখি হওয়া ছেড়ে দেয়? সত্যকে গ্রহন করেই এগিয়ে যেতে হবে। এটাই তো জীবন।”
,
,
,
মাথায় ঘোমটা টেনে বসে আছে রেহাংশী। তার হাতে, গলায় একরকম জবরদস্তি করে গয়না পরিয়ে দিচ্ছেন তমালিকা। রেহাংশী না করলেও তিনি শোনেননি। । রেহাংশী রয়ে সয়ে বলল—

” আম্মা, এসবের কী দরকার? এগুলো তো আপনার।”

তমালিকা মৃদু ধমকে উঠে বললেন–

“আমার হয়েছে তো কী হয়েছে? আমার কী আরেকটা মেয়ে আছে যে তাকে দেবো! আর নতুন বউ এমন হাত-গলা খালি থাকলে ভালো লাগে?”

টুকটুক করে ঠোঁট চিপে হাসছে ত্রিনা। খুশি খুশি গলায় বলল—

“ফুফি আম্মু, নতুন বউ কোথায়? ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে তো….।”

“এই তুই চুপ করবি!”

ত্রিনাকে ধমকে উঠেন সুরমা। বিছানার একপাশে পাশাপাশি বসে আছেন পারভেজ মির্জা আর ত্রিমুল। তারা কিছু একটা নিয়ে নিজেরাই কথা বলছেন। সহসা চিৎকার করে উঠে ত্রিনা। আঁতকে উঠেন সবাই। ত্রিনার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন সুরমা। চুপসে যায় ত্রিনা। মিহি কণ্ঠে বলল—

“না, মানে…মিষ্টি বউয়ের জন্য নুহাশ ভাইয়া যে গিফ্ট বক্স পাঠিয়েছে তার কথা মনে পড়ল। তাই আর কী!”

রেহাংশী চকিত গলায় বলল—

“নুহাশ ভাইয়াকে কোথায় পেলে? কোথায় সে?”

ত্রিনা চপল পায়ে উঠে দাঁড়ায়। নিজেদের কাপড় ভর্তি ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে রেহাংশীর হাতে দেয়। সরস হেসে বলল—

“একদিন ধানমন্ডিতে দেখা হয়েছিল নুহাশ ভাইয়ার সাথে। আসতে চাইছিল না। জোর করে বাসায় নিয়ে এসেছিলাম। তারপর অন্য একদিন এসে এই বক্সটা আমাকে দিয়ে বলল, যেন তোমার সাথে দেখা হলে দিয়ে দিই। ”

“কী আছে এতে?”

“তাতো জানি না।”

রেহাংশী চোখ নামাল। নীল রঙের রেপিং পেপারে মোড়ানো বক্সটায় অনিমেষ চেয়ে রইল। হৃৎপিন্ডের গতি বাড়ল অচিরেই। মানুষটাকে সে ধোঁকা দিয়েছে। নুপূরের সাথে ইনজাদের বিয়ে আটকানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টায় নুহাশ ছিল রেহাংশীর পাশে। না খেয়ে থাকা রেহাংশীর মুখে খাবার তুলে দিতে এই মানুষটি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যখন আপন মানুষগুলোর তিরস্কার মুখ বুজে সহ্য করত সে, তখনো এই মানুষটিই মাঝে মাঝে তার হয়ে প্রতিবাদ করত। কিন্তু এতকিছু করেও আকাঙ্ক্ষীত মানুষটি থেকে ধোঁকা পেল নুহাশ। রেহাংশীর চোখ থেকে টুপ টুপ করে মেঘহীন বর্ষণ হলো। মোলায়েম হাতের বিচরণে কাতর হয়ে উঠল নুহাশের দেওয়া সেই নীল রঙা অচ্ছুঁৎ ভালোবাসায় আবৃত বক্সটি।
,
,
,
ত্রিনার কণ্ঠের কলতানে মুখোর পরিবেশ। চটপটে ত্রিনার বয়স বাড়লেও বাবা- মায়ের অতি আহ্লাদে অনেকটা অবুঝ। সবকিছুতেই তার দূরন্তপনা, খেয়ালিপনায় কখন কী বলেও তাতেও হদিস থাকে না। খাবার টেবিলে সবাই। পারভেজ মির্জা কৌতূহল নিয়ে বললেন—

“রেহাংশীকে কিছু বলেছিস?”

ইনজাদ থমকাল। মুখের খাবার চিবিয়ে নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল—

“উঁহু।”

তমালিকা ভয়ভীত গলায় বললেন—

“যদি ও রেগে যায়, যদি ও আবারও কোনো পাগলামি শুরু করে?”

“সামলে নেব আমি। আপনি চিন্তা করবেন না।”

ত্রিমুল প্রশ্বস্ত কপালে ভাঁজ ফুটিয়ে বলল—

” আর সাইক্রিয়াটিস্ট?”

ইনজাদ নিঃশব্দে শ্বাস ফেলল। দন্তপাটিতে জিব ঠেকিয়ে বলল–

“বলিনি। যদি যেতে না চায়?”

সুরমা বিস্ময় নিয়ে বললেন—

“বলোনি? বলোনি কেন? যদি ওখানে গিয়ে ঝামেলা শুরু করে? যদি উলটা পালটা কিছু করে বসে?”

ইনজাদ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল—

“ভরসা রাখো আমার ওপর। অন্তত তোমরা আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করো না। এমনিতেও মাথা কাজ করছে না আমার। স্যার লাগাতার ফোন করে যাচ্ছেন। একবার শুধু রেহাংশীকে দেখতে চায়। ওর মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে চায়। আমাকে ঘর থেকেও বের হতে দেয় না রেহাংশী। ফোনে কারো সাথে কথা বললেও তা নিয়ে সংশয় জাগে ওর মনে। আর কী করব আমি বলো?”

তমালিকা ছেলের ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন—

“তুই ভেঙ্গে পড়ছিস কেন? আমরা সবাই আছি তো। ও ঠিক…।”

রেহাংশীকে দেখে সবার কথা বন্ধ হয়ে যায়। গালভর্তি হাসে রেহাংশী। প্রসন্ন গলায় বলল—

“মামি, আপনি বসুন। আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।”

সুরমা নাকচ করে বললেন—

“তার দরকার নেই। তুমি বসো। আজকের মতো শান্তিতে খেয়ে নাও বুঝলে! কাল কিন্তু আমরা দুই ননদ-ভাবী একটা কাজও করব না। সব তোমাকেই করতে হবে। তোমার হাতে রান্না কিন্তু খাওয়া হয়নি আমাদের। ইনজাদ সে সুযোগ-ই দিলো না। বউ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। এবার আর তা হচ্ছে না।”

লজ্জামিশ্রিত হাসে রেহাংশী। চোখের পাতা নামিয়ে আড় চোখে চাইল ইনজাদের দিকে। ইনজাদের চোখের ঝলমলে ভাব রেহাংশীর প্রাণে দোলা দেয়।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here