মোহঘোর #পর্বঃ৪৭

0
1107

# মোহঘোর
# পর্বঃ ৪৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

অল্পতেই দুশ্চিন্তাকারী বা ওভারথিংকিং এক ধরনের মানসিক ব্যাধি।

একজন ওভারথিংকার সহজে কারো প্রেমে পড়ে না বা ভালোবাসে না। কিন্তু যখন তারা আপনাকে নিজের ওভারথিংকিং এর জগতে জায়গা দিয়ে ফেলবে তখন
তারা আপনার খুব ছোটছোট ব্যাপারেও প্রেমে পড়ে যাবে খুব সহজেই। তারা আপনার হাসিতে, তাকানোর দৃষ্টিতে, মুখের বুলিতে খুব সহজেই প্রেম খুঁজে নিবে।
তারা গোটা একটা দিন শুধু এটা কল্পনা করেই কাটিয়ে দিতে পারবে যে কথা বলবার সময় আপনার মুখের অবয়ব কেমন হয়! রাতের পর রাত কাটাতে পারবে আপনার বলা প্রতিটা কথা নিয়ে ভাবতে ভাবতে। আপনি পাশে থাকুন বা না থাকুন তাদের গোটা দিনটা কেটে যাবে আপনাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই৷..

এই ধরনের মানুষগুলোর আবেগী হয়। এই মানুষগুলো যখন সত্যিই কাউকে ভালোবেসে ফেলে তখন সারাক্ষণ তাকে আকড়ে থাকতে চাইবে। নিজের ভালোবাসা,কেয়ার দিয়ে নিজের কাছে বেধে রাখতে চাইবে যেটা দেখা যাবে হয়তো বিপরীত ব্যক্তির কাছে দমবন্ধ অনুভূতি হবে।

তাদের ওভারথিংকিং এর ফলে ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলবার ভয় সারাক্ষন তাড়া করে ফিরে। যার জন্য তারা সর্বদাই নিজের মানুষটিকে আগলে রাখতে চায় বা অল্পতেই ভেবে নেয় তাকে হয়তো মানুষটি আর ভালোবাসে না! যেমন ধরেন কোন দিন যদি ব্যস্ততার কারনে আপনি কল বা ম্যাসেজ না দিতে পারেন তারা সারাক্ষন এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে একটা সময় কল্পনা থেকে ধরে নিবে আপনি হয়তো তাকে আর পছন্দ বা ভালোবাসেন না তাই কল/ম্যাসেজ দেন নি। দেখা যাবে আপনাকে অন্য কোন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সাথে সামান্য কথা বলতে দেখলেই কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলবে। কখনো যদি আপনার এটেনশন, কেয়ার এক্টুও কমে যায় তখন তো তারা একদম ধরেই নিবে যে আপনি আর ভালোবাসেন না৷

কখনো যদি আপনার সামান্য মন খারাপ ও থাকে তারা অইটা নিয়েও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়বে। বারবার জিজ্ঞাসা করবে আপনি ঠিক আছেন কিনা, সব কিছু ঠিক আছে কিনা। যখন তখন ভালোবাসি বলে কানের সামনে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকবে শুধুমাত্র আপনার মুখ থেকে ফিরিয়ে ভালোবাসি শোনবার জন্যে। এই ভালোবাসি শব্দটাই যদি আবার তাদের মনে হয় যে আপনি কেবল অভ্যাস থেকেই বলছেন তখনও তারা কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলবে এটা ভেবে যে সে আপনার অভ্যাস ভালোবাসা নয়৷ মোট কথা তারা সারাক্ষন ই আপনাকে নিয়ে চিন্তার সাগরে ভেসে থাকে। কখনো তো দেখা যায় কারণ ছাড়াই তারা দুশ্চিতায় পড়ে যায় এটা ভেবে যে আপনি সত্যি ই তাকে ভালোবাসেন কিনা!

এমনকি যদি কখনো আপনি তাদের ছেড়ে চলে যান তখনো তারা দিন-রাত,মাসের পর মাস এটা ভেবে কাটিয়ে দিবে যে তার ভুলটা কোথায় ছিলো! সে কি এমন ভুল করেছিলো যে আপনি ছেড়ে চলে গেলেন! এবং নিজেকে সবকিছুর জন্য দোষী ভেবে দোষারোপ করে যাবে৷

এই ধরনের মানুষ গুলো মূলত আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগে। জীবনের কোনো ঘটনা হতে অথবা অযথাই তারা নিজেকে সহজেই রিপ্লেসমেন্ট যোগ্য মেনে নেয়। অন্যকে বিশ্বাস করে উঠতে পারে না সহজেই। আর এই আত্নবিশ্বাসহীনতার এবং অন্যের উপরের বিশ্বাসহীনতার কারণেই তারা এরকম সারাক্ষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকে………..( কালেক্টেড)

ছোট্ট রেহাংশীর মায়ের মৃত্যু তাকে জগতের সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় জিনিসে পরিণত করে। সে নিজেকে ততটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে পারে না যতটা সে সত্যিই কারো জীবনে মূল্য রাখে। ইনজাদের ক্ষণিকের রাগ, আক্রোশ রেহাংশীকে তা ভাবতে বাধ্য করেছিল যার আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই। ভালোবাসার প্রমত্তা সাগর ইনজাদের উড়ো রাগ স্তিমিত করে দিলো রেহাংশীর শ্বাস!

“মন জানে, সব মানে, তবু শুধু ভাসে
মেয়ে জানে, তার ছবি, চোখ শুধু আঁকে
অভিমান, তোর টান, মিছে মায়া তোর
কেন হারিয়ে গেল প্রেম হয়ে মোহঘোর?”

ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে ইনজাদ। তার হৃৎপিন্ড লাফাচ্ছে। কপালে জমেছে স্বচ্ছ জলের ফোটা। শ্বাস পড়ছে স্বশব্দে। ইনজাদের দম আটকে এলো। সে বুকে হাত দিয়ে ঘষতে লাগল। মিথ্যে ! মিথ্যে সব। ইনজাদ নিজের শ্বাস আয়ত্বে আনার চেষ্টা করছে। ছড়ানো পা গুটিয়ে নিয়ে স্থির হয়ে বসল। সমাহিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নতমুখে। শ্বাসক্রিয়া স্বাভাবিক হতেই ঘড়ির দিকে তাকাল। ভোর হয়েছে। প্রভাতের সূর্য উঁকি দিচ্ছে ক্রমশ। ইনজাদ ধাতস্থ হলো। সংগোপনে শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। মেঝের শীতল বুকে পা পড়তেই সচল হলো তার মস্তিষ্ক। ঘুমাতে পারেনি সে। গত আট মাস ধরে সে ঘুমাতে পারে না। চোখের পল্লব নেমে মস্তিষ্কের স্নায়ু অচেতন হতেই ভেসে উঠে রেহাংশীর রক্তমাখা সেই নিশ্চল দেহ। কায়ার সাথে পাঁজরের মাঝে থাকা ছোট্ট কম্পিত যন্ত্রটিও লাফিয়ে উঠে। ইনজাদ ভয়ে সিদিয়ে যায়। ভয়াতুর চোখ দিয়ে ধোঁয়া উড়তে থাকে।

ঘুমাতে পারে না ইনজাদ। ভয়ংকর সেই রাত তাকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেয় না। চোখ জ্বলে উঠে ইনজাদের। দুই হাতে চোখ চেপে ধরে। ভেজা গলায় স্বগতোক্তি করে বলল-কেন করলে বিষবাণ? কেন? কেন আমার ঘুম কেড়ে নিলে? নিঃস্ব করে দিলে আমাকে? আমার মোহের ঘোরে করা অপরাধের সাজা কেন বারবার মৃত্যুদণ্ড হয়? কেন ক্ষমা করোনি তুমি আমাকে? ফিরে এলে না কেন বিষবাণ? কেন এলে না?”

চোখের ধারায় কপোল সিক্ত হয় ইনজাদের। দুই হাতে আলগোছে মুছে নিল তা। ঘোলা চোখে তাকাল সে। যেন কোনো নারী অবয়ব চেয়ে আছে তার দিকে। ইনজাদ আচমকা হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে পড়ে। ডুকরে উঠে বাচ্চাদের মতো। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে বলল—

“ফিরে এসো রেহাংশী, প্লিজ ফিরে এসো। আমি আমার সব অপরাধের সাজা মাথা পেতে নেবো। শুধু একবার ফিরে এসো। ক্ষমা করে দাও তোমার পরদেশীকে। এই বুকে আগলে রাখব তোমায়। কোনো মোহের ঘোর তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। বুকপাঁজরে লুকিয়ে রাখব তোমায়। ফিরে এসো বিষবাণ।”

এক আহত প্রেমিকে শ্বাসরোধ করা স্বর পৌঁছায় না তার প্রেয়সীর কানে। ইনজাদ ভাঙা কাঁচের মতো বিক্ষিপ্ত হয়। বিছানার সাথে হেলান দিয়ে অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শূন্যে।

নয় বাই নয় ফিটের ছোট্ট কামরায় নিজের বসত গড়েছে ইনজাদ। গত ছয় মাস ধরে সে একাই থাকে এই ছোট্ট খুপরিতে। রাত জেগে কাজ করতে হয় বলে কারো সাথে রুম শেয়ার করে না। একটি মেস দালানের ছোট্ট কক্ষে ইনজাদের বসবাস। রোজ নিয়ম করে অফিস যাওয়া, রাতে ফিরে আসার সময় টিউশনি, রাত জেগে অনলাইনে কাজ করা তার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ইনজাদ হাঁপিয়ে উঠে না। কারণ, তার সচেতন মন সবসময় ভয়ে আড়ষ্ট থাকে। চোখের পাতা লাগতেই ভেসে উঠে রক্তের স্রোতে ভাসা রেহাংশীর মুখ। ইনজাদের সহ্য হয় না। বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা তাকে পলে পলে ক্ষত-বিক্ষত করে।

ইনজাদের অতন্দ্রি রাত কাটে রেহাংশীর স্মৃতির পাতায় নিজেকে ডুবিয়ে। যে নারীর উষ্ণ শ্বাস তার হৃৎকম্পন বাড়ায়, যার সৌরভে তার বুকের ভেতর জোয়ার উঠে, যার হাসির খলখলানিতে তার নিষ্প্রভ অধরে হাসি ঝোলে, যার চোখের চাহনিতে সে বিমুগ্ধ হয়, যার কথার বিষে নিজেকে বিষাক্ত করে বারংবার বাঁচতে ইচ্ছে হয়; সে আজ দূরে, বহুদূরে। ফিরে আসবে কী না তা ইনজাদের অজানা।

“অভিমানী কন্যা,
বইয়ে হৃদয়ে প্রণয়ের বন্যা,
মুছে দিয়ে ছায়া, অমোঘ মায়া
বাড়ে টান, আমার নিঃশ্বাসের অবসান
ভোলা কী যায়?
অসংবরণীয় প্রেমাসক্তির এই নীরব অভিমান!

ইনজাদ ভার শ্বাসে বলে উঠে—

“কেন এত অভিমান তোমার? কেন ফিরলে না তুমি? কেন আমার কষ্টে তোমার অভিমানের পারদ গলল না? বিষবাণ! কেন মেরে ফেললে আমাকে? আমার ছোট্ট ভুলে এত বড়ো সাজা কেন দিলে?”

সময় বহতা নদীর মতো চলতে থাকে। ঘড়ির কাটা ঘুরতে থাকে যান্ত্রিক নিয়মে। স্মৃতির পাতারা অস্পষ্ট হতে থাকে ক্রমশ। চিরচেনা মুখটাও ঝাপসা হতে থাকে অচিরেই। প্রেমে ডোবা পুরুষ সমূলে উপড়ে যায়। শেকড়বিহীন নিষ্প্রাণ গাছ হয়ে পড়ে থাকে হেথায়। সে জীবন্মৃত। ইনজাদের ঘড়ির কাটায় আবদ্ধ জীবন। চঞ্চল, প্রাণাবেগে ভরপুর পুরুষ আজ হতপ্রায়। চোখের চাহনির নেশাক্ততা, চোয়ালের দৃঢ়তা, দেহের জৌলুসতা সব যেন আজ মরীচিকা !

নিজেকে কলের পুতুল মনে হয় ইনজাদের। সে বেঁচে তো আছে তবে, কেন বেঁচে আছে তার উত্তর সে জানে না। কোন প্রতীক্ষায় তার দিনানিপাত হয় তা তার অজ্ঞাত।

কাঠের কপাটে তালা ঝোলাল ইনজাদ। মেস বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় দিনভর। কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু চিৎকার-চেঁচামেচি। ইনজাদ ধীরগতিতে পা চালাল। চারপাশের কোনো কিছু তার সচেতন মনে দাগ ফেলছে না। দোতালা থেকে নেমে নিচতলায় আসে ইনজাদ। তার পা থামেনি। মেস বাড়িটির মূল ফটকের বাইরে আসতেই মোবাইল ফোন বেজে উঠে ইনজাদের। তমালিকা ফোন করেছেন। ইনজাদ রিসিভ করল। গাঢ় স্বরে বলল—

“কেমন আছেন আম্মা?”

তমালিকা উত্তর না দিয়েই খেপাটে গলায় বললেন—-

“তুই ফিরে আসছিস না কেন? কেন পাগলামি করছিস?”

ইনজাদ বিধ্বস্ত গলায় বলল—

“কোথায় আসবো আম্মা? ওই গ্রামে আমি আর কখনো ফিরে যাব না। আমার রেহাংশীকে আমি মেরে ফেলেছি আম্মা। যদি ওকে আমি গ্রামে নিয়ে যেতাম, তাহলে আমার রেহাংশী আমাকে ছেড়ে এত দূরে থাকত না। ও আমাকে এত বড়ো সাজা কেন দিলো? কেন ক্ষমা করল না আম্মা?”

তমালিকা মুখে কাপড় গুঁজে দিলেন। পাশে বসে নিঃশব্দে বুক কাঁপিয়ে কাঁদছেন পারভেজ মির্জা। উষাপতি গনগনিয়ে জ্বলে উঠছে। তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে আছে ইনজাদ। তমালিকা কিছু বলতে পারলেন না। শুধু কাঁদলেন। ইনজাদ বিধুর সুরে বলল—-

“সেদিন যদি ওর গায়ে আমি হাত না তুলতাম, তাহলে ও কখনো এমন করত না। আম্মা আমি ওকে ছাড়া কী করে থাকব? যে শহরকে ও বিষাক্ত বলেছে আজ সেই শহরে হাওয়াতে মিশে আছে আমার রেহাংশীর শ্বাস, ওর সুবাস। ওকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না আম্মা। আমি ফিরব না আম্মা, ওকে ছাড়া আমি ওই বাড়িতে কখনো ফিরতে পারব না। তাহলে ও কোনোদিনও ক্ষমা করবে না আমায়। কোনোদিনও না।”

ইনজাদের চোখের পাতা ভিজে উঠল। সেই জলসিক্ত নয়নে চাইল সামনের দোকানে। তাজা ফুলের দোকান। হলুদ রঙের গোলাপ আর বেলির দিকে তাকিয়ে রইল সে। ইনজাদের গায়ে জড়ানো হলুদ রঙের শার্ট।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here