সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-০৩

0
553

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব-০৩

(৪)
হেমন্তের শিশিরস্নাত আরো একটি রোদ্র-উজ্জ্বল সকাল। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত চারপাশ। টেন্টের সামনে এক কাপ চা হাতে বসে আছে স্মরণ। গরম গরম চায়ে চুমুক বসাতেই এক স্বর্গীয় সুখ অনুভব করলো সে। গত কাল ক্যাম্পে পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে। গ্রামের ভিতর তিন ক্রোশ রাস্তা হেঁটে পার করা যেই সেই কথা নয়। রমিজ সহ তাকে ক্যাম্পে পৌঁছাতে প্রায় রাতের দ্বিপ্রহর কেঁটে গিয়েছিলো।

চায়ের কাপে দ্বিতীয় বার চুমুক বসাতে শরীরে ঝাঁকুনি অনুভব করলো স্মরণ। পেছনে কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে ফিরে না তাকিয়েই বলল,

“বস এখানে।”

” চা খাচ্ছিস?”

স্মরণ কিছু না বলে তার পাশে এসে বসা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হাসলো।

“চা পান করার বস্তু, একে শুধু পানই করা যায় খাওয়া যায় না।”

“ওই একই তো হলো তাই না?”

“উহু এক নয়। খাওয়া আর পান করা দুটোই ভিন্ন বস্তু। এই দুটোর কখনই এক হবার কথা নয়।”

“ভাই তুই দেখছি আজকাল যুক্তিবাদী হয়ে উঠেছিস।”

ফায়াজের কথায় এই বার উচ্চস্বরে হাসলো স্মরণ। ফায়াজ বরাবর ভালো ডাক্তার হলেও অন্যান্য বিষয়ে কিছুটা অজ্ঞ। সব কিছুতেই তার খামখেয়ালি ভাব। তবে কলেজ জীবন থেকে এই খামখেয়ালি ছেলেটাই তার একমাত্র সঙ্গী যার সাথে অনায়াসে সব কিছু শেয়ার করা যায়।

স্মরণ একজন হার্ট সার্জন। দু বছর হলো সে ডাক্তারী পেশায় যোগ দিয়েছে। একজন ব্যাক্তিত্ব সম্পূর্ণ মানুষের যতগুলো বৈশিষ্ট থাকা প্রয়োজন তার চেয়ে অধিক কিছু স্মরণের মধ্যে উপস্থিত। একরোখা জেদি প্রকৃতির স্মরণ নিজের সিদ্ধান্তকে সবার আগে পায়োরেটি দেয় সর্বক্ষেত্রে। নিজের কর্ম ক্ষেত্রে কোনো রকম বিশৃঙ্খলা তার বিশেষ একটা পছন্দ নয়। নিজের জায়গায় অবিচল থাকাই যেনো তার স্বভাবের বড় একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে ছোট বেলা থেকে। তবে স্মরণে আরো একটি স্বভাব রয়েছে যার জন্য তাকে অনেকেই বেয়াদব উপাধি দিয়ে থাকেন আর সেটি হলো সোজা কথা সোজাসুজিভাবে বলা।

নিশ্চিন্দপুর গ্রামে প্রতিবছরের মতো এইবারো মেডিকেল ক্যাম্প গঠন করা হয়েছে। এই গ্রামের বেশিরভাগ পরিবারই মূর্খ। স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের মাঝে তেমন কোনো জ্ঞান নেই বললেই চলে। এদের মাঝে প্রাথমিক শিক্ষার ও বড্ড অভাব। আশেপাশের গ্রাম গুলোর তুলনায় এই গ্রামটি অনেক ক্ষেতেই পিছিয়ে আছে। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষগুলো স্বাস্থ্য বিষয়ে একেবারে অজ্ঞ যার ফলশ্রুতিতে গ্রামে রোগ বালাই সব সময় লেগেই থাকে। বিশেষ করে শীতের আগমুহূর্তে মানুষ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই এই এলাকার কাউন্সিল থেকে প্রতিবছর মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। দেশের বড় বড় হাসপাতাল থেকে বড় বড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের নিয়ে আসা হয় এই ক্যাম্পে। প্রতিবারের মতো এইবারে ঠিক একইভাবে মেডিকেল ক্যাম্প ঘটন করা হয়েছে আর এবার সেখানে ডাক পড়েছে দেশের বিশিষ্ট হার্ট সার্জন ডা. ইশরাক আব্রাহাম স্মরণ এর।

(৫)

শিউলিতলায় ঝড়ে পড়া ফুল গুলো কুড়িয়ে আঁচলে তুলে নিলো রুমাইসা। সমীর কোথায় থেকে একটা বাঁশের কঞ্চি তুলে দৌড়ে রুমাইসার কাছে এসে হাঁফিয়ে বলতে লাগলো,

“আপা এইটা ধরো। এটা গাছের ডালে লাগায়া টান দেও দেখবা কত্ত গুলা শিউলি তোমার কোলে ঝাইড়া পড়বো।”

রুমাইসা সমীরের দিকে ভ্রুকুঞ্চিত করে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে দেখলো। তারপর তার তুলতুলে নরম গাল দুটো টেনে দিয়ে বলল,

“লাগায়, দেও, ঝইড়া এগুলো কেমন কথা হুম? বলবে লাগিয়ে,দাও,ঝড়ে ঠিক আছে। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবে সব সময়।”

সমীর মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালে রুমাইসা কিছুটা ঝুঁকে এসে সমীরের গালে আলতো করে চুমু বসিয়ে দিলো। সমীর অনেকটা খুশি হয়ে রুমাইসার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

” আপা আমি তোমাকে ফুল পেড়ে দেই?”

রুমাইসা আলতো হেসে বলল,

“উঁহু আর পেড়ে কাজ নেই। চলো বাড়ি যাই মা দেখলে বকবে।”

“আপা?”

“আবার কি হলো?”

“আমার আম্মা তোমার মা না তাই না?”

সমীরের এমন প্রশ্নে তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারলো না রুমাইসা। মুখে শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলল,

“এসব কথা বলতে নেই।”

“আম্মা তোমারে মারে ক্যান আপা? তোমার বুঝি ব্যাথা লাগে না?”

রুমাইসা এইবারো সমীরের কথায় মৌনতা পালন করল। সমীর কিছুক্ষণ রুমাইসার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে পরে অন্য কথায় চলে গেলো। রুমাইসা সমীরের সব কথায় হু হু করলেও এই মুহূতে সেসব কথা তার কান অবধি পৌঁছালো না।

আজও রুমাইসার স্কুলে যাওয়া হলো না। নিলুফার বেগম নানান অজুহাতে আজও তাকে স্কুলে যেতে দেন নি। বাড়ির সব কাজ তিনি রুমাইসাকে দিয়েই করিয়ে নিচ্ছেন। আর কিছুমাত্র ভুল পেলে তার শাস্তিও দিচ্ছেন কড়ায়গণ্ডায়। সামনে রুমাইসার এস এস সি পরিক্ষা। নিলুফার কোনোভাবেই চান না রুমাইসা পড়াশুনা চালিয়ে যাক কিংবা পরিক্ষা দিক।

রুমাইসা বরাবরই পড়াশুনোতে ভালো বলে করিম সাহেব এক প্রকার স্ত্রীর বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়ের পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই নিয়ে নিলুফারের আক্রোশ যেনো আর কিছুতেই কমে না। তিনি চান যে করেই হোক সতিনের মেয়ে যেনো কিছুতেই পড়াশুনা করতে না পারে। তার মতে স্বামীর টাকা নষ্ট করে সতিনের মেয়েকে পড়ানোর কোনো মানেই হয় না। কুলি, মজুর একজন দেখে রুমাইসাকে বিয়ে দিয়ে এই সংসার থেকে বিদায় করতে পারলেই তিনি বাঁচেন। কিন্তু করিম সাহেব চান তার প্রথম স্ত্রীকে দেয়া কথা রাখতে। রুমাইসাকে পড়াশুনা করিয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে একজন সুপাত্রের হাতে তুলে দিতে। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর তাতে আপত্তি জেনেও তিনি মেয়েকে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু এত কিছু করেও কি তিনি শেষ পর্যন্ত মেয়ের পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারবেন?

(৬)

নিশ্চিন্দপুর গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের গ্রাম গুলো থেকে অনেক মানুষ মেডিকেল ক্যাম্পে আসে চিকিৎসা নিতে। প্রতিদিন প্রায় শতাধিক মানুষ চিকিৎসা নিতে ছুটে আসে দূরদূরান্ত থেকে। তাদের মাঝে কেউ বৃদ্ধ কেউ বা মধ্যবয়সী আবার কেউ কেউ শিশু। তাদের মাঝে বেশিরভাগ লোকই হতদরিদ্র। স্মরণ প্রথম বার কোনো পাড়াগাঁয়ে এসে এভাবে গ্রামের অসহায় মানুষদের সেবা করছে। তবে সে শুধু রুগীদের সেবাই দিচ্ছে না কথায় কথায় তাদের জীবনদশা সম্পর্কেও জেনে নিচ্ছে।

স্মরণের চেম্বারের বাহিরে বেশ কয়েকজন লোক বসে আছেন। তাদের মাঝে একজন মধ্যবয়স্ক লোক ছিলেন যিনি তাদের সকলের চেয়ে একটু আলাদা। স্মরণের চোখ সবার আগে ওই লোকটির উপর গিয়েই পড়লো। সাদাসিধে লোকটির পড়নে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। স্মরণ কি মনে করে চেম্বার থেকে বেড়িয়ে এলো। মধ্যবয়স্ক লোকটির কাছে যাবার জন্য পা বাড়াতে যাবে সঙ্গে সঙ্গে কোথায় থেকে রমিজ এসে স্মরণকে লম্বা সালাম দিয়ে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম ডাক্টার সাহাব! ভালো আছেন।”

“আরে রমিজ সাহেব কি খবর আপনার।”

“আলহামদুলিল্লাহ আছি।”

“সেদিন রাতের পর আপনার তো আর দেখাই নেই।”

রমিজ বরাবরের মতো এবারো লাজুক হাসি দিয়ে বলল,

“গ্যারামের ডাক পিয়ন আমি। সারাদিন চিডি বিলি করন আমার কাম তাই তো আর আইবার সময় পাই নাই।”

“তা অবশ্য ঠিক। তা কি মনে করে এলেন? জরুরী কিছু?”

“হ, একরম তাই।”

“তো দেরি কিসের বলে ফেলুন।”

রমিজ তার থলে থেকে একটা চিঠি বের করে স্মরণের হাতে দিয়ে বলল,

“এই চিডি খান আপনার লাইগা।”

“আমার!”

“জ্বী হ্যাঁ।”

স্মরণ চিঠির খামটা উলট পালট করে কয়েকবার দেখলো। কোথাও সে প্রাপক কিংবা পেরকের নাম খুঁজে পেলো না। অত্যন্ত বিস্ময়ে সে ভ্রুবিলাস করতে করতে বলল,

“চিঠি টা কে পাঠিয়েছে বলুন তো?”

রমিজ এবার ঘুরে দাঁড়াল। হাত ইশারা করে কাউকে ডাকলো। রমিজের ইশারা পেয়ে একজন মধ্যবয়স্ক লোক উঠে এদিকেই এগিয়ে আসছিলেন। স্মরণ লক্ষ্য করলো উনিই সেই ব্যাক্তি যাকে দেখে স্মরণ চেম্বার থেকে বেড়িয়ে এসেছিলো কথা বলার উদ্দেশ্যে।

রমিজ এবার আর কোনো ভণিতা করলো না। স্মরণের হাতে থাকা চিঠিটা দেখিয়ে বলল,

“এই চিঠিখান করিম চাচার মাইয়া রুমাইসা আপনার লাইগা পাডাইছে। ওই যে এদিকে আসতাছে লোকটা উনিই করিম চাচা। গ্যারামের হাই স্কুলের অংকের মাস্টার।”

স্মরণ একবার চিঠির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আবার সামনে তাকিয়ে লোকটিকে দেখলো। অতঃপর রমিজকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“উনার মেয়ে আমাকে কেনো চিঠি পাঠালেন? উনি কি কোনো ভাবে আমার পরিচিত! আই মিন উনি কি আমায় চেনেন?”

“আরে কি যে কন আপনে ডাক্টার সাহাব। হে আপনেরে চিনবো ক্যামনে? এই যে করিম চাচা, মেলা দিন ধইরা অসুস্থ, বাড়িতে কাউরে কিছু জানায়ও নাই। কিন্তু কাউরে না জানাইলে কি হইবো কথায় আছে না পোলাপান সব কিছু সবার কাছে লুকাইবার পারলেও মায়ের কাছে লুকাইবার পারে না। আর নিজের মাইয়া তো মায়ের লাহান ই তার কাছে লুকাই রাখবো তার সাধ্য কি?”

“হুম বুঝতে পারলাম। উনাকে চেম্বারে আসতে বলুন আমি দেখছি ব্যাপারটা। ”

” এই জন্যই চিঠিখান আমি আপনেরে দিছি। আমি জানি আপনে ভালা মানুষ করিম চাচার অসুবিধাটা আপনেই ভালো বুঝবেন।”

স্মরণ রমিজের কথায় কোনো উত্তর করলো না ফিরে চেম্বারে গিয়ে বসলো। হাতে থাকা চিঠিটা পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখলো। চিঠিটা হাতে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ নিজের ভিতর কিছু একটা অনুভব করেছিলো। কিন্তু সেই অনুভূতিটা তার মনে বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না, অচিরেই সে সেটা খুলতে ব্যাস্থ হয়ে পড়লো।

চিঠির ভাঁজ খোলবার সাথে সাথে শিউলি ফুলের কড়া গন্ধ এসে স্মরণের নাকে ঠেকল। অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে আছে সেই গন্ধে।

চলবে,,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here