সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-১২

0
431

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১২

(২৪)

বাড়িতে ডুকতে রুমাইসার পথ আগলে দাঁড়াল শেহ্ওয়ার। অন্ধকারে রুমাইসা তার মুখ দেখতে না পেলেও বুঝতে পারলো শেহ্ওয়ার অনেক রেগে আছে।

“কোথায় গিয়েছিলি এই ভর সন্ধ্যেবেলায়? ”

“কাজ ছিলো একটু।”

“আমি কাজের কথা জানতে চাইনি রুসা। কোথায় গিয়েছিলি সেটা জানতে ছেয়েছি।”

শেহ্ওয়ার কিছুটা উচ্চবাক্যে কথা গুলো বলল কিন্তু তাতেও রুমাইসার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। চুপচাপ মাথা নিচু করে শেহ্ওয়ার
সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।

“তুই কি ঠিক করেছিস আমার কথার উত্তর দিবি না?”

“উত্তর দেই নি কে বলল?”

“কি বুঝাতে চাইছিস তুই রুসা।”

“বলেছি তো কাজ ছিলো।”

“বুঝতে পেরেছি, তোকের আর এই বিষয়ে কথা বলে কোনো লাভ হবে না। বাই দ্যা ওয়ে বসার ঘরে ফুফাজান আর বাবা তোর জন্য অপেক্ষা করছে এলে ভালো হয়।”

রুমাইসা এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে জানে বাবা আর মামা তাকে কি বলতে পারে। তবে তারা যাই বলুক না কেনো এই মুহূর্তে সে বিয়ে করতে চায় না, অনেক দূর পর্যন্ত লেখা পড়া করতে চায় সে। আজ কাল শুধু লেখাপড়া করতে চায় এর মধ্যেই রুমাইসার স্বপ্ন সীমাবদ্ধ নেই, সে স্বরণের মতো বড় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু তার এই স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে কি না তা কে বলতে পারে?

রুমাইসা কয়েক সেকেন্ড কি যেনো ভাবল তারপর
শেহ্ওয়ারের চোখে চোখ রেখে বলল,

“মামাজান আর বাবা নিশ্চই আমাকে ইংল্যান্ড নিয়ে যাওয়া নিয়েই কথা বলতে চান?”

“হবে হয় তো তাই।”

“কিন্তু আমি সেখানে যেতে চাই না।”

এবার শেহ্ওয়ার প্রশস্ত শ্বাস ছাড়লো। কয়েক পা এগিয়ে রুমাইসার কাছে সরে এসে দাঁড়াল, তারপর বলল,

“দেখ রুমাইসা আমরা কেউই তোর খারাপ চাই না।
এখানে তুই ভালো থাকতে পারবি না। মিসেস নিলুফারের এমন আক্রোশ থেকে তুই সহজে বের হতে পারবি না। উনি তোকে পড়াশুনা করতে দিবেন না কোনোভাবে তাছাড়া এমন পাড়াগাঁয়ে থেকে তুই কখনো নিজের স্বপ্নপূরণ করতে পারবি না।”

“দেখো আমি জানি মা আমাকে পছন্দ করেন না,সব সময় আমাকে কথা শুনায় তাই বলে আমি আমার নিজের বাড়ি ছেড়ে বাবাকে ছেড়ে অন্য দেশে চলে যাবো?”

“তুই জানিস বাবা চাইছে আমি তোকে এখনি বিয়ে করে ওই দেশে নিয়ে যাই।”

“জানি।”

“কিন্তু আমি সেটা চাইছি না। কারণ আমি জানি তুই এই মুহূর্তে বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়, তাছাড়া তোর এখনো বিয়ের বয়স হয় নি। আমি চাই তুই পড়াশুনা কর। তোকে আমি অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করবো। এখানে পড়ে থাকলে তো সেটা সম্ভব নয়।”

রুমাইসার কথাগুলো চুপচাপ শুনতে লাগলো। এখানে কেউ নেই যে তার মনের কথা বুঝবে। সবাই তাকে নিয়ে নিজের মন গড়া গল্প তৈরী করে চলেছে আর সে সব গল্পের ভিড়ে তার নিজের গল্পটাই বেমালুম চাপা পড়ে যাচ্ছে।

(২৫)

খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে স্মরণ। চারপাশে উত্তরী সমীরণ বইছে সাথে বাড়ছে শীতের তীব্রতা। অন্ধকারে সামনে যতদূর দেখা যায় শুধু কুয়াশা ঘণ প্রলেপ। স্মরণ চোখ বুজে নাক টেনে নিশ্বাস নিলো। বাতাসে লেগে থাকা শিউলির শেষ ফুলটার সুবাস নিশ্বাসের সাথে গ্রহন করতে চাইলো কিন্তু সেটা আর হলো কোথায়? বিন্নি ধানের পাকা গন্ধ এসে তার নিশ্বাসের সাথে নাসিকাপথে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে নাড়া দিলো। সঙ্গে সঙ্গে স্মরণের কপালের চামড়া কুচকে উঠলো। ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে উঠলো। চোখ খুলে সে চারপাশে তাকালো আর প্রচণ্ড বিরিক্ত নিয়ে বলল,

“পুরো মুডটাই নষ্ট করে দিলো।”

“একা একা কি কথা বলছিস ”
বলেই ফায়াজ এসে স্মরণের পাশে দাঁড়াল।

“যাবার আগে মুড খারাপ করার জন্য এই ধানের বিচ্ছিরী গন্ধটাই যথেষ্ট।”

ফায়াজ স্মরণের কথা মুচকি হাসলো। তারপর তার দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুই সত্যি কি মেয়েটার অনুরোধ উপেক্ষা করে চলে যেতে পারবি?”

“আমি কি এমন কোনো প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে কেউ এসে আমাকে অনুরোধ করলো আর আমি সেটা রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবো?”

“তুই একটু বেশিই রেগে যাচ্ছিস না? মেয়েটা এই ভর সন্ধ্যেবেলায় অকারণে তোর কাছে ছুটে আসেনি স্মরণ। ”

“কি বুঝাতে চাস তুই ফায়াজ।”

“কিছুই না, শুধু বলতে চাইছি যে কারো অনুরোধ রক্ষার্থে কিন্তু তুই ওই মেয়েটার বই কিনে এনেছিলি আর সে বই কিনে আনতে তুই স্কুলের দপ্তরী কি ঠিক কত টাকা খাইয়েছিস সেটা নিশ্চই তোর অজানা নয়। তুই চাইলেই বই আনতে পারতিস একটু জোর দিয়ে বললে কিন্তু তুই সেটা করিস নি বলেছিস যত টাকা লাগে তুই তাকে দিবি তারপরো যেনো তিনি তোকে একসেট বই দেন।”

“পুরোনো কথা ঘাটাঘাটি করার কোনো মানে নেই। চল যাই অনেক ঠান্ডা পড়ছে। একটু পর গাড়ি আসবে।”
বলে স্মরণ সেখান থেকে যাবার জন্য পা বাড়ালো।

“তুই সত্যি চলে যাচ্ছিস তাহলে?”

“কেনো সন্দেহ আছে তাতে?”

“আর ওই মেয়েটা।”
এবার স্মরণ থামলো কিছু একটা ভেবে ফিরে ফায়াজের সামনে এসে মুখামুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

“একটা কথা কি জানিস তুই আমাকে এখন যেমন দেখছিস আমি মোটেও তেমন নয় আর সেটা হয় তো তুই খুব ভালো করেই জানিস আর বুঝিস। গ্রামে যে স্মরণকে তুই দেখছিস নিজের জীবনে যে সে এমন নয় সেটা নিশ্চই তোর থেকে ভালো কেউ জানে না।”

“তুই অতটাও হৃদয়হীন নয়।”

“কি দায় পড়েছে আমার যে ওই মেয়েটাকে আমাকে সাহায্য করতে হবে।”

“যে দায়ে পড়ে তুই তার জন্য অতদূর ছুটে গিয়েছিলি, টাকা খাইয়ে বই এনেছিলি।”

“বার বার এক কথা কেনো বলছিস বলতো?”

“তুই কি শেহ্ওয়ারের উপর রাগ করে এসব করছিস?”

“মিসেস রুমাইসা তার বাগদত্তা, আমাদের কোনো রাইট নেই তাদের জীবন নিয়ে কথা বলার।”

“কোনো রাইট নেই মানে? মেয়েটা তোর কাছে ছুটে এসেছে স্মরণ, ও বিয়েটা করতে চায় না।”

“বিয়ে করতে চায় না কে বললো? সে এখন করতে চায় না বলেছে বিয়ে করবে না তা তো বলে নি। আর দেখ আমি এসব নিয়ে একদম কথা বলতে চাই না। আমার হাতে সময় নেই যদি যাবার হয় তো চল না হয় এখানেই পড়ে থাক।”

বলে স্মরণ দ্রুত গতীতে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। ফায়াজ স্মরণের যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল,

“এই ছেলে কোনো দিন কিছু বুঝবে না। শুধু নিজের জেদ আর একরোখা নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেবে।”

(২৬)

বাবার সামনে নতমুখে বসে আছে রুমাইসা। দুচোখে অশ্রু জমাট বেঁধেছে সে কখন। মনের ভেতর প্রচণ্ড ঝড় বয়ে চলেছে অনবরত কিন্তু তার খবর নেবার মত কেউ নেই। শরীরের ব্যাথা সবাই দেখতে পায় কিন্তু মনের ব্যাথা সেটা কে দেখে? রুমাইসার ভেতরটা কেমন গুড়িয়ে যাচ্ছে। সে চায় না এখন বিয়ে করতে তাও সবাই মিলে তাকে জোর করছে যাতে সে বিয়েটা করে নেয়।

করিম সাহেব মেয়ের হাতের উপর হাত রেখে বললেন,

“দেখ মা তুই যদি শেহ্ওয়ারকে বিয়ে করে ওই দেশে চলে যাস তাহলে আমার আর কোনো চিন্তা থাকবে না। রোজ রোজ আর এত অশান্তি তোকে সয্য করে এখানে পড়ে থাকতে হবে না। শেহ্ওয়ার অনেক ভালো ছেলে তোর অযত্ন সে কখনো করবে না।”

“বাবা আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। আমি পড়াশুনা করতে চাই।”

“তারা তো তোকে পড়াশুনা করাবে না বলে নি। অবশ্যই করাবে।”

“আমার পরীক্ষা সামনে।”

“তাতে কি? বিয়েটা না হয় দু মাস পড়েই হবে। পরীক্ষা হয়ে গেলেই হোক।”

“কিন্তু বাবা।”

“আর কোনো কিন্তু করিস না মা। আমার হাতে হয় তো আর বেশি সময় নেই। তোকে শেহ্ওয়ারের হাতে তুলে দিতে পারলেই আমি শান্তিতে মরতে পারবো।”

“বাবা আমি মায়ের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করতে চাই।”

“অবশ্যই করবি। কিন্তু সেটা বিয়ের পর।”

রুমাইসা কোনো কথা বলতে পারলো না আর। এবারো তার গতিহীন জীবন বরাবরের মতো তাকে তার করুণ পরিণতির দিকে টেনে নিতে চাইছে সেটা সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। অথচ তার কিছুই করার নেই আর নিজের ইচ্ছাগুলোকে বলি দেয়ার জন্যই যেনো তার জন্ম হয়েছে বলে মনে হলো রুমাইসার।

জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রুমাইসা। শিউলি গাছের পাতায় বিন্দু বিন্দু শিশির জমেছে। সেখান থেকে টপ টপ করে কেয়েক ফোঁটা শিশির জল গড়িয়ে নিচের সবুজ গাসের উপর পড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। রুমাইসা গভীর দৃষ্টিতে সে দৃশ্য চোখে ধারণ করছে। দূর থেকে ট্রেনের ঝকঝক শব্দ ভেসে আসতে শুনলো রুমাইসা। গভীর রাতে ঝকঝক শব্দটা কতটা ভয়ংকর শুনা যায় সেটা চোখ বুজে অনুভব করতে চাইলো সে। কিছুসময় চোখ বুজে পরে ধীরেধীরে চোখ খুললো। বিষণ্ণতায় ছেয়ে উঠে তার মন। কয়েক মুহূর্তের জন্য স্মরণের মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। হয় তো এই শেষ ট্রেনে করেই স্মরণে শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। বিদায় নিয়েছে এই নিশুতি রাতের গ্রাম ছেড়ে। ধীরেধীরে রুমাইসার মন ভার হয়ে উঠলো। বুকের ভেতর কেমন চিন চিন ব্যাথা অনুভব করলো সে। স্মরণের সাথে তার পরিচয় খুব একটা বেশি দিনের নয় তবুও কেনো তাকে এত কাছের বলে মনে হয় রুমাইসার? এই উত্তর সে খুঁজে পায় না।

চলবে,,,,।

পেইজে যারা গল্প পড়েন তারা অবশ্যই পোস্টে সাড়া দিবেন। পেইজের রিচ কমে গেছে। সবাই পোস্টে কমেন্ট করলে অন্যদের কাছে গল্পটা পৌছাবে এবং তারা পড়ার সুযোগ পাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here