সন্ধ্যে নামার আগে পর্ব-১৩

0
433

#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১৩

(২৭)

উন্মুক্ত বাতায়নের কার্ণিশে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্মরণ। সকালের মিষ্টি রোদ এসে তার মুখের একপাশটায় পড়েছে। চারপাশের মৃদু সমীরণ তার অগোছালো চুলগুলোতে বার বার ঢেউ খেলিয়ে বেরাচ্ছে। স্মরণ কিছুটা সময় একইভাবে কাটিয়ে ফিরে এসে বিছানার একপাশ দখল করে করে বসলো। সারা রাতের ক্লান্তি আর অবসাদগ্রস্ত দেহ একটু প্রশান্তির ছোঁয়া চাইছে। স্মরণ মাথার পেছনে দুহাত জড়ো করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। পুরো একটি নির্ঘুম রাত সে ট্রেনের একা কামরায় কাটিয়ে দিয়েছে। দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি সারা রাত। নিশ্চিন্দপুর গ্রাম ছাড়ার পর থেকেই তার বুকের ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে। বার বার মনের মাঝে রুমাইসার বলা কথাগুলো কারণে অকারণে উঁকি মারছিলো।

“আচ্ছা, একটা মেয়ে মানুষ কখন এভাবে একজন অপরিচিত পুরুষ মানুষের কাছে ছুটে আসে? যাকে কিনা সে খুব ভালো করে জানে না, চেনে না, যার জীবন সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই, সে মানুষটার কাছে কি করে একটি মেয়ে ছুটে আসতে পারে আর বিশ্বাস করতে পারে যে সে মানুষটা তার বিপদে হাত বাড়িয়ে দিবে? শুধু কি সেদিন করিম সাহেবের কথা রাখতে সে বই গুলো এনে দিয়েছে বলে রুমাইসা তাকে এত ভরসা করছে নাকি তার পেছনে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে?”

না আর ভাবতে পারলো না স্মরণ অবসাদে তার চোখজোড়া লেগে আসতে চায়। এই মুহূর্তে তার লম্বা একটা ঘুমের প্রয়োজন।

(২৮)

দীর্ঘ তিন মাস পর রুমাইসা স্কুলে এসেছে। স্কুলে এসে সে প্রথমে প্রধান শিক্ষক আমিনুল হকের সাথে দেখা করতে অফিস কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলো। আমিনুল হক কি এক বিশেষ প্রয়োজনে তাকে স্কুলে ডেকে পাঠিয়েছেন। রুমাইসা অবশ্য কারণ জানে না তবে এটা বুঝতে পেরেছে খুব জটিল কোনো সমস্যা হয়েছে যার কারণে তাকে জরুরী ভিত্তিতে ডাকা হয়েছে।

অফিস কক্ষের সামনে একা দাঁড়িয়ে আছে রুমাইসা। ভেতরে তার বাবা প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কি এক বিষয় নিয়ে অনেক্ষণ যাবত আলোচনা করছেন। রুমাইসা বার কয়েক উঁকি দিয়ে দেখলো কিন্তু তাদের কি কথোপকথন হচ্ছে তার কিছুই সে শুনতে পেলো না। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে সে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে বুক ধুরু ধুরু করছে। অজানা আশংকায় হৃদপিন্ডের রক্ত দ্রুত উঠানামা করছে। সে জানে না ভিতরে কি নিয়ে কথা হচ্ছে তবে তার মনের ভেতর কেনো যেনো কু গাইতে শুরু করেছে। সামনে সব কিছু অন্ধকারের মতো লাগছে।

প্রায় বিশ মিনিট পর অফিস কক্ষ থেকে করিম সাহেব বেড়িয়ে এলেন। বাবাকে বেড়িয়ে আসতে দেখে রুমাইসা কিছুটা এগিয়ে এসে উৎসুক দৃষ্টিতে বাবার মুখের দিকে তাকালো। মেয়ের এমন উৎকন্ঠিত চাহনি দেখে করিম সাহেব স্মিত হাসলেন তারপর বললেন,

“বাবা মা যা করে তা সন্তানের মঙ্গলের জন্যই করে রুমাইসা এ কথাটা তুমি সব সময় মনে রাখবে। কখনো এটা ভেবো না যে তোমার বাবা তোমার খারাপ চাইছে। জীবনে সফলতা অর্জন করতে হলে ছোট ছোট অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়। সামনে হয় তো তোমাকেও এমন কিছু পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তবে তাতে তুমি ভেঙে পড়ো না মনে সাহস রেখে সামনে এগিয়ে যাবে।”

কথা শেষ করেই করিম সাহেব সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। রুমাইসা হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো বাবার যাওয়ার দিকে। সে এখনো বুঝতে পারছে না ঠিক কি ঘটেছে তবে এতটুকু বুঝতে পারছে তার জীবনে অকল্পিত কোনো ঝড় উঠতে চলেছে।

প্রধান শিক্ষকের অফিস থেকে বেড়িয়ে সোজা ক্লাস রুমের দিকে হাঁটা ধরলো রুমাইসা। রাত্রি আরো কয়েকজন সহ মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। রুমাইসাকে অফিস কক্ষ থেকে হনহনিয়ে বেড়িয়ে আসতে দেখে রাত্রি সেখান থেকে রুমাইসাকে ডাকতে শুরু করলো কিন্তু রুমাইসা সে দিকে কান দিলো না দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলো ক্লাস রুমের দিকে। রাত্রি কিছুটা সময় মৌন থেকে কিছু বুঝার চেষ্টা করলো তারপর নিজেও দ্রুত এগিয়ে গেলো ক্লাসের দিকে।

(২৯)

গ্রামের পথ ধরে রুমাইরা এবং রাত্রি পাশাপাশি হাঁটছে। দুজনেই চুপচাপ কারো মুখে কথা নেই। রাত্রি মাঝে মাঝে আড় চোখে রুমাইসাকে দেখছে মেয়েটার মুখে একরাশ বিষণ্ণতা।

“তুই কি সত্যিই আমারে কিছু কইবি না রুমাইসা?”

রাত্রির কথায় রুমাইসার ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। তারপর উদাসীন ভাবে বলল,

“মাঝে মাঝে নিজের বাবা মাও অনেকটা স্বার্থপর হয়ে যায়। সময় আর পরিস্থিতি হয় তো তাদের বাধ্য করে স্বার্থপর হতে।”

“হঠাৎ এ কথা কেনো কতাছোস?”

“আজকাল নিজেকে সত্যিই অপরের বোঝা বলে মনে হয় তবে আজ সেটা খুব জোরালো ভাবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে।”

“চাচা কিছু কইছে তোরে?”

“উহু।”

“তবে?”

“কখনো বলবো সব, আজ আর ভালো লাগছে না।”

“তোরে একখান কথা জিগামু রুমাইসা?”

“কি কথা?”

“নিশ্চিন্দপুরের মেডিকেল ক্যাম্পে যে ডাক্তার আইছিলো ওই যে স্মরণ নাকি কে যেনো তিনি নাকি চাচার চিকিৎসা করাইতে রাজী হইছেন?”

“হুম।”

“এত বড় একজন ডাক্তার চাচার চিকিৎসা করবো?”

“হুম।”

“মেলা টাকা খরছ হইবো তাইলে।”

রুমাইসা উত্তরে কিছু বলতে পারলো না। স্মরণের কথা মনে পড়তেই তার ভেতর টা কেমন হুহু করতে শুরু করলো। বুকের ভেতরটা কেমন চিন চিন করে উঠলো। স্মরণ নামক মানুষটির সাথে তার খুব একটা গভীর সম্পর্ক নেই তবুও কেনো যেনো এই লোকটার কথা মনে পড়লে তার ভেতরে এমন অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব হয়। স্মরণে মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই রুমাইসার কেমন কান্না পেতে লাগলো। দুচোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। এই মানুষটাকে অজানা কারণেই তার এত কাছের মনে হয় কেনো? এই প্রশ্নের উত্তর সে জানে না। তবে এতটুকু জানে যে এই মানুষ যখন তার আশে পাশে থাকে তখন সে মনে একটা আলাদা সাহস পায়। মনে হয় যেনো পুরো পৃথিবীটা তার হাতের মুঠোয়।

বাড়ি ফিরে রুমাইসা দেখতে পেলো শেহ্ওয়ার মাঝ উঠোনে বসে সমীরের সাথে গল্প করছে। কাছেই রিমা গালে হাত রেখে শেহ্ওয়ারের প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করছে। রুমাইসা কিছুটা সময় এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাঁকিয়ে থেকে পরে গটগট করে হেঁটে শেহওয়ারের সমুখে এসে দাঁড়াল। শেহ্ওয়ার তার দিকে একবার আড়চোখে তাকালো তারপর আবার নিজের কাজে মন দিলো। রুমাইসা কয়েক মুহূর্ত একি ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর বলল,

“আপনার সাথে আমার কথা আছে।”

শেহওয়ার এবার সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলো রুমাইসার দিকে তবে রুমাইসার তীক্ষ্ম দৃষ্টি দেখে সে একগাল হেসে ফেলে বলল,

“এই দৃষ্টি দিয়ে কি আমাকে ভস্ম করার প্লান করেছিস নাকি?”

রুমাইসা জবাবে কিছুই বলল না আগের মতোই তার দিকে তাকিয়ে রইলো। শেহ্ওয়ার কিছুটা সময় রুমাইসাকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলো রুমাইসা কিছু একটা নিয়ে বেশ খ্যাপে আছে তাই সে আর কোনো কথা বাড়ালো না আবারো নিজের কাজে মন দিলো।

“আপনি আমার স্কুলে গিয়েছিলেন?”

“কেনো বল তো?”

“আমি যা প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দিন।”

“আমি তো যাই নি।”

“আমি বিশ্বাস করি না বাবা নিজ থেকে কথা গুলো বলেছেন। আপনি নিশ্চই তাকে এসব বুঝিয়েছেন।”

রুমাইসার কথায় শেহওয়ার এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পকেটে দুহাত গুঁজে সে রুমাইসার একেবারে কাছে এসে বলল,

“তোকে এখানে রেখে যেতে ভরসা পাচ্ছি না।”

“তাই বলে আপনি আমার পরীক্ষার আগেই,,।”

শেহওয়ার রুমাইসার মুখে আঙ্গুল চেপে ধরলো তার ফিসফিস করে বলল,

“আমি চাই না আমার হবু স্ত্রীর উপর অন্য পর পুরুষ অধিকার খাটাক। আমি তিন দিনের মাঝে তোকে এখান থেকে ঢাকায় ট্রান্সফার করে নিচ্ছি। রেজিস্টেশন কার্ড কিংবা বোর্ড এর ব্যাপার আমি আগেই দেখে রেখেছি তুই পরীক্ষা ঢাকায় থেকে দিবি এখানে নয়।”

“এসব করার মানে কি? আমি বলেছি আমি এখান থেকে কোথাও যাবো না তার পরো কেনো আমার উপর জোর খাটাচ্ছেন?”

“ভুলে যাস না তুই আমার স্ত্রী হতে চলেছিস।”

“বিয়েটা এখনো হয় নি।”

“তাতে কি আজ নয় কাল হবেই সেটা নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না।”

“এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে?”

শেহওয়ার এবার বাঁকা চোখে রুমাইসার দিকে তাকালো। তারপর মুখে তির্যক হাসি ফুটিয়ে বলল,

“কি ভাবছিস ডা. স্মরণ তোকে বাঁচাতে আসবে?”

“কি বলতে চাইছেন?”

“দেখ রুসা আমি তোকে মেরে ফেলছি না যে কেউ এসে তোকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে কিংবা তোকে কেউ সাহায্য করতে এত দূর ছুটে আসবে।”

রুমাইসা অবাক হয়ে শেহওয়ারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

“বুঝতে পারছিস না কিছু তাই না?”

রুমাইসা নির্বাক হয়ে তখনো তাকিয়ে রইলো। শেহওয়ার এবার রুমাইসাকে সরাসরি বলে বসলো,

“ভর সন্ধে বেলায় তুই কেনো সেখানে ছুটে গিয়েছি রুসা? তোর কাছে অপরিচিত একজন এতটাই আপন হয়ে গেলো যে তার কাছে ভিক্ষা চাওয়ার জন্য তোকে এতদূর পর্যন্ত যেতে হলো।”

“আপনাকে এসব কে বলেছে?”

“তুই কি ভেবেছিস আমি কিছুর খবর রাখি না?”

“এত কিছুই যখন জানেন, বুঝেন এবং খবর রাখেন তবে এটা বুঝতে পারছেন না যে আমি এখন বিয়ে করতে চাই না আর এখান থেকে কোথাও যেতেও চাই না।”

“আমি তোর ভালোর জন্যই এসব করছি।”

“আমি তো চাই নি ভালো। তবে কেনো আমার উপর জোর করে ভালো কিছু চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে?”

রুমাইসার একথার কোনো জবাব করলো না শেহওয়ার। শুধু একটা বাক্যই তার মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো,

” ভালোবাসি বলেই হয় তো।”

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here