#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২২
(৪৯)
গাড়ি থেকে নেমে স্মরণের পিছু পিছু একটা বড় দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল রুমাইসা। পড়নে কালো আর খয়েরী মিশেল সেলোয়ার কামিজ, মাথা আধগোমটা টেনে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে স্মরণের ঠিক দুইহাত পেছনে। ভয় আর লজ্জা মিশ্রিত অনুভূতি তার চেহারায় খেলা করছে। সে জানে না স্মরণ তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে তবুও তার অন্তঃকরণে অজানা উৎকন্ঠা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বার বার। বুক ধুক ধুক করছে। হাত পা শীতল থেকে আরো শীতলা ধারণ করছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব ঘাবড়ে আছে সে।
স্মরণ দরজায় কলিংবেল চেপে ফিরে রুমাইসার দিকে তাকালো। মেয়েটা যে সত্যি খুব ঘাবড়ে আছে এই ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ নেই।
“মিস রুমাইসা আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?”
স্মরণের কথায় মাথা তুলে তাকালো রুমাইসা। বেকুল চাহনিতে যেনো সে তারই উত্তর দিতে চাইলো সে খুবই ভয় পাচ্ছে। রুমাইসার চাহনি দেখে বুঝতে ভুল হলো না স্মরণের তাই কিছুটা পরিহাস্য করে বলল,
“ভয় পাবার কিছু নেই, এটা আমারই বাড়ি। কোনো যমালয়ে নিয়ে আসি নি যে এই শীতেও ঘামতে হবে।”
রুমাইসা এবার কিছুটা আশ্বস্ত হলো। ইতিউতি করে পুরো বাড়িটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলো তারপর স্মরণের উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনি পরিবারকে না জানিয়ে একটা মেয়েকে বাড়ি এনে তুলেছেন দেখলে আপনার পরিবার নিশ্চই রাগ করবে?”
“সে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি আপনার লক্ষ্যে ঠিক থাকুন, মন দিয়ে পড়াশুনাটা করুন। এমনিতেই নানান ঝামেলায় পড়ে পড়ার অনেক ক্ষতি হতেছে তাই এখানে এসে আর কোনো কিছুতে সময় নষ্ট করবেন না।”
“এই পুরো বাড়িটা আপনাদের?”
“কোনো সন্দেহ আছে?”
“উঁহু।”
“তবে এত প্রশ্ন কেনো?”
রুমাইসা আর কোনো কথা বলল না। নিশ্চুপে মাথানত করে নিলো। স্মরণ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে দেখলো রুমাইসাকে আর মনে মনে ভাবলো এই কি সে মেয়ে যার একটুকরো চিঠির প্রেমে সে পড়েছিলো। যার অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় চোখের চাহনি তাকে প্রথমবারের মতো ঘায়েল করেছিলো, হৃদয়ে অসারত্ব অনুভব করিয়েছিলো প্রতিনিয়ত। শরৎের কোনো এক কুয়াশা ঝড়া আঁধার রাত্রিতে যখন চারপাশ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন জেগেছিলো শুধু গুটিকয়েক রাত জাগা পাখি আর শিউলি ফুলের মাধকতা ছড়ানো সুবাস। চারদিকের নিস্তব্ধতা আর নিশুতি রাতের আঁধার যখন মিলেমিশে এক হয়ে উঠেছিলো ঠিক তখনই পাড়াগাঁয়ের এক ছোট্ট বাড়ির পাশে গাছ আর ঝোঁপের আড়াল থেকে হারিকেনের আলোয় কিশোরীর সজলনেত্র দেখে দম আটকে যাবার মতো অনুভূতি হয়েছিলো স্মরণের। প্রথম প্রেমের অনুভূতি কাকে বলে তা তার জানা নেই তবে রুমাইসার জল টলমল চোখ তাকে দিশেহারা করে তুলেছিলো অন্তঃকরণে চাপা কষ্টের অনুভূতি সৃষ্টি করেছিলো।
হঠাৎ খট করে দরজা খোলার শব্দে ঘোর ভেঙে গেলো স্মরণের। অর্শা দরজা খুলেই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তাদের দিকে তারপর কিছুটা ইতস্ততভাবে বলল,
“ভাইয়া তুমি? আসবে যে তো বলো নি।”
“আমার বাড়িতে আমি আসবো সেটা এত জানিয়ে আসার কি হলো?”
” না আসলে,,,। ”
বলেই রুমাইসার দিকে তাকালো। রুমাইসা ভীত চাহনিতে অর্শার দিকে একবার তাকিয়ে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলো। স্মরণ অর্শার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বলল,
“ও রুমাইসা আজ থেকে এখানেই থাকবে, তোদের পরে সব কিছু খুলে বলছি এখন তো ভেতরে যেতে দে। অনেক ক্লান্ত একটা লম্বা ঘুমের প্রয়োজন।”
“আচ্ছা এসো। বাবা বাসায় নেই দাদু আর মা আছে তুমি যাও আমি রুমাইসাকে নিয়ে আসছি।”
“তুই ওকে নিতে হবে না ওর পা আছে একাই যেতে পারবে। আপনি অর্শার সাথেই আসুন।”
রুমাইসা মাথা নাড়লে স্মরণ ভেতরে চলে যায়। অর্শা রুমাইসার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো তারপর বলল,
“আরে তুমি এত ভয় পাচ্ছো কেনো চলো আমার সাথে। আর শুনো আমাকে এত লজ্জা করতে হবে না এখন এসো আর দাঁড়িয়ে থাকলে ভাইয়া রেগে যাবে।”
অর্শার কথায় কিছুটা হালকা হলো রুমাইসা। তারপর ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে অর্শার সাথে করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো।
(৫০)
কপালে হাত ঠেকিয়ে নির্লিপ্তভাবে পুকুর ঘাটে বসে আছে শেহ্ওয়ার। মাথায় হাজারটা ভাবনা। রুমাইসার চলে গেছে আজ পাঁচ দিন হলো আর এই পাঁচদিনে সে এতটুকু শান্তি কোথাও খুঁজে পায় নি। যে দিকে যায় আর যে দিকেই তাকায় রুমাইসার স্মৃতি ছাড়া কিছুই সে খুঁজে পায় না। আজকাল অন্তঃকরণে বড্ড বেশি যন্ত্রণা অনুভব করে। নিজের জেদ টিকিয়ে রাখতে গিয়ে নিজের সবচেয়ে কাছের, ভালোবাসার মানুষটাকেই সে হারিয়ে ফেলেছে। কি বা হতো আর কয়টা মাস অপেক্ষা করলে, নিজের সিদ্ধান্তগুলো রুমাইসার উপর চাপিয়ে না দিলে হয় তো মেয়েটা এতবড় একটা কাজ করতে পারতো না ভাবতে ভাবতে তার চোখ দুটো সিক্ত হয়ে উঠলো।
“আপনি এখানে বসে আছেন যে, মামা আপনাকে ডাকছে।”
রিমার কন্ঠস্বর কানে একে নিজেকে ধাতস্থ করে নেয় শেহওয়ার। ঘাটের একেবারে উপরের সিঁড়িটায় দাঁড়িয়ে আছে রিমা। শেহওয়ার ঘাড় ঘুরিয়ে রিমাকে দেখলো একবার, মেয়েটার দিকে তাকানোর মতো মুখ নেই তার। সে জানে না তার বাবা আর নিলুফার কি করে তার অনুপস্থিতিতে রিমার সাথে বিয়ে ঠিক করতে পারে। এই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটার কতই আর বয়স সে তো এখনো বিয়ে কি জিনিস সেটাই জানে না ভালো করে অথচ তার মা কিনা তাকে এখনি বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। ভাগ্যিস সে সময় স্মরণ গ্রামের চেয়ারম্যানকে নিয়ে হাজির হয়েছিলো নয় তো কি কান্ডটাই না ঘটে যেতো। কিন্তু বাবা আর নিলুফার বেগমকে বা সে দোষ দেয় কি করে ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে রিমাকে বিয়ে করার ব্যাপারটা তো সে নিজেও এড়িয়ে যেতে পারে নি। কাপুরুষের মত নিজেও তাদের কথায় রাজী হয়ে গিয়েছিলো।
“আপনারে মামা ডাকতাছে।”
আবারো বলল রিমা। এবার শেহওয়ার নড়েচড়ে বসল তারপর বলল
“বাবাকে গিয়ে বলো আমি তার কথা শুনতে যেতে পারবো না, উনার যা খুশি তা করতে বলে দিও।”
“মামা শহরে চইলা যাইতাছে আপনারে একবার দেখা করতে কইছে।”
“উনার যেখানে খুশি যাক কিন্তু আমি উনার সাথে দেখা করতে চাইছি না বলে দিও।”
রিমা কিছু না বলে চুপচাপ খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে রইলো শেহওয়ারের পরবর্তী জবাবের আশায় কিন্তু না শেহওয়ার আর কোনো উত্তর দিলো না পুকুরের জলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে রইলো।
রিমা অপেক্ষা করেও যখন কোনো জবাব পেলো না, তখন সে বাড়ির দিকে চলে যাবার জন্য অগ্রসর হতে লাগে আর ঠি সে সময় শেহওয়ার তাকে দাঁড়াতে বলে নিজে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
“রিমা তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
কয়েক সিঁড়ি এগিয়ে রিমার সামনে এসে বাহুতে হাত গুঁজে প্রশস্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,
“রুসাকে চলে যেতে সেদিন তুমিই সাহায্য করেছিলে তাই না?”
শেহওয়ারের কথায় রিমা এতটুকু অবাক হলো না বরং স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিয়ে বলল,
“আপনের কি তাই মনে অয়?”
“রিমা কথা ঠিক করে বলো। আঞ্চলিকতা ছেড়ে একটু শুদ্ধ করেও তো কথা বলতে পারো।”
“আমার শুদ্ধ কথা দিয়া আপনের কি লাভ?”
“তুমিই সাহায্য করেছিলে তাই না?”
“যদি কই আমিই আপারে কইছিলাম চইলা যাইতে তাইলে কি করবেন?”
“কেনো করেছিলে এমন?”
“আপনের বিদেশে একটা বউ থাকতে ক্যান আমার আপারে বিয়া করতে চাইছেন?”
“এ কথা তোমাকে কে বলল।”
“আপনে অস্বীকার করতে পারবেন আপনে বিদেশে বিয়ে করেন নাই?”
“আমি বাধ্য হয়েছিলাম বিয়েটা করতে।”
“তবে ক্যান আবার আমার আপারে বিয়া কইরা তার জীবন নিষ্ট করতে চাইছিলেন, আইচ্ছা আপনের উদ্দেশ্যটা কি?”
“উদ্দেশ্য কিছু নয় রিমা, আমি রুসাকে বড্ড বেশি ভালোবেসেছি।”
“যদি তাই হইতো তাইলে ওইদিন আপনের বাবা আর আমার মায়ের কথা ধইরা আমারে বিয়ে করতে রাজী হইতেন না।”
“আমি উপরিস্থিতির স্বীকার।”
শেহওয়ারের কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠলো রিমা। তারপর বলল,
“কোন পরিস্থিতির কথা কইতাছেন? আপনে পরিস্থিতির স্বীকার হইলে আমার পরিস্থিতিরে কি কইবে লোকে?”
“পরিহাস করছো।”
“তার মতো কথা কইলে যে কেউই পরিহাস করবো।”
“রুসা কোথায় গেছে?”
“হেইডা আমি কেমনে কমু।”
“তুমি সব জানো আমি জানি।”
“জানলেই কি আপনারে কন লাগবো।”
“রিমা তুমি বড্ড বাড়াবাড়ি করছো মনে হচ্ছে না?”
“আপনে কি কম করতাছেন, অন্য দেশে বউ রাইখা দেশে আইসা আমার আপারে বিয়া করতে চাইছেন আপনে কি মনে করেন আপনাগো চক্রান্ত কেউ ধরতে পারবো না? আপনি আসলে আমার আপারে কোনো দিন ভালোবাসেন নাই যদি বাসতেন তবে তার লগে এমন বেইমানী করতেন না।”
বলে গট গট করে হেঁটে রিমা সেখান থেকে চলে গেলো। শেহওয়ার রিমার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
(৫১)
ছাদের কার্ণিশ ভর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে স্মরণ। আকাশে গুটিকতক তারার মাঝে একফালি চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। চারদিকে উত্তরী সমীরণ বইছে। খোলা ছাদের কার্ণিশে ভর দিয়ে স্মরণ বিগত কয়েক দিনের কথা মনে নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফায়াজ ফোনে কথা বলছিলো, স্মরণকে আনমনা হয়ে কিছু ভাবতে দেখে সে ফোন রেখে স্মরণের পাশে এসে দাঁড়াল।
“কি ভাবছিস এতো?”
“কিছু না তো।”
“মেয়েটাকে শেষ পর্যন্ত নিয়েই এলি।”
“হু।”
“যাকে উপেক্ষা করার শক্তি তোর নেই তাকে শুধু শুধু কেনো এত কষ্ট দিতে গিয়েছিলি।”
“তার ভালো চেয়েছিলাম বলে।”
“আচ্ছা একটা কথা বলতো, তুই কি রুমাইসাকে ভালোবাসিস।”
“ভালোবাসা বলে জগতে কিছু আছে?”
“যদি নাই থাকে তাহলে তোর কি দায় পড়েছিলো পাড়াগাঁয়ের একটা সহজ সরল মেয়ে যে তোর কেউ হয় না,যার সাথে তোর কোনো সম্পর্কই তার জন্য এতটুকু করার। এমনকি তার জন্য তোর মত এত বড় মাফের একজন ডাক্তার সে কিনা শুভ্রনগরের মতো ছোট্ট মফস্বলের ছোট হাসপাতালে,,,,,।”
“আর গভীরে যাস না।”
“সত্যি বেড়িয়ে আসবে তাই তো।”
“যদি বলি তাই।”
“এত লুকোচুরি কিসের আমি বুঝতে পারছি না। আমার তো মনে রুমাইসাও তোকে।”
“বার বার এক কথা কেনো বলছিস বলতো?”
“মানে কি স্মরণ?”
“সে অনেক ছোট। মাত্র মেট্রিক পরীক্ষা দিবে আর আমার বয়স কত জানিস?”
“এটাই বুঝি আসল কারণ?”
“তুই বুঝবি না। অনেক রাত হয়েছে চল যাই।”
“সত্যি করে একটা কথা বলতো স্মরণ তুই ঠিক কি চাইছিস?”
“আমি চাই সে খুব বড় ডাক্তার হোক। নিজের স্বপ্ন পূরণ করুক। আমি সব সময় তার পাশে আছি আর থাকবো এর চেয়ে বেশি কিছু না।”
বলে দ্রুত হেঁটে ছাদ থেকে নেমে গেলো স্মরণ। ফায়াজ ক্ষণকাল দাঁড়িয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার কাছে স্মরণকে পাথর বলে মনে হয় মাঝে মাঝে, যার বুকে হাজারটা আছড় কাটলেও তাতে এতটুকু দাগ পড়ে না।
চলবে,,,।