#সন্ধ্যে_নামার_আগে
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২৩
(৫২)
পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের পাতা উলট পালট করছে রুমাইসা। আজকাল তার মন অল্পতেই খারাপ হয়ে উঠে। গ্রাম থেকে এসেছে প্রায় একমাস হতে চলল অথচ নিজের বাড়ি আর বাবাকে ছাড়া সে কখনো কোথাও গিয়ে এত দিন থাকে নি। অলকানন্দপুর ছোট্ট গ্রামের সারি সারি ধান খেত, পথঘাট,শিউলি তলা আর মায়ের কবর ছেড়ে আজ সে বহু দূরে। চাইলেও এখন আর তার মায়ের কবরের কাছে যেতে পারে না, কষ্টগুলোও আর মাকে বলা হয়ে উঠে না। এসব ভাবতে ভাবতে রুমাইসার বুক ভার হয়ে আসে, নেত্রপল্লব দুটি অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে।
“মিস রুমাইসা।”
হঠাৎ স্মরণে কন্ঠস্বর কানে আসতে দ্রুত চোখ মুছে নিলো রুমাইসা। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে স্মরণের সামনে এসে দাঁড়ায়।
“গ্রাম থেকে আপনার বাবার চিঠি এসেছে। তিনি বোধহয় কিছুটা অসুস্থ, রমিজের চিঠি পড়ে তাই মনে হলো।”
“বাবা অসুস্থ?”
“তাই তো বললেন রমিজ সাহেব। তবে সব খুলে বলেন নি তিনি কিছুটা বলেছেন। আপনি আপনার বাবার চিঠি পড়লে হয় তো কিছু জানতে পারবেন।”
“আমরা গ্রামে ফিরবো কবে?”
“ফেরার জন্য কি গ্রাম ছেড়েছিলেন?”
“আমার পরীক্ষা?”
“সেটার জন্য নিশ্চিন্দপুর যাওয়া হলেও অলকানন্দপুর যাওয়া হবে কিনা কথা দিতে পারছি না।”
“বাবার সাথেও দেখা করা হবে না?”
“হতেও পারে। এসব নিয়ে আপনাকে এখন ভাবতে হবে না। যেটার জন্য আপনি সব ছেড়ে এখানে এসেছেন আগে সেটায় মনোযোগ দিন। পড়াশোনাটা ভালো করে করুন আপনার হাতে খুব একটা বেশি সময় নেই। তাই যতটুকু সময় আছে কাজে লাগান, পড়াশুনা করুন।”
“আপনাকে খুব বিপদে ফেলে দিলাম তাই না।”
“সেটা আপনাকে এখন না ভাবলেও চলবে মিস রুমাইসা। আর আপনি আমাকে বিপদে ফেলতে চাইলেই যে আমি বিপদে পড়ে যাবো তা কিন্তু নয়। সেদিন আপনি আমার কাছে এসেছিলেন আমি চাইলেই আপনাকে আবার ফিরিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু সেটা আমি করি নি। আর বিপদে যদি পড়ে থাকি সেটা আমি নিজেই নিজের জন্য পড়েছি আপনার জন্য নয়। তাই আর এসব নিয়ে কথা না বলাটাই ভালো। ”
বলেই স্মরণ রুমাইসার দিকে চিঠি এগিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। স্মরণ চলে গেলে রুমাইসা বিছানার একপাশ দখল করে বসে। কাঁপা কাঁপা হস্তে খাম ছিঁড়ে একটুকরো চিঠি বের করে সেটা চোখের সামনে মেলে ধরে। চিঠিতে বাবার হাতে লেখার উপর দৃষ্টি পড়তে তার দুচোখ ছলছল করে উঠলো। অন্তঃকরণে চাপা কষ্ট অনুভব হতে লাগলো। বাবাকে ছেড়ে এতদূর আসতে হবে কখনো আসতে হবে সেটা সে ভাবে নি।
আজকাল করিম সাহেবের স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। মেয়েকে একটিবার দেখার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন। রোজ রমিজকে ডেকে তিনি নানানভাবে রুমাইসার খবর জানতে চাইতেন কিন্তু রমিজ তাকে তেমন কোনো খবরই দিতে পারে নি গত একমাস যাবত। রুমাইসাকে শহরে নিয়ে আসার পর নানান ঝামেলায় পড়ে রমিজকে আর চিঠি পাঠানো হয় নি স্মরণের। এমনকি রমিজের দেয়া চিঠিরও সে কোনো উত্তর করে নি। অন্যদিকে মেয়ের কোনো খবর না পেয়ে চিন্তায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন করিম সাহেব। দিন চার কি পাঁচেক আগে স্মরণ যখন একটু অবসর পেল তখনি সে রমিজের নামে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলো তার উত্তরেই আজ রমিজ তাকে চিঠি পাঠিয়েছে আর সাথে করিম সাহেবও মেয়ের উদ্দেশ্যে একখানা চিঠি পাঠালেন।
চিঠি শেষ করে রুমাইসা চোখ মুছল। অনেকদিন পর সে বাবার খবর পেয়েছে। এখন তার একটু নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে। তবে একটা ব্যাপারে সে কিছুটা চিন্তিত কারণ স্মরণের কথা অনুযায়ী রমিজ বলেছিলো তার বাবা অসুস্থ অথচ পুরো চিঠির কোথাও অসুস্থতার কথা লিখে নি তার বাবা বরং বার বার করে বলেছে তিনি সুস্থ আছেন, রিমা এবং সমীর দুজনই তাকে দেখে রাখছে।
বেশ কিছুটা সময় রুমাইসা বাবার চিঠি বুকে জড়িয়ে উপর হয়ে শুয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ কি যেনো ভেবে সটান করে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াল আর বালিশের তলায় চিঠি রেখে দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।
(৫৩)
“আচ্ছা বাবা স্মরণের মাথা কি ঠি আছে বলুন তো?”
“কেনো বউ মা স্মরণের আবার কি হলো?”
“এই যে গ্রাম থেকে অচেনা অজানা একটা মেয়েকে তুলে এনে বাড়িতে রেখেছে লোকে জানলে কি ভাববে বলুন তো।”
“তুমি কি বলতে চাইছো আমি ঠিক বুঝতে পারছি না বউ মা।”
“এই যে রুমাইসা মেয়েটা ওকে এইভাবে বাড়িতে এনে তোলার কি কোনো মানে আছে? কোথাকার কোন পাড়াগাঁয়ের মেয়ে তাকে সাহায্য করার জন্য আপনার নাতি কিনা করছে শেষ পর্যন্ত বাড়িতে এনে তুলেছে তাও এক দুই দিনের জন্য নয় একেবারে সারাজীবনের জন্য মনে হচ্ছে।”
“বউ মা তুমি এই কথা কি করে বলতে পারছো? আমার দাদুভাই কি খুব খারাপ কাজ করে ফেলেছে? একটা অসহায় মেয়েকে সে সাহায্য করেছে তাতে খারাপের কি দেখলে তুমি। আর বার বার মেয়েটাকে তুলে এনেছে বলছো কেনো?”
“বাবা আপনিও স্মরণের মতো এত দিল দরদী হয়ে যাবেন না। কে জানে কোন উদ্দেশ্যে আমার ছেলের ঘাড়ে এসে চেপেছে মেয়েটা।”
“বউ মা ভদ্রভাবে কথা বলো তোমার মুখে এমন কথা মানায় না, আর আমি তোমাকে যতটুকু চিনি তুমি তো এভাবে কথা বলার মেয়ে না, তবে কেনো বলছো এসব। আর এই মেয়েটাকে নিয়ে তোমার কি এত সমস্যা কিসের আমি তো বুঝতে পারছি না।”
বলেই মাহতাব শেখ নিজের পুত্রবধূর মুখের দিকে তাকালেন।
সেলিনা রহমান কিছুটা রেগে আছেন কিন্তু শ্বশুরের চোখে চোখ পড়তেই মনে হলো রাগটা কিছুটা প্রশমিত করে আনলেন।
“বউ মা ভুলে যেও না তোমার নিজেরো একটা মেয়ে আছে তাই অন্যের মেয়েকে নিয়ে দুটো কথা বলার আগে একটু ভাবনা চিন্তা করে বলবে।”
“বাবা আপনার ছেলে এখন বাড়ি নেই দুদিন পর তিনি আসলে কি জবাব দেবো আমি বলতে পারেন?”
“তোমাকে কোনো কিছু নিয়ে বাবার কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে না মা।”
হঠাৎ পেছন থেকে স্মরণের কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে উঠলেন সেলিনা রহমান। চোর চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে যেমন হয় সেলিনা বেগমেরও এখন ঠিক সেইরকম অবস্থা। তিনি ভাবতে পারেন নি স্মরণ তার কথাগুলো শুনে ফেলবে তাই নিজের দোষ ডাকতে বললেন,
“আরে বাবা আমি সে জন্য বলছি না, তুই আমাকে একদম ভুল বুঝিস না।”
“আপনি কি জন্য কথাগুলো বলেছেন তার কৈফিয়ত আমি আপনার কাছে চাইনি আম্মা। আপনি যা বলার তা তো বলেই দিয়েছেন। আপনার যখন মিস রুমাইসাকে বাড়িতে আনা নিয়ে এত সমস্যা তাহলে প্রথম দিন কেনো বারণ করেন নি। আর হ্যাঁ ভুলে যাবেন না এই বাড়িটা শুধু আপনার একার, এই বাড়িতে আরো মানুষ বাস করে, কই তাদের তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না একলা আপনারই কেনো উনাকে নিয়ে এত সমস্যা হচ্ছে।”
“স্মরণ তুই আমাকে এবারো ভুল বুঝছিস। তোর বাবা ব্যাপারটা জানলে কি হবে বুঝতে পারছিস?”
“আপনি কি ভাবছেন বাবা ব্যাপারটা জানেন না?”
“মানে?”
“মানে কিছুই নয়, মিস রুমাইসা যে এখানে আছেন সেটা বাবা প্রথম দিন থেকেই জানেন। তাই বাবা জানবে বাবা জানবে বলে আপনাকে এত মরিয়া হয়ে উঠতে হবে না।”
বলেই স্মরণ কিছুটা রেগে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। স্মরণ চলে গেলে মতলব শেখ দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তারপর পুত্রবধূর দিকে হতাশ চাহনিতে তাকিয়ে বললেন,
“মেয়েটাকে নিয়ে তোমার সমস্যাটা ঠিক কোথায় তা আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছি বউ মা। তুমি আসলে যা চাইছো তা কখনোই স্মরণ মেনে নিবে না। মা হয়ে যে এখনো নিজের ছেলেটাকে বুঝতে পারো নি তা যে কারোই আর অজানা নেই।”
বলে মতলব শেখও নিজের ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন। সেলিনা রহমান মুখে কিছু বলতে না পারলেও মনে মনে বেশ রুষ্ট হলেন রুমাইসার উপর। মেয়েটাকে তিনি প্রথম দিন থেকেই সহ্য করতে পারেন না। স্মরণ যেদিন রুনাইসাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসে সেদিনই তিনি ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখন নি, যদিও ছেলের মুখের সামনে কিছু বলতে সাহস করেন নি তবে তিনি যে তাতে খুব একটা খুশি হননি তা আচরণে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। রুমাইসাকে এই বাড়ির প্রত্যেকে খুব ভালোবাসে। ইতিমধ্যে অর্শাও তার বন্ধু হয়ে উঠেছে। স্মরণের বড় ভাই শয়নও তাকে নিজের বোনের মতো ভালোবাসে শুধু সেলিনা রহমানই রুমাইসার উপর বিরক্ত।
(৫৪)
রুমাইসাদের বাড়ির সামনে বিরাট বড় ভিড় জমেছে। মধ্যরাতে বাড়ির অন্তঃপুর থেকে কারো ক্রন্দনরত সুর শুনে আশেপাশে লোকজন ছুটে আসে রুমাইসাদের বাড়ির উঠানে। করিম সাহেবের মৃতদেহের পাশে বসে মরা কান্না জুড়ে দিয়েছেন নিলুফার বেগম। সমীর রিমা এক পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছে। মনোয়ারা বেগম শক্ত হয়ে ছেলের লাশের পাশে ঠায় বসে আছেন। এতটুকু জল নেই চোখে, যেনো অতি শোকে পাথর হয়ে গেছেন তিনি।
উঠানে মানুষের ভিড় ঠেলে ঘরের দিকে ছুটে গেলো রমিজ। তিনি যেনো এমন কিছুর জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। করিম সাহেবের মৃত দেহের দিকে তাকিয়ে তিনি থ হয়ে গেলেন। বুঝতে পারছেন এই মুহূর্তের তার কি করা উচিত।
ইতিমধ্যে গ্রামের সব লোক জড়ো হয়েছে রুমাইসাদের বাড়িতে। শেহওয়াদেরও খবর পাঠানো হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ সময় আগে। আত্নীয় স্বজনরাও শেষ রাতে এসে পৌঁছে গেছে। রমিজ এই দিকের সব দেখা শুনা করে দ্রুত মফস্বলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। যত দ্রুত সম্ভব তাকে শহরে পৌছে স্মরণকে টেলিফোনে খবর জানাতে হবে নয় তো পরবর্তীতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। রুমাইসা তার বাবাকে শেষ দেখা টুকু দেখতে পাবে না।
চলবে,,,।