সায়াহ্নের 🦋 পর্ব-১৯

0
889

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#উনবিংশ_পর্ব (ধামাকা স্পেশাল‌ ২)

৫৪.
দুপুরের পর রাইয়্যান‌ যখন নিজের রুমে শাওয়ার নিতে ব্যস্ত ছিল তখনই রুমে চুপিচুপি প্রবেশ করে প্রাচী। ঠিক যেন এই সময়টার ই সুযোগে ছিল সে। রুমের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিতেই আতকে উঠে প্রাচী‌। চারপাশে দেয়ালে ঝুলন্ত অনেক ছবিই রয়েছে যেগুলোতে ক্রস দেয়া আর সবগুলো মুখশ্রী ই অপরিচিত তার কাছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে অনেকবারই আনাগোনা হয়েছে রাইয়্যানের‌। টেবিলের উপর থাকা বিভিন্ন অস্ত্র, ল্যাপটপ দেখেই গলা শুকিয়ে আসে প্রাচীর।
– “কাম ডাউন প্রাচী, কাম ডাউন! এভাবে টাইম ওয়েস্ট করলে চলবে না। তাড়াতাড়ি করে নিজের ফোনটা খুঁজে বের কর। সমুদ্রকে ফোন করে সবটা জানাতে হবে।”

যেই ভাবা সেই কাজ। রুমের ভেতরে অতি সন্তর্পণে প্রবেশ করে প্রথমেই টেবিল আর বিছানা ভালো করে খুঁজে নেয় প্রাচী। কিন্তু না কোথাও ফোন নামক বস্তুটার চিহ্ন ও নেই। আশপাশে একবার তাকিয়ে কর্ণারে থাকা কাবার্ডের‌ দিকে চলে যায় সে। হাত সহ পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে ভয় আর আশংকায়; এই ভেবে যদি রাইয়্যানের‌ কাছে ধরা পড়ে যায় তাহলে? কাবার্ডের‌ এক পার্ট খুলতেই ভেতরে বিভিন্ন ফাইলপত্র আর সারি সারি ওয়াইনের বোতল চোখে পড়ে প্রাচীর। চোখ মুখ কুঁচকে নিচের তাকে থাকা লকারের‌ দরজা টান দিতেই তা খুলে যায়। অবাক হয় প্রাচী। কেননা সাধারণত সব কাবার্ডের‌ লকার তালা দেয়া থাকে। বাড়তি চিন্তা ভাবনা ছেড়ে লকারের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই এক কর্ণারে ফোন চোখে পড়ে তার‌। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফোন নিতেই ফোনের সাথে একটা ছবি হাত থেকে নিচে পড়ে। তাৎক্ষণিক দ্রুত কাবার্ডের দরজা লাগিয়ে ছবিটা হাতে তুলে নেয় প্রাচী।
রাইয়্যানের‌ কাছে ধরা পড়লে রক্ষে নেই। রাইয়্যান ও যেকোনো সময় বেরিয়ে পড়তে পারে। তাই আর বিলম্ব না করে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে প্রাচী।
এদিকে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রুমে আসতেই কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায় রাইয়্যান‌। কেউ কি এসেছিল তার রুমে? এমন লাগছে কেন? কিছু একটা ভেবে বিছানায় পড়ে থাকা শার্ট টা তুলে নেয় সে।

ফোনে আর মাত্র ৯% চার্জ বাকি। আর একটু পরেই তো ফোনের ব্যাটারি ডেড হয়ে যাবে। শীঘ্রই সমুদ্র কে ফোন করা জরুরি। পাশেই বিছানায় বসে পিহু সাদা পৃষ্ঠায় মনমতো আঁকিবুঁকি করে চলেছে। রুমে পায়চারি করতে করতে বিছানায় পড়ে থাকা ফোন হাতে তুলে নেয় প্রাচী। কললিস্ট ঘেঁটে সমুদ্রের নাম্বারে ডায়াল করে সে। রিং হচ্ছে। কিন্তু অপর পাশে থাকা মানুষটির কোনো রেসপন্স নেই।
– “প্লিজ, সমুদ্র ফোন রিসিভ করুন। আমার হাতে বেশি সময় নেই। ফোনের ব্যাটারি ডেড হয়ে গেলে আর কোনো কিছু বলতে পারব না আপনাকে। প্লিজ একবার ফোন রিসিভ করুন।”
অপর পাশ থেকে অনবরত রিং হতে হতে একসময় কেটে যায় কল। হতাশ হয় প্রাচী।
বিছানায় উল্টো হয়ে পড়ে থাকা ছবিটার দিকে চোখ যেতেই ভ্রু কুঁচকে নেয় সে। খানিকটা কৌতুহল নিয়ে ছবিটা হাতে নিতেই আরেক দফা অবাক হয় প্রাচী।
– “নিকিতা! এটা তো নিকিতার ছবি। কিন্তু নিকিতার ছবি রাইয়্যানের কাছে কি করে এলো? রাইয়্যানের সাথে কি কোনোভাবে নিকিতার সম্পর্ক রয়েছে? কিন্তু সেটা কি করে?”
গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে প্রাচী। মাথায় শুধু বিশাল বিশাল প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে যার উত্তর আদৌ পাবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

৫৫.
প্রাচীর সব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র সমুদ্রই দিতে পারবে। তাই দেরি না করে নিজের ফোন খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে‌।
-“সমুদ্র আপনি কোথায়? প্লিজ অন্তত একবার আমার কথাটা শুনুন। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান। আমি পারছি না আপনাকে ছাড়া থাকতে। প্লিজ ফোনটা রিসিভ করুন।”
বলেই দ্বিতীয়বারের মতো কল দেয় প্রাচী। রিং হওয়ার এক পর্যায়ে কেউ হাত থেকে খপ করে ফোন কেড়ে নিতেই হালকা ভড়কে যায় সে।
পরক্ষণেই পাশ ঘুরে তাকাতেই রাইয়্যানের রাগান্বিত মুখশ্রী চোখে পড়ে তার।

– “সমুদ্রকে ফোন করছিলে? এটা জানাতে যে তুমি কোথায় আছো? কি মনে করেছ? সমুদ্র তোমাকে এখানে এসে আমার কাছ থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে?”
শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে উঠে রাইয়্যান‌। এতে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভয় পেলেও তা প্রকাশ করে না প্রাচী।
– “হ্যাঁ, আমার সমুদ্রের প্রতি বিশ্বাস আছে। সমুদ্র ঠিকই এখানে এসে আমাকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে। আপনার এসব ভিত্তিহীন কথায় আমি বিশ্বাস করি না।”
কাঠ কাঠ গলায় জবাব দেয় প্রাচী।
– “এত বিশ্বাস? সব বিশ্বাস গুড়িয়ে যায় না যেন!”
– “আমার মন বলছে সমুদ্র এখানে আসবে।”
আর কিছু বলতে পারে না প্রাচী। খোলা জানালার অপর পাশ থেকে হেলিকপ্টারের তীক্ষ্ণ আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই নড়েচড়ে উঠে প্রাচী, পিহু সহ রাইয়্যান‌।
– “সমুদ্র!”
– “বাহ্, মিস্টার সাইকো লাভার তাহলে এসেই পড়েছে। দুজনেই বেশ ইন্টেলিজেন্ট বলতে হবে। অবশেষে আমার খোঁজ পেয়েই গেল। কিন্তু তোমার সমুদ্র আমার কিছুই করতে পারবে না।”
বলেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে পিহুকে কোলে তুলে নেয় রাইয়্যান‌। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব বনে যায় প্রাচী‌। পিহুর‌ কথা তো মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল। এখন কি করবে সে? রাইয়্যান‌ যদি পিহুর‌ কোনো ক্ষতি করে তাহলে?

– “প্রাচী, পিহু?”
হুড়মুড় করে রুমে প্রবেশ করতেই বলে উঠে সমুদ্র। চোখে মুখে তার আতংকে ঘেরা। প্রাচীও পেছনে ঘুরে সমুদ্রকে দেখতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
– “ওয়েলকাম ব্যাক মিস্টার জুনায়েদ আরহাম‌ সমুদ্র। আমি জানতাম তুই আসবি‌। প্রাচীর জন্য না হলেও অন্তত পিহুর‌ জন্য তোকে আসতেই হতো।”
হাসতে হাসতে প্রলাপ বকে রাইয়্যান‌। এদিকে সমুদ্রের দৃষ্টি স্থির।
– “পিহুকে ছেড়ে দে রাইয়্যান‌। আমি তোকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি পিহুর কিছু হলে আমি তোকে ছেড়ে দেব না।”
– “ছেড়ে দেব? তুই বললেই ছেড়ে দেব? কিন্তু কি করি বল তো খেলার মূল গুটি যেহেতু পিহু; পিহুকে কি করে ছেড়ে দেই?
মনে আছে পাঁচ বছর আগের কথা? কি করে পুরো গ্যাং এর সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে অপমান করেছিলি? আমার এতদিনের পাওয়ার আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলি? শুধু মাত্র একটা ছোট্ট কারণের জন্য!
সেসব ভুলে যাই কি করে? এসবের প্রতিশোধ না নিয়ে তোকে ছেড়ে দেই কি করে? ভেবেছিলাম এসবের প্রতিশোধ তোর মৃত্যুর মাধ্যমে নেব কিন্তু না। তোকে একেবারে শেষ করে দিলে কি করে হবে? তার চেয়ে যখন তোর চোখের সামনে তোর মেয়েকে মেরে ফেলি সেটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় প্রতিশোধ। নিজের চোখের সামনে নিজের মেয়েকে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাওয়াটা খুব তৃপ্তির হবে তাই না সমুদ্র?”
বলেই পকেট থেকে একটা ধারালো ছুরি বের করে পিহুর‌ দিকে তাক করতেই ভয় পেয়ে যায় প্রাচী। পিহু কাঁদছে। ফর্সা মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে ইতিমধ্যে। চোখ দুটোও অশ্রুসিক্ত।

– “আমি চাইনা এখানে আমার হাতে কোনো অঘটন ঘটুক রাইয়্যান‌। আর তোর কর্মের ফল তুই পেয়েছিস‌। তুই যেই ভুল করেছিস সেটার জন্য তোর প্রাণ যায়নি এটাই অনেক। আমি একজনকে প্রমিজ করেছিলাম তাই তুই সেদিন বেঁচে গিয়েছিলি‌।
পিহুকে‌ ছেড়ে দে রাইয়্যান‌। লড়াই তোর আর আমার মাঝে। পিহু আর প্রাচীকে এসবের মধ্যে ইনভল্ব করিস না লাস্ট বার বলছি!”

– “এইতো ফাইনালি তোর চোখে কাউকে হারানোর তীব্র ভয় দেখতে পারছি আমি সমুদ্র। আমি তো এটাই চেয়েছিলাম। তোর মনে ভয় প্রবেশ করুক‌। কাউকে হারানোর তীব্র ভয়। এবার বুঝবি নিজের প্রিয় জিনিস হারালে কতটা কষ্ট হয়।”
রাইয়্যানের বলা কথায় কিছু সময়ের জন্য হলেও থমকে যায় সমুদ্র। মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু নিকিতার বলে যাওয়া কথাগুলোর বিচরণ ঘুরপাক খাচ্ছে।

৫৬.
– “নিজের মেয়েকে নিজের হাতে মারতে পারবি তো রাইয়্যান‌?”
ধারালো ছুরি টা পিহুর দিকে এগোতে ব্যস্ত ছিল রাইয়্যান‌। সমুদ্রের শান্ত স্বরে বলা কথা শুনে শরীর হিম হয়ে আসে তার‌। তার মেয়ে মানে? পিহু তো সমুদ্রের মেয়ে!
– “আমার মেয়ে মানে? কি যা তা বলছিস এসব? পিহু আমার মেয়ে হতে যাবে কেন? পিহু‌ তো তোর মেয়ে!”
বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে রাইয়্যান‌। সমুদ্রের দৃষ্টি অপরিবর্তিত। তার কল্পনায় ভেসে ওঠে নিকিতার দৃশ্যপট।

– “নিকিতা? মনে হয় এই নামটার সাথে তুই ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই না রাইয়্যান‌? যার সাথে ভালোবাসার নাটক করে খুব বাজেভাবে ঠকিয়েছিলি?”
নিকিতা নামটা শুনতেই পিলে চমকে ওঠে রাইয়্যান‌। নিকিতা? নিকিতা তো! নিকিতার নাম শুনতেই হাত আলগা হয়ে আসে তার‌। আর এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল সমুদ্র। রাইয়্যানের হাত থেকে পিহু আলগা হয়ে আসতেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে পিহুকে আগলে নিতেই রাইয়্যানের‌ হুঁশ ফিরে আসে।
এদিকে সবটাই যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে প্রাচীর। পিহু আসলে কার মেয়ে? সমুদ্র নাকি রাইয়্যানের?

– “সমুদ্র! পিহুকে‌ আমার কাছে ফিরিয়ে দে।”
কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে ওঠে রাইয়্যান‌। তাতে কোনো ভাবান্তর ঘটে না সমুদ্রের। বরং আরো দৃঢ় কন্ঠে প্রত্যুত্তরে বলে ওঠে,

– “সেটা তো আর হওয়ার নয়, রাইয়্যান‌! পিহুর ছোঁয়া তুই আর পাবি না। যেই রহস্য তুই জানিস না সেটা তোকে জানতেও দেব না আমি। আজকে এখানেই তোর সাথে সেই রহস্য দাফন হয়ে যাবে।”
– “মানেহ্!”
আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই সমুদ্র জ্যাকেটের পেছন থেকে গান বের রাইয়্যানের দিকে তাক করে পরপর দুটো শট করতেই একটা গুলি বাম হাত আরেকটা বুক ছেদ করতেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে রাইয়্যান‌। পিহুও ভয়ে ঝাপটে ধরে সমুদ্রকে‌। প্রাচী এককোণে ভয়ে জড়সড় হয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।
মিনিট পাঁচেক পর রাইয়্যানের নিথর দেহ মেঝেতে লুটিয়ে পড়তেই সমুদ্র মুচকি হেসে বলে ওঠে,
-“চ্যাপ্টার ক্লোজড!”………….

#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here