#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#পঞ্চবিংশ_পর্ব (অন্তিম খন্ডাংশ-২)
৭২.
ডক্টর আয়েশার উক্ত কথায় অতি পরিমাণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সমুদ্র। টেবিলের উপর থাকা রিপোর্ট গুলো উঠিয়ে নিঃশব্দে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। প্রাচীও পিছু পিছু বেরিয়ে পড়ে সমুদ্রের। মুখে টু শব্দটির ও নেই।
গাড়িতে সারা রাস্তায় একটা কথাও বলেনি সমুদ্র। প্রাচীও আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলেনি। দীর্ঘ সময় পর বাসার সামনে এসে গাড়ি থামতেই সিটবেল্ট খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়ে প্রাচী। অন্যদিন হলে সমুদ্র নিজেই তাকে সিটবেল্ট খুলে বাইরে বের হতে সাহায্য করত। প্রাচী বাইরে বের হতেই সমুদ্র দ্রুত গাড়ি ফুল স্পীডে ইউটার্ন নিয়ে চলে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও পরমুহূর্তে প্রাচী বেশ কয়েকবার সমুদ্রকে পিছু ডাকলেও সাড়া দেয় নি সে। প্রাচীও ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়ায় ভেতরের দিকে। জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত এমন অদ্ভুত কঠিন কেন?
রাতে পিহুকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে রুমের দরজার দিকে তাকায় প্রাচী। ঘড়ির কাঁটায় রাত এগারোটা বেজে এসেছে ইতোমধ্যে; কিন্তু সমুদ্রের বাসায় ফেরার কোনো নাম গন্ধ নেই। বিচলিত হয়ে ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে পড়ে সে। উদ্দেশ্য টেবিলের উপর পড়ে থাকা ফোন। ফোন হাতে নিয়ে সমুদ্রকে ফোন করতে যাবে তখনই রুমে প্রবেশ করেন মিসেস কোহিনুর চৌধুরী।
– “প্রাচী?”
কোহিনুর চৌধুরীর ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকায় প্রাচী।
– “মা, আপনি? আসুন না ভেতরে আসুন।”
– “সমুদ্র এখনো ফিরে নি?”
কোহিনুর চৌধুরীর প্রশ্নে মুহূর্তেই মুখ চুপসে যায় প্রাচীর। অতঃপর মাথা নিচু করে না বোঝাতেই ফুস করে দম ফেলেন কোহিনুর চৌধুরী। এগিয়ে এসে প্রাচীর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা স্বরূপ বলে উঠেন,
– “চিন্তা করো না, সমুদ্র এসে পড়বে। একদম টেনশন করবে না; বেবিদের সমস্যা হবে।
পিহু ঘুমিয়ে পড়েছে?”
– “জি মা।”
প্রাচীর উত্তর পেয়ে বিছানায় থাকা ঘুমন্ত পিহুকে অতি সন্তর্পণে কোলে তুলে নিলেন কোহিনুর চৌধুরী। প্রাচীও আটকায় নি; কেননা তিনি হুটহাট ই পিহু ঘুমিয়ে পড়লে পিহুকে নিজের ঘরে নিয়ে যান। পিহুকে নিয়ে যেতেই প্রাচী সমুদ্রের নাম্বারে ডায়াল করে। রিং হচ্ছে কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর কোনো প্রতিক্রিয়া না হতে রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে হলরুমের দিকে পা বাড়ায় প্রাচী। হলরুমে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দুশ্চিন্তায় পায়চারি করতে করতে দরজার দিকে বারবার তাকাচ্ছে সে। মিনিট বিশেক এভাবে কাটাতে কাটাতেই অপেক্ষার অবসান ঘটে প্রাচীর।
অগোছালো চুল, শার্টের বোতাম খোলা, হাতে বিয়ারের বোতল। নেশায় আসক্ত হয়ে ঢুলুঢুলু শরীর নিয়ে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে সমুদ্র। সমুদ্রের এহেন দশা দেখে এক মুহূর্তের জন্য আতকে উঠে প্রাচী। কেননা বিয়ের পর কিংবা এ পর্যন্ত কোনোদিনই সে সমুদ্রকে এভাবে নেশায় বুঁদ হতে দেখে নি। হলরুমে আসতে গিয়ে একপর্যায়ে মেঝেতে পড়ে যেতে নিলেই প্রাচী দ্রুত পায়ে গিয়ে সমুদ্রকে আগলে নেয়।
– “সমুদ্র! আপনি কি ঠিক আছেন? কি অবস্থা করেছেন নিজের! আর আপনি ড্রিঙ্কস করে এসেছেন, সমুদ্র?”
সমুদ্রকে ঘিরে প্রলাপ বকে প্রাচী। এদিকে প্রাচীর কথা শুনে সমুদ্র ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠে। সমুদ্রকে এমন বাচ্চাদের মত হাসতে দেখে বুঝতে বাকি থাকে না প্রাচীর যে সমুদ্র এখন নিজের আয়ত্তে নেই। সমুদ্রকে কোনোমতে সোফার উপর বসিয়ে কিচেনে গিয়ে তড়িঘড়ি করে লেবুর শরবত তৈরি করে নিয়ে সমুদ্রকে জোর করে খাইয়ে দিতেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে নেয় সমুদ্র। ড্রিঙ্কস এর প্রভাব কাটতে বেশ কিছু সময় চলে যায় চোখের নিমিষেই।
নিশুতি রাত। চোখে লেগে থাকা ঘুম কাটতেই সমুদ্র খেয়াল করে তার পায়ের উপর ভর দিয়ে কেউ শুয়ে রয়েছে। চোখ খুলে তাকাতেই নিজেকে সোফায় আর প্রাচীকে নিজের পায়ের কাছে আবিষ্কার সমুদ্র। হয়তো চোখ লেগে এসেছিল প্রাচীর। সমুদ্রের নড়েচড়ে ওঠার প্রভাব পড়ে প্রাচীর উপর ও।
– “সমুদ্র, আপনি ঠিক আছেন? আপনি ড্রিঙ্কস করেছেন? কিন্তু কেন?”
প্রাচীর প্রশ্ন শুনে উঠে দাঁড়ায় সমুদ্র।
– “এত রাত পর্যন্ত জেগে ছিলে কেন? উপরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”
প্রাচীর প্রশ্ন এভাবে এড়িয়ে যাওয়ায় বেশ ক্ষিপ্ত হয় প্রাচী। ইদানিং প্রেগন্যান্সি তে হুটহাট ক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া তার নিত্যদিনের বিষয়।
৭৩.
– “আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি, সমুদ্র! আপনি এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন আমাকে? কিছু হয়েছে? আপনি কি কিছু লুকাচ্ছেন আমার কাছ থেকে, সমুদ্র?”
– “জানতে চাও তো আমার সমস্যা কিসে? তাহলে শুনো! আমার সমস্যা আমাদের বেবিদের নিয়ে! আমার সমস্যা তোমাকে নিয়ে।”
সমুদ্রের কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক প্রাচী। কি সব উল্টোপাল্টা বলছে সমুদ্র। কিছুক্ষণ বাদেই প্রাচী খেয়াল করে সমুদ্র নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় নিজের ভেতরে পুষে রাখা যন্ত্রণা গুলোকে অশ্রুর সাহায্যে ব্যক্ত করছে। এ প্রথম সমুদ্রকে কান্না করতে দেখে প্রাচী। প্রাচী খুব ভালো করেই জানে সমুদ্র খুব স্ট্রং; কিন্তু এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে তার মন ও বিষন্ন হয়। আলতো করে নিজের হাত সমুদ্রের চিবুক ছুঁয়ে দিতেই মাথা তুলে তাকায় সমুদ্র।
– “কি হয়েছে সমুদ্র? আপনি কেন এসব বলছেন?”
– “আমি তোমাকে হারাতে পারব না মেহু পাখি! কোনোভাবেই না। তোমাকে হারালে আমি বাঁচব কি করে? প্লিজ এমনটা করো না; চলো এক কাজ করি। বাচ্চা তো পরেও হবে তাইনা? চলো এখন বেবি দুটো এবোরশন করে ফেলি।”
সমুদ্রের এমন ভয়ঙ্কর রূপী কথাবার্তা কর্ণপাত হতেই ভয়ে আতকে দু কদম পিছিয়ে যায় প্রাচী। তড়িৎ গতিতে নিজের দুটো হাত দিয়ে নিজের পেট আঁকড়ে ধরে সে। কি বলছে এসব সমুদ্র?
– “আপনার মাথা ঠিক আছে সমুদ্র? কি সব বলছেন এসব? আপনি আমার বাচ্চাদের মেরে ফেলতে চাইছেন!”
– “না, না মেহু পাখি! আমি বেবিদের মারতে চাই না; আমি তো শুধু তোমাকে বাঁচাতে চাই। চলো না প্লিজ।”
– “আপনার মাথা ঠিক আছে? আপনি কি পাগল হয়ে গিয়েছেন? এই বেবি আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন সমুদ্র; আর সেই চিহ্ন কেই আপনি নিঃশেষ করে দিতে চাইছেন? এই আপনার ভালোবাসা! ছিঃ সমুদ্র ছিঃ!”
সমুদ্রের দিকে ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে প্রাচী। এদিকে সমুদ্রের হাল বিধ্বস্ত। চোখ দুটো টকটকে লাল। রাগে ক্ষোভে পাশে থাকা টি টেবিলে সজোরে লাথি মারতেই সেটা ছিটকে পড়ে সুদূরে। এতে আরো একধাপ ভয়ে জড়সড় হয়ে যায় প্রাচী।
– “তুমি মানবে না তো আমার কথা? তুমি করবে না এবোরশন তাই তো?”
– “না আমি মানব না আপনার কথা! আমি নিজ হাতে আমার বাচ্চাদের শেষ করে দিতে পারব না। এতে যদি আমার নিজের ও শেষ হয়ে যেতে হয় তাহলে তাও করব। আপনি আর এখন আমার সেই সমুদ্র নেই। আস্ত একটা বিবেকহীন মানুষে পরিণত হয়েছেন আপনি!”
– “আমার কথা মানবে না তুমি? ঠিক আছে না মানো! থাকো তোমার বেবিদের নিয়ে! আমিও আর থাকব না তাহলে এখানে!”
বলেই আর এক মুহূর্তও দেরি করে না সমুদ্র। হনহনিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। এদিকে এতক্ষণ ঘটে যাওয়া ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে অঝোরে কান্না করতে করতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে প্রাচী। জীবন তার এমন কঠিন পরীক্ষা নিচ্ছে কেন?
৭৪.
সকালের আলো ফোটার পর পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় প্রাচী। ফ্যানের বাতাস থাকা সত্ত্বেও দর দর করে ঘামছে সে। চোখ খোলার পর নিজেকে বেডরুমে আবিষ্কার করতেই একপ্রকার হুড়মুড় করে উঠে বসে সে। পাশে তাকাতেই ব্যালকনিতে সমুদ্রকে বসা অবস্থায় দেখতে পায় প্রাচী। গতকাল রাতের কথা মনে পড়তেই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে এককোণে চুপচাপ জড়সড় হয়ে চুপটি মেরে বসে থাকে সে। সমুদ্র ও প্রাচীকে উঠে যেতে দেখে নিজেও উঠে পড়ে। গতকাল রাতের পর থেকেই মেয়েটা যথেষ্ট ভয় পেয়েছে আর এ সময় এমন ভয়, টেনশন প্রাচীর স্বাস্থ্যে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। ধীর পায়ে উঠে গিয়ে প্রাচীর সামনে দাড়াতেই প্রাচী মাথা তুলে তাকায়। সমুদ্রের চোখ মুখ রক্তিম হয়ে আছে, চোখ দু’টো অশ্রুসিক্ত। হয়তো অনেকক্ষণ যাবৎ কান্না করেছে তাই। ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রাচী কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই সমুদ্র গিয়ে ছোট বিড়াল ছানার মতো প্রাচীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
প্রাচী উপলব্ধি করে সমুদ্র আবারো অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত।
– “আ’ম সরি মেহু পাখি! আমি কাল রাতে তোমাকে ইচ্ছে করে হার্ট করতে চাই নি। আমি সত্যি বলছি; আমি আমাদের বেবিদের কোনো ক্ষতি করতে চাই না। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তোমাকে হারানোর ভয় জেঁকে বসেছিল। কি করব বলো? ডক্টরের কথা শুনে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার তাইতো নেশায়, রাগে কাল রাতে ওসব বলেছি। আ’ম রিয়্যালি সরি মেহু পাখি! প্লিজ মাফ করে দাও। আই প্রমিজ আর কখনো তোমাকে, বেবিদের হার্ট করব না। প্লিজ!”
বলেই ছোট বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সমুদ্র। প্রাচীও নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে। এখন শুধু অপেক্ষা সময়ের চক্রের; সামনে কি ঘটবে তা আদৌ কারো জানা নেই।…………
#চলবে 🍂