সায়াহ্নের 🦋 পর্ব-২৬

0
2840

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ষট্বিংশ_পর্ব (অন্তিম খন্ডাংশ-৩)

৭৫.
সেদিনের পর থেকে প্রতিটি মুহূর্তই সমুদ্র প্রাচীর পাশে থেকেছে। প্রাচীর প্রেগন্যান্সির কম্প্লিকেশন সম্পর্কে মিসেস কোহিনুর চৌধুরী অবগত হতেই প্রাচীর বিশেষ খেয়াল রাখা শুরু করেছেন। কোন সময় কোনটা লাগবে তা নিয়ে সবসময় নজরে রাখেন তিনি। সমুদ্র ও সবসময় চোখে চোখে রাখে প্রাচীকে আর এটাও খেয়াল রাখে যাতে কোনো প্রকার টেনশন না করে সে। আর এতসব পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রাচীও আগের চেয়ে বেশ খানিকটা ই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
আর এসবের জন্য অফিস থেকে তিন মাসের ছুটিও নিয়েছে সমুদ্র; কেননা সাদাত চৌধুরী নিজেই তাকে এ আদেশ দিয়েছেন। এভাবেই আরো কেটে গিয়েছে চার মাস। এই তিন মাসে প্রাচীর শরীরেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। টুইন বেবি থাকার কারণে পেট আগের চেয়ে দ্বিগুণ বড় হয়েছে, হাত পায়ে পানি এসেছে, মুখের লাবন্যতাও‌ বৃদ্ধি পেয়েছে বেশ কয়েক গুণ। যার ফলস্বরূপ হাঁটাচলা করতেও বেশ অস্বস্তিতে ভুগতে হয় প্রাচীর। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত ছিল প্রাচী‌। তখনই এক প্লেট ভর্তি বিভিন্ন ফল নিয়ে রুমে প্রবেশ করে সমুদ্র। আয়নার সামনে উদাসীন চেহারায় প্রাচীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে যায় প্রাচীর দিকে।

– “কি হয়েছে মেহু পাখি? চেহারায় এমন উদাসীন উদাসীন ভাব কেন? মন খারাপ?”
পেছন থেকে প্রাচীকে জড়িয়ে ধরে বেশ আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে সমুদ্র।
– “মন খারাপ হবে না কেন? দেখুন না দিন দিন কি হাল হচ্ছে; গাল দুটো ফুলে কেমন টমেটোর মতো হয়েছে!”
বেশ মন খারাপ নিয়ে নিচু কন্ঠে বলে উঠে প্রাচী।
– “কে বলেছে আমার মেহু পাখিকে খারাপ দেখা যায়; আমার মেহু পাখি তো দিন দিন আরো বেশি কিউট হয়ে যাচ্ছে।
লিসেন‌ প্রাচী প্রেগন্যান্সির সময় এগুলো খুবই কমন বিষয়‌। আর এটা ভুলে যেও না তোমার ভেতর একটা না বরং দু দুটো বেবি বেড়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। তাই মন খারাপ করো না। এখন লক্ষী মেয়ের মতো এগুলো খেয়ে নাও।
বিকেলে তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।”

সারপ্রাইজের কথা শুনতেই খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠে প্রাচী। সমুদ্রের বলা কথাগুলো উপলব্ধি করাতে মন খারাপ নিমিষেই কর্পূরের মতো মিলিয়ে যায়। বাধ্য মেয়ের মত চেয়ারের উপর বসতেই পিহু দৌড়ে প্রাচীর কাছে চলে আসে। প্রাচীও‌ আগলে নেয় পিহুকে‌।
রাতে ক্লান্ত শরীরে বেঘোরে ঘুমাতে ব্যস্ত ছিল সমুদ্র। বিকেলের দিকে বেশ অনেকদিন পর প্রাচীকে নিয়ে লং ড্রাইভে বের হয়েছিল সে। প্রাচীকে খুশি রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। সারা বিকেল ঘোরাঘুরি করার পর রাতের ডিনার করেই বাসায় ফিরেছে।

হঠাৎ পাশ থেকে কারো কান্নার আওয়াজ পেতেই ঘুমের মধ্যেই ধড়ফড় করে উঠে বসে সমুদ্র। দ্রুত পাশ ফিরে তাকাতেই খেয়াল করে প্রাচী উঠে বসে চুপচাপ কান্না করেই‌ যাচ্ছে। এতে ভয়ে আতকে উঠে সমুদ্র। বিচলিত হয়ে দ্রুত প্রাচীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
– “প্রাচী কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছো? শরীর খারাপ লাগছে? হসপিটালে যাবে?”
প্রাচী মাথা দু’পাশে নাড়িয়ে না বোঝায়। প্রাচীর উত্তর পেয়ে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চুপ থাকে সমুদ্র। অতঃপর চোখ দুটো ছোট ছোট করে বলে উঠে,
– “খিদে পেয়েছে?”
প্রাচীও ছোট বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে সম্মতি জানায়‌। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রাচীর অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে দেয় সমুদ্র। এ কয়েক মাসে প্রাচী আরো অনেকবার এমন করেছে‌। রাতবিরেতে হুটহাট উদ্ভট সব আবদার করেছে। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হবে না বোধহয়।
– “কি খাবে?”
– “আইসক্রিম!”
প্রাচীর উত্তর শুনে চোখ দুটো বড় বড় করে নেয় সমুদ্র। ঘড়িতে রাত তিনটে বাজে। এত রাতে আইসক্রিম কোথায় পাবে সে? ফ্রিজে রাখা সব আইসক্রিম ও তো বোধহয় শেষ হয়ে গিয়েছে। মুখটাকে যথেষ্ট অসহায় করে প্রাচী বলে উঠে,
– “আইসক্রিম? এত রাতে? বলছিলাম কি মেহু পাখি এত রাতে আইসক্রিম খাওয়া মোটেও ঠিক না; ঠান্ডা লেগে গেলে বেবিদের প্রবলেম হতে পারে। আর বাইরে থাকা বাদবাকি সব দোকানপাট ও বন্ধ। আমি না হয় অন্য কিছু নিয়ে আসি।”
অন্যসব দিন হলে সমুদ্রের কথা শুনে প্রাচীর মেজাজ বিগড়ে গেলেও আজকে তার সম্পূর্ণ বিপরীত ই ঘটলো‌। সমুদ্রের উত্তর পেয়ে প্রথমে মন বিষণ্ন হলেও পরমুহূর্তেই তা কাটিয়ে প্রাচী পুনরায় বলে উঠে,
– “আচ্ছা ঠিক আছে; আমি যেকোনো একটা ডেজার্ট খাব!”
প্রাচীর কথা শুনে অবাক হলেও সম্মতি জানিয়ে ধীর পায়ে খাট থেকে নেমে দ্রুত রুমের বাইরে চলে যায় সমুদ্র।

৭৬.
শুক্লাদ্বাদশীর‌ রাত্রি। জানালা থেকে হিমশীতল শো শো বাতাস ক্রমেই রুমে প্রবেশ করছে‌। শরীরে বেশ শীত অনুভূত হওয়ায় বিরক্ত হয় প্রাচী। বিছানা থেকে ধীর পায়ে নেমে সামনের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ ডোরমেটে‌ পা পিছলে যেতেই নিচে পড়ে যায় প্রাচী। নিচে পড়ে যেতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় প্রাচীর। যন্ত্রণায় শরীর অচেতন, অসাড় হয়ে আসছে ক্রমশ। চোখ দিয়েও নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসতেই মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে,
– “স,স্,সমুদ্র!”

বাটি ভর্তি পায়েস নিয়ে খুশিমনে রুমে প্রবেশ করে সমুদ্র। কিন্তু রুমের কোথাও প্রাচীকে দেখতে না পেয়ে তার ভেতরটা ধক করে ওঠে। প্রাচী ঠিক আছে তো? দ্রুত পায়ে এগিয়ে রুমের লাইট অন করতেই সামনে প্রাচীকে পড়ে থাকতে দেখে হাত থেকে বিস্ময়ে বাটি পড়ে যায় মেঝেতে সমুদ্রের। অবাক চাহনিতে প্রাচীর দিকে তাকিয়ে পলক ফেলতেও ভুলে যায় সে।

রাত ৩ টা বেজে ৪৫ মিনিট। হসপিটালের করিডোরের সামনে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে একদৃষ্টে নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সমুদ্র। দ্রুত হৃৎস্পন্দন হচ্ছে তার। পাশেই কোহিনুর চৌধুরী, সাদাত চৌধুরী ও আছেন। পুরো চৌধুরী পরিবার ই বিষাদগ্রস্ত। আনোয়ার সাহেবকে ও ফোন করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। একটু আগেই প্রাচীকে হসপিটালে এনে ইমার্জেন্সি অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করানো হয়। ডক্টর, নার্স সবাই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে প্রাচীকে নিয়ে।
হঠাৎ অপারেশন থিয়েটারের ভেতর থেকে ডক্টর আয়েশা বের হতেই সমুদ্র দ্রুত এগিয়ে যায় তার কাছে।

– “ডক্টর? কি হয়েছে? প্রাচী কেমন আছে? ও ঠিক আছে তো?”
– “নো মিস্টার জুনায়েদ! শি ইজ নট ফাইন। প্রাচীর অবস্থা অনেক ক্রিটিক্যাল। আপনাকে আমি আগেই ওয়ার্ন করেছিলাম যে প্রাচীর প্রেগন্যান্সিতে বেশ কম্প্লিকেশন‌ আছে; তারপরও এত বড় একটা এক্সিডেন্ট!
উই উইল ট্রাই আওয়ার বেস্ট মিস্টার জুনায়েদ। বাট,,”
ডক্টর আয়েশা আরো কিছু বলতে যাবে তখনই ভেতর থেকে আরো একজন নার্স বেরিয়ে আসে।
– “ডক্টর তাড়াতাড়ি ভেতরে চলুন। মিসেস প্রাচীর পালস রেট কমে যাচ্ছে।”
– “ওহ শিট! দিস কেস ইজ গোয়িং টু বি ভেরি ক্রিটিক্যাল! মিস্টার জুনায়েদ, এক্সকিউজ মি!”
বলেই আর এক মুহূর্তও দেরি করলেন না ডক্টর আয়েশা। দ্রুত ওটির ভেতরে চলে গেলেন।

দীর্ঘ সময় ধরে বাইরে সবাই ওয়েট করছে‌। ইশরাক, আনোয়ার সাহেব ও এসে উপস্থিত হয়েছেন ইতোমধ্যে। ইশরাক সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে সাহস দিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র তার অনুভূতিহীন পাথর শরীরটাকে নিয়ে এক কর্ণারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সময় যেন ফুরাচ্ছেই না।
– “এখানে মিসেস প্রাচীর হাজবেন্ড কে?”
একজন নার্সের কথায় মাথা তুলে তাকায়। নার্স হাতে ফাইল নিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে উপস্থিত মানুষগুলোর দিকে।

– “জি আমি। আমি প্রাচীর হাজবেন্ড। নার্স প্রাচী ঠিক আছে? আমার বাচ্চা?”
– “মিস্টার জুনায়েদ প্লিজ সাইন হেয়ার! আমাদের হাতে সময় খুবই কম।”
বলেই হাতে থাকা ফাইলটি সমুদ্রের দিকে এগিয়ে দেয় নার্স।
– “সাইন? কিন্তু কেন?”
– “মিস্টার জুনায়েদ আপনার ওয়াইফ এবং বেবিদের অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারে। এখন শুধু যেকোনো দুজনকেই বাঁচানো যাবে। আপনি এখানে সই করে দিন আর বলুন মা ও বাচ্চাদের মধ্যে কাদের বাঁচাতে চান।
আর পেপারটাতে লিখা আছে অপারেশন চলাকালীন সময়ে মিসেস প্রাচীর কিছু হয়ে গেলে তার দায়ভার হসপিটাল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করবে না।”
নার্সের কথা কর্ণপাত হতেই শরীর হিম হয়ে আসে সমুদ্রের। এক মুহূর্তের জন্য তার পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসে। বাকি সবার অবস্থাও বেশ নাজেহাল।
জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছে সমুদ্র। ঠিক কি করবে, কি সিদ্ধান্ত নিবে তার জন্য মাথা কাজ করছে না। কি করে পারবে মা ও বাচ্চাদের মধ্যে যেকোনো দুজনকে বাঁচাতে।

৭৭.
– “আচ্ছা সমুদ্র কখনো যদি এমন হয়; ডক্টর আয়েশার কথা সত্যি হয় তখন আপনি কি করবেন?”
প্রাচীর বলা কথা শুনে মাথা তুলে তাকায়‌ সমুদ্র।
– “হুসস! এমন কথা আর মুখেও আনবে না। এমনটা কখনোই হবে না।”
– “আচ্ছা মানলাম। কিন্তু কখনো যদি এমনটা হয় প্লিজ কথা দিন আপনি সবার আগে আমাদের বাচ্চা দুটোকে বাচাবেন‌।”
– “প্রাচী!!”
সেদিন প্রাচীর জেদের কাছে হার মেনে কথা দিয়েছিল সমুদ্র। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল প্রতিনিয়ত।

চার মাস আগের কথা মনে পড়তেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা শুরু করে সমুদ্রের। কে জানত তার দেয়া কথাটা এভাবে সত্যি হয়ে যাবে।

– “স্যার, প্লিজ জলদি করুন। আমাদের হাতে সময় নেই।”
নার্সের কথা শুনে ভাবনার সুতো কাটে সমুদ্রের।
– “বেবি! বেবিদের বাঁচান!”
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে নার্সকে উদ্দেশ্য করে বলেই হাতে থাকা পেপারটাতে সাইন করে দেয় সমুদ্র। সমুদ্রের এহেন সিদ্ধান্তে চৌধুরী আর হোসেন পরিবারের সবাই হতবাক। তবে কি প্রাচী ফিরবে না আর কোনোদিন?………

#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here