উপন্যাস প্রপর্ণ, পর্ব-১

0
7687

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(১)
#কুরআতুল_আয়েন

আশাকুঞ্জ নিবাসে বিয়ের আমেজ যেনো দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।বিনার বিয়ের সাথে সাথে বেলীরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে।বিনার বিয়েটা পরিবার থেকেই ঠিক করা হয়েছিলো।কিন্তু বেলী তো এইরকম কিছুই আশা করে নি।নিজের চাচাতো বোনের বিয়ের সাথে সাথে নিজেও এক অজানা মানুষের সাথে পবিত্র বন্ধনে আবব্ধ হয়ে গিয়েছে।বেলীর পাশে বসা বুরাগের মাথাটা যেনো রাগে শিরশির করছে।বেলী একবারও তার পাশে বসা লোকটির দিকে থাকানো পর্যন্ত সাহস পেলো না।লোকটি যে খুব রগচটা তা বেলীর জানা।একটু দূরে বসা বিনার দিকে তাকালো।বিনা কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে তার সদ্য বিবাহিত বর আক্কাসের সাথে।অবশ্য তাদের হাসি মুখটা দেখে বেলীরও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।যাক অবশেষে বিনা খুশি থাকলেই হলো।মেয়েটা পড়াশোনায় খুব অবাধ্য।পড়াশোনা একদমই করতে চায় না।বিয়ের আগের দিনেই বিনার সাথে বেলীর কথোপকথন ছিলো এইরকমঃ

–“আমার বিয়ে হয়ে যাবে বলে তোর খুব হিংসে হচ্ছে তাই না।”

তখন বেলী বিছানা গুছাতে ব্যস্ত।বিনার বিয়ের জন্য কলেজ থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েছিলো।পিছনে ফিরে বিনার দিকে তাকালো।বিনা মুখটাকে অদ্ভুত করে রেখেছে।মেয়েটা ফর্সা কিন্তু মাথার চুল গুলো খুব কোঁকড়ানো।বেলীর খুব পছন্দ কোঁকড়া চুল।কিন্তু,তার চুল গুলো অনেক লম্বা,সোজা আর কিচকিচা কালো।বিছানা গুছানো বাদ দিয়েই বেলী বিনাকে হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলো।বিনা হাত টাকে জোর করে ছাড়িয়ে নিলো।অনেকটা ঠেস দিয়ে বললো,

–“কিরে বললি না তো।আমার যে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে তোর অনেক হিংসা হচ্ছে তাই না।আমি ভালো ঘর পাচ্ছি,আক্কাসের মতো একটা ভদ্র জামাই পাচ্ছি।বিয়ের পর আক্কাসের সাথে বিদেশে পাড়ি জমাবো।এইজন্য তোর পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তাই না।’

তখন বেলী শুধু মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিলো,

–“আমি কেনো হিংসা করতে যাবো তোকে।তুই শুধু আমাকে ভুল বুঝেই গেলি বুনি।আমি তো শুধু তোকে বলেছিলাম বিয়ে টা পরে কর আগে অত্যন্ত কলেজ টা পাশ কর।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো বেলী।খুব ইচ্ছে ছিলো পড়াশোনা করে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া।কিন্তু,তার আগেই একটা কালো ঝড় এসে সব কিছু উলোটপালোট করে দিয়েছে।আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিকে খোঁজার চেষ্টা করছে।কিন্তু,বেলীর আশা নিরাশা হয়ে গিয়েছে।চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলো।বুরাগ আর না পেরে উঠে দাঁড়ালো।আফিয়া এতোক্ষণ চিন্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন একপাশে।যেটার ভয় পাচ্ছিলো সেটাই হলো।বুরাগকে উঠতে দেখে এমনেই মনের ভিতর ভয় জেঁকে বসেছে।মনের মাঝে শুধু একটাই প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি বাইছে ছেলেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে কি উনি কোনো ভুল করে ফেলেছেন।কিন্তু,ছেলেকে এইভাবে চোখের সামনে কষ্ট পেতে দেখলে কোনো মা ঠিক থাকতে পারেন না।উনি খুব তাড়াহুড়ো করে বুরাগের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।বুরাগকে নিয়ে বাড়ির সামনের উঠোন টায় গিয়ে দাঁড়ালেন।বেলী তাদের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।বুরাগ রাগে ফোসফাস করছে।রাগ টাকে সামলাতে না পেরে উঠোনে রাখা চেয়ারটায় জোরে একটা লাথি মারলো।যার ফলে চেয়ারটা ছিটকে গিয়ে দূরে পড়লো।আফিয়া ছেলের এমন রাগের সাথে পরিচিত।

–“কি করছো তুমি বুরাগ।এইভাবে রাগ দেখানোর মানে কি?”

বুরাগ তেজী চোখে মায়ের দিকে তাকালো।নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিলো মা’কে অনেক কথা শুনাবে।কিন্তু,মায়ের মুখে তুমি সম্বোধন টা শুনে নিজের রাগ টাকে কিছুটা মিহিয়ে নিয়েছে।তাও অনেকটা রগচটা হয়ে বললো,

–“মা কাজ টা তুমি ঠিক করো নি।হুট করে ওই মেয়ের সাথে বিয়েটা দিয়ে তুমি একদম ভালো করো নি।আর তুমি তো জানো মা স্নিগ্ধার ধোঁকা দেয়ার পর থেকে আমি আর কোনো মেয়ের সাথে নিজেকে জড়াতে চায় নি।”

–“আমি যা করেছি তোমার ভালোর জন্য করেছি।মা হই আমি তোমার।কালকেই বেলীকে নিয়ে ঢাকায় রওনা দিবো।”

বুরাগ একটা তাচ্ছিল্যেময় হাসি দিয়ে বললো,

–“নিয়ে এসেছিলে ছোটআম্মুর ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে আর এখন ছোটআম্মুর আরেক ভাইয়ের মেয়েকে আমার গলায় জোরজবরদস্তি করে ঝুলিয়ে দিলে।”

আফিয়া ছেলের এমন বেসামাল কথায় অনেকটাই চটে গেলেন।না পেরে বুরাগের গালে সটান করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন।

–“কিসব বলছো তুমি বুরাগ।ঝুলিয়ে দিয়েছি মানে কি।বেলী তোমার কপালে ছিলো তাই তোমার সাথে বিয়ে নামক বন্ধনে যুক্ত হয়েছে।বেলী নিজেও তো ইচ্ছে করে বিয়ে করতে আসে নি।চেয়ারম্যানের ছেলে করিমের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাকে বাধ্য হয়ে এই বিয়েটা করতে হয়েছে।ভুলে গেলে তুমি চেয়ারম্যানের ছেলে করিম কি করতে চেয়েছিলো বেলীর সাথে।”

–“তোহ!সমস্যা সমাধান।ঢাকায় নিয়ে গিয়ে আমি ওই মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো আর তুমি না হয় তাকে নিজের কাছে রেখে দিও।তাহলে ওই করিমের হাত থেকে বাঁচাও হয়ে যাবে।আর,স্নিগ্ধা আমার সাথে প্রতারণা করলেও ওর জায়গা টা আমি কাউকে দিতে পারবো না।’

–“আমার চোখের সামনে থেকে যাও বুরাগ।তোমাকে দেখলেই আমার এখন রাগ লাগছে।”

বিনার বিদায়ের পালা।বিদায় নিতে নিতে একটু বিকেল হয়ে গেলো।বাহিরের এতোক্ষণ ঝুম বৃষ্টি হয়েছিলো।এই বৃষ্টিতে আক্কাসের পরিবার বের হতে চায় নি।তাও আবার গ্রামের রাস্তা।বিনা চলে যাওয়াতে বিনার মা রেহানা বিলাপ করে কান্না করলেও বিনার চোখ দিয়ে একফোঁটাও পানি বের হলো না।বরং,বিনা আক্কাসের হাত ধরে দিব্বি হেটে চলে গেলো গাড়ির সামনে।বেলী দূর থেকে বিনাকে দেখছে।বেশ খানিকটাই অবাক হচ্ছে বিনাকে দেখে।যে-কেউ দেখলে বুঝবে বিনা আর আক্কাসের সম্পর্ক টা আগে থেকেই ছিলো।কিন্তু,তা সম্পূর্ণ ভুল।এমনকি বিয়ের আগে না হয়েছিলো তাদের কোনো কথাবার্তা।যখন আক্কাস দেখতে এসেছিলো তখনই শুধু দেখা হয়েছিলো।এতো ভিড়ের মাঝে বেলী একজনকে আগ্রহসহকারে খুঁজছে।কিন্তু,মানুষটির দেখা এখনো মিলে নি।একটু দূরে শিউলি কে দেখে জোরে ডাক দিলো।শিউলি বেলীর ডাক অনুসরণ করে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।শিউলি যেতেই বেলী তাড়া দিয়ে বললো,

–“শিউলি আম্মা কোথাও?আম্মাকে অনেকক্ষণ হলো দেখি নি।”

–“আপা!আম্মা লেবু গাছের দিকে দাঁড়িয়ে আছে।”

–“ঠিকাছে তুই যা!”

শিউলি বেলীর হাত থেকে ছাড়া পেয়ে দৌড়ে চলে গেলো ভিড়ের দিকে।বিনার বিদায়ের সাথে সাথে এইখানের মানুষজনও কমে গিয়েছে।মানুষজনের কোলাহল না থাকায় বেলী গুটিগুটি পায়ে লেবু গাছের দিকটায় এগিয়ে গেলো।

জাবেদা লেবু গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছেন।লেবু গাছটার চারপাশে সারি সারি গন্ধরাজ ফুল গাছ।চারপাশ টা গন্ধরাজের ফুলের গন্ধে মো মো করছে।নিচে কড়ি কড়ি লেবুর ফুল গুলো পড়ে আছে।সাথে মজে যাওয়া লেবুর শুকনো পাতা।বেলী জাবেদার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো।হুট করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।শান্তশিষ্ট এমন একটা পরিবেশে এমন হওয়ায় জাবেদা বেশ খানিকটাই চমকে উঠলেন।পিছনে ফিরে বেলীকে দেখে হৃদয়ের গহিনে এক অজানা কষ্টের রেখা জমা হয়েছে।বেলী কান্নারত অবস্থায় বললো,

–“আম্মা আমি তো পড়তে চেয়েছিলাম।বিয়ে নামক কোনো বন্ধনে আবব্ধ হতে চাই নি।তুমিও তো চেয়েছিলে আমি যেনো পড়াশোনা করে অনেক বড় হই।”

জাবেদা নির্বাক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছেন বেলীর দিকে।এমন একটা পরিস্থিতি আসবে সেটা কোনোদিনও মাথায় আনেন নি।কিন্তু,চেয়ারম্যানের ছেলে করিমের দিন দিন যেনো বেলীর প্রতি বাজে আকর্ষণ বেড়েই যাচ্ছিলো।সেই সাথে হুমকি তো আছেই।আর বুনির বিয়েতে হওয়া কান্ড টা মনে পরতেই হাত পা এমনেই জমে যায় জাবেদার।বেলী এখনো আগের মতো ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।জাবেদা মুখে শুষ্ক হাসি টেনে বললেন,

–“এতো কান্না করছিস কেন তুই।কপালে যা ছিলো তাই হয়েছে।সব কিছুর সাথে মানিয়ে চলতে শিখ।এখন থেকে তোর অনেক দায়িত্ব।শ্বশুড় বাড়ির সবার কথামত তোকে চলতে হবে।”

বেলী খুব অবাক হচ্ছে জাবেদার কথা শুনে।মা’র মুখে এমন অযৌক্তিক কথা শুনে বেলী অনেকটাই হতাশা হয়ে যায়।সবসময় তো তাকে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ জাগিয়েছে। আর,আজকে সংসারের প্রতি।সব কিছুই যেনো তার কাছে কেমন ধোঁয়াশা লাগছে।তবে ভিতর টায় অনেক ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে।একরাশ অভিমান নিয়ে তাকালো জাবেদার দিকে।জাবেদা বেলীর চোখে লেপ্টে থাকা পানিটুকু মুছে দিলো।

–“বেলী তুই এইখানে।চল তোর শাড়ি টা পাল্টে দিবো।বুনির বিদায় দিয়ে এসেছি।বড় ভাবি আর ভাইজানের মন টা একদম ভেঙে গিয়েছে।যতোই হোক মেয়ে তো।’

কোহিনূরের কথায় জাবেদা আর বেলী পাশে ফিরে তাকালো।কোহিনূর তাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন।বেলী চোখ দুটো চটপট করে মুছে নিলো।জাবেদা কোহিনূরের দিকে তাকিয়ে বললেন,

–“হ্যাঁ কোহিনূর নিয়ে যাও।একটু কষ্ট করে আমার আলমারি থেকে লাল খয়েরী শাড়ি টা বের করে পরিয়ে দিও।আমার অনেক কাজ বাকি আছে।”

–“ছোট ভাবি তুমি দাঁড়াও।আর বেলী তুই গিয়ে সোজা ছোট ভাবির রুমে গিয়ে বসবি।আমি এখনি আসছি।”

বেলী একবার জাবেদার দিকে তাকালো।চোখ নামিয়ে কোহিনূর কে বললো,

–“ঠিকাছে ফুপি”

বেলী আগের মতোই গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো।বেলী চলে যেতেই কোহিনূর আস্বস্ত করে জাবেদা কে বললেন,

–“ছোট ভাবি তুমি একদম চিন্তা করো না বেলীকে নিয়ে।আমাদের বুরাগের মনটা অনেক ভালো।রাগটা একটু বেশি আমার ভাসুরের মতো।তবে আফিয়া ভাবি বেলীকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসবেন।ভাবির অনেক আগে থেকেই ইচ্ছা ছিলো আমাদের বেলীকে বুরাগের জন্য বউ করে নিয়ে যাওয়া।অবশ্য আমারও ইচ্ছা ছিলো।”

জাবেদা মুখে হাসি টেনে বললেন,

–“তোমার আর আফিয়া আপার ভরসাতেই আমি আমার বেলীকে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছি।”
————-
বেলীকে খুব সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে কোহিনূর।লম্বা চুল হওয়ায় কোহিনূর খুব হিমশিম খাচ্ছে।তাও কোনো মতে হাত খোপা করে দিয়েছে।চুল গুলো ঝরঝরে হওয়ায় খোপাটা ঢিলে হয়ে ঘাড় অবধি এসে আটকে আছে।গলায় চিকন একটা চেইন,কানে দুল আর হাতে চিকন বালা।সবই জাবেদা টুকটাক করে বানিয়ে রেখেছিলেন বেলীর জন্য।অবশ্য আরো কিছু বানাতে চেয়েছিলেন কিন্তু হাতে টাকা না থাকায় আর বানাতে পারেন নি।বেলী খুব উশখুশ করছে।তার মনের ভিতর কেমন যেনো ভয় ভয় করছে।সাথে হৃদপিন্ডের ধুকধুকানি।কোহিনূর বেলীর দিকে ভ্রুকুটি কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,

–“কিরে!তুই এমন নাড়াচাড়া করছিস কেন?”

কোহিনূরের সাথে বেলীর স্বভাব খুব বন্ধুত্বপূর্ণ।বেলী কোহিনূরের দিকে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো মুখ করে বললো,

–“ফুপি,আমার এইসব পড়তে খুব অসুবিধা হচ্ছে।এখন তো রাত।রাতে আমি ঘুমানোর সময় থ্রিপিস পড়ে ঘুমাই।আমি এইসব পড়ে ঘুমোতে পারবো না।”

বেলীর কথায় কোহিনূর মুচকি হেসে জবাবে বললেন,

–“তুই নতুন বউ।তাই তোকে শাড়ি পড়ে থাকতে হবে।অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে যাবি আস্তে আস্তে।”

বেলী আর কিছু না বলে চুপ করে বসে আছে।এরমধ্যে দরজা ভেদ করে লাঠিতে ভর করে আমেনা বেগম আসলেন।দাদিকে আসতে দেখে বেলী কিছুটা নড়েচড়ে বসলো।না জানি আবার কি কথা শুনিয়ে দেয় তাকে।পিছনে জাবেদা আর আফিয়াও আস্তে করে ঘরে আসলেন।জাবেদা বেলীর দিকে তাকিয়ে আছেন একপলকে।বিয়ে হওয়ার সাথে সাথে কি মেয়েটা তার বড় হয়ে গিয়েছে।লাল খয়েরী শাড়িটায় বেশ মানিয়েছে বেলীকে।হলদে ফর্সা শরীর টা যেনো ফুটে উঠেছে।আমেনা বেগম বেলীর পাশে বসে পড়লেন।বেলীর থুঁতনিটা ধরে মুখটা তোলে বললেন,

–“আমগোর বেলীরে তো সুন্দর লাগতাছে।স্বামীর সোহাগ পাইবি আইজকা রাতে।”

লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো বেলী।মনে মনে বিরবির করছে,আম্মা’র সামনে এইসব কথা না বললেও হতো।দাদি টা যে কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলে না।
জাবেদাও শ্বাশুড়ির কথায় কিছুটা থতমত খেয়ে যান।সেটা বাহিরে প্রকাশ করেন না।চুপচাপ এককোনায় দাঁড়িয়ে আছেন।আমেনা বেগম আবারও বললেন,

–“এতো লাফাইছিলি যে পড়ালেহা শেষ কইরা বিয়া বইবি।তোহ কই গেলো এহন লাফানি।আর তোর মাও তোরে না শিক্ষিত বানাইয়া বিয়া দিতো না।তোর মাও তো শিক্ষিত আছিন পরে কি তার আগের জামাই তারে স্বর্ণ দিয়া মুড়াই রাখছিন।তালাক দিয়া তো ঠিকই বাইর কইরা দিছিন।পরে আইছে না আমার ছোড পোলার কান্ধে।”

শ্বাশুড়ির কথায় নিমিষেই চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠলো জাবেদার।উঠতে বসতে ডিভোর্সি কথাটা শুনতে হয় তাঁকে।ভুল কি তাঁর ছিলো নাকি!তাও সমাজ তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।কিন্তু,বেলীর বাপের সাপোর্ট গুলো তাঁকে মনের ভিতর অনেকটা সাহস জুগিয়েছে।দাদির কথাটা বেলীর কর্ণপাত হতেই চট করে জাবেদার দিকে তাকালো।মা’র চোখে পানি দেখে নিজের চোখ দুটো পানিতে টুইটুম্বুর হয়ে উঠলো।

জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে বুরাগ।আকাশে মেঘের গুড়গুড় আওয়াজ।গ্রাম হওয়ায় এইখানে আর শহরের মতো রুমের সাথে আলাদা বারান্দা নেই।যার জন্য সিগারেট টানতে খুব অসুবিধা হচ্ছে।তাও কষ্ট করে জানালার দিকে কোণঠাসা হয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটে একের পর এক টান দিচ্ছে।ঘর টায় জিনিসপত্র খুব কম।কিন্তু কম হলেও বেশ সুন্দর করে গোছানো।জানালার দিকে তাকিয়ে আজকের ঘটনা গুলোর হিসেব মিলাচ্ছে বুরাগ।দুইদিনও ভালো করে চিনতে পারে নি এই বাড়ির মানুষগুলোকে।তার মধ্যেই এই বাড়ির মেয়ের সাথে বিয়ে নামক বন্ধনে আটকে গেলো।ঠিকমতো যাকে ভালো করে দেখেই নি।আর দেখবেই বা কি করে যতোবারই বুরাগ ভুলবশত ওই মেয়েটির সামনে চলে আসতো ততবারই মেয়েটি নিজের মুখ আড়াল করে নিতো।হঠাৎ স্নিগ্ধার হাসিমুখ টা ভেসে উঠলো বুরাগের চোখের সামনে।ভিতর টা কেমন জ্বালাপোড়া করছে তার।অতীত চাইলেই ভুলা যায় না।সেই একই অবস্থা বুরাগেরও হয়েছে।কিছুতেই নিজের অতীত টাকে ভুলতে পারছে না।কাছের মানুষজনের প্রতারণা গুলো ভিতর টাকে দুমড়েমুচড়ে দিতে সাহায্য করেছে।আনমনে আকাশের কালো মেঘ গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।

বেলীকে দরজা পর্যন্ত নিয়ে আসলো রেশমি।এতোক্ষণ নিজের শ্বাশুড়িকে সামাল দিয়েছিলো।বুনির চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।হুট করেই বিলাপ করে কেঁদে উঠেন।রেশমি ভেবে পায় না এতোই যদি মায়া তাহলে বিয়ে দেয়ার জন্য কেন এতো উঠেপড়ে লেগেছিলো।নিজের কাছেই রেখে দিতো।যাই হোক,রেশমি আর কিছু বলতে চায় না।যতোই হোক শ্বাশুড়ি তো।শ্বাশুড়ি তাকে দেখতেই পারে না।সাথে বুনিও না।আসলেই ননদ ভাবির তেমন একটা মিলে না।বেলী ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বেলীকে দাঁড়াতে দেখে রেশমি বললো,

–“কি হলো!দাঁড়িয়ে পড়লে কেনো?”

বেলী হাত কচলাতে কচলাতে বললো,

–“ভাবি খুব ভয় করছে।”

রেশমি বেলীর সামনের চুল গুলো কানের মধ্যে গুজে দিয়ে বললো,

–“প্রথম প্রথম তো একটু ভয় লাগবেই।আর হুট করেই তোমার বিয়ে টা হয়ে গিয়েছে।তবে এখন তোমার মনে যতোটা ভয় করছে বুরাগ ভাইয়ার সাথে একবার ফ্রী হয়ে গেলে ততোটা ভয় করবে না তোমার।কি বলো তো আমারও না বিয়ের প্রথম রাতে খুব ভয় হয়েছিলো।যখন তোমার তামিম ভাইয়া রুমে আসে তখনি আমি ভয়ে আরো জমে যাই।পরে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।”

বেলী কিছু বলে না শুধু মাথা দোলায়।যতোই রেশমি ভাবি আস্বস্ত করুক না কেন তাও মনের ভিতর এক অজানা ভয় কাজ করছে।রেশমি বেলীকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো।

বেলী ঘরে ঢুকে চুপচাপ এককোণায় দাঁড়িয়ে আছে।দরজাটাও লাগায় নি।দরজার ক্যাটক্যাট আওয়াজে বুরাগ পিছনে ফিরে তাকালো।দরজার কিছুটা সামনে বেলীকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাথাটা যেনো রাগে ভর করে উঠলো।হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেট টা জানালার গ্রিল ভেদ করে দূরে ফেলে দিলো।ধপাধপ্ পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে দরজা টা ঠাস করে লাগিয়ে দিলো।এতে বেলী কিছুটা কেঁপে উঠলো।বুরাগ আর কিছু না বলে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো।বেলী আহাম্মক এর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই আছে।সে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।হঠাৎ করেই আকাশে গুড়গুড় মেঘের গর্জনের তান্ডব টা যেনো বেড়ে উঠলো।মেঘের গর্জনের সাথে জোড়ালো বাতাসের খেল।বাতাসের ঝাপটায় জানালার ছোট ছোট দরজা গুলো একটু পর পর বাড়ি খেয়ে উঠছে।বেলী দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেলো জানালার কাছে।বাতাসের ঝাপটা আগের থেকে এখন বেশি হচ্ছে।কেমন শো শো করে শব্দ হচ্ছে।বাতাসের তাড়নায় বেলীর কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচল টা পড়ে যায়।ঘাড়ে আটকে থাকা চুল গুলো একমুহূর্তেই খোলে যায়।সারা পিঠময় জুড়ে লম্বা কালো চুলের খেল।
বুরাগ এতোক্ষণ চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়ে ছিলো।কিন্তু হঠাৎ করে এমন বাতাসের শো শো আওয়াজ শুনে চোখের উপর থেকে হাত টা সরিয়ে নেয়।তখন বেলীকে জানালার কাছে এগিয়ে যেতে দেখে তার দিকেই চোখ নিক্ষেপ করে তাকিয়ে থাকে।হঠাৎ চোখের সামনে বেলীকে এই অবস্থায় দেখে বুরাগের বুকটা কেমন জানি ধক করে উঠলো।খুব টানছে ওকে।বুরাগ হুট করে শোয়া থেকে উঠে বসলো।আস্তে আস্তে পায়ে এগিয়ে আসছে বেলীর দিকে।বেলী এখনো আগের মতো জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।বুরাগ একদম বেলীর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো।নিজের নাক ডুবিয়ে দিলো বেলীর কালো চুলে।বুরাগের এমন শান্ত স্পর্শ পেয়ে বেলীর সারা শরীর শিউরে উঠলো।নিজেকে একদম শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো।বুরাগ আগের থেকে একটু গভীর ভাবে বেলীর চুলে নাক ডুবিয়ে দিলো।বেলী আর না পেরে সরে আসতে নেয়।এতে বুরাগ অনেকটা রেগে যায়।আচমকাই বেলীর চুলের মুঠি ধরে বেলীর মুখটা নিজের মুখের সামনে ফিরালো।চুলের মুঠিটা অনেক জোরে ধরার কারণে বেলী ব্যথায় চোখ,মুখ কুঁচকে ফেলে।বুরাগ এই প্রথম বেলীকে ভালো করে দেখতে পেয়েছে।নিষ্পলক চেয়ে আছে বেলীর দিকে।চোখের ঘন পাপড়ি গুলো একটু পর পর নড়ে উঠছে।ঠোঁট টা কামড়ে ধরে আছে।বুরাগের কেমন যেন নেশা ধরে যাচ্ছে।কানের কাছে মুখটা এগিয়ে নিয়ে গেলো।ফিসফিসিয়ে বললো,

–“এই মেয়ে তাকাও আমার দিকে।”

বেলী আস্তে করে চোখ খুলে তাকালো বুরাগের দিকে।বুরাগের নিষ্পলক চাহনিতে নিজেও হারিয়ে যাচ্ছে।দুজন দুজনের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে।বুরাগের হাত আপনাআপনি চুলের মুঠি থেকে সরে গিয়ে বেলীর উন্মুক্ত কোমড়ে চলে গিয়েছে।বেলী ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।বুরাগ বেলীর এমন সাড়া পেয়ে হাত টা কোমড় থেকে ছাড়িয়ে আস্তে আস্তে উপরের দিকে বিচরণ করতে লাগলো।বেলী শাড়ি খামচে ধরে আছে।বুরাগের চোখের পলক যেনো পড়ছেই না।মনে মনে আওড়াতে লাগলো,কেন এমন নেশা কাজ করছে ওর প্রতি।আচ্ছা!একটু আদর করে দিলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে!
বুরাগ বেলীকে নিজের কাছে আরেকটু টেনে নিয়ে আসলো।হুট করেই নিজের সিগারেটের পোড়া অধর গুলো বেলীর মসৃণ অধরে চেপে ধরল।পাঁচ মিনিটের মতো চেপে ধরেছিলো বুরাগ।বেলী সরে আসতে নেয়।যার ফলে বুরাগ বেলীর অধরগুলোতে আরেকটু চেপে ধরে।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বেলীর অধর গুলো নিজের স্বাদ মতো শুষে নিতে লাগলো।বেলীর গা গুলিয়ে আসছে।বুরাগের মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ টায় নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না।আর না পেরে কান্না করে দেয় বেলী।বেলীর কান্নায় বুরাগ রেগে যায়।বেলীর ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে বেলীর দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে তাকালো।বেলী আগের মতো কেঁদেই যাচ্ছে।বুরাগ রাগে নিজের হাত দুটো বেলীর ব্লাউজের কাছে নিয়ে গিয়ে টান মেরে ব্লাউজের হুক গুলো খুলে দেয়।বেলী ভয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বুরাগের দিকে।বুরাগ রগচটা হয়েই বেলীকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেয়।বুরাগের এমন আচরণে বেলী মুখে হাত গুজে নিচে বসে পড়ে।চোখের কার্ণিশ বেয়ে উপচে পানি পড়ছে তার।

চলবে..
(ভুল-ত্রুটি হলে ক্ষমার চোখে দেখবেন অনুরোধ রইলো।যেহেতু উপন্যাস একটু ধৈর্য ধরে পড়বেন।রঙতুলি কাল দিবো)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here