#উপন্যাস_প্রপর্ণ(৩৮)
#কুরআতুল_আয়েন
রাতে এপাশ ওপাশ করেও অনামিকা কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারছে না।তার একটাই চাওয়া তা হলো রায়ান।সে যেকোনো মূল্যে রায়ানকে চায়।বাংলাদেশে এসে সে আশ্রমেই উঠেছে।তবে,প্রত্যেক বিকেলে সে রায়ানদের বাসায় আড্ডা দিতে যায়।এই কয়েকদিনে রায়ানের মা,বাবার সাথে অনামিকার সম্পর্ক খুব ভালো হয়ে গিয়েছে।এমনকি,অনামিকা অনেক ইশারা ইংগিতে রায়ানের মা ইমা খানমকে বুঝিয়েছে রায়ানের প্রতি তার দূর্বলতা।কিন্তু,তবুও তার মন শান্ত হচ্ছে না।মনে মনে ভেবে নিয়েছে সে সরাসরি রায়ানের সাথে এইটা নিয়ে কথা বলবে।এখন শুধু সকাল হওয়ার পালা।
————-
রায়ান,খাবার টেবিলে এসে অনামিকা দেখে কিছুটা চমকালো।সকাল সকাল সে অনামিকা কে নিজের বাসায় একদম আশা করে নি।ইদানীং অনামিকার ব্যবহার গুলো তার কাছে খুবই বিরক্তিকর লাগে।রায়ান কোনোমতে খাবার খেতে লাগলো।তার এইখানে বসে থাকতে একদন্ডও ভালো লাগছে না।অর্ধেক খেয়েই উঠে পড়ে রায়ান।রায়ান কে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে রায়ানের মা ইমা খানম কিছুটা ভ্রু কুঁচকিয়ে বললেন,
–“উঠে পড়লে কেনো তুমি রায়ান।পুরোটা শেষ করে যাও।”
রায়ান সোজাসাপ্টা উত্তরে বললো,
–“আমার জরুরি একটা কাজ আছে।এখনোই যেতে হবে।”
–“আজকে তো শুক্রবার।তাহলে,আজকে কিসের কাজ।আর,এইদিকটা তো তোমার বাবা সামলায়।এক কাজ করো!তোমার অফিস যেতে হবে না।অনামিকাকে নিয়ে সময় কাটাও আজকে।একটু বাহির থেকে ঘুরেফিরে আসো।ভালো লাগবে দু’জনেরই।”
রায়ানের খুব রাগ হলো ইমা খানমের উপর।রায়ান না করার আগেই ইমা খানম রায়ানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
–“আমি যা বলেছি তাই হবে রায়ান।যাও,আজকের দিনটা অনামিকার সাথে কাটাও।মেয়েটা অনেকক্ষণ হলো এসেছে।”
ইমা খানমের কথায় অনামিকার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সে তো এটাই চাচ্ছিলো।তার ইচ্ছে করছে ইমা খানমকে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে।আর,এদিকে রায়ানের খুব রাগ হচ্ছে ইমা খানমের কথা শুনে।রায়ান কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না।তাই,সে খুব দ্রুত গতিতে হাঁটতে লাগলো জায়গা প্রস্থান করার জন্য।অনামিকা রায়ানের যাওয়ার পানে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।অন্যসময় তো রায়ান তার সাথে কথা বলতো আর,আজকে পুরোপুরি তাকে এড়িয়ে গিয়েছে।মনে,হয়েছে এইখানে সে নামক কেউ নেই।অনামিকার কাছে রায়ানের হাবভাব খুব খটকা লাগছে।আপাতত,রায়ানের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে অনামিকা।তার একটাই লক্ষ্য ইমা খানমকে নিজের হাতে রাখা।এতে,করে তার রায়ানের বউ হতে বেশি হিমশিম খেতে হবে না।
—-
পড়ন্ত বিকেল।চারপাশে গোধূলির আলো ছেঁয়ে পড়ছে।ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে হাসি আর খুশি।তাদের আজকে কোচিং ছিলো।সামনেই তাদের এসএসসি পরীক্ষা।হাসি আর খুশি নিজেদের মতো হেঁটে যাচ্ছে।হাসি কথার ঝুড়ি খুলে বসলেও খুশি শুধু চুপটি মেরে আছে।বুকে হাত গুঁজে হাসির কথায় শুধু হু হা করছে।
একটা সময় হাসি কথা থামিয়ে দিয়ে খুশির একটা হাত আঁকড়ে ধরে বললো,
–“এই খুশি!ওইটা রায়ান ভাইয়া না?সাথে অনামিকা আপুও আছে।”
হাসির কথা শুনে খুশি চট করে পাশের মাঠটার দিকে তাকালো।হাসির কথা একদমই ঠিক।মাঠের এককোনায় রায়ান আর অনামিকা বসে আছে।শুধু তারা না আরো অনেক কপোত-কপোতীরা বসে আছে।খুশি একমনে তাকিয়ে আছে রায়ান আর অনামিকার দিকে।খুশির হৃদয়ের গহীনে এক অসহনীয় ব্যথা অনুভব করছে।কেনো জানি,সে রায়ানের পাশে অনামিকা নামক মেয়েটিকে একদন্ডও সহ্য করতে পারে না।দেখলেই তার সারা শরীর রাগে শিরশির করে উঠে।শুধু তাই নয় গলা ফাটিয়ে কান্না করতেও ইচ্ছা করে।খুশির এইসব কথার ভাবনার মাঝেই হাসি একপ্রকার টেনে খুশিকে মাঠের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো।খুশি যখন ব্যাপার টা বুঝতে পারলো তখন হাসিকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
–“হাসি আমি যাবো না ওইখানে।তুই যা!”
হাসি নাছোড়বান্দা হয়ে জবাবে বললো,
–“তুই কি বোকা খুশি!কতো একটা সুযোগ পেয়েছি রায়ান ভাইয়াকে ক্ষেপানোর।এইটা কোনোমতেই হাতছাড়া হতে দেওয়া যাবে না।”
–“আমার এইসব ভালো লাগে না হাসি।প্লিজ তুই যা।আমি এইখানে দাঁড়িয়ে আছি।”
–“পাগল নাকি।তুইও যাবি আমার সাথে।দু’জনে একসাথে গেলে ব্যাপার টা বেশ জমবে।”
খুশি না করলেও হাসি একদন্ডও খুশির কথা শুনেনি।বাধ্য হয়েই খুশিকে যেতে হচ্ছে।যতোই রায়ান আর অনামিকার দিকে আগাচ্ছে ততই খুশি ভিতরে ভিতরে কষ্টে জমে যাচ্ছে।
—
রায়ান তার মা’র কথা শুনে বাধ্য হয়ে অনামিকাকে নিয়ে এখানে এসেছে।মা’র উপর তার খুব রাগ হচ্ছে।এদিকে,অনামিকা কথার পর কথা বলেই যাচ্ছে।তবে,অনামিকার একটা কথারও ঠিকঠাক উত্তর দিচ্ছে না রায়ান।মাথা নিচু করে ঘাসের দিকে তাকিয়ে আছে।যা দেখে অনামিকা অনেকটা রেগে যায়।দাঁত কিড়মিড় করে রায়ানকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই হাসি এসে জোর গলায় বলে উঠলো,
–“বিয়ের দাওয়াত পাবো কবে রায়ান ভাইয়া।প্রেম তো দেখছি ভালোই জমেছে।এবার শুধু বিয়ে করার পালা।”
হাসির আওয়াজ পেয়ে রায়ান চমকে তাকালো সামনে।রায়ানের সাথে অনামিকাও অনেক টা চমকে গিয়েছে।হাসির পাশে খুশিকে দেখে অনামিকার রাগ যেনো মাথায় চড়ে গেলো।আর,রায়ান অসহায় চোখ নিয়ে তাকালো খুশির দিকে।খুশিকে দেখে তার মন খুব উশখুশ করছে।রায়ান শুধু একটাই চিন্তা করছে,খুশি তাকে অনামিকার সাথে এইভাবে দেখে কিছু উল্টা পাল্টা ভাবলো না তো!রায়ান আড়চোখে তাকালো খুশির দিকে।খুশির চোখ,মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে বিষন্নতা।যা রায়ানের চোখ এড়ালো না।আচ্ছা!খুশি কি কোনোভাবে তাকে আর অনামিকাকে একসাথে দেখে কষ্ট পাচ্ছে নাকি এইখানে আসার আগে থেকেই তার মুখ,চোখ এইরকম হয়ে ছিলো।কথাটা রায়ান মনে মনে ভেবে একটা ফন্দি আঁটলো।সে একটু খুশিকে বাজিয়ে দেখতে চায়।তাই,অনামিকার সাথে আরেকটু ঘেঁষে বসলো।হাসির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বললো,
–“খুব পেঁকে গেছো তুমি হাসি।”
হাসি রায়ানদের পাশে থপাস করে বসে পড়লো।খুশিকেও টেনে বসিয়েছে।খুশি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না।হাসি রায়ানের কথার পিঠে মুখ ফুলিয়ে বললো,
–“ওমনি আমি পেঁকে গেলাম রায়ান ভাইয়া।আপনি প্রেম করছেন সেটা কিছু হচ্ছে না আর আমি বললেই দোষ।”
–“আমার তো এখন বিয়ের বয়স হাসি।এই বয়সে আমি যে প্রেম করছি এটাই গুরুতর অপরাধ।এখন তো বাচ্চা নিয়ে ঘুরা উচিত।”
–“সেটা তো বুঝলাম।তবে,আপনি বিয়ে করছেন কবে।
–“সেই খবর টাও পাবে।খুব শীঘ্রই।দেখবে,একদিন হুট করে বিয়ে করে তোমাদের কে চমকে দিবো।কি বলো অনা!”
অনামিকার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।রায়ানের এই কথার প্রেক্ষিতে অনামিকা ভেবে নিয়েছে রায়ান তাকে বিয়ে করার কথা ভাবছে।অনামিকার ইচ্ছা করছে রায়ানকে একরাশ চুমুতে ভরিয়ে দিতে।কিন্তু,তা এই পাবলিক প্লেসে সম্ভব না।অনামিকা চোখ বেঁকিয়ে খুশির দিকে তাকালো।এমতাবস্থায়,মনে মনে আওড়াতে লাগলো,
–“আমি জানি খুশি!তোমার মনে রায়ানের জন্য অনেক অনুভূতি কাজ করে।তা যে ভালোবাসার অনুভূতি সেটাও জানি।কিন্তু,আমি তো রায়ানকে ভালোবাসি।তাকে ছাড়া আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না।এমনকি,যাই কিছু হয়ে যাক না কেনো আমি রায়ানকে ছাড়বোনা।”
খুশি হুট করে উঠে দাঁড়ালো।তার পক্ষে এখানে থাকা আর সম্ভব না।রায়ানের প্রতিটি কথায় সে কষ্ট পেতে বাধ্য হয়েছে।এইখানে থেকে আর কষ্ট পেতে চায় না খুশি।কোনমতে,চোখের পানিটা লুকিয়ে খুশি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
–“হাসি তুই থাক,আমি গেলাম।আমার খুব মাথা ব্যথা হচ্ছে।”
খুশি আর এক মুহুর্তের জন্যও দাঁড়ালো না।ধপাধপ্ পা’য়ে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো।হাসি খুশির যাওয়ার পানে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।খুশিকে এতোটা মনমরা সে কখনোই দেখে নি।একটু চাপা স্বভাবের হলেও এমন দেখে নি।
রায়ানের ঠোঁটে বিশ্বজয় করা হাসি ফুটে উঠলো।সে যা ভেবেছিলো তাই।খুশির মনে সে জায়গা করে নিয়েছে।এবার আর সে দেরি করবে না,খুশিকে তার মনের কথা জানিয়ে দিবে।
————-
বুরাগ নিজের কেবিনে বসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল দেখছিলো।তখনি হুড়মুড়িয়ে জয়নব এসে বুরাগের কেবিনে ঢুকে পড়লো।এমন হওয়ায় বুরাগ কিছুটা রেগে যায়।কিন্তু,সামনে তাকিয়ে জয়নব কে দেখে বেশখানিকটাই অবাক হয়।মাঝখানে জয়নব যে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলো তা বুরাগের কাছে অজানা ছিলো।এমনকি,জয়নবের বাবাও তাদের কোম্পানির সাথে পার্টনারশিপ ছেড়ে দিয়েছিলেন।বুরাগ আজাদ রহমানের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে আজাদ রহমান তাকে এড়িয়ে গিয়েছেন।বুরাগ আর সেদিকে তেমন একটা পাত্তা দেয় নি।তবে,আজকে জয়নবকে দেখে বুরাগ অনেকটাই অবাক হয়েছে।
জয়নব তাড়াহুড়ো করে বুরাগের সামনের চেয়ার টায় বসে পড়লো।ছলছল চোখে বুরাগের দিকে তাকিয়ে আচমকাই বুরাগের হাতি দুটো আঁকড়ে ধরে ডুকরে কেঁদে দিলো।বুরাগ যেনো অবাকের উপর অবাক হচ্ছে।জয়নবের কান্নার মানে সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
এরিমধ্যে,জয়নব ক্রন্দনরত গলায় বলতে শুরু করলো,
–“প্লিজ!বুরাগ আমাকে বিয়ে করে নাও।আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।নিজেকে অনেক চেষ্টা করেছি তোমাকে ভুলে থাকার জন্য কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না।এমনকি,এতোগুলো দিন আমি বিদেশ গিয়ে কাটিয়েছি! শুধুমাত্র তোমাকে ভুলার জন্য।কিন্তু,তাও আমি তোমাকে ভুলতে পারি নি।”
বুরাগ কিছুই বুঝতে পারছে না জয়নবের কথা।শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।জয়নব পুনরায় বলতে শুরু করলো,
–“জানো বুরাগ!বাবা আমাকে না করে দিয়েছে তোমার কাছে আসতে।তুমি নাকি বিবাহিত।কিন্তু,আমি এইটা বিশ্বাস করি নি।এমনকি,বাবা এটাও বলেছে তোমার বিয়ের কথাটা আংকেলেই বলেছেন।অথচ,উনিই আমাকে তোমার বউ করতে চেয়েছিলেন।”
বুরাগ চেঁচিয়ে বললো,
–“মানে!কি বলছো তুমি এসব।বাবা কেনো আমাকে বিয়ে দিতে চাইবে।”
–“তুমি কি জানতে না বুরাগ!বাবা আর আংকেল তো আমাদের বিয়ের কথা ঠিক করেই একে অপরের পার্টনারশিপ হয়েছে।কিন্তু,কয়েকদিন যেতে না যেতেই আংকেল মুখ ফঁসকে বলে ফেলেন তুমি বিবাহিত।এইজন্যই তো বাবা আংকেলের সাথে পার্টনারশিপ শেষ করে দিয়েছে।”
রায়ানের খুব লজ্জা হচ্ছে তার বাবার কান্ডকারখানা শুনে।ব্যবসার উন্নতির জন্য তাকেও কিনা প্রায় পণ্যের মতো বানিয়ে ফেলেছিলো।আজকে,বুরাগ এইসবের উত্তর চাইবে আজাদ রহমানের কাছ থেকে।একটা মেয়েকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তার মন ভেঙেছে।এর চেয়ে বড় খারাপ কাজ আর কি হতে পারে।জয়নবের অসহায় চেহারা দেখে বুরাগের খুব খারাপ লাগছে।এমনকি,বাবার করা কাজের জন্যও জয়নবের সামনে খুব গিল্টি ফিল হচ্ছে।
—-
দেখতে দেখতে,আরো কতোগুলো দিন কেটে যায়।বেলীর পরীক্ষার সমাপ্তি ঘটেছে।বেলীর নিজেকে খুব
ফ্রী লাগছে।পরীক্ষার সময় টা তার কাছে যেনো ভয়ংকর সময় মনে হয়।এমনকি,পরীক্ষার দিনগুলোও সহজে যেতে চায় না।ট্রাফিক জ্যামের মতো আটকে থাকে সামনে।
বেলী গুনগুন করে গান গাইছে আর বিছানা গোছাচ্ছে।আজকে সে নতুন একটা শাড়ি পড়েছে।শুধু তাই নয়,চোখের কোণে একটু কাজলও লাগিয়েছে।কপালের মাঝখানে বড়সড় না হলেও মাঝারি সাইজের একটা কালো টিপও দিয়েছে।হুট করেই তার সাজতে ইচ্ছা হয়েছে কেনো তা নিতান্তই বেলীর অজানা।এরিমধ্যে কোথা থেকে শিউলি এসে বেলীর আঁচলের নিচে লুকিয়ে পড়লো।বেলী শিউলিকে দেখে মুচকি একটা হাসি দিয়ে আঁচলের নিচ থেকে বের করে এনে কোলে তোলে নিলো।শিউলির ফোলা ফোলা গালদুটোতে চুমু খেলো।এমন হওয়ায় শিউলি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।তা দেখে,বেলীর ভিতর থেকে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে আসলো।মা’য়ের মন তো এমনেই!!
বুরাগ,আজকে একটু দেরি করেই অফিস থেকে এসেছে।অফিসের অনেক কাজ তাকে সামলিয়ে আসতে হয়েছে।রুমে ঢুকে বিছানার একপাশে শিউলিকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে বুরাগের মুখে হাসি ফুটে উঠে।শিউলির কাছে গিয়ে কপাল থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে গভীর একটা চুমু খেলো।ইদানীং,বুরাগ অফিস থেকে এসে শিউলিকে ঘুমন্ত অবস্থায় পায়।বেলীর মুখে অনেকবার শুনেছে,শিউলি তার আসার অপেক্ষা করতে করতে একটা সময় কান্না করে ঘুমিয়ে পড়ে।বেলীর কথা মাথায় আসতেই বুরাগ আশেপাশে তাকিয়ে বেলীর খোঁজ লাগালো।বারান্দায় চোখ পড়তেই বুরাগ প্রথমে চমকে গেলেও পরক্ষণেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো।বেলীকে প্রায় অনেকদিন পর শাড়ি পড়তে দেখেছে।বুরাগ আর দেরি না করে নিঃশব্দে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেলো।টি-শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে গুটিগুটি পা’য়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
বেলী চোখ বন্ধ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাহিরের ঠান্ডা আবহাওয়া টা অনুভব করছে।সেই সাথে রাতের আকাশে মেঘের গর্জন।হঠাৎ বেলী তার উন্মুক্ত কোমরে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পায়।যা তার সারা শরীরে শিহরণ জাগিয়ে দিলো।বেলী জানে এই স্পর্শ বুরাগের।এমনকি,সে অনেক আগেই টের পেয়েছে বুরাগের উপস্থিতি।ইচ্ছা করেই সে সাড়া দেয় নি।
–“বেলী!বৃষ্টি বিলাস করবে সেইদিনের মত?যেদিন টঙের দোকানে চা খেতে গিয়ে দু’জনেই বৃষ্টিবিলাস করেছিলাম।”
বুরাগের ফিসফিসানি কথা শুনে বেলী চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।তার নিঃশ্বাস খুব দ্রুত চলছে।বুরাগের কথার পিঠে জবাব দিতে পারছে না।বুরাগ বেলীর মতিগতি দেখে হেসে ফেললো।বেলীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
–“এতো হাইপার হচ্ছো কেনো বেলী!তোমাকে তো আমি আর নতুন স্পর্শ করছি না।আমাদের একটা মেয়ে আছে।তোমাকে স্পর্শ না করলে তো সে আর পৃথিবীতে আসতে পারতো না।কিন্তু,আজকে তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি তোমাকে নতুন স্পর্শ করছি।সেই প্রথম দিনের মতো।বেলী মনে পড়ে!সেই দিন গুলির কথা!!”
বেলীর কথা যেনো আরো আটকে গিয়েছে।শুধু তাই নয়,বুরাগের চোখের দিকে তাকাতেও পর্যন্ত পারছে না।বুরাগ বেলীকে নিজের দিকে ফিরাতেই বেলী বুরাগকে জাপটে ধরে তার বুকে মুখ লুকালো।বুরাগও নিজের সাথে বেলীকে চেপে ধরে রেখেছে।
ঝুমঝুম শব্দ করে বৃষ্টির তেজ যেনো বাড়ছেই।কমবে বলে মনে হচ্ছে না।বারান্দার এককোনায় বেলী আর বুরাগ একে অপরের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে।বৃষ্টির ফোটা তাদেরকে একসাথে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।দু’জন দু’জনের দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছে।যে চাহনিতে আছে দু’জনের জন্য অসীম ভালোবাসা।বুরাগ বেলীর চোখের দিকে তাকিয়ে এক অন্য জগতে হারিয়ে যেতে শুরু করে দিলো।আচমকাই বেলীকে নিজের আরেকটু কাছে চেপে ধরে ঠোঁট মিলিয়ে দিলো।বৃষ্টির তেজের সাথে বুরাগও যেনো মত্ত হয়ে গিয়েছে।বেলীকে একটু একটু করে নিজের ভালোবাসার অতল সাগরে ডুবিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।বেলীও বুরাগের প্রতিটি ভালোবাসার স্পর্শে সাড়া দিয়ে যাচ্ছে।
_______
রায়ান নিজের রাগ সংবরণ করার জন্য দেয়ালে একটা ঘুষি মারলো।মুহুর্তেই ব্যথায় চোখ,মুখ কুঁচকিয়ে নিয়েছে।আজকে,কয়েকদিন যাবত ধরে সে খুশির কোনো খোঁজ পাচ্ছে না।স্কুলের সামনে,কোচিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও সে খুশির কোনো দেখা পেলো না।আর,এদিকে ইমা খানমের বিয়ের তাড়া দেখেও রায়ান অনেকটা রেগে আছে।তাই,রায়ান ভেবে নিয়েছে আজকে সে বুরাগদের বাসায় যাবে!যে করেই হোক খুশির সাথে সামনাসামনি কথা বলবে,খুশিকে নিজের মনের কথা জানাবে।
————-
খুশি লিভিং রুমে এসে রায়ানকে দেখে কিছুটা চমকে উঠলো।এমনকি রায়ানের ক্ষিপ্ত চোখের চাহনি দেখে শুকনো কয়েকটা ঢোক গিললো।কোহিনূর রান্নাঘর থেকে খুশিকে দেখে চেঁচিয়ে বললেন,
–“খুশি যা তো!ছাঁদ থেকে কাপড়গুলো নিয়ে আয়।ভুলেই গেছিলাম কাপড়গুলো আনার কথা।”
খুশি মা’য়ের কথায় সাথে সাথে মাথা নাড়ালো।যাক,এইখান থেকে যাওয়ার একটা বাহানা পেয়েছে।খুশি এদিক সেদিক না তাকিয়ে দিলো এক দৌড়।রায়ান খুশির যাওয়ার পানে মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলো।একটা আর্জেন্ট ফোনকলের কথা বলে রায়ানও উঠে দাঁড়ালো।সেও,পা বাড়ালো ছাঁদের দিকে।
সিঁড়িঘরের সামনে রায়ানকে দেখে খুশির হাত থেকে কাপড়গুলো পড়ে যায়।পিটপিট করে রায়ানকে ভালো করে দেখে নিলো।ফর্সা চেহারাটা লাল হয়ে আছে।হয়তো রাগে।খুশি রায়ানকে পাত্তা না দিয়ে নিচ থেকে কাপড় গুলো তোলে সামনে পা বাড়ালো।রায়ানকে ক্রস করে যেতে নিলেই রায়ান হাত ধরে আঁটকে দিলো।যার ফলে,পুনরায় খুশির হাত থেকে কাপড়গুলো নিচে পড়ে যায়।এবার খুশি কিছুটা রেগে যায়।রায়ানের দিকে তাকিয়ে চোখ,মুখ কুঁচকে বললো,
–“সমস্যা টা কি আপনার!দেখলেন তো আপনার জন্য হাত থেকে কাপড়গুলো পড়ে গেলো।”
–“পড়েছে বেশ ভালো করেছে।”
–“মানে!আমার হাত ছাড়ুন।আমাকে নিচে যেতে হবে।”
–“আজকে তোমাকে ছাড়ছি না খুশি।আমার কথা না শুনে তুমি যেতে পারবে না।”
–“কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি।আপনি একটা অসভ্য।”
–“ঠিকাছে আমি অসভ্য।তাও,আমার কথা তোমাকে শুনে যেতে হবে।”
খুশির এক কথা সে কিছুতেই রায়ানের কথা শুনবে না।রায়ানকে দেখেই তার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।কটমট দৃষ্টিতে রায়ানের দিকে তাকালো।রায়ান খুশির তাকানো দেখে মুচকি হেসে খুশিকে পাশের দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বললো,
–“এতো রাগ কোথা থেকে আসে তোমার খুশি!সেইদিনের পিচ্চি মেয়েটা এতো রাগী আর অভিমানী হবে তা আমার জানার বাহিরে ছিলো।”
খুশি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো।সে কিছুতেই রায়ানের চোখে তাকাবে না।রায়ানকে তার বিশ্বাস নেই।রায়ানকে নিজের থেকে দূরে সরানোর জন্য চেষ্টা করছে।কিন্তু,কিছুতেই সরাতে পারছে না।রায়ান খুশির মুখটা আগলে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
–“এই খুশি!ভালোবাসি।খুব ভালোবাসি।সেইদিন থেকে যেদিন তোমাকে ছাঁদে দেখেছিলাম।সেই,ছোট্ট খুশিকে আমি খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম।”
খুশির চোখের কার্ণিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।ঝাপসা চোখে রায়ানের দিকে তাকালো।রায়ান চোখ বন্ধ করে রেখেছে।কিন্তু,খুশির সেদিনের মাঠে বসে থাকা রায়ানের কথাটা মনে পড়ে যায়।মুহুর্তেই তার ভিতরে গড়া সুপ্ত অনুভূতি টা ভেঙে গেলো।রায়ানকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো।এমন হওয়ায় রায়ান অবাক হয়ে তাকালো খুশির দিকে।খুশি চোখের পানিটা মুছে দিয়ে রায়ানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“কেনো আপনার অনা কোথাও!তার কাছে যান।সে কি আপনাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছে।যার জন্য এখন আমার কাছে এসেছেন।আপনি ভাবলেন কীভাবে!আপনি আমাকে এসে ভালোবাসার কথা বললেই আমি নাচতে নাচতে রাজি হয়ে যাবো।কখনোই না।সেইরকম ভেবে থাকলে আপনার ধারণা ভুল।আপনি একটা অসভ্য!আপনার চরিত্রে সমস্যা আছে।একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরবেন,অন্যদিন আরেকজনকে নিয়ে মাঠে বসে প্রেমআলাপ করবেন।আপনি কি মনে করেছেন আমি বুঝি না নাকি!আমি আপনাদের থেকে বয়সে ছোট হলেও সবকিছু আমার চোখে পড়ে।এমনকি,আপনি আর আপনার অনা যে বিদেশে একসাথে থেকেছেন সেটাও আমার অজানা নয়।না জানি কি করেছেন আপনারা একসাথে।”
রায়ান আর সহ্য করতে না পেরে খুশির গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো।খুশির কাছ থেকে এইসব কথা সে কোনোভাবেই আশা করে নি।আজকে,খুশি তাকে চরিত্রের দোষ দিয়েছে!ও যা যা করেনি তার সবকিছুর অপবাদ শুনেছে খুশির থেকে!তার চেয়ে বড় কথা রায়ান একটুও ভাবে নি খুশির মনে তার জন্য এতো খারাপ ভাবনা জমে আছে।রাগান্বিত চোখে খুশির দিকে তাকিয়ে বললো,
–“খুশি!আজকে তুমি খুব বড় ভুল করলে।পস্তাবে!খুব পস্তাবে তুমি।”
কথাটা বলেই রায়ান চলে গেলো।একটিবারও খুশির দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
আর এদিকে,খুশি রায়ান চলে যেতেই মুখে হাত গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়লো।সে তো এইসব কথা বলতে চায় নি রায়ানকে।যা যা বলেছে সব রাগের মাথায় বলেছে।রায়ানের শেষ কথাটা মনে পড়তেই খুশির কান্না যেনো দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।খুশি এখন অনুভব করতে পারছে সে আসলেই রায়ানকে ভালোবেসে ফেলেছে।খুব ভালোবেসে ফেলেছে।রায়ানের থেকে দূরে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না।
চলবে..