পুনম পর্বঃ০৬

0
1745

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ০৬

—-তোমাকে আসতে বললেই তুমি চলে আসবে।তোমার নিজের ওয়েট নেই নাকি?
সুমন কাচুমাচু হয়ে তার ভাইজানের কথা শুনছে, নিজের ওয়েটের সাথে কোথাও আসার কি সম্পর্ক তা সুমন বুঝতে পারছেনা।ওর ওয়েট ৬৭ কেজি, এখন কেউ ৬৭ বার বলার পর কোথাও গেলে কি নিজের ওয়েট বজায় থাকবে?বুঝতে পারছে না। একবার কি ভাইজানকে জিজ্ঞেস করবে? না থাক। এমনিতেই কথা বলছে চিবিয়ে চিবিয়ে। এরপর যদি কামড়িয়ে কথা বলে তাহলে সর্বনাশ!

ঘটনা হলো গতকাল রাতে পুনম ফোন দিয়ে সুমনকে বাসায় আসতে বলেছে, আর সুমনও সকালে চলে এসেছে কুমিল্লা থেকে।এতে পুনমের বড় দুলাভাই হারুন আর তার স্ত্রী রুমা বেশ অসন্তুষ্ট।
—–রুমা তোমার দেবরকে বলে দাও সে একজন নিম্নবর্গের আহাম্মক। আমাদের তালুকদার বংশে আমরা কখনো কারো মর্জিতে চলি না,বিশেষ করে মেয়েদের।মেয়েদের কথায় উঠা বসা করা হলো বাদর স্বভাব!

সুমন এসব কথা চুপটি করে শুনছে ঠিকই কিন্তু তার চোখ ও মস্তিষ্ক পুনমদের বসার ঘর দেখায় ব্যস্ত।ছয়টি কাঠের সোফা যা ওল্ড মডেলের।অনেক আগে বানানো বুঝা যাচ্ছে। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে এই পরিবারের সবার ছবি।একটি টি টেবিল আর দু কর্ণারে দুটো ফুলদানি, ছোট সাইজের একটি টেলিভিশন। যাতে এখন রান্নার অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। সম্ভবত থাই স্যান্ডউইচ বানানো শিখাচ্ছে। কিন্তু সুমন সব থেকে আশ্চর্য হচ্ছে মহিলা খুব সেজেগুজে রান্না করছে, টকটকে লাল লিপস্টিক দেয়ায় মহিলাকে লিপষ্টিক ব্রান্ডের মডেল মনে হচ্ছে। মহিলার এই সজ্জা সুমনের কাছে বিশ্রী লাগছে!

সুমন খুব শান্ত গলায় বললো, ভাইজান আপনাদের না বলে আমার আসা উচিত হয় নি কিন্তু পুনমের ডাক আমি উপেক্ষা করতে পারি না।চেষ্টা করেও পারি না। ভাবি আপনার বোন এমন ভাবে বলে যে না এসে আমি পারি না।
এখন আমি দেখে আসি পুনম কেন ডেকেছে।উঠি ভাইজান?উঠি ভাবি?
সুমন চলে যাওয়ার পর হারুনের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠে।পুনমরে মত বুদ্ধিমতী মেয়ের কি এমন কাজ সুমনের কাছে?সুমন আজ তার কথা অগ্রাহ্য করেছে কাল যদি সোচ্চার হয় তখন?
****************************
—–ক্লাস নেওয়া শেষ ? এবারো কি মিনমিন করে কথা বলেছেন সুমন ভাই? ফোনের অপর পাস থেকে মৃদু হেসে জানতে চায় পুনম।
সুমনের অসস্তি হয়।এই মেয়েটা এত ঠোঁটকাটা।
—–কেন আসতে বলেছো পুনম?তুমি তো বাসায়ও নেই।তবে এত জরুরী তলবে কেন ডাকা?
—–শুনুন সুমন ভাই আমি আপনার মত ঘরকুনো ব্যাঙ নই। আমার এই সময়ে কোচিং-এ ক্লাস নিতে হয় জানেন না। আচ্ছা সেজো আপা আপনার আশেপাশে ?
—-আমি তারে দেখিনি পুনম।
—-শুনুন সুমন ভাই আপনার বড় ভাইজান তো আসার পর থেকে পায়ের উপর পা তুলে শুধু অর্ডার করছে।আপনি তার হয়ে না হয় আমাদের একটু সাহায্য করুন। কিছু কেনাকাটা করার দরকার, আপনি একটু সেজো আপার সাথে বাজারে যাবেন।
সুমনের মাথা ঝিমঝিম করে।গলা শুকিয়ে আসে। ক্ষীণ কন্ঠে জানতে চায়, —কার সাথে?
—–আহা আপনার তো দেখছি মেরুদন্ডের সাথে শ্রবণশক্তিতেও সমস্যা।আপনি তো বিয়ের জন্য মেয়েই পাবেন না সুমন ভাই….বলে হাসতে হাসতে কল কেটে দেয় পুনম।সে এখন নিশ্চিন্তে কাজ করবে।
******************
—-আপনার কি হাঁপানির সমস্যা আছে সুমন ভাই?পাবনী চিন্তিত কন্ঠে বলে ওঠে।
সুমন কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।একে তো সে কোন মেয়ের সাথে এভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে কখনো রিকশায় বসেনি।সুমনের মনে হচ্ছে রিকশাটা ছোট,সে পুনরায় জরোসরো হয়ে বসলো।তার নিঃশ্বাস ঘনঘন ওঠানামা করছে,ঘাম হচ্ছে প্রচুর। পিঠের কাছে শার্টটা ভিজে জবজব করছে।পাবনী ঘামের গন্ধ না পেলেই হয়।
—-হাঁপানির সমস্যা নেই কিন্তু কেমন যেন লাগছে।
বলে সুমন
—-ইজি হয়ে বসুন সুমন ভাই।আসলে পুনম মাঝে মাঝে বড্ড খামখেয়ালি করে।এই যে এতদূর থেকে এনে আপনাকে বাজারে পাঠালো,আপনি তো একটুও রেষ্ট পেলেন না।
—– না না ঠিক আছি আমি।
—-জানেন তো পড়ালেখা টাও আমার হলো না।বিয়ে হচ্ছে না।আমার মত লেংরা মেয়েকে কে বিয়ে করবে বলুন? সারাদিন বাসায় থাকি তাই আমাকে বাহিরে বের করার জন্য পুনমের এই কাজ।মাঝে মাঝে এমন কাজ দিয়ে বাহিরে পাঠায় ও আমায় কিন্তু বাসার সবাই চিন্তিত থাকে আমাকে নিয়ে তাই এবার মনে হয় আপনাকে সাথে পাঠালো।

—-আমি এতটা অসহায় কেন হলাম সুমন ভাই? সবাই কেন করুণার চোখে দেখে আমায়?… বলে আকুতি ভরা চোখে সুমনের দিকে তাকায় পাবনী।
সুমন তখনই খেয়াল করে পাবনী চোখে কাজল দিয়েছে,অসম্ভব মায়ায় ঘিরে থাকা কাজল চোখে পদ্মদীঘির মত জল থৈ থৈ করছে কিন্তু বহমান নয় এ দীঘি খুবই ধীর! কি সর্বনাশ!এতটা কাছ থেকে কাজল চোখের মালিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নিজেকে এলোমেলো লাগছে
সুমনের সত্যি নিজেকে আহাম্মক মনে হচ্ছে, ওর এখন পাবনীকে কিছু বলে সান্ত্বনা দেয়া উচিত।কিন্তু সে তা পারছেনা। অক্সিজেনের অভাব বোধ করছে।আবহাওয়া উত্তপ্ত লাগছে এই সন্ধ্যা বেলাতেও।বাতাস প্রয়োজন এখন ওর। বিশুদ্ধ বাতাস যাকে বলে।সুমন টের পায় ওর আবার ঘাম হচ্ছে, মাথা ঝিমঝিম করছে।
—-আপনার কি বেশি খারাপ লাগছে সুমন ভাই?আপনি এরকম অস্থির কেন হচ্ছেন? আমরা না হয় বাসায় ফিরে যাই।
—–না বাসায় যাবো না।পুনম বাজার করে যেতে বলেছে। আমার সাথে কি হচ্ছে আমি বুঝতে পারছিনা কেন পাবনী?
কিছুক্ষণ পর সুমন টের পায় পাবনী ওর হাত শক্ত করে ধরে রেখে বলছে, আপনার কাছে টিস্যু বা রুমাল নেই সুমন ভাই? তাহলে ঘাম মুছে নিন।
সুমনের ছোট্ট জবাব, নেই।
পাবনী ওর ওরনার এক প্রান্ত এগিয়ে দেয় মুখের ঘাম মুছার জন্য। কি রকম যেন ঘ্রাণ পায় সুমন ওর ওরনা থেকে। সুমন বিড়বিড় করে বলে,এবার ঘ্রাণ শক্তিও লোপ পেয়েছে।
সুমন আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকে,এ যাত্রায় ওকে বাঁচিয়ে দেও,ওর মাথা চরকির মত ঘুরছে। এখন অজ্ঞান হলে কেলেংকারী হয়ে যাবে। পুনম চিরকাল খেপাবে আর পাবনী কি করবে?
সুমন রিকশা জোরে ছুটাতে বলে।এ রিকশা না থামা পর্যন্ত ও স্থির হবে না। সুমন চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস নেয়, আলগোছে নিজ অজান্তে পাবনীর হাত আরো শক্ত করে ধরে রাখে সুমন। যেন ছেড়ে দিলেই পড়ে যাবে।
**************
তারিন খুব মনোযোগ দিয়ে তার ভাইয়ের খাওয়া দেখছে। শুধু বেগুন শুটকি দিয়ে এত তৃপ্তি করে তার ভাই ভাত খাচ্ছে দেখে চোখে পানি চলে আসে।
—একটু মাংস দেই ভাই?শুধু বেগুন শুটকি দিয়ে ভাত খাবি বোনের বাসায়।
—-বুবু তুমিতে জানো আমার বেগুন দিয়ে শুটকি রান্না কতটা পছন্দ কিন্তু বাসায় কেউ রান্না করে না……খেতে খেতে জবাব দেয় তানভীর।
—–একটা বিয়ে করলেই তো পারিস?বউ রোজ রেধে দিবে।
তানভীর খেতে থাকে কোন জবাব দেয়না।
—-তুই ভালো আছিস তো ভাই?
তানভীর চোখ তুলে বোনের দিকে তাকায়, সে চোখে যে অজস্র কষ্টের পাহাড় দেখতে পাচ্ছে তারিন। তারিনের বুক কেঁপে ওঠে, তার ভাইয়ের কি হয়েছে?
——আমি ভালো নেই বুবু। একদম ভালো নেই। ওই লাখ লাখ টাকার অট্টালিকায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।নিজের মাকে রোজ একটু একটু করে মরতে দেখলে কে ভালো থাকে বল বুবু।ও বাড়িটাকে আমার মৃত্যুকূপ মনে হয়।তুমি পালিয়ে এসে ভালো করেছো বুবু।আমারও পালাতে মন চায়। অনেক দূরে চলে যেতে মন চায় যেখানে হায়দার হোসেনর মত কেউ থাকবেনা, সেখানে যেত মন চায় বুবু।
তারিন কাঁদতে থাকে মুখে আঁচল চেপে।তানভীর আবার চুপচাপ খাবার খেতে শুরু করে।তারিনের একটা প্রশ্ন বার বার করে নিজেকে, কেন তারা একটা স্বাভাবিক জীবন পেলনা।কেন?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here