সিন্ধু ইগল – (২৬)

সিন্ধু ইগল – (২৬)
ইসরাত জাহান দ্যুতি

দক্ষ মারপিট জানা আয়মানের ঘুষির ওজন মোটেও সহনীয় ছিল না। আঘাতটা আচমকাই চোখে করার ফলে জায়িন চোখ চেপে ধরেই অপ্রস্তুতভাবে ব্যথায় কাতর হয়ে পিছিয়ে পড়ে। নিজেকে প্রস্তুত করার মতো সময়টুকু তো সে পেলই না, বরঞ্চ নেশার পর ক্রূরমতি আয়মান মুহূর্তেই আরও নির্মমভাবে তার পেটে লাথি মেরে বসে। চোখের পর এবার পেটে ভয়াবহ ব্যথা পেতেই চোখমুখ খিঁচে পেটে চেপে ধরে কিছুটা ঝুঁকে পড়ে জায়িন। খ্যাপা ষাঁড়ের মতো আয়মান তারপরই আবার তেড়ে গিয়ে জায়িনের ঘাড়সমেত মাথা জাপটে ধরে পিঠে কনুই দ্বারা অনবরত আঘাত করতে থাকে। এই আঘাতের পরিমাণ বেশি হলে জায়িনের মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়ারও সম্ভাবনা বেশি ছাড়া কম নয়। দম যেন বেরিয়ে আসার মতো দশা জায়িনের।

প্রথম আর দ্বিতীয় আঘাতটার পরও জায়িন মোটেও যা করতে ইচ্ছুক ছিল না, তা সে আয়মানকে আটকানোর জন্যই এবার করতে বাধ্য হলো। আয়মানের ডান পায়ের উরুতে প্রচণ্ড জোরে একবারই মুষ্ট্যাঘাত করল সে৷ উরুর ওই নরম অংশে এত জোরেই আঘাত পেল আয়মান, যেন মনে হলো ওর মাংসের ওপরসহ ভেতরের অস্থিতে গিয়েও চোটটা লেগেছে৷ পা চেপে ধরে দাঁড়িয়েও থাকতে পারল না সে। ব্যথায় চিৎকার না করলেও চোখমুখ খিঁচে ধপাস করে ফ্লোরে বসে পড়ল। এই একটা আঘাতেই তাকে ছিটকে পড়তে হলো! না জানে আরও কয়েকবার এমন আঘাতের মুখে পড়লে সে বসেও থাকতে পারবে না হয়তো! নিজেকে হার মেনে নিতে হচ্ছে, এমনটা ভাবতেই ক্রোধে যেন রক্ত টগবগিয়ে উঠছে ওর।

জায়িনের অবস্থাটা খুব খারাপ না হলেও খুব ভালোও নয়। পেটে আর পিঠের যন্ত্রণার থেকেও চোখের যন্ত্রণাটা সে সহ্য করতে পারছে না। মাথা ঝিমঝিম করছে, বাঁ চোখে দেখতেও কষ্ট লাগছে কিছুটা। রাগটা এই কারণেই তরতরিয়ে বেড়ে গেল ওর। গায়ের সাদা শার্টটার বোতাম না খুলেই টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে গা থেকে খুলে ছুঁড়ে মারল নিচে। আয়মান পা চেপে ধরে ততক্ষণে আবার দাঁড়িয়ে গেছে। ও যে আবার আঘাত করতে হামলে পড়বে তা বুঝতেই জায়িন আর একটা মুহূর্ত ওকে সময় না দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দু’আঙুলে এমনভাবে ওর কণ্ঠনালি চেপে ধরল যে, জায়িনের হাত ছাড়াতেই ছটফট করতে আরম্ভ করল আয়মান। আর পালটা আঘাত করা তো দূরে থাক। কিন্তু জায়িন সহজে ছাড়ল না। রাগত স্বরে চিবিয়ে বলে উঠল, ‘এই গ্যাংস্টার আয়মান হয়েছ কত বছর? পাঁচ বছর! সর্বোচ্চ ছয় বছর। আর এই জায়িন মাহতাব তৈরি হয়েছে বারো বছর। তুমি কতগুলো ক্রাইম করেছ? তুমি যখন ক্রাইম শুরু করেছ তখন আমি ক্রাইম জগতে অলমোস্ট গডফাদার।’

দম এবার যেন আয়মানের ফুরিয়ে আসছে। চোখে মুখের চেহারা কালো হতেই জায়িন ছেড়ে দেয় ওকে। একটু সময় ধরে ঘনঘন শ্বাস নিয়ে ক্রুদ্ধ চোখে জায়িনের দিকে তাকাতেই জায়িন আবার এগিয়ে আসে ওর কাছে। আয়মান সে মুহূর্তে ওকে ধাক্কা দিয়ে বলে ওঠে, ‘গডফাদারের দশা তাহলে আয়মানের কাছে খাঁচায় বন্দি বাঘের মতো হয়েছিল কী করে?’
-‘হুঁ হুঁ, তাই তো! কী করে টেরোরিস্ট আয়মান মেহরিনের কাছে মেনি বিড়ালের মতো অবস্থা হলো আমার? আমার পরিচিত যে শোনে ওই ঘটনা সে-ই অবাক হয়, বুঝলে? আসলে অতি উত্তেজনার ফল যে কতটা খারাপ হয় তা সেদিনের পরিস্থিতি দ্বারাই বুঝলাম। ওইদিনের মতো উত্তেজনা জীবনে কখনো আর কিছুতে উপলব্ধি হয়নি আমার। মানুষ ঠিকই বলে। প্রথমবার প্রেমে পড়লে সেই প্রেমী পাগল প্রেমীই হয়ে যায়। না হলে আমি সেদিন কী করে অসতর্ক হয়ে পড়লাম? তোমাকে খুব দ্রুত কাছে পেতে চলেছি। এই উত্তেজনায় দিনের বেলাতেই জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম যেন৷ আর সেখানেই কট’টা খেয়ে গেলাম।’
জায়িনের কথাগুলো শোনার ফাঁকে ফাঁকে আয়মান ওর কপালের ডানপাশে ছোট্ট একটা কাটা চিহ্নসহ গায়ের বিভিন্ন কাটা দাগ, সেলাইয়ের দাগগুলো লক্ষ করছিল। এই দাগগুলো তো আগে দেখেনি সে। গাজীপুর বাংলোতে থাকাকালীন গাছের মোটা গুড়ি কাটার সময়ই জায়িনের খোলা শরীর দেখেছিল সে। মেকআপের আবরণের নিচে এই দাগগুলো ঢাকা পড়েছিল। তাহলে কি এই দাগগুলো ঢাকতেই তার ওই ছদ্মরূপ ছিল? না আরও কোনো বিশেষ কারণ আছে?

কথা শেষ হতেই আয়মানের দৃষ্টি খেয়াল করল জায়িন। তখন আবারও এগিয়ে এল ওর কাছে। তা দেখে আয়মানও আবার ওকে মারতে উদ্যত হলেই জায়িন ওর দু’পায়ের পাতাতে পাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে ওর হাতদু’টোও তখনই এক হাতের মাঝে খুব শক্তভাবে আয়ত্ত করে নিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে একটা ইঞ্জেকশন বের করল আরেক হাতের সাহায্যে। ইঞ্জেকশনের ক্যাপটা দাঁত দিয়ে টেনে খুলে ফেলে নিমিষেই সেটা আয়মানের কোমরে পুশ করে দিলো। এর মাঝে আয়মান চেষ্টা করেও হাত বা পা মুক্ত করতে পারেনি। ধীরে ধীরে ও অনুভব করল পা দু’টো অবশ হয়ে আসছে ওর। কিছু মুহূর্ত পরই ও আর চলতে বা পা নড়াতে পর্যন্ত পারবে না। তা বুঝে উঠতেই জায়িনের দিকে কেবল রাগান্বিত দৃষ্টি ছোঁড়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না। পা পুরোপুরি অবশ হতেই পড়ে যেতে চাইলে জায়িন ওকে আঁকড়ে ধরে কোলে তুলে নিয়ে বিছানাতে শুইয়ে দিলো। আকস্মিক অবস্থাটাই আয়মান গালিটুকু দিতে পর্যন্ত ভুলে গেল। আর ওর স্তম্ভিত অবস্থার সুযোগ নিয়ে জায়িন হাতদু’টোরও একই হাল করল। ঝুঁকে পড়ে ওর কপালের ওপরে শুয়ে থাকা বাদামী, কালো বর্ণের এলোমেলো ছোটো চুলগুলো আলতো স্পর্শে গুছিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আরও অনেক চমক দেখার বাকি আছে, জাদু। তুমি এখন একটু ঘুমাতে চেষ্টা করো। আমি ফিরে আসার পর আর ঘুমাতে পারবে না কিন্তু।’

ঘরের লাইটটা অফ করে দিয়ে জায়িন বেরিয়ে গেল। আয়মান কতটা বাজেভাবে আটকা পড়ে গেছে, তা ও যথেষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে নিজের শরীরের নতুন পরিচ্ছদ দেখেই।
—————

মেলবোর্ন থেকে আটশো কিলোমিটার দূরত্বে কপারের বাসাটা। সেখানেই এখন জায়িন আয়মানকে নিয়ে থাকছে। বাসাটা কপার কিনে রেখেছে বহু আগেই। ওর পরিবারও এই বাসা কেনার কথা এখন অবধি জানে না। তাই এখানেই নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে জায়িন।

বাসা থেকে বেরিয়ে জায়িন কপারের সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে। চোখ সংবেদনশীল একটি অঙ্গ। চোখের ট্রিটমেন্টটা যেন তার না নিলেই হচ্ছিল না। ব্যথাটা ক্রমশ বেড়েই চলছিল কমার বদলে। মেলবোর্নের দিকেও গিয়েছিল তারা। মূলত স্যামুয়েলের বাসাতে। এখন আবার ফেরার পথে। রাস্তায় গতিসীমা ওদের ১৪০-১৬০। গাড়িতে দু’জনই চুপচাপ। কিছুদিন পরই জায়িনের বন্ধু চারজন নিজেদের কর্মজগতে ফিরে যাবে আবার। ওদের সঙ্গে এখন ওর থাকা সম্ভব হচ্ছে না আয়মানের জন্য। তাই স্যামুয়েলের বাসাতেই সবাই দেখা করতে গিয়েছিল।

রাস্তার দুই ধারে শুধুই মাঠ। মাঠের সীমারেখা টানা যেন মুশকিল। যেতে পথে চোখে পড়ল কিছু পশুখামার। আবার সামনে এগিয়ে পাহাড়ি রাস্তা। মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে দু’একটা বড়ো বড়ো লরি চলে যাচ্ছে। জানালার বাইরে শূন্য দৃষ্টি ফেলে আয়মানের কথায় ভেবে চলেছে জায়িন। এই ভাবনার মাঝে চোখদু’টো কখন যেন লেগে এল ওর। ফিরতে ফিরতে ওদের ভোর হয়ে গেল। কপার ওকে ডেকে তুলে দিতেই গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে জাইমাকে কল করল সে। কয়েক ঘণ্টার মাঝে ওর সাথে আর কথা বলা হয়নি। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেল না ফোনের ওপাশ থেকে।

বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়েই আয়মানের ঘরে উঁকি দিলো জায়িন। কিছুক্ষণের মাঝেই অবশ ভাবটা কেটে যাবে ওর। তাই ব্যালকনির দরজাটা ভালোভাবে আটকে খাবার আনতে চলে গেল। তার কিছু সময় পরই জেগে উঠল আয়মান। বাথরুমে যাবার প্রয়োজন বোধ করতেই হাত পায়ের করুণ দশার কথা খেয়াল হলো। কিন্তু অনুভব করল পা নাড়াতে সক্ষম হচ্ছে ও। আশেপাশে তাকিয়ে কতক্ষণ ঘরের সব কিছু লক্ষ করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। তখনই জায়িন খাবারের ট্রে হাতে করে ঘরে এল। খুব সহজ স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি অপেক্ষা করছি। ফ্রেশ হয়ে এসো।’
আয়মানও অতিরিক্ত কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করল না। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসেই জায়িনের মুখোমুখি বসল। জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আমাকে ঠিক কী কাজে ব্যবহার করতে চাও?’
প্রশ্নটার অর্থ জায়িন চট করেই বুঝে ফেলল। আয়মানের ধারণা, জায়িন কোনো স্বার্থে বা উদ্দেশ্যে ওকে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ এমন ধারণাটা হওয়া অবশ্য অস্বাভাবিক কিছুও নয় আয়মানের পেশা লক্ষ করলে। জায়িন জবাব দিলো, ‘বলব। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার সবকিছু তোমাকে মানতে হবে।’
-‘সব কিছু বলতে?’
-‘আগে নাশতাটা করে নাও।’
কথাটা বলেই জায়িন জানালাটা খুলে দিলো। পর্দাটাও সরিয়ে দিলো, শান্ত গলায় বলল, ‘আমার কাজটা একদিনের জন্য নয়। সারাজীবনের জন্য।’
আয়মান কোনো জবাব দিলো না। শুধু মনোযোগের সাথে খেতে ব্যস্ত সে। জায়িন ওর পাশে এসে বসল আবার। পানির গ্লাসটাতে পানি ঢেলে ট্রের এক পাশে রেখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। খাওয়া প্রায় শেষ তখন আয়মানের। জায়িন পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেবার আগেই ও জগটা নিয়ে জগের মুখে চুমুক বসাল। হাসল জায়িন। ট্রেটা নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল সে। তবে ফিরল খুব দ্রুতই। আয়মান তখন শার্টের হাতা গুটিয়ে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়েই চুলগুলো ব্রাশ করে নিচ্ছে। জায়িন ওর পিছে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘আর একটু চড়া মাত্রার ফর্সা হলেই তোমাকে আর দেশি লাগত না।’
-‘আমি এখনি বের হবো। তুমি ডিল করতে আসবে আমার হোটেল। কাজের জন্য তোমার সঙ্গে থাকার প্রয়োজন নেই আমার।’
কথাগুলো বলতে বলতে প্যান্টের নিচটাও ভেঙে গুটিয়ে নিলো কিছুটা। কারণ প্যান্টের সাইজটা একটু বেশিই বড়ো মনে হচ্ছে ওর। জায়িন ওর কার্যকলাপ দেখে আর কথা শুনে নিঃশব্দে হাসতে হাসতে বিছানাতে আধশোয়া হয়ে গা এলিয়ে দিলো। আয়মান প্যান্টের দুই পকেটে হাত পুড়ে দাঁড়িয়ে, ভ্রুজোড়া নিজস্ব ভঙ্গিতে উঁচিয়ে ওকে দেখতে থাকল। জায়িনের ভাবগতি কিছুটা বোঝার চেষ্টা আরকি।

ইশারায় ওকে বসতে বলল জায়িন। কিন্তু আয়মান যে ওর গা ঘেঁষে বসতে একেবারেই নারাজ, তা জায়িন বুঝেও পাত্তা দিলো না। তাই আচমকা টানে ওকে নিজের কাছে এনে অনেকটা পেছন থেকে জাপটে ধরার মতো করে জড়িয়ে ধরে বসল। আয়মান কিছু বলা বা করার আগেই এক হাতে ওকে জড়িয়ে রেখে অন্য হাতে ওর সামনে বেশ কয়েকটা ছবি মেলে ধরল। মৃদুস্বরে ডাকল ওকে, ‘আয়মান, চেনা যায় ছেলেটিকে?’
_________________

***গত পর্বের মন্তব্যগুলোতে জাদু ছিল। রিপ্লাই না করলেও আমি প্রতিটা মন্তব্য পড়েছি আর সত্যিই খুশি হয়েছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here