পুনম পর্বঃ১৫

0
1695

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১৫

গত কাল থেকেই বৃষ্টি ভেজা প্রকৃতি।রোদের তাপদহনে অতিষ্ট শহর যেন বৃষ্টির পরশে স্বস্তি পাচ্ছে।কিছু মানুষের জন্য এই বৃষ্টি হলো খিচুড়ি আর ইলিশ উদযাপন আর দিনভর কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানো বা কারো জন্য বৃষ্টি বিলাস আর সাথে চায়ের পেয়ালায় রোমান্টিক মুহুর্ত! আবার কারো জন্য স্বস্তি তো কারো জন্য দূর্ভোগ।সবাই বৃষ্টি বিলাস করতে পারে না ঘরে বসে, কর্মের জন্য বের হতে হয় তখন তাদের জন্য বৃষ্টি মানেই ঝামেলা!

সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে। পুনম লাবণ্য আর মরিচাকে নিয়ে মার্কেটের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে।একই রিকশায় ওরা তিনজন উপর নিচ করে বসেছে।আজ শুক্রবার তাছাড়া এক সপ্তাহ পর ঈদ,বাসার সবার জন্য ঈদ মার্কেট করার উদ্দেশ্যে এই যাত্রা। লাবণ্য আর মরিচা বিরতিহীন কথা বলছে।পুনমের কপাল কখনো বিরক্তিতে কুঁচকে আসে আবার কখনো ওদের কথা শুনে মুচকি হাসে।মরিচা শহরে আসার পর পুরাই বদলে গেছে আর লাবণ্য যেন তার কথার মেশিন চালানোর জন্য যোগ্য একজন মানুষ পেয়েছে।

পুনম প্রথমে লাবণ্যর জন্য ড্রেস কিনতে যায়…বাড়ির সব চেয়ে ছোট সদস্যদের ঈদের প্রতি আগ্রহ থাকে বেশি।ইষ্টি মিষ্টি যদিও ছোট কিন্তু লাবণ্যর আগ্রহ সবচেয়ে বেশি।
লাবণ্য একটার পর একটা ড্রেস দেখছে কোনটাই তার পছন্দ হচ্ছে না।পুনম ধমক দিয়ে বলে,
—–আহা লাবণ্য এসব কি? এর জন্যই বাবা তোকে নিয়ে মার্কেটে আসতে চায় না…
লাবণ্য ভেংচি কাটে।মনে মনে বলে, হুহ! ঈদ ছাড়া দামী ড্রেস কেনা হয় নাকি…ওর সবচেয়ে বেস্টটা দরকার।
দোকানী কাচুমাচু মুখ করে চেয়ে থাকে পুনমের দিকে, এপর্যন্ত গোটা বিশেক জামা দেখিয়ে ফেলেছে এই মেয়েকে কিন্তু কোনটাই তার পছন্দ হচ্ছে না।
মরিচা পাশ থেকে বলে,–ও ছুডু আফা, আমনে না কইলেন ছরারা ডেস নিবেন… আর ও ভাই আমনে খাম্বার মত খারাইয়া রইছেন কে?ছরারা দেহান আমার আফারে।ওই যে পায়ের দারে ফের আলা ডেস…..
—- মরিচা বু ছরারা না,সারারা ড্রেস হবে।তুমি ঠিক করে কেন কথা বল না।
—-যা ছরারা তাই ছা–রারা।
লাবণ্য অনেক বেছে গোলাপি আর সাদার মিশ্রনে একটা ড্রেস পছন্দ করে।পুনমের চোখ জুরিয়ে আসে।তার বোনটাকে সবাই কালো বলে অথচ তারা কি জানে শ্যামবর্ণের এই মেয়েটি যে একটা মায়াবতী!হাসলে মনে হয় পুরো পৃথিবী হাসছে! দোকান থেকে বের হওয়ার সময় লাবণ্যের মুখটা খুশিতে জ্বলজ্বল করে… পুনম মরিচার জন্যও একটা গোলাপি রঙের থ্রি-পিস কেনে।লাবণ্য খুশিতে বলে ওঠে,
—ঈদের দিন আমরা একই রঙের ড্রেস পড়ব মরিচা বু।খুব মজা হবে।
মরিচার অতি খুশিতে চোখ ছলছল করে, এই মানুষ গুলা এত ভালা কেন?
—- ও হাইজা আফা মেন্দি নিবেন না।
পুনমের এই মানুষগুলোর মুখে হাসি দেখে ভালো লাগে।ওর কষ্ট সার্থক মনে হয়…
—-অবশ্যই নিব।তোমার আর কিছু লাগবে মরিচা?
মরিচা কাচুমাচু করে, মিন মিন করে বলে,দু মুঠ চুড়ি লাগবো হাইজা আফা…ওই যে রেশমি চুড়ি…হাডলেই কি সুন্দর ঝুনঝুন আওয়াজ দেয়….
—-আমিও কিন্তু নিব মরিচা বু… লাবণ্যের আদুরে আবদার। ড়

পুনম অন্য দোকানের দিকে হাটা শুরে করে,ও হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পায় পিছনে কুটুর কুটুর করে ফিসফিসিয়ে কথা চলছে দুজনের মধ্যে। যার টপিক হচ্ছে ঈদের দিন কিভাবে সাজবে আর কিভাবে মেহেদী দিবে।পুনম ফিরে ধমক দেয়, জোরে পা চালাতে বলে কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না….

অনেক ঘুরে পুনম মায়ের জন্য তাতের শাড়ি,ইষ্টি মিষ্টির জন্য একই ডিজাইনের টকটকে লাল দুটো ফ্রক, দুলাভাইদের জন্য পান্জাবী, বড় আপার জন্য এপ্লিকের কাজ করা একটা কাপড় আর মেজ আপার জন্য একটা একটা কমলা রঙের শাড়ি কিনে। মেজ আপা নিশ্চিত কমলা রঙের কাপড় দেখে খুব খুশি হবে…আর মেজ আপার মতে, তার বরও নাকি তার দিকে গাধার মত চেয়ে থাকবে কমলা রঙের শাড়িতে তাকে দেখে……

বাহিরে তখনও টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।কাঁচের দরজা ঠেলে পুনম বাটার শো রুমে প্রবেশ করে।অনেক বেছে ১৮৫০ টাকা দিয়ে বাবার জন্য একজোরা জুতা কিনে পুনম।খুব যত্নের সাথে পুনম জুতার খোলের উপর হাত বুলায়।ওর চোখ ছলছল করে ওঠে।সেদিন বাবার জুতোর পায়ের গোড়ালির অংশের কাছ থেকে একটা ফুটো দেখেছে পুনম।জুতার সেই ছোট্ট ফুটো পুনমের মস্তিষ্কে খুব করে আলোড়ন তুলে ছিল…হু হু করে উঠেছিল বুকের ভিতরটা….বাবারা এমন কেন হয়? তাদের প্রয়োজন এত সীমিত কেন থাকে? কেন পুরানো পাঞ্জাবিই সব ঈদে তাদের কাছে নতুন লাগে? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তরে আমারা একটি কথাই জানি …”প্রত্যেক বাবা মানেই স্বভাবে খুব কৃপণ!তারা না কিনে দিতে জানে, না নিজে কিনতে জানে!” কত অভিযোগ?
***************
জামাল বসে বসে টিভি দেখছিল আর চা পান করছিল। সে রোজা রাখে নি কারণ তার স্ত্রী ঝুমা বাচ্চা হবে বলে রোজা রাখতে পারেনি।তাই সেও রাখেনি।জামালের স্বভাব হলো তার বউ যদি গু ভর্তা খায় তবে সেও গু ভর্তা খাবে। সেটা কিসের ভর্তা বা কেন খাবে তা তার জানার কোন দরকার নেই।
নিয়াজ উদ্দিন এসে সোফায় বসে।তাকে দেখে চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েও রেখে দেয় জামাল।রোজার দিনে রোজা রাখেনি বলে এই লজ্জায় সে চায়ের কাপ রাখে নি, রেখেছে কারণ সে চা পান করার সময় গড়গড় শব্দ হয়। যা শশুড়ের সামনে করা শোভা পায় না।এতটুকু জ্ঞান তার আছে।
—–তা জামাল তোমার চাকরির কি খবর?
—এই তো চেষ্টা করছি আব্বা।
নিয়াজ উদ্দিন বিড়বিড় করে বলে, তা তো দেখতেই পাচ্ছি তোমার চেষ্টা… হাত পা গুটিয়ে আমার মেয়ের কোলে বসে চাকরি খুঁজার চেষ্টা… গাধা!
—-চেষ্টা চরিত্রটা একটু জোর দিয়ে করো বাবা। এখন যে বাবা হচ্ছো সে কথা মাথায় রেখো।
—জ্বি, আব্বা।ঝুমুর টেনশনে তাকে একা ছেড়ে যেতে পারি না, নইলে….
—–আমরা আছি,তোমার বউ আমার মেয়ে। তাই ফালতু টেনশন করো না।ভবিষ্যতের টেনশন করো।বুঝেছো?
—-জ্বি আব্বা।
—-নাও এখন চা খাও।চা ঠান্ডা হলে আর খেয়ে স্বাদ পাবে না….বলে উঠে রুমের দিকে চলে যান নিয়াজ উদ্দিন। তার শান্ত মেজাজ বিগড়ে গেছে এই গাধার জন্য।

সালেহা বেগম বিছানায় বসে গুনগুন করে কোরআন পড়ছে।স্বামীকে রুমে ঢুকতে দেখে কোরআন পড়া থামাতে গেলে নিয়াজ উদ্দিন চোখের ইশারায় না করে।বিছানার অপর পাশে শুয়ে স্ত্রী কোরআন পড়া শুনতে থাকে চোখ বন্ধ রেখে।কোরাআন পাঠ শুনলে বুকটা প্রশান্তিতে ভরে আসে।
—-মা আসবো? দরজার ওপাশ থেকে রুমা বলে ওঠে।
সালেহা কোরআন শরীফ বন্ধ করে একপাশে রেখে তার বড় মেয়েকে আসতে বলে।
রুমা এসে মায়ের কাছে বসে বলতে শুরু করে,
—–মা জিজ্ঞেস করতো বাবাকে, সে কোন আক্কেলে পুনমকে টাকা দিয়ে ঈদের মার্কেট করতে পাঠায়। আমি তো বড় আমাকে দিলে কি হতো।এখন যদি সস্তার জিনিস নিয়ে আসে বা পছন্দ না হয় তোমার জামাইর তবে তোমার জামাইর কাছে আমি ছোট হবো না বলো?
সালেহার উত্তর দেয়ার আগে নিয়াজ উদ্দিন বলে ওঠে,
—তোমার বাবার সামর্থ্য যদি থাকে দু টাকার তবে তুমি আমার মেয়ে হিসাবে তা হাসি মুখে গ্রহণ করা উচিত।
—বাবা তুমি এভাবে বলছো কেন? পুনম সম্পর্কে কিছু বললেই তুমি কেন সহ্য করতে পারো না।
—-শোন রুমা,আমার পুনম সম্পর্কে কোন কথা তোমরা বল না।শুধু তারই দায়িত্ব আমার প্রতি তোমার নেই।মাত্র পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছে সে আমার কাছ থেকে অথচ দেখো গিয়ে তোমার ছোট বোনই কেনা কেটা করেছে কত টাকার।আর সব টাকা আমার মেয়ের।কোথায় পেয়েছে জানো?রাত দিন টিউশন করিয়ে, কোচিং করিয়ে, বাড়তি টিউশন করে।তারপরও তুমি বলছো, পুনম সস্তা জিনিস কিনবে? তুমি বড় স্বার্থপর রুমা।কিসের এত রাগ তোমার পুনমের প্রতি।তুমি কেন ভুলে যাও সে তোমার ছোট বোন।

রুমা জবাব দেয় না কোন বাবার কথার কিন্তু মায়ের দিকে রাগান্বিত চোখে চেয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
সালেহা বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে,
—-মেয়েটাকে এভাবে না বললেও পারতেন।নাইওরি এসেছে ওরা।দুদিন পরতো চলেই যাবে।
নিয়াজ উদ্দিন কঠিন চোখে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলেন,
—–তুমি চুপ থাক নির্বোধ মেয়ে মানুষ। পুনমের মুখের দিকে তুমি তাকিয়ে দেখেছো? মেয়েটা যে ভালো নেই তা কি তুমি জানো? কেমন মা তুমি?

সালেহা স্বগোতক্তি করে, আমার হয়েছে যত জ্বালা!

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here