#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ৮
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি
মাহাদ এর দোতালার করিডোরে পায়চারী করছে আম্বের।সিড়ি ভেঙে ত্রস্ত পায়ে উপরে উঠে মাহাদ।মাহাদ সেই সকালে গিয়েছে আর এখন ফিরলো।আম্বের মাহাদ কে দেখেই স্মিত হাসে।লজ্জায় চক্ষু সংবরণ করে আম্বের।
তার কী হয়েছে সে নিজেই জানে না।কেন মাহাদ কে দেখলে তার বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতি হয়!কেন এক ঐন্দ্রজালিক মোহ তাকে আচ্ছন্ন করে!ঝনঝন করে উঠে আম্বের এর শরীর।
আম্বের কে দেখেই বিগলিত হাসে মাহাদ।আম্বের তার দীর্ঘ কালো চুল ছেড়ে রেখেছে।মাহাদ আম্বের এর খোলা চুল পছন্দ করে।মাহাদ আম্বের এর কাছে এসে ওর গালে হাত রেখে গলায় চুমু খায়।আম্বের দুর্বল হাতে মাহাদ কে সরায়।মাহাদ হাসি হাসি মুখে বললো–
“কী হয়েছে প্রজাপতি!রেগে আছেন মনে হচ্ছে?
কপট রাগি গলায় আম্বের বললো—
“সকালে এইসব কী ছিলো!যতসব অসামাজিক কাজ!
মাহাদ ফিকে হাসলো।মাথাটা হালকা নিচু করে বাম হাতের তর্জনী দিয়ে কপাল চুলকায়।নম্র গলায় বললো—
“রিয়েলী সরি।আসলে সময় ছিলো না।তাই….।”
“তাই বলে আপনি সবার সামনে চুমু খাবেন!
আম্বের এর মুখ বিষন্নতায় ডুবে।মাহাদ তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আম্বের এর চুল তার কানের পিছনে গুঁজে হালকা গলায় বললো—
“সরি ফর দিস।আপনি দাঁড়ান আমি আপনার বাবাকে সরি বলে আসছি।”
আম্বের মাহাদ কে টেনে ধরে ব্যস্ত গলায় বললো—
“লাগবে না।আর কখনো এমন করবেন না।”
মাহাদ আম্বের এর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো–
“ওকে ডিয়ার বাটারফ্লাই।এখন থেকে বদ্ধ দরজার আড়ালে চুমু খাবো।চলবে তো?
আম্বের শক্ত গলায় বললো–
“নাহ।সবসময় এইসব কী বলেন!যতসব অসামাজিক কথাবার্তা।”
মাহাদ হেসে উঠে।নরম গলায় বললো–
“আমার জীবনটাই তো অসামাজিক।”
হাঃ,হাঃ,হাঃ।মাহাদ আবার হাসে।
আম্বের গম্ভীর গলায় বললো–
“এইসব কী বলছেন!চুপ করেন।”
“খেয়েছেন মিস সুগন্ধি?
“হুম।”
“দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল।রাতে কখনো না খেয়ে থাকবেন না।”
আম্বের গলার স্বর হালকা নিচু করে বললো–
“আপনি খেয়েছেন?
“উহু।”
“তাহলে ফ্রেশ হয়ে আসেন।আমি খাবার দিচ্ছি।”
“ওকে।”
মাহাদ ফ্রেশ হয়ে একটা ট্রাউজার আর পোলো শার্ট পড়ে আসে।মাহাদ মৃদু হাসে।মাহাদ দেখে আম্বের ডাইনিং এ মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।মাহাদ কিছু বললো না।আম্বের কে ডাকলোও না।একটা চেয়ার টেনে বসলো।সব খাবার সামনেই রাখা।মাহাদ নিজের হাতেই খাবার বেড়ে খেলো।খাওয়া শেষ করে বেশ কিছুক্ষন নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো আম্বের এর দিকে।আম্বের এর ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে তার মানে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আম্বের।
মাহাদ ম্লান হাসে।ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দেয় আম্বের এর ঠোঁট।মাহাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে আসে।হাঁটু ভেঙে বসে আম্বের এর সামনে।সেখানে বসেও চেয়ে থাকে মাহাদ আম্বের এর দিকে।এক নিরব চাহনি।এক শূন্য হৃদয়ের আর্তনাদ।এক মুকুটহীন সম্রাটের আহাজারি।এক বিষন্ন মানুষের হৃদ স্পন্দন।যা আম্বের শুনতে পায় না।কী করে শুনবে!
ডাইনিং টেবিলে রাখা জগের পানিতে স্লিপিং পিল মেশানো ছিলো।আর তা খেয়েই অকস্মাৎ আম্বের হারিয়েছে ঘুমের দেশে।
আম্বের কে কোলে তুলে নেয় মাহাদ।নিজের বিছানায় শুইয়ে গায়ে কমফোর্টার টেনে দেয়।
এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মাহাদ এর বুক চিরে।আম্বের এর গালে আলতো হাত রাখে।নির্লিপ্ত,নির্বিকার মাহাদ কাতর নয়নে তাকিয়ে আছে আম্বের এর দিকে।হালকা ঝুঁকে গাঢ় চুম্বন করে আম্বের এর ললাটে।শান্ত,স্নিগ্ধ,নিশ্চল গলায় মাহাদ বললো—
“কেন এলেন আপনি আমার জীবনে!এখন কী করবো আমি বলেন!এই যে আপনি আমার এতো কাছে,তবুও আমি আপনাকে নিজের করে নিতে পারছি না।এর চেয়েও তো ভালো আপনি আমার জীবনে নাই ই আসতেন।”
মাহাদ থামলো।বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো সে।আলতো করে নিজের মাথাটা রাখলো আম্বের এর বুকের উপর।মাদার এর গলা ধরে আসে,বললো–
“জানেন,পাঁচ বছর আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারি নি।প্রতিটা দিন আমি আপনাকে স্বপ্নে দেখেছি।আম্বের!
আপনার এই নাম আমার কাছে বিষাক্ত মনে হতো।কেন বলেন তো!
কী সম্পর্ক আপনার সাথে আমার!আমার অতীতের অন্ধকারে চাঁদের আলো আপনি।কী করে আপনার আলো আমি নিভিয়ে দেই আমার এই কলুষিত জীবনের সাথে জড়িয়ে!
মাহাদ মাথা তুলে।তিরতির করে কাঁপছে মাহাদ এর ওষ্ঠদ্বয়।অক্ষিপল্লব ভিজিয়ে এক ফোঁটা অশ্রুজল টুপ করে পড়লো আম্বের এর ঠোঁটের উপর।আর্দ্র গলায় আবার বললো–
“আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না মিস সুগন্ধি।কিন্তু আপনাকে কাছেও আনতে পারবো না।আপনার কাছেই তো আছে আমার সব প্রশ্নের জবাব।”
মাহাদ স্মিত হাসে।নরম গলায় বললো–
“ঘুমন্ত মিস সুগন্ধি কে এতোটা সুন্দর লাগে তা যদি আপনি জানতেন তাহলে সারা জীবন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতেন প্রজাপতি।”
মাহাদ কিছুক্ষন আবার তাকিয়ে রইলো।সেই চাহনি তে কী ছিলো তা মাহাদ জানে না।তার বুকে অজানা এক নামহীন ব্যথা।যা আম্বের এর আগমনে চড়াও হয়েছে।
নিচে দাঁড়িয়ে আছে আলতাফ আর আহমেদ।নিচে নেমে আসে মাহাদ।মুখ গোল করে শীতল ফুঁ ছাড়ে মাহাদ।অধর কোণে হালকা হেসে আহমেদ কে বললো—
“মিস আম্বের ঘুমিয়ে পড়েছেন।তাই তাকে আমার ঘরে শুইয়ে দিয়েছি।”
মাহাদ সদর দরজার দিকে পা বাড়ায়।গাঢ় গলায় ডেকে উঠে আহমেদ,বললো–
“আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো মাহাদ স্যার।”
মাহাদ অপরাধী গলায় বললো—
“ইশ!
সরি।আপনি বলে ছিলেন।আসলে একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই মনে ছিলো না।আপনি আমার সাথে আসেন।”
মাহাদ এর সাথে বাড়ি থেকে বের হয় আহমেদ।আলতাফ গভীর শ্বাস ফেললো।মাহাদ কে সে আজকাল বুঝতে পারছেন না।আসলে বুঝতে পারছে না নাকি বুঝতে চাইছেনা তা তিনি জানেন না।আলতাফ মৃদু পায়ে বিনা শব্দে দোতালায় আসেন।মাহাদ এর ঘরের দরজা ভেজানো।তাতে হালকা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে আসলেন।দেখলেন আম্বের ঘুমোচ্ছে।হতাশার এক সুদীর্ঘ শীতল শ্বাস ফেললো আলতাফ।আজ অনেক বছর পর তার নিজেকে আবার অসহায় মনে হচ্ছে।বুকের কোথাও একটা অবর্ণনীয়,অব্যক্ত,অসহ্যকর ব্যথা অনুভুত হতে লাগলো।যার কারণ অনেকটা ভয়াবহ।আনমনেই আলতাফ বললো–
“কেন এলেন আপনি!মাহাদ বাবা না আপনাকে ছাড়বে না আপনাকে নিজের করে নিবে।আপনাকে যে অনেক ধৈর্যশীল হতে হবে।আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় অধ্যায় শুরু হতে চলেছে বউমনি।
মাহাদ বাবা তার প্রশ্নের জবাব আপনার কাছে চায়।তা পেতে তার কতো সময় লাগবে আমি জানি না।ঘুমিয়ে নিন বউমনি।হয়তো এরপর আর এমন শান্তির ঘুম আপনি দীর্ঘ সময় ঘুমাতে পারবেন না।ততোদিন পর্যন্ত আপনি সহ্য করতে পারবেন তো সব!!
আলতাফ থমকে যায়।এই বিরান বাড়ি কী কখনো ভালোবাসায় পূর্ন হবে!
আলতাফ লাইট অফ করে বাইরে বের হয়ে আসে।করিডোর থেকে ধীর পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।সেখান থেকে হালকা পায়ে হেটে বা দিক দিয়ে স্বপ্নমহলের সামনের খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।সদর দরজার বাইরে লাগানো লাইটের আলোয় দেখতে পায় মাহাদ আর আহমেদ দাঁড়িয়ে কথা বলছে।লাইটের আলোয় আহমেদ এর মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।থমথমে মুখ তার।একরাশ হতাশা,গ্লানি আর ভয় দেখা যাচ্ছে আহমেদ এর মুখে।তার কিছুক্ষন পর মাহাদ উচ্চ শব্দে হেসে উঠে যার ক্ষীনকায় আওয়াজ স্পষ্ট কানে আসে আলতাফ এর।আরো কিছুক্ষন কথা বললো মাহাদ আর আহমেদ।মাহাদ তার পকেট থেকে কিছু একটা বের করে আহমেদ এর হাতে দেয়।আবার আলতাফ এর হাত থেকে তা নিয়ে নিজের পকেটে গুঁজে।পার্কিং থেকে নিজের গাড়ি বের করে তাতে বসে মাহাদ।চলতে থাকে তার গাড়ি।
আলতাফ নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে।আহমেদ নিজের ঘরের দিকে যায়।
,
,
,
সকালে আড়মোড়া ভাঙতেই আম্বের নিজেকে আবিষ্কার করে এক নরম তুলতুলে গদিতে।হকচকিয়ে উঠে আম্বের।এক সাদা শুভ্র বিছানায় বসে আছে সে।তার মনে পড়লো কালকের রাতের কথা।সেতো টেবিলে ছিলো!এখানে আসলো কী করে!
জিভ কাটে আম্বের।মাহাদ নিয়ে এসেছে!আর সে একটুও টের পেলো না!ঝিমঝিম করছে তার মস্তিষ্ক।
হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে আম্বের।বাইরে বের হতেই দেখে আলতাফ দাঁড়িয়ে আছে।শশব্যস্ত হয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আম্বের।সংকীর্ণ গলায় বললো–
“চাচা,উনি কোথায়?
আলতাফ অধর কোণে হাসলেন।স্মিত গলায় বললেন–
“মাহাদ বাবা তো কাল রাতেই বের হয়ে গেছেন।”
নিরাশ হয় আম্বের।ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে স্বপ্নমহল থেকে বেরিয়ে আসে।গার্ডেনে গাছে পানি দিচ্ছিলো আহমেদ।মেয়েকে দেখেও কোনো ভাবান্তর হলো না তার।আম্বের নিজেকে অপরাধী ভাবলো।বাবার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ভেজা গলায় বললো–
“সরি বাবা।বিশ্বাস করো,কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম একটুও টের পাইনি।”
আহমেদ পানির ঝাঝড়ি টা নিচে রাখলেন।মেয়েকে সামনে এনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।হালকা হেসে বললেন–
“আমার পরী কখনো ভুল করতে পারে না।”
আম্বের বাবাকে খুব করে জড়িয়ে ধরলো।কেনো যেনো মনে হলো এইরকম সুযোগ সে হয়তো আর পাবে না।
পাশে এসে দাঁড়ায় রহিম।তাকে দেখেই উচ্ছলিত হয়ে বললো—
“রহিম আঙ্কেল,ইমু স্কুলে গেছে?
আজ তো ওর স্কুল খুলেছে।”
রহিম কিছু বললেন না।স্থির দৃষ্টিতে নিচে তাকিয়ে রইলেন।আম্বের চিন্তিত গলায় আবার বললো—
“কী হয়েছে আঙ্কেল!কিছু বলছেন না যে!ইমু ঠিক আছে তো!
বিরস চোখে তাকালেন রহিম।চোখে তার অনুনয়।নিষ্প্রভ তার অভিব্যক্তি।নিষ্প্রতিভ গলায় বললেন–
“ইমুটার সকাল থেকে কী যেনো হয়েছে।ঘর থেকেই বের হচ্ছে না,কথাও বলছে না।স্কুলে যাওয়ার কথা বলতেই আরো ক্ষেপে গেলো।”
আম্বের গভীর চোখে তাকায়।কপাল কিঞ্চিৎ ভাঁজ করে বললো–
“কেন !কী হয়েছে?
রহিম ছোট্ট করে দম ফেললো।নম্র গলায় বললো–
“তাতো জানি না।ছেলেটার আজকাল কী হয়!
আম্বের ঝুমঝুম করে হেসে বললো—
“কান টেনে ছিঁড়বো আমি ওর।স্কুলে না যাওয়ার ফন্দি সব।আপনি দাঁড়ান আমি দেখছি।”
মলিন হাসে আহমেদ।তাকে দেখে কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয় রহিম।গাঢ় গলায় রহিম বললো—
“কী হয়েছে আহমেদ ভাই?কী নিয়ে এতো চিন্তিত !কতোদিন ধরে দেখছি কিছু একটা নিয়ে আপনি ভাবছেন!
আহমেদ গভীর শ্বাস ফেললেন।ঘাসের উপর সূর্যের তীর্যক রশ্মি পড়ছে।আহমেদ নিজেকে খুব ভারী অনুভব করছে।ঘাসের উপর শরীরের পুরো ভর ছেড়ে বসলেন।তার কপাল জুড়ে ভাঁজ স্পষ্ট।মুখে বিষন্নতার ছাপ।চোখে কাতরতা।শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন আহমেদ।কন্ঠে নমনীয়তা রেখে বললেন–
“আজকাল শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।মেয়েটাকে নিয়ে অনেক দুঃচিন্তা হচ্ছে।আমার ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে ওর কী হবে!
রহিম আহমেদ এর কাঁধে হাত রেখে সরস গলায় বললেন—
“এতো চিন্তার কী আছে!আম্বের মা যথেষ্ট বুদ্ধিমতি।আর পড়াশোনাতেও ভালো।দেখতেও মাশাআল্লাহ।একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়েটা না হয় দিয়ে দিন।”
আহমেদ নির্বাক চোখে তাকালেন।আহমেদ কে ঘিরে ধরেছে রাজ্যের ভয়।সে যে একটা ভয়ংকর বলয়ে আটকে গেছে।এখন সেখান থেকে কী করে বের হবে!
আহমেদ নিষ্প্রাণ গলায় বললো—
“ওর যোগ্য ছেলে আমি কোথায় পাবো!
“কেন!
আলতাফ ভাই কে বলে দেখেন।সে নিশ্চয় কোনো সাহায্য করতে পারবে।”
আঁতকে উঠে আহমেদ।তার বুকে ব্যাথা করছে।ঝিমঝিম করছে মাথা।অথৈ সাগরের ঢেউ উপচে আসছে তার চোখ বেয়ে।বেশ কিছু সময় কথা বললেন না আহমেদ।গার্ডেনের গাছগুলোর দিকে তাকালেন।সূর্যের রোদ পড়ায় গাছের পাতাগুলো হীরের মতো চিকচিক করছে।আহমেদ দুরে একটা কোকিল দেখতে পেলেন।তিনি গভীরভাবে কোকিলটির পদচারনা দেখছেন।একটু দুর থেকেই আহমেদ শুনতে পেলেন একটা কাকের কর্কশ গলার আওয়াজ।
মৃদু হাসলেন আহমেদ।ছোট্ট বেলায় তিনি শুনেছেন কোকিল নাকি কাকের বাসায় ডিম পেড়ে রেখে যায়।বেচারা কাক নিজের ডিম মনে করে তাতে তা দিয়ে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটায়।কিন্তু যতদিন না সেই পাখির ছানা নিজ গলায় ডেকে উঠতে পারে বেচারী মা কাক বুঝতেই পারে না এ তার সন্তান নয়।
আচ্ছা তখন মা কাকটির কেমন অনুভূত হয়!তখন কী তার খুব কষ্ট হয়!তার কী নিজেকে গালাগাল করতে ইচ্ছে করে!
না,তা কেন হবে!মা তো মাই হয়।শুধু কী জন্ম দিলেই মা হওয়া যায়!
আহমেদ নির্বিকারভাবে রহিম কে বললেন–
“অনেকদিন ধরে আপনাকে একটা কথা জিঙ্গেস করবো ভাবছিলাম।আপনি কী একটু শুনবেন?
রহিম বিগলিত হেসে বললেন–
“এভাবে কেন বলছেন আহমেদ ভাই!আমরা কী আপনার পর!এই যে এতোদিন ধরে এখানে আছি।রক্তের সম্পর্ক না থাকলে কী হবে ভালোবাসারও একটা সম্পর্ক আছে।”
আহমেদ প্রসন্ন হাসলেন।আবেগভরা গলায় বললেন—
“আমার কিছু হলে আমার মেয়েটাকে একটু দেখবেন।”
আহমেদ এর গলা ধরে আসলো।রহিম কিছুতেই বুঝতে পারলো না আজ হঠাৎ এমন ব্যবহার কেন করছে আহমেদ।উদ্বিগ্ন গলায় রহিম বললেন–
“কী হয়েছে বলেন তো!
আহমেদ ছোট্ট করে শ্বাস ফেললেন।নিরুদ্বেগ গলায় বললেন–
“ধরেন কোনো শিশু একটা কৃষক পরিবারে জন্ম নিলো।কিন্তু তাকে যদি তারই অজান্তে সেই পরিবেশ থেকে নিয়ে শহুরে কোনো পরিবেশে বড় করে তোলা হয় তাহলে কী সে তার অস্তিত্ব ভুলে যাবে!
রহিম গভীর মনোযোগের সাথে আহমেদ এর কথা শুনছিলেন।চোখের কোণ ক্ষীন করে নরম গলায় বললেন—
“ভাগ্য কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায় কে জানে!ছোট বেলায় একবার এক গল্পে পড়েছিলাম রাজপুত্র রাখাল পুত্র হয়েছে আর রাখাল পুত্র রাজপুত্র।আদৌ কী বাস্তব জীবনে এমন হয় কিনা কে জানে!
আহমেদ এর কী হলো সে জানে না।তিনি ঝট করে বললেন—-
“হয়।আমি দেখেছি।”
রহিম ভ্রু কুঁচকে উৎসুক চোখে তাকালেন।গাঢ় গলায় বললেন–
“মানে!
আহমেদ স্থির গলায় বললেন–
“কিছু না।
আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।আম্বের কে বলবেন আমার জন্য চিন্তা করতে না।”
আহমেদ নির্বিকারভাবে হেঁটে চললেন বাইরের দিকে।রহিম নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।আজ তিনি অন্য আহমেদ কে দেখলেন মনে হয়।
,
,
আম্বের দপ দপ পা ফেলে রহিমের ঘরে গেলো।ইমু নিশ্চুপ হয়ে বিছানার উপর দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে।আম্বের লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে ইমুর পাশে বসে সরস গলায় বললো–
“কিরে ভ্যাবলা,স্কুলে যাসনি কেন?
ইমু মাথাটা হালকা ঘুরিয়ে আম্বের এর দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় ক্রোধ নিয়ে বললো—
“কেন এসেছো এখানে?
চলে যাও তুমি।”
আম্বের ভ্রু কুঞ্চি করে তাকায়।দ্বিধান্বিত গলায় বললো—
“কী হয়েছে তোর!এমন করে কথা বলছিস কেন?
ইমু শক্ত গলায় নির্বিকারভাবে বললো–
“চলে যাও তুমি।চলে যাও।”
আম্বের চোখ বড় বড় করে তাকায়।উদ্বিগ্ন গলায় বললো—
“কী হয়েছে তোর!এভাবে কথা বলছিস কেন?
ঝাঁঝিয়ে উঠে ইমু।ক্ষুব্দ গলায় বললো—
“কেন এসেছো এখানে?যাও তোমার ফিল্মস্টার এর কাছে।তার তো অনেক টাকা।সে দেখতেও অনেক সুন্দর।যাও তার কাছে।আর কখনো আসবে এখানে।চলে যাও তুমি।চলে যাও।”
আম্বের গলার স্বর তীক্ষ্ম করে রাগাম্বিত হয়ে বললো—-
“এক চড় মারবো।এইসব কী বলছিস তুই!
তৎক্ষণাত ঘরে ঢুকে রহিম।ইমু হুলস্থুল হয়ে বিছানা থেকে নেমে রহিম কে জড়িয়ে ধরে কান্না জড়ানো গলায় বললো—
“বাবা,তুমি কেশবালা কে চলে যেতে বলো।চলে যেতে বলো কেশবালা কে।ওকে আমার একদম সহ্য হচ্ছে না।একদম না।”
আম্বের এর চোখ ছলছল করে উঠে।কাতর গলায় বললো–
“ইমু!
ইমু ঝামটা মেরে বললো—
“চলে যাও তুমি।চলে যাও।”
আম্বের তার চোখের জল ছেড়ে দেয়।ঘর থেকে বেরিয়ে গার্ডেন এর দিকে যেতেই ধাক্কা খায় মাহাদ এর সাথে।আম্বের তার মুখ গুঁজে দেয় মাহাদ এর বুকে।ঝমঝম করে কেঁদে উঠে আম্বের।মাহাদ আলতো হাতে স্থির করে দাঁড় করায় আম্বের কে।আম্বের এর দু চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনতা জলের প্রস্ররণ।মাহাদ বিগলিত গলায় বললো—
“কী হয়েছে মিস সুগন্ধি!
আম্বের এর গলা জমে যায়।সে হেঁচকি তুলতে থাকে।মাহাদ দু হাতের আঁজলায় আম্বের এর মুখ নিয়ে একটু উঁচু করে বললো—
“কান্না থামান প্রজাপতি।কী হয়েছে খুলে বলেন।”
আম্বের পুরো ঘটনা খুলে বলে।হো হো করে হেসে উঠে মাহাদ।আম্বের এর কান্না মাহাদ এর হাসিতে কর্পূর এর ন্যায় উবে যায়।কপট রাগ দেখিয়ে বললো–
“হাসছেন কেন?
মাহাদ হাসি থামিয়ে ধীর গলায় বললো–
“আমি তো আপনাকে আগেই বলেছিলাম ওর থেকে দুরে থাকেন।শুনলেন না আমার কথা।”
আম্বের এক ভ্রু উঁচিয়ে জিঙ্গাসু গলায় বললো—
“কী বলছেন এইসব!কী করেছি আমি!
মাহাদ আম্বের কে ঘুরিয়ে নিজের বুকের সাথে আম্বের এর পিঠ ঠেকায়।নিজের চিবুক রাখে আম্বের এর কাঁধে।ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে নম্র গলায় বললো–
” আসলে ইমুর কোনো দোষ নেই।সদ্য মা কে হারিয়েছে সে।আর এখন ওর বাড়ন্ত বয়স।এই বয়সে এমন হয়।আপনার ওর প্রতি করা কেয়ারিং ওর উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।ওর বিক্ষিপ্ত মনের অনুভূতি গুলো জোড়া লাগতে শুরু করেছে আপনার ভালোবাসার প্রলেপে।আর তাই ওর মনে আপনাকে নিয়ে এক ধরনের ফ্যান্টাসি কাজ করে।এই যেমন কোনো একটা গাড়ি আমাদের পছন্দ হলে তা আমাদের চাই ই চাই।ঠিক তেমন।
আপনি তো আর গাড়ি নন।”
আম্বের কিছুই বুঝতে পারলো না।ইমুকে সে ছোট ভাই এর মতো আদর করে।মাহাদ আবার বললো–
“আপনার প্রতি যা ইমু যা অনুভব করে তা ইনফেচুয়েশন।যার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই।এইটা ওর ভ্রান্ত ধারণা।ক্ষণকালীন চোখের ভালোলাগা নট ভালোবাসা।এই ভালোলাগা ধীরে ধীরে বদলে যায় বয়স,সময় ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে।ওর মনে হচ্ছে আপনি হারিয়ে যাবেন।যেভাবে ওর মা হারিয়ে গেছে।তাই সে কারো সাথে আপনাকে শেয়ার করতে চায় না।”
আম্বের চুপ করে রইলো।মাহাদ ওকে ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে শান্ত গলায় বললো–
“কী ভাবছেন!
এতো চিন্তা করবেন না।আমি থাকতে আপনার কোনো চিন্তা নেই।আসেন আমার সাথে।আমি ইমুর সাথে কথা বলছি।”
চলবে,,,