বদ্ধ হৃদয়ের অনুভুতি পর্বঃ১২

0
3996

#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ১২
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

উজ্জ্বল ঝলমলে আলোয় আলোকিত চারপাশ।কিছুক্ষন পরপর আলোর ঝলকানি।দামি পারফিউম এর গন্ধে চারপাশে দম বন্ধ হওয়ার যোগাড়।
ওয়েষ্টার্ন কালচার পুরোদস্তুর চলছে।আজ মাহাদ এর নতুন ফিল্ম লঞ্চ হবে।আর তাই একটা প্রমোশন ফাংশন এর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মিডিয়ার অনেক লোক উপস্থিত।নতুন পুরাতন হিরো হিরোইনদের আগমন।মাহাদ এর নতুন ফিল্ম এর ডিরেক্টর বেশ আয়োজন করেই লঞ্চ করছে তার ফিল্ম কারণ হিরোইন নবাগতা।

মাহাদ এর সাথেই ল্যাপ্টে দাঁড়িয়ে আছে ইপ্তিহা।ইপ্তিহা এই ফিল্মের হিরোইন।ফটোসেশন চলছে তাদের।মাহাদ এর চোখে মুখে অসহনীয় বিরক্তি।কিন্তু তবুও তার একরত্তিও তার চেহারায় পরিস্ফুটন হচ্ছে না।অধর জুড়ে হৃদয় কাঁপানো হাসি।ইপ্তিহার বামহাত ঠিক মাহাদ এর বুকের উপর।একে অপরের মাঝে ইঞ্চি পরিমান দূরত্ব বললে ভুল হবে।মাহাদ জার্নালিস্টদের দিকে তাকিয়ে আছে।ইপ্তিহার গাঢ় নজর মাহাদ এর দিকে।মাহাদ এর ঠোঁট,চোখ, গলায় চোখ হারাচ্ছে ইপ্তিহা।কিন্তু মাহাদ এর তাতে বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই।ওর মস্তিষ্কের নিউরণগুলো তাড়া করে বেড়াচ্ছে বাসায় ফেরার জন্য।

গত তিন চার দিন ধরে আটকে রাখা হয়েছে আম্বের কে।সারাদিন চিৎকার চেচামেচি করতে থাকে।আলতাফ যতবার খাবার নিয়ে যায় ততবার ই খাবার ফেলে দেয়।তাই একমাত্র ভরসা মাহাদ।অনেকটা বাচ্চাদের মতো জোর জবরদস্তি করেই খাওয়াতে হয় আম্বের কে।কিন্তু প্রমোশন ফাংশন এর কারণে অনেক লেট হয়ে যাচ্ছে।

ইপ্তিহাও কোনো অংশে কম না।সিডনির একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলো ইপ্তিহা।সেখান থেকেই বিভিন্ন ছোট খাটো ম্যাগাজিনের জন্য মডেল হয়েছে সে।আর সেখান থেকেই তাকে পছন্দ করা হয়।ইপ্তিহা ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে মাহাদ এর দিকে।আলগোছে তার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে নরম গলায় বললো–

“ইউ আর লুকিং ডেম হট মাহাদ।”

মাহাদ আজ হোয়াইট শার্ট এর সাথে ডার্ক ব্লু রঙের ব্লেজার পড়েছে।ঘন পল্লবের গভীর আঁখি দূর থেকেই কমনীয় লাগে।মাহাদ এর এক হাত ইপ্তিহার কোমরে আবদ্ধ।ইপ্তিহার কথা শেষ হতেই সেই হাতে হালকা চাপ দেয় মাহাদ।ইপ্তিহা চোয়াল শক্ত করে।মাহাদ ঝরা হাসিতে সবাইকে হাত নাড়িয়ে সম্মোধন করছে আর ধীর গলায় ইপ্তিহা কে বলছে—

“কয়লা নিভে গেলেও তার উত্তাপ কিন্তু থাকে।হাত দিও না পুড়ে যাবে।”

মাহাদ দাঁতে দাঁত চেপে আরো একবার চাপ প্রয়োগ করে নিজের হাতে।আর তাতেই আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায় ওরা দুজন।ওদের ফিল্ম এর ডিরেক্টর গাঢ় চোখে তাকিয়ে আছে।মাহাদ তার দিকে তাকিয়ে মেকি হাসে।

ফটোসেশন শেষ হলে অন্যান্যদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয় মাহাদ।ইপ্তিহা একা দাঁড়িয়ে আছে।ওকে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়েই খলখল করে হাসে আশিরা।আশিরাও এই মুভিতে ছোট্ট একটা রোল প্লে করেছে।ফিসফিসানো গলায় উপহাস করে বললো—

“কী হলো মিস ইপ্তিহা !পারলেন নাতো!

ফুঁসলে উঠে ইপ্তিহা।তপ্ত গলায় বললো–

“একদম চুপ।ওই মাহাদ আবইয়াজ কে তো আমি দেখেই ছাড়বো।”

আশিরা আবারো খলখলিয়ে হাসে।ঝুমঝুম করে বললো–

“এর আগেও অনেকে চেয়েছে।কিন্তু লাভ হয়নি।আপনিও দেখেন পারেন কিনা!
আসলে কি হয়েছে বলেন তো আপনার আগে আরো অনেকেই ট্রাই করেছে মাহাদ কে ফাসাতে।ওর মন তো দূরের কথা ওর ঘর পর্যন্ত যাওয়ার সৌভাগ্য কারো হয়ে উঠেনি।আপনার দ্বারাও কিচ্ছু হবে না।”

আশিরার শেষের কথাগুলো যেনো জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো।ফোঁস ফোঁস করতে থাকে ইপ্তিহা।পুরো মুভির শুটিং চলাকালীন ইপ্তিহা কম চেষ্টা করে নি মাহাদ এর কাছে যেতে।কিন্তু সম্ভব হয় নি।কাজ শেষে আর একবারের জন্যও মাহাদ ইপ্তিহার সাথে কোনো ধরনের কথা বলায় আগ্রহ প্রকাশ করে না।

মাহাদ টের পায় তার মোবাইল ভ্রাইব্রেট করছে।স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে আলতাফ এর কল।রিসিভ করতেই চোখ,মুখ কুঁচকে ফেলে মাহাদ।আর এক মিনিটও ব্যয় না করে বেরিয়ে আসে কনভেনশন হল থেকে।
,
,
,
স্বপ্নমহল এ ঢুকতেই কানে আসে আম্বের এর চিৎকার।মাহাদ হুড়মুড়িয়ে সিড়ি বেয়ে উঠে।ঘরে ঢুকেই দেখে হুলস্থুল কান্ড।ঘরময় কাঁচ ভাঙার ছড়াছড়ি।খাবার ছড়িয়ে রয়েছে এধারে ওধারে।আম্বের এর পা কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।মাহাদ ঢুকতেই সরে দাঁড়ায় আলতাফ।মাহাদ ইশারা করে তাকে যেতে বললো।মাহাদ কে দেখেই আরো রেগে যায় আম্বের।আম্বের কে ছুঁতেই হাত পা ছোড়াছুড়ি করা শুরু করে।তাই বাধ্য হয়ে মাহাদ আম্বের এর গলা থেকে ওড়না নিয়ে তার দুই হাত বেঁধে দেয়।একটা ছোট্ট শ্বাস ফেললো মাহাদ।স্মিত গলায় বললো–

“কী পাগলামো শুরু করেছেন আপনি!

আম্বের সংক্ষুব্ধ গলায় বললো–

“হা আমি পাগল।দিন আমাকে পাগলাগারদে পাঠিয়ে।তাও এই জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিন আমাকে।”

মাহাদ আম্বের কে বিছানাত সোজা করে বসায়।আম্বের হাত বাঁধা থাকায় পা ছুঁড়তে থাকে।মাহাদ ওর পা দুটো চেপে ধরে।গমগমে গলায় আম্বের বললো–

“একদম ছুঁবেন না আপনি আমাকে।”

মাহাদ বিগলিত গলায় বললো—

“খেয়ে ফেলবো আপনাকে।একদম চুপ।”

আম্বের তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে।সাথে বেগতিক নড়াচড়া।মাহাদ আম্বের এর পা ধরে বিতৃষ্ণ গলায় বললো—

“কী অবস্থা করেছেন পায়ের!এইরকম কেউ করে!আর কী অবস্থা চেহারার!এই গোসল করেন না আপনি!

আম্বের রোশভরা গলায় শক্তভাবে বললো–

“একদম নাক ফাটিয়ে দিবো আপনার।ছাড়েন আমাকে।”

মাহাদ ঝরা হাসে।ফিচেল গলায় বললো–

“তা কী দিয়ে ফাটাবেন!হাত তো বাঁধা।আর পায়ের যে অবস্থা করেছেন!আগামী কয়েকদিন তো ঠিকমতো হাটতেই পারবেন না।”

আম্বের গম্ভীর হয়ে বসে থাকে।আলতাফ খাবার দিতে এলে দরজা খোলা পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে আম্বের।কিন্তু টাইলস এর উপর অগোছালো পায়ের কারণে পিছলে পড়ে যায়।আর পড়ার সময় একটা ছোট্ট টেবিল ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে গেলে টেবিল ক্লথ এ টান লেগে তার উপর থাকা সকল জিনিস নিচে পড়ে যায়।আম্বের আবারো উঠে ব্যস্ত হয়ে সামনে আগাতেই কাঁচের টুকরো বিঁধে যায় তার পায়ে।

আম্বের থম মেরে বসে আছে।মাহাদ আলতাফ কে গরম পানি আনতে বলে।ততক্ষনে ওয়েট টিস্যু দিয়ে আম্বের এর পায়ে লেগে থাকা ধূলাবালি পরিষ্কার করতে থাকে।গরম পানিতে রুমাল ভিজিয়ে আলতো করে মুছে দেয় আম্বের এর পা। ভালো করে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দেয়।আম্বের নির্বিকার তাকিয়ে নিষ্প্রভ গলায় বললো–

“কেন আটকে রেখেছেন আমাকে?কেনো যেতে দিচ্ছেন না আমাকে?

নিজের কোল থেকে পা সরিয়ে রাখে মাহাদ।স্মিত গলায় প্রশ্ন করলো—

“এখানে থাকতে কী সমস্যা আপনার?

“দম আটকে আসে আমার এখানে।বাঁচতে দিন আমাকে।”

মাহাদ রাগি চোখে তাকালো।সরস গলায় বললো—

“কোথায় যাবেন আপনি!কে আছে আপনার!

আম্বের নিভে যাওয়া প্রদীপ এর মতো ধপ করে নিভে যায়।কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে মাহাদ এর দিকে।আহত গলায় প্রশ্ন করলো–

“বাবা কী সত্যিই আমাকে আপনার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে?

মাহাদ অস্ফুটভাবে বললো–

“হুম।”

“আপনি কেন কিনে নিলেন আমাকে?

মাহাদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো।গম্ভীর গলায় বললো–

“আমি আপনাকে হারাতে পারবোনা তাই।”

“আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”

মাহাদ বাঁকা হাসে।দৃঢ় গলায় বললো—

“তাহলে আর সমস্যা কোথায় এখানে থাকতে!

মাহাদ আম্বের এর দুই হাতের বাঁধন খুলে দেয়।আম্বের কে কোলে তুলে নেয়।আম্বের চকিতে মাহাদ এর গলা জড়িয়ে ধরে।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আলতাফ।মাহাদ স্বাভাবিক গলায় বললো—

“ঘরটা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করেন চাচা।”

আম্বের কে নিজের ঘরে নিয়ে যায় মাহাদ।বিছানায় বসিয়ে দেয়।আম্বের এর পিঠের দিকে দুটো বালিশ দিয়ে আরাম করে বসায়।পা টা টেনে সোজা করিয়ে দেয়।মাহাদ নিজের ব্লেজার খুলে রাখে।শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বললো–

“আপনার এইসব পাগলামি কবে যাবে?কেন নিজের ক্ষতি করতে চান!

আম্বের ক্ষোভভরা গলায় বললো—

“কোন হৃদয়হীন মানুষের কাছে আমি থাকবো না।”

মাহাদ স্মিত হাসে।আক্ষেপের গলায় বললো—

“ভালো তো বাসবেন না।তাহলে হৃদয় দিয়ে কী করবেন!সেটা না থাকাই তো বেটার।”

আম্বের চুপ করে থাকে।মাহাদ এর কোনো কথার জবাব দিতে তার আর ইচ্ছে হচ্ছে না।মাহাদ বললো–

“আপনি বসেন আমি ফ্রেশ হয় আসছি।পালানোর চিন্তা অন্তত কয়েকদিনের জন্য ক্যান্সেল করে দিন।”

জ্বলন্ত চোখে তাকায় আম্বের।মাহাদ মিচকি হাসে।চুপচাপ বিছানায় বসে আছে আম্বের।এতোক্ষন অতি উত্তেজনার কারনে ব্যথা অনুভব না হলেও এখন চিনচিন করছে পা।মনে হচ্ছে যেনো টেনে ধরেছে কেউ।মাহাদ তার মোবাইল রেখে যায় বিছানার উপর।আচমকা তা বেজে উঠে।কোনো রকম দু হাতের উপর ভর দিয়ে তা নেয় আম্বের।প্রাইভেট নাম্বার লিখা।আম্বের তা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে চিকন নারী কন্ঠ বলে উঠলো—

“কী হলো মাহাদ!তুমি এভাবে চলে গেলে কেন?

আম্বের কিছুক্ষন চুপ থেকে ফিচেল হাসে।কন্ঠ বিকৃত করে বললো—

“কী হলো মাহাদ!তুমি এভাবে চলে গেলে কেন?
পুরুষ মানুষ দেখলেই পেয়ার উতলে উঠে!রাত বারোটায়ে কল করতে ইচ্ছে করে!কেনো রে তোদের চোখে ঘুম নেই!

“ছিঃ
এইসব কী ধরনের কথা!কে আপনি আর মাহাদ কোথায়?

“আমি তোর নানী।রাখ ফোন।”

লাইন কেটে দেয় আম্বের।বেশ ভালো লাগছে তার।নিশ্চিত ওই ব্যাটা ফিল্মস্টারের কোনো গার্লফ্রেন্ড হবে।কত জায়গায় কতো কিছু ছড়িয়ে রেখেছে।নিজেই নিজেকে ভেঙচি কাটে আম্বের।
মাহাদ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে আম্বের বসে আছে।মাহাদ কিচেনে যায়।নিজের হাতে স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসে।মাহাদ এর হাতে খাবার দেখেই ভ্রু ক্রুটি করে আম্বের।নাক,মুখ ছিটকে বললো–

“খাবো না আমি।”

মাহাদ সরস গলায় বললো–

“খাবেন কিনা তাতো জিঙ্গেস করিনি।খেতে হবে আপনাকে।”

“বললাম তো খাবো না আমি।”

মাহাদ ছোট্ট দম ফেললো।শান্ত হয়ে আম্বের এর সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে।পাশেই টেবিলের উপর খাবার রাখে।আম্বের কে প্রনোদিত করার জন্য বললো—

“যদি খাবারটা খেয়ে নেন তাহলে আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”

আম্বের সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো।ঝট করে বললো—

“লাগবে না আপনার সারপ্রাইজ।”

মাহাদ ধীরস্থির গলায় বললো—

“আপনাকে একটা গল্প শোনাই।”

আম্বের কোনোমতেই শুনবে না।কিন্তু মাহাদ আম্বের এর না এর তোয়াক্কা না করে বলতে লাগলো–

“আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন আমার এক ক্লাসমেট এর কলম হারিয়ে যায় যা ওর বাবা সৌদি থেকে নিয়ে এসেছিলো।তার সে কি কান্না!
পুরো ক্লাস জুড়ে শুধু তার কান্নার আওয়াজ।তো আমাদের ক্লাস টিচার এলে তাকে বলা হয় পুরো ঘটনা।তিনি সবাইর ব্যাগ চেক করার নির্দেশ দিলেন।মজার কথা কী বলেন তো!
সেই কলম আমাদেরই ক্লাস এর একটা ছেলে চুরি করেছে যার বাবাও বাইরের দেশে থাকে আর সে তাদের একমাত্র সন্তান।
আরো মজার বিষয় কী বলেন তো!আমার ব্যাগেও তখন কিছু টাকা ছিলো।তাই আমিও একবার আমার ব্যাগ চেক করলাম কিন্তু পরক্ষনেই বুঝতে পারলাম আমার টাকাও হাওয়া।সেই ছেলেকে আবার চেক করা হলো।আশ্চর্যজনকভাবে আমার টাকাও তার কাছে পাওয়া গেলো।কিন্তু সে বললো টাকাগুলো তার।বাট আফসোস!ছোটবেলায় আমার এক বদ অভ্যাস ছিলো।বাবা যখনই আমাকে নতুন কচকচে নোট দিতো তা আমি খরচ না করে রেখে দিতাম আর তাতে নামও লিখে রাখতাম।”

কথা শেষ করে মাহাদ হা হা করে হাসতে থাকে।আম্বের নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে।মাহাদ হাসি থামিয়ে শান্ত গলায় বললো–

“এইটাকে কী বলে জানেন!খাল কেটে কুমির আনা।এই যে আপনি আমার খাল আমি আপনার কুমির।”

মাহাদ আবারো হাসতে থাকে।হাসতে হাসতে তার চোখের কোণে জল নামে।এই হাসির পিছনে লুকিয়ে আছে অনেক অজানা হিসেব যা আম্বের জানে না।কিন্তু আম্বের বেশ বুঝতে পারে মাহাদ আজকেও তাকে ধোঁকা দিয়েছে।আম্বের কে প্রতিদিনই কোন না কোনো কথার জালে ফেলে খাবার খাওয়ায় মাহাদ।মাহাদ তার গল্পের ফাঁকে এক বাটি স্যুপ গিলিয়ে দেয় আম্বের কে।টেবিল থেকে একটা আপেল নিয়ে তা কেটে দিলে আম্বের খাবেনা বলে।মাহাদ ধরা গলায় বললো—

“আপনার নিশ্চয়ই আমাকে মারতে ইচ্ছে করে মিস সুগন্ধি !তাহলে আজ একটা সহজ পদ্ধতি শিখিয়ে দেবো আপনাকে।খেয়ে নিন।”

আম্বের শক্ত গলায় বললো–

“নাহ।”

মাহাদ হতাশ গলায় বললো–

“ওকে।যা খেয়েছেন আজকের জন্য তাই যথেষ্ট।”

আম্বের কে জোর করে শুইয়ে দেয় মাহাদ।অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মাহাদ এর সব কিছু মেনে নেয় কারণ পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে।মাহাদ আম্বের এর উপর উপুর হয়।দুজনের নিঃশ্বাস একে অপরকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।মাহাদ বিগলিত হাসে।সরস গলায় বললো–

“রান্না ঘরে ইঁদুর মারার ঔষধ আছে শুনলাম।সুযোগ বুঝে একটু আমার খাবারের সাথে মিশিয়ে দিবেন।বাস,কাম তামাম।”

আম্বের শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।এই মানুষটাকে ও কখনো বুঝতে পারে না।নিজেই নিজেকে মারার জন্য বুদ্ধি শিখিয়ে দেয় কেউ!
মাহাদ আম্বের এর কপালে চুমু খেয়ে স্বাভাবিক গলায় আবার বললো–

“এইটা একবার ট্রাই করেন।যদি বেঁচে থাকি অন্য কোনো পদ্ধতিও শিখিয়ে দেবো।”

মাহাদ আম্বের এর পাশ থেকে একটা বালিশ তুলে দরজা পর্যন্ত যেতেই আম্বের গম্ভীর গলায় বললো—

“মরার এতো শখ কেন আপনার?

“জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।গুড নাইট।”

করিডোরে গিয়ে কাউচে বালিশ রাখে মাহাদ।আর সেখানেই চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ে।আলতাফ এসে জানায় নিচে মাহাদ এর জন্য রহিম অপেক্ষা করছে।কপাল কুঁচকে আসে মাহাদ এর।নিচে গিয়ে দেখে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে রহিম।মাহাদ কে দেখেই উঠে দাঁড়ায়।মাহাদ তাকে বসতে বলে।স্মিত গলায় মাহাদ প্রশ্ন করলো–

“আপনি এতো রাতে!
কিছু হয়েছে?

রহিম আনম্র গলায় বললেন–

“ইমু কিছুতেই বোর্ডিং স্কুলে যেতে চাইছে না।”

মাহাদ দুর্বোধ্য হাসলো।ছোট্ট করে বললো–

“তাতো হবেই।”

মাহাদ উঠে এসে রহিম এর সামনে দাঁড়ায়।রহিমও উঠে দাঁড়ায়।মাহাদ দৃঢ় গলায় বললো–

“ইমুকে যেতে হবে।আপনি ভাল করেই জানেন মিস আম্বের এর সাথে কী হয়েছে!এই মুহূর্তে ইমুর এখানে থাকা ঠিক নয়।ওর পড়ালেখায় সমস্যা হবে।আপনি যেভাবেই হোক ওকে রাজী করান।আর চিন্তা করবেন না।আজকের পর থেকে ইমুর সকল এডুকেশনাল এক্সপেন্স আমি ক্যারি করবো।যান,অনেক রাত হয়েছে।কাল কথা হবে।”

রহিম চলে যেতেই মাহাদ উপরে চলে আসে।কাউচে বসে মোবাইল বের করে।ইপ্তিহা অনবরত কল করে যাচ্ছে।কিন্তু মাহাদ এর এখন একদম কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।মোবাইল সুইচ অফ করে শুয়ে পড়ে মাহাদ।

মাঝরাতে কিছু একটার আওয়াজে ঘুম ভাঙে মাহাদ এর।আজ আর আম্বের কে লক করে রাখেনি।দরজার ফাঁক দিয়ে আসা আবছা আলো দেখে মাহাদ শশব্যস্ত হয়ে রুমে আসে।আম্বের থম মেরে বসে আছে।পাশেই পড়ে আছে ল্যাম্পশেড।মাহাদ ব্যস্ত গলায় বললো–

“কী হয়েছে মিস সুগন্ধি?

মাহাদ কে দেখেই আম্বের অপ্রস্তুত হয়।মাথা নিচু করে গড়িমসি করতে থাকে।মাহাদ বিগলিত হেসে ফিচেল গলায় বললো–

“আমি এতোটাও বেহায়া নই যে আপনার সাথে ওয়াশরুমে চলে যাবো।অবশ্য পারমিশন দিলে তা অন্য কথা।”

আম্বের কিছু বললো না।মাহাদ তাকে ওয়াশরুমে যেতে সাহায্য করে।ওয়াশরুম থেকে এনে আবার ঠিক করে শুইয়ে দেয় আম্বের কে।স্থির গলায় বললো–

“পালানোর চিন্তা মাথা থেকে একদম ঝেড়ে ফেলেন।আগামী সাত দিন আমি কোথাও যাচ্ছি না।সো কিপ সাইলেন্ট।”

আম্বের শক্ত হয়ে রইলো।চোখ দুটো নিবদ্ধ করে রেখেছে মাহাদ এর যাওয়ার পানে।

ভোর হতে চললো।এখন আর মাহাদ এর ঘুম আসবে না।পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে মাহাদ।মোবাইলের পাওয়ার বাটন অন করে কাউকে কল করে।ওপাশের ব্যক্তিটি কল রিসিভ করেই অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকে।মাহাদ শুনে যায়।ব্যক্তিটি একসময় হাঁপিয়ে উঠে শান্ত হয়।মাহাদ বিগলিত গলায় বললো–

“তোকে একটা ঠিকানা এস.এম.এস. করছি।খুঁজে বের কর।”

“শালা মাঝ রাতে তোর ঠিকানার কথা মনে পড়লো।তোকে তো…।”

কথা শেষ হওয়ার আগেই কল ডিসকানেক্ট করে মাহাদ।কতগুলো ভয়েজ মেসেজ এসে জমা হয়েছে।ইপ্তিহা পাঠিয়েছে।মাহাদ বাঁকা হাসে।মেয়েটা সত্যিই পাগল হয়ে যাবে।ইপ্তিহা এতো সহজে মাহাদ কে ছাড়বে না।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here